[চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের বরিষ্ঠ শিক্ষক এবং 'সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ'-এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক প্রফেসর ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। দেশে-বিদেশে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকে তিনি রচনা করেছেন আন্তর্জাতিক মানসম্মত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। তাঁর সঙ্গে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর, বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। প্রফেসর ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবিরের বক্তব্যের চুম্বক অংশ পত্রস্থ হলো:]
এশিয়ার গুরুত্ব
বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটারে পরিণত হয়েছে এবং আগামীতেও আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশেষ করে, চীনের অপ্রতিরোধ্য বিকাশ, ভারতের শক্তি বৃদ্ধি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং এ অঞ্চলে বেশ কিছু 'সিরিয়াস টেনশন' ও 'কনফ্লিক্ট জোন' থাকাতে এই এশীয় অঞ্চলের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে বৈ কমবে না। এই আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে কাশ্মীর ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যু নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারিত্ব ও এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র তালিবান প্রতিরোধ তথা আফগানিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন, চীনের উত্থান, চীন-ভারত রেষারেষি ও প্রতিযোগিতা, তাদের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ও ১৯৯২ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত সখ্যতা, চীন-মর্কিণ দূরত্ব সৃষ্টি, চীনের শিন জিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা ও এর বিরুদ্ধে চীনা সরকারের কঠোর ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ, হংকংয়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায় পদক্ষেপ, তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু, জাপান-চীন টানাপোড়েন, বিশেষ করে সেনকাকু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, কোরীয় উপদ্বীপের সঙ্কট, মধ্যপ্রাচ্যের/পশ্চিম এশিয়ার সংকট, ইসলামী উগ্রপন্থার বিকাশসহ মধ্য এশিয়ার নতুন রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্নমুখীন সংকট আমরা লক্ষ্য করি, বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।
সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ
হাল আমলে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এশীয় অঞ্চলের নানা বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-গবেষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি ও জারি রাখা খুবই জরুরি একটি প্রসঙ্গ। সেজন্যই একটি সম্পূর্ণ একাডেমিক উদ্দেশ্যে এমন একটা সেন্টার থাকলে ভালো, থাকা দরকার, এমন চিন্তা থেকেই :সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ' প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি একটি non-profit organization. কোন দেশ বা সরকারের প্রতি এই সেন্টারের বিশেষ কোন রাগ, অনুরাগ, বিরাগ নেই। এই সেন্টার কোন শর্তযুক্ত বা শর্তের ইঙ্গিতপূর্ণ কোন সাহায্য-সহযোগিতামূলক সম্পর্কের বিরোধী। নিজস্ব সীমিত অর্থায়নে এর কার্য পরিচালিত হয়। ফলে, এর কার্যক্রমও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তা সত্ত্বেও সেন্টার বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছে, নিয়মিতভাবে ২০১৭ সাল থেকে এটি Journal of Asian Politics and Society -- JAPS নামক একটি অর্ধ-বার্ষিক একাডেমিক peer reviewed ও ISSN নম্বরযুক্ত জার্নাল প্রকাশ করে আসছে। আগামীতে Center for Asian Studies এর কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে Center for Asian Studies-- CAS প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে। এটা প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারের Higher Education Quality Enhancement Project (HEQEP) এর একটি Subproject এর Off shoot. এই Sub-project টির বিষয়বস্তু ছিল অনেকটা নিম্নরূপ: Improving the Capability of Research on Political Science and Asian Studies in the Department of Political Science, University of Chittagong. ২০১১-২০১৩ পর্যন্ত এই তিনবছর মেয়াদী সাব-প্রজেক্ট শেষ হলে এই সাব-প্রজেক্টের টিম মেম্বারদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে গবেষণা কাজ অব্যাহত রাখার আকাঙ্খা থেকেই এই Center for Asian Studies -- CAS প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হয়। সেই মোতাবেক এই সেন্টার গঠনের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মিটিংয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের এবং সর্বশেষে সিন্ডিকেট মিটিংয়ে পাশ হয় ও তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গ: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল
ইন্দো-প্যাসিফিক টার্ম-এর ব্যবহার নিয়ে প্রথম কথা হলো, এই টার্মটা যতটা না ভৌগোলিক, তারচেয়ে ঢের বেশি "সিকিউরিটি" ও "স্ট্র্যাটেজিক"। ইন্ডিয়ান ওশ্যান ও প্যাসিফিক ওশ্যানকে কানেক্ট করা হয়েছে এই টার্মের মাধ্যমে। এই টার্মটা সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন একজন ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক ও সিকিউরিটি আ্যানালিস্ট। পরবর্তীতে এটা সমমনা বাকী অনেক দেশ, যেমন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাস্ট্র ইত্যাদি দেশ এই 'ইন্দো-প্যাসিফিক' টার্মটি ব্যবহার করতে থাকে। পূর্বে প্রচলিত ও ব্যবহৃত টার্মটা ছিল 'এশিয়া-প্যাসিফিক' অঞ্চল। ইন্দো-প্যাসিফিক টার্ম আসলে মেরুকরণের প্রতীকী উপস্থাপন। অর্থাৎ, এই টার্ম দ্বারা এটাই বুঝানো হয় যে, ভারত মহাসাগরীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত স্বার্থকে একক পরিকল্পনার ভিতরে বিবেচনায় নিতে হবে বা দেখতে হবে। কারণ, উভয় অঞ্চলের কৌশলগত স্বার্থ, চ্যালেঞ্জ এবং সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কৌশলও এই ভারত মহাসাগরীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করা আবশ্যক।
চীনের উত্থান
কিন্তু, প্রশ্ন রয়েই যায় যে, কেন এবং কি সেই মেরুকরণ? কি তার প্রকৃতি? কি হতে পারে এর প্রভাব? এক্ষেত্রে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মেরুকরণের প্রধান ও বলা যেতে পারে, একমাত্র কারণ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান। অনেকেই হয়তো বলবেন, কেন? ইতিপূর্বে ধ্বংসস্তূপ থেকে জার্মানিতে, জাপানে, অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে, এমন পোলারাইজেশানতো তখন ঘটেনি! এখন চীনকে কেন্দ্র করে কেন ঘটছে? এই প্রশ্নটাও নিশ্চয়ই করা যেতে পারে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যখন ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে মার্কিন পলিসি মেকারগণ ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকেন, তখন মার্কিন যুক্তরাস্ট্র জাপানের উপর নানাধরণের বিধিনিষেধ ও শর্ত আরোপ করা শরু করে। জাপানি মাইক্রো চিপসের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, আনফেয়ার ট্রেড প্র্যাকটিস, মার্কিন কৃষি ও ফল, গাড়ি ইত্যাদি রফতানির জন্য বাধ্যতামুলক কোটা আরোপ, বোয়িং বিমান ক্রয়ে "রাজি" করানো ইত্যাদি পদক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিল। সিনিয়র বুশ ১৯৯১ সালের দিকে বিশাল বহর নিয়ে জাপান সফর করেন ও ট্রেড কনসেশানের জন্য চাপ দিতে থাকেন। এমন প্রচণ্ডরকমের চাপ আসে যে, মনে করা হয়, এই প্রেসার নিতে না পারায় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্যেই তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী, একদার ঝানু বুরোক্র্যাট, মি. কিচি মিয়াজাওয়া অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কনসেশান মার্কিনিরা ঠিকই আদায় করেছিলেন। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে বশে রাখতে চেষ্টা করতো।
কিন্তু, চীনের উত্থানের বিষয়টা বহু দিক থেকে আলাদা। ইউরোপে উঠতি বড় অর্থনীতি জার্মানি ও এশিয়ার ইকনোমিক পাওয়ার হাউজ জাপান, কেউই কোন কমপ্রিহেনসিভ পাওয়ার ছিলনা, তেমন হওয়ার কোন সম্ভাবনা বা প্রয়াসও ছিল না। তদুপরি, তাদের উত্থান ঘটেছিল বেশ খানিকটা মার্কিন বদান্যতায়। আদর্শগতভাবে তারা মার্কিন-পশ্চিমা ভাবধারার অনুসারী ছিল। ফলে, সামরিক ও/বা আদর্শিক কোন চ্যালেঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি মেকাররা এসব দেশের কাছ থেকে আশঙ্কা করেননি। সর্বোপরি, এই দেশগুলোর অর্থনীতি বড় হলেও এরা একটা অর্থনৈতিক পাওয়ার হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্রে "গ্লাস সিলিংয়ে" আটকা পড়ে যায়। এদের কারো টোটাল জিডিপির সাইজ ৪-৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপর উঠতে পারেনি।
পক্ষান্তরে, চীন এই জিডিপির গ্লাস সিলিং ব্রেক করে ফেলে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী চীনের টোটাল জিডিপি হলো ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো কম। বিভিন্ন প্রোজেকশান থেকে জানা যে, মোটামুটি ২০৩১ সালের দিকে নমিনাল জিডিপির হিসাবে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যাবে। এমন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসহ। এটা হলে, 'প্যাক্স আমেরিকানা'র আইডিয়া হোঁচট খাওয়ার আশংকা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, পিপিপির হিসাবে চীন ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
চীন-মার্কিন প্রসঙ্গ
যদিও অন্যসব দেশের সাথে মার্কিন স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক তেমন কোনো কৌশলগত কোন বিষয়ও ছিলনা, তথাপি, চীনের ব্যাপারটা যথেষ্ট আলাদা। একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান পর্বের প্রথমদিকে প্রায় দুই দশক (১৯৭২-১৯৮৯) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থী পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের (যেমন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর) বিনিয়োগ, সহযোগিতা, মার্কেট এক্সেস ইত্যাদি অর্থনৈতিক নীতি চীনের উত্থানের জন্য পজিটিভ ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। তবে, এটা এদের সবারই জানা ছিল যে, চীনের অনুসৃত সংস্কার ও চার আধুনিকীকরণের (Four modernization) নীতির অন্যতম ছিল সামরিক সংস্কার, যার লক্ষ্য ছিল চীনের সামরিক শক্তিকে অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। ফলে, চীনের উত্থানের একটা মৌলিক 'কম্পোনেন্ট' বা 'ইন্টিগ্রাল পার্ট'ই ছিল মিলিটারী রিফর্ম ও ডেভেলপমেন্ট। আসলে, এই সংস্কার কর্মসূচীর লক্ষ্যই ছিল চীনকে একটা টোটাল, কমপ্রিহেনসিভ পাওয়ার হিসাবে গড়ে তোলা। ১৯৮৯ সালের তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনা, ঐ একই বছরে কোল্ডওয়ারের পরিসমাপ্তি চীনকে এক নতুন অপরিচিত বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়। কিছুদিনের জন্য চীন নিজেকে "ক্ষুদ্র" হিসাবে দেখতে পায়। আপাতঃ কিংকর্তব্যবিমূঢ় চীন ১৯৯২ সালে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীকে আরও বেগবান ও গভীর করার (deepening of reform)। এর মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে চীন আরও বেশী Liberalization, Privatization, Marketization, Globalization -- LPMG এর পথে অগ্রসর হয় ও আরো বেশি বেশি করে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে মাকড়সার জালের মত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা যেমন চলতেই থাকে, চীনের সামরিক শক্তিও তেমনিভাবে উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। সামরিক খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান বাজেট বরাদ্দ থেকেই এটা বোঝা যায়। চীনের ব্যবসা, উন্নয়ন সহযোগিতা পূর্ব-এশিয়া, দক্ষিণ-এশিয়া, মধ্য-এশিয়া, আফ্রিকায় বিস্তৃত ও বর্ধিত হতে থাকে। চীনের এই বর্ধণশীল অবস্থা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
ফলে, সেই বিংশ শতকের শেষ থেকে ও একবিংশ শতকের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি মেকারদের ও থিঙ্কট্যাঙ্কের পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক ও আলোচনা চলতে থাকে 'চীনের পিসফুল রাইজ' নিয়ে। এটা কতটুকু পিসফুল, কতদিন পিসফুল থাকবে, কিভাবে চায়নার সঙ্গে ডিল করা যাবে, কনফ্রনটেশান না একোমোডেটিভ পলিসি নেয়া সঠিক হবে, সেসব বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা, তর্কবিতর্ক, মতামত প্রদান চলতে থাকে। এমনই পটভূমিতে চীনের উত্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শংকার ক্ষেত্রগুলো নিম্নরূপ:
ক. চীন একটি একদল-শাসিত দেশ। গণতন্ত্রহীন। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। নানান উদাহরণ দিয়ে তা বোঝানো হয়। ফলে, আল্টিমেটলি গনতন্ত্র ও অগণতন্ত্রের বিরোধ-দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।
খ. চীন ক্রমাগত একটি আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। সে তার ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি ও প্রসারিত করছে। তাইওয়ানকে হুমকি দিচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপক ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সেনকাকু/দাইয়ায়ুতি দ্বীপ নিয়ে জাপানের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েই চলেছে।
গ. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আনফেয়ার ট্রেড প্র্যাকটিস ফলো করছে। পাশ্চিমা দেশগুলোর কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তি হস্তান্তরে বাধ্য করছে। চীনের মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের প্রোডাক্টের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর সেনসিটিভ সিকিউরিটি রিলেটেড ডাটা ও তথ্যাবলী পাচার করছে।
ঘ. সামরিকভাবে "ভয়ঙ্কর রকমের" assertive হয়ে যাচ্ছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ট্র্যাডিশনালি ভারতের সহজাত প্রভাব বলয়ের অঞ্চল হিসাবে দক্ষিণ এশীয়াতে চীনের ব্যাপক আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামরিক পেনিট্রেশন ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঙ. মধ্য এশীয়াতেও চীন তার উপস্থিতি সরব করেছে। সেখানকার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য কাঁচামালের ক্রেতা হয়েছে চীন।
চ. আফ্রিকাতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে ও সেখানকার বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের বড় ক্রেতা হিসাবে চীন আবির্ভূত হয়েছে। ফলে, আফ্রিকাকে পূর্বের ন্যায় নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো ব্যবহার করা কমে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর বার্গেইনিং পাওয়ার বাড়ার ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে আগের ন্যায় আর সহজে আফ্রিকাকে এক্সপ্লয়েট করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রতি চ্যালেঞ্জ
আরো কিছু বলা গেলেও, আপাততঃ এটুকু বলাই যথেষ্ট, চীন-মার্কিন সংশ্লিষ্ট পয়েন্টটা এস্টাবলিস করার জন্য। এখন উপরের বিষয়গুলো যদি আমরা একসঙ্গে বিবেচনা করি, তবে আমরা কি পাই? পরিষ্কার চ্যালেঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি। অন্ততঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিসমুহ সেভাবেই বিষয়টা দেখে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের বিজয়ের মাধ্যমে কোল্ডওয়ার শেষ হবার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে তার নির্দেশে ও তার নেতৃত্বে 'ইউনিপোলার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' তৈরির প্রয়াসে মত্ত হয়ে পড়ে। সারা দুনিয়াকে তারা পদানত করতে থাকে। কিন্তু, চীনের উত্থানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিমেকাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্নের ইউনিপোলার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রতি চ্যালেঞ্জ বলে গণ্য করতে থাকেন। তারা চীনের কমপ্রিহেনসিভ পাওয়ার হয়ে ওঠার স্পষ্ট আলামত অবলোকন করেন ও এটাকে ডিল করার স্ট্র্যাটেজি হিসাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অনুসারী চারটি এশীয় দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ও ভারত) নিয়ে ২০০৭ সালে Quadrailateral Agreement -- QUAD গঠন করে। পরবর্তীতে চীনের বিরূদ্ধে বিভিন্ন মাত্রার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা, ইত্যাদি আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন পশ্চিমা দেশসমূহ। ২০১৩ সালে চীন তার মাল্টি-ট্রিলিয়ন ডলার বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (Belt and Road Initiative) গ্রহণ করার পর থেকে চীনকে নিয়ে মার্কিনী উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার এশীয় অনুসারী দেশসুমহ চীনের এই উত্থান ও ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি অগ্রহণযোগ্য ও উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করেছে। ফলস্বরূপ একধরণের অলিখিত Containment of China পলিসি গ্রহণ করে। যেটাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বলেছেন, নতুন স্নায়ুযুদ্ধ নয়, কিন্তু, policy of extreme competition। এ লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই কোল্ড ওয়ার আমলের মতো QUAD, Indo-Pacific Strategy -- IPS, AUKUS, Indo-Pacific Ecomomic Cooperston, ইত্যাদ বিভিন্ন নামে জোট গঠন করছে। এই মেরুকরণকে বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশসমূহের জোট, রুল বা বিধি বিধান ভিত্তিক জোট, আগ্রাসী-সম্প্রসারণবাদী চীন-বিরোধী জোট।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, উভয়েই চাইবে বাংলাদেশকে তার সাথে পেতে। পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়েছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে। বঙ্গোপসাগর বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা কারণে ও নানা দিক দিয়ে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায়, চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী ও বিনিয়োগকারী ও সাহায্যদাতা দেশ। তদুপরি, চীনের সাথে রয়েছে আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক। এখনও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য প্রায় সবটা হার্ডওয়্যারই আসে চীন থেকে। আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যের বিবেচনাতেও চীন বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
একটা কথা কেউ সচরাচর প্রকাশ্যে না বললেও এটা সবাই অনুভব করেন যে, চীনের সাথে সুসম্পর্ক বাংলাদেশীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাবোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন নিজেও চায় না যে, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কোন নতুন "এশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের জোটে" যোগদান করুক। বাংলাদেশস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত থেকে খোদ চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে বাংলাদেশ যেন কোন মার্কিন জোটে না যায়, সেটা স্পষ্ট করে বলেছেন। এ ব্যাপারে চীন তার অবস্থান পরিষ্কার করে জানিয়ে গিয়েছে।
অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে চীনের বিরূদ্ধে বিরূপ বক্তব্য দিয়ে গিয়েছেন ও বাংলাদেশকে চীনের সাথে অতি-ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে গিয়েছেন।
এদিকে ভারত তার নিজের চীনের সাথে তীব্র টানাপোড়েনের সম্পর্কের কারণে ও "চীন ঠেকাও" জোটের অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশে চীনের প্রভাবের বাড়বাড়ন্তের ব্যাপারে বাংলাদেশকে বারবার যৌক্তিক ও অযৌক্তিকভাবে সতর্ক করে দিয়েছে, যা অনেকটা ভারতের দিক থেকে হিস্টিরিয়াতে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু, এটা আমাদের ভুললে চলবেনা যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে আর আমাদের রফতানির অন্যতম বৃহৎ বাজার হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমগোত্রীয় ইউরোপীয় দেশসমূহ। কাজেই, একতরফাভাবে শুধু ভারত বা চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যাওয়া হবে আত্মঘাতী, হঠকারী ও বোকামীপূর্ণ। কোন পক্ষের দিকে "হেলে পড়ার" (Tilt) নীতি হবে 'দুঃখজনক' ও 'ভেরী আনস্মার্ট'। এটা এখন ভবিষ্যতের জন্য দেখার বিষয় যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কতটুকু তার বন্ধু ভারতের বুদ্ধিতে বা মার্কিন চাপে, বা কোন তাৎক্ষনিক সুবিধার জন্য চীনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে কিনা। কিংবা যদি কখনো বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তবে কি তার পশ্চিমপ্রিয়তা তাকে চীনের প্রতি অতিসতর্কতার নীতির দিকে ঠেলে দেবে? মনে হয়, মার্কিন ও পশ্চিমপ্রিয়তা সত্বেও বিএনপির সম্ভাব্য সরকার হয়তো ভারতের সাথে সম্পর্কের কাউন্টারভেলিং ফোর্স হিসাবে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নীতিই অনুসরণ করতে চাইবে।
মোদ্দা কথা হলো, আঞ্চলিক বা/ও বৈশ্বিক মেরুকরণের অভিঘাত বাংলাদেশের উপর পড়বেই। বাংলাদেশের উচিৎ হবে কোন অবস্থাতেই কোন একটি পক্ষে গিয়ে আরেক পক্ষের বিপরীতে নিজেকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলা। বরং, বাংলাদেশকে এই সকল কনফ্লিকটইলিং পক্ষগুলোর সাথে সম্মানজনক ভারসাম্য বজায় রাখার মতো ডিপ্লোম্যাটিক স্কিল ডেভেলপ করা আবশ্যক। সেইসাথে জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে দৃঢ়ভাবে এস্টাবলিশ করার ব্যাপক উদ্যোগের নেতৃত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জন্য চীন, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ সবাই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশ এদের মধ্যে পক্ষ বেছে নেয়া এফোর্ড করতে পারেনা। সেটা করা সঠিকও নয়, সেটা করার বিলাসিতাও বাংলাদেশের জন্য মানায়ও না।
এশিয়া: ভবিষ্যতের সংকট/সম্ভাবনা
সকল কিছুরই দুটো দিকই থাকে। একদিকে যেমন অনেক সংকট থাকতে পারে, চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। আবার তেমনি সম্ভাবনাও থাকতে পারে। সম্ভাবনাগুলোকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর দক্ষতা অর্জণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ও সংকট সমাধানের দক্ষতা অর্জন আমাদেরকে অবশ্যই করতে হবে।
চ্যালেঞ্জ ও সংকট, আমার মতে, আপেক্ষিক। আমরা চ্যালেঞ্জ ও সংকট মোকাবিলায় কতটা দক্ষতার বা অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছি, তার উপরই নির্ভর করবে চ্যালেঞ্জ ও সংকটের ক্ষেত্র, তীব্রতা, মেয়াদ। সকল চ্যালেঞ্জ ও সংকটই মোকাবিলাযোগ্য।
আপাতদৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে: চীন-ভারত রেষারেষি, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে জটিলতা, তাইওয়ান ইস্যু, ইত্যাদি। এছাড়াও, চীনের উত্থানের ফলে সৃষ্ট চীনের প্রভাবের বিস্তৃতি।
আর সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, এশিয়া হলো পৃথিবীর গ্রোথ সেন্টার। ফলে, এশিয়ার বিকাশ ঘটতেই থাকবে। আর এর বেনিফিট সবাই পেতে থাকবে। আর এ অঞ্চলের কেউই হয়তোবা চাইবেনা, কোন সংকট সেই বিকাশের সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিক। তদুপরি, চীন আজ গ্লোবাল ইকনোমির সাথে এতটাই লিঙ্কড হয়ে গিয়েছে যে, চীন গ্লোবাল ইকনোমির ইন্টিগ্রাল পার্ট। সেই চীনকে এর থেকে ডি-লিঙ্ক করার চিন্তা ও চেষ্টা করাটা নিদেনপক্ষে মধ্যমেয়াদে হবে চরম হঠকারী ও ভয়ংকর। সম্পূর্ণ গ্লোবাল প্রোডাকশন ও সাপ্লাই চেইনে এত বড় অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে যে, সেই ঝুঁকি কেউই হয়তোবা নিতে চাইবেনা। কারণ, সেটা কারোরই স্বার্থানুকুল নয়। তাই, অন্যান্য চ্যালেঞ্জের বেশীরভাগেরই হয়তোবা শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।