নুহাশের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত?

, যুক্তিতর্ক

মনোয়ার রুবেল | 2023-09-01 08:55:09

মানুষের সাধারণ চোখে স্টারকিড হওয়া দারুণ উপভোগ্য মনে হতে পারে কিন্তু স্টার কিড হওয়ার অসুবিধাও আছে। তাকে সারাটা জীবন তারকার প্রেতাত্মা তাড়িয়ে বেড়ায়৷ পিতার তারকা খ্যাতি সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঘাড়ে বসে থাকে, বেড়ে  উঠতে দেয় না। একসময় গিয়ে এই খ্যাতিকে খুব ভারী মনে হয়।  স্টার কিডকে প্রতিনিয়ত  সিন্দাবাদের ভূতের সাথে যুদ্ধ করতে হয়, নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। এসব করতে করতে কখনো তারা হাঁপিয়ে উঠেন, বিক্ষুদ্ধ হন, রাগ হন। যেমনটা সম্প্রতি নুহাশ হুমায়ূন হয়েছেন৷ নুহাশ প্রথিতযশা লেখক হুমায়ূন আহমেদের পুত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্য ও গণমাধ্যমে ঠিক তেমনটাই জনপ্রিয়তা উপভোগ করেছেন যেমন ভারতে শাহরুখ খান, আমির খান বা সালমান খানরা করে থাকেন। তাঁর জীবন সাধারণ লেখকদের মতো নিরস ছিল না, বর্নিল ছিল। তিনি ধনী ও বুদ্ধিমান ছিলেন।  তার সন্তানদের  ঘিরেও মানুষের আগ্রহ ও ভালোবাসা ছিল চোখে পড়ার মতো। নুহাশ যতোই সাংবাদিকদের বলুক তার পিতাকে নিয়ে প্রশ্ন না করতে তবু একজন সংবাদ কর্মীকে পাঠকের আগ্রহের জায়গা থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গ আনতেই হয়।  নুহাশের মুখ থেকে হুমায়ূন আহমেদ নামটি উচ্চারিত হোক, মানুষ সেটাই শুনতে চায়। মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ও একজন সাংবাদিকের সীমাবদ্ধতাকে নুহাশ ক্ষমাসুন্দর দেখতে পারতেন।

দুনিয়ার সব স্টার কিডের মতো নুহাশ চাচ্ছেন নিজের আলোয় আলোকিত হতে। তিনি এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া করেন।  তাই, তাকে প্রশ্ন করার সময় সঞ্চালকের আরেকটু কৌশলী হওয়াই শ্রেয় ছিল৷ নুহাশের লেখা পড়ে মনে হলো, তাকে পিতার খ্যাতি তাড়িয়ে বেড়ায়। পোড়ায়। এমনটাই হয়। অভিষেক বচ্চনকে এখনো অমিতাভের ছায়ার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। সন্দীপ রায় খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা, এখনো তাকে শুনতে হয় তিনি সত্যজিতের রায়ের পুত্র। তিনি সেটাকে মেনেও নিয়েছেন। কিশোর কুমার পুত্র অমিত কুমার এখনো পিতার-পুত্র এই পরিচয়ের বাইরে স্বতন্ত্র মুখ হয়ে উঠেননি। এরা প্রত্যেকেই পিতৃপরিচয় ছাড়াও দুর্দান্ত। কিন্তু তাদের ঘাড়ে পিতার খ্যাতি শাকচুন্নি ভূতের মতো ঝুলে আছে।

নুহাশ হুমায়ূন ২৮ এপ্রিল ফেসবুকে নোটে লিখেছেন, সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দরকার। এটা আমিও বোধ করি। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে মুন্নি সাহা যখন প্রশ্ন করেন আপনাকে বিশ্ববেহায়া বলা হয়, আপনার বক্তব্য কী? তখন সাংবাদিকতার শিক্ষা নিয়ে আহত হই। সমাজের প্রান্তিক স্রোত থেকে উঠে আসার জন্য যখন টকশোতে হিরো আলমকে অপদস্থ করা হয়,  আহত হই। একটি ছোট শিশুকে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বৈশাখের উৎসবে মুখের সামনে বুম ধরে ইন্টারভিউ নেয়া হয় তার ইথিকস নিয়ে আহত হই। প্রতিটি স্বাক্ষাৎকারের পূর্বে স্বাক্ষাৎকার গ্রহীতার অনুমতি নিতে হয়, তার স্বস্তি ও অস্বস্তির জায়গাগুলো জেনে নিতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা, যার স্বাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে তাকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে হয়।  হিরো আলম অনন্ত জলিলকে প্রশ্ন করার সময় বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম টিভিগুলোর সেই শ্রদ্ধাবোধ দেখিনা।

নুহাশ সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিতে গেলে সঞ্চালিকার প্রশ্নে আহত হন৷ নুহাশ তার কাজের ক্ষেত্রে  পিতার ছায়া টেনে আনতে চাননি। প্রশ্নটি ছিল ''যদি আপনি নুহাশ হুমায়ূন না হতেন, হুমায়ূনপুত্র না হতেন, তাহলে কি আপনি যেখানে আছেন সেখানে থাকতেন বলে মনে হয়'? রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এসব প্রশ্ন ডালভাত। কিন্তু একজন সংস্কৃতি কর্মীর জন্য এটা বোধহয় তীর্যক ছিল। প্রশ্ন হতে পারতো, তার চলচ্চিত্র নির্মাণে হুমায়ুন আহমেদের প্রভাব আছে কিনা, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে হুমায়ুন আহমেদের চলচ্চিত্র নুহাশ  ভিন্ন সময়ের এজজন নির্মাতা হিসেবে কীভাবে দেখেন অথবা হুমায়ুন আহমেদ পুত্র হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গণের মানুষের আন্তরিকতা তিনি উপভোগ করেন কিনা?  সবপ্রশ্নই তাকে হূমায়ুন আহমেদের খ্যাতিকে স্মরণ করিয়ে দিবে কিন্তু অসম্মানবোধ হওয়ার অনুভূতি তাকে দিত না।

এটাও সত্য যে, নুহাশ যতোই 'না' বলুক যেকেউ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্তত একটি প্রশ্ন হূমায়ুন বিষয়ে নুহাশকে করত, হয়তো আমৃত্যু করবে। নুহাশেরও সেই বাস্তবতাকে মেনে নেয়া উচিৎ।

হুমায়ূন আহমেদের পরিবার তাঁর জনপ্রিয়তার স্তরটি পরিমাপ করতে পারেনা৷ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল হুমায়ুনের প্রয়ানে বাঙালির আবেগ দেখে মিডিয়া হাইপ কিনা সন্দেহে ছিলেন। সেদিনের আগ পর্যন্ত হূমায়ুন আহমেদ কতটা জনপ্রিয় পিঠাপিঠি ভাই হয়েও বুঝতে পারেন নি। তার লেখনিতেই আছে। হূমায়ুন আহমেদের প্রতি মানুষের আবেগ নুহাশ মেনে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আমি নুহাশের কাজ হোটেল আলবাট্রস দেখেছি। ষ নামে একটি কাজ করেছে চরকিতে, দেখিনি। হোটেল আলবাট্রস দেখেছি, আসাদুজ্জামান নূরকে কিভাবে নুহাশ হ্যান্ডেল করেছে তা দেখতে। হোটেল আলবাট্রস এক্সপেরিমেন্টাল ড্রামা মনে হয়েছে৷ নুহাশ তখনো শিখছে। আসাদুজ্জামান নূর সন্তানের প্রতি অনুরক্ত পিতার মতো নুহাশের কাজকে সাপোর্ট করেছে, টিভিতে কথা বলেছেন বলেই অনেকে নবাগত নুহাশের মুভি দেখেছে। তরুণ নুহাশ ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে আন্তার্জাতিক খ্যাত ও প্রশংসিত পরিচালক দাবি করেছেন।

আমি হয়তো নুহাশের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে পিছিয়ে আছি ভেবে, পাড়ার চায়ের দোকানে কয়েকজন তরুণকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা নুহাশ কে চিনেন কিনা? তাদের কাছে তিনি হূমায়ুন আহমেদের পুত্র। তার নামে একটা পল্লী আছে, সেটাও তারা জানেন।৷ নুহাশের কাজের সাথে এসব মুভি দেখিয়ে তরুণরা এখনো পরিচত নন। কেউ কেউ বলল তারা তার কোন কাজের নাম জানে না।

নুহাশ হূমায়ুন ফেসবুক নোটে লিখেছেন, "আমার অনুরোধ থাকবে, কেউ আমার জীবনে আমার বাবার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে মার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করুন"। শেষের এই লাইনটি দ্বিধায় ফেলে দেয় নুহাশ স্টারকিড বৃত্ত থেকে বের হতে চায় নাকি পিতা-মাতার বিচ্ছেদ ও মান-অভিমান ভরা জীবনের কিছু অংশ মগজে বয়ে বেড়াচ্ছে, বুঝতে পারছিনা। নুহাশ তার কৈশোরে পিতা মাতার বিচ্ছেদ দেখেন, মাকে হয়তো নিগৃহীত ভেবেছেন, দূর থেকে বাবাদ বর্ণাঢ্য জীবনযাপন দেখেছেন। বিষয়গুলো কোনভাবে তার মনের কোণে তীব্র রেখাপাত করেছে কি? হতে পারে।

নুহাশ এসময়ে মায়ের সাথে বড় হয়েছে। সন্তানের বেড়ে উঠার পেছনে মায়ের ভূমিকা আমাদের সমাজে না বলাই থাকে। নুহাশ চাচ্ছে লোকে তার মায়ের ভূমিকাও বলুক। নুহাশ চাচ্ছেন তিনি মায়ের সংগ্রামের গল্প এগিয়ে রাখতে। তিনি রাখুক।

তবে সরাসরি না লিখে সময় নিয়ে বহুভাবেই এই কথাগুলো নুহাশ প্রকাশ করতে পারতেন, মা'কে এগিয়ে রাখতে পারতেন, মহান করতে পারতেন।

নুহাশ বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম লেখক পরিবারের অংশ এটা তাকে উপলব্ধিতে নিতে হবে। তিনি ও তার পরিবার প্রকাশ্যেই চর্চিত হবেন যদি তার ক্ষোভগুলো ভিন্ন উপায়ে প্রকাশ না করেন। নুহাশ সৃজনশীল মানুষ, নিশ্চয়ই তিনি কোন না কোন উপায় বের করে ফেলবেন, যেন তার মা মহিমান্বিত হন।

লেখক: মনোয়ার রুবেল, ফ্রিল্যান্স রাইটার প্রাবন্ধিক, monowarrubel@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর