সামাজিক পরিবর্তন ও প্রজন্মের অভিব্যক্তি

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-09-01 22:02:28

সমাজ গতিশীল। পরিবর্তনশীলতা এর ধর্ম। আজ আমরা যে সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি তা পূর্বে ছিল না এবং বর্তমান কাঠামোও আগামী দিনে থাকবে না। সামাজিক পরিবর্তন বলতে বুঝায় সমাজস্থ মানুষের আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিল্পকলা,রাজনীতি, অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন।

সমাজ পরিবর্তন হয় সময়ের সাথে সাথে। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সব সময় সামাজিক অগ্রগতি বা প্রগতির সম্পর্ক থাকে না। পরিবর্তনের দ্বারা সমাজ বর্তমান অবস্থা থেকে খারাপ দিকে যেতে পারে, আবার উন্নতির দিকেও যেতে পারে। সমাজ পরিবর্তনের সাথে অনেক সময় সামাজিক মূল্যবোধের সম্পর্ক থাকে না। যেমন, সংস্কৃতির ব্যাপ্তির মাধ্যমে সমাজের যে পরিবর্তন ঘটে তাতে সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধের পতনও ঘটতে পারে। আবার বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে কোন সমাজ তার নিজস্ব মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে সমাজ মূল্যবোধের সংকটে পড়তে পারে।

উদারপন্থীরা এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে চাইলেও প্রাচীনপন্থীরা প্রচলিত মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে অনেক সময় মানুষের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষার সম্পর্ক থাকে না। সামাজিক পরিবর্তন কখনও মন্থর গতিতে আবার কখনও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়। তবে এই পরিবর্তন সাধারণত মন্থর গতিতেই হয়ে থাকে।

সামাজিক মূল্যবোধ সমাজের ভিত্তি। মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে সমাজ সামনের দিকে অগ্রসর হয়। সামাজিক মূল্যবোধ হল কতকগুলো নীতি, আদর্শ এবং আচরণবিধি যাকে একটি সমাজের মানুষ ভাল ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করে। প্রত্যেক সমাজে ভাল-মন্দের একটি মানদণ্ড আছে। এই মানদণ্ডের আলোকে মানুষের ভাল-মন্দ আচরণকে বিচার করা হয়। এই বিচারের মানদ-ই হল সামাজিক মূল্যবোধ। সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তি ও সমাজের অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তি হল সামাজিক মূল্যবোধ। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে।

সামাজিক পরিবর্তনের অনেক কারণ রয়েছে তার মধ্যে সাংস্কৃতিক কারণ অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানী অগবার্নের মতে, সংস্কৃতির ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে পুরাতন সংস্কৃতির বিলোপ এবং নতুন সংস্কৃতি নির্ভর সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে। তিনি সংস্কৃতিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতি। অগবার্ন বলেন, যখন বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পরিবর্তন আসে তখন ধীরে বা মন্থর গতিতে অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যেও একটা পরিবর্তন দেখা দেয়। এই অবস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। যেমন ডিস এ্যান্টেনা, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তনের ফলে সমাজের চিন্তাধারা ও কাজের ধরনের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত হয়ে সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে। ভিনদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ফলে প্রচলিত সংস্কৃতি ধীর গতিতে লোপ পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি ও বিস্তরণের ফলে এবং বিদেশি সংস্কৃতির ভাল দিক সংযোজিত হওয়ার ফলে দেশীয় সংস্কৃতির ইতিবাচক উন্নয়ন সামাজিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

এছাড়াও বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে ব্যক্তি নতুন নতুন কলাকৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়। প্রযুক্তির পরিবর্তন সমগ্র সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন আনতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী ভেবলেন বলেন, “প্রযুক্তি প্রধানত তিনটি জিনিসে পরিবর্তন আনে। যথা ১. উৎপাদন, ২. যোগাযোগ ও ৩. মনোভাব।” এই তিনটি জিনিস প্রকৃতপক্ষে সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের প্রসারের ফলে সমাজের পুরাতন কাঠামো বিলুপ্ত হয়ে নতুন সমাজ সচেতনতার জন্ম দেয়। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইমের মতে, “বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে সমাজে বসবাসরত ব্যক্তিদের মধ্যে সহজ-সরল ও স্বাভাবিক সস্পর্কের পরিবর্তে কৃত্রিম সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।”

আজকাল অনেকেই ফেসবুকে একটি লেখা শেয়ার করে থাকেন উপরে বর্ণিত সামাজিক পরিবর্তনের সাথে যার অনেকটাই মিল রয়েছে। এটাকে একটা প্রজন্মের সামাজিক পরিবর্তনের যথাপোযুক্ত অভিব্যক্তি হিসেবে ধরে নেয়া যায়। বিজ্ঞ পাঠকদের জন্য লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো সেইসাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হলো লেখাটির মূল লেখকের প্রতি। “আমরাই শেষ জেনারেশন যাঁরা পৃথিবীর বুকে স্বর্গ দেখেছি। আর কোনো জেনারেশনই হয়তো আর তা দেখতে পাবে না। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা গরুর গাড়ি থেকে সুপার সনিক কনকর্ড জেট দেখেছি। পোস্টকার্ড, খাম, ইনল্যান্ড লেটার থেকে শুরু করে আজকের হোয়াটস্যাপ চ্যাটিং, ফেসবুক, ই-মেইল পর্যন্তও করছি। অসম্ভব মনে হওয়া অনেক জিনিসই সম্ভব হতে দেখেছি। আমরা সেই জেনারেশন, যারা টেলিগ্রাম এসেছে শুনলেই ঘরগুষ্টির মুখ শুকিয়ে যেতে দেখেছি। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা মাটিতে বসে ভাত খেয়েছি আর প্লেটে ঢেলে চা খেয়েছি সুরুৎ শব্দে, পরে জেনেছি ওটা বদ-অভ্যাস। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি, টিলো এক্সপ্রেস, ডাঙ্গুলি, দাড়িয়াবাধা, গোল্লাছুট, মার্বেল খেলেছি, কাগজের ঘুড়ি বানিয়ে আকাশে উড়িয়েছি। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা হ্যারিকেন আর কূপির আলোতে পড়াশুনা করেছি, বেত থেকে পাখার ডাঁটির চাপকানি খেয়েছি আর চাদরে হাফ বডি ঢুকিয়ে উপুড় হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা, কুয়াশা সিরিজ।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা এসি, হিটার, ফ্রিজ, গ্যাস, মাইক্রোওভেনের অস্থাবর সুখ ছাড়াই কাটিয়েছি ছোটবেলা। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা বিনা টিফিনে স্কুলে গেছি, ইস্কুলে টিচারের হাতে মার খেয়ে, বাড়ি এসে নালিশ করাতে সেকেন্ড-রাউন্ড বেদম ফ্রি-স্টাইল ওয়ান-ওয়ে ফাইট সহ্য করেছি। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা বড়দের সম্মান করেছি এবং এখনও করি।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা জোৎস্না রাতে ছাদে ট্রানজিস্টরে বিবিসি’র খবর, অনুরোধের আসর আর সৈনিক ভাইদের দুর্বার অনুষ্ঠান এর শেষ সাক্ষী। আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা টেলিভিশনে খেলা দেখার জন্য ছাদে উঠে এ্যান্টেনা এডজাস্ট করে স্যিগনাল ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের ছিল তিন লাঠির এন্টেনা, আর ছিল টিভি স্ক্রিনে পার্মানেন্ট ঝিলমিলানি, তাতে কোনও প্রব্লেমই হতো না, ওটা জীবনের অঙ্গ ধরাই ছিল। গন্ডগোল পাকাতো ঐ বেয়াড়া লোডশেডিং।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভিজে ইস্কুল থেকে বাড়ি ঢুকেছি। আমরা সেই শেষ জেনারেশন যাঁরা পাশের জঙ্গলে শিয়াল ডাকার আগেই বাড়ি ঢুকেছি। আমরা সেই শেষ জেনারেশন যারা পূজো বা ঈদের সময় শুধু একটা নুতন জামার জন্য অপারগ বাবার দিকে চেয়ে থেকেছি। আমরাই লাস্ট জেনারেশন যারা এখনও সত্যিকারের বন্ধু খুঁজি। যেখানে নতুন প্রজন্ম ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর হোয়াটস অ্যাপের নেশায় বুঁদ! সেই দিন সেই সময় আর আসবেনা। তবে স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে।”

লেখক: গবেষক উন্নয়নকর্মী

এ সম্পর্কিত আরও খবর