‘ত্রিশঙ্কু অবস্থা’

, যুক্তিতর্ক

ড. হাসিন মাহবুব চেরী | 2023-09-01 23:19:12

জীবনে কখনো কখনো রাজা ত্রিশঙ্কুর মতো হাল হয়। পৌরাণিক কাহিনীর মতো এমন অবস্থা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। যখন মান্ধাতা স্বর্গ জয় করতে গিয়ে নিহত হন, তখন ভারতীয় পুরাণের আরেক রাজা ত্রিশঙ্কু স্বর্গে যেতে গিয়ে আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে আটকে থেকে যান।

রাজা ত্রিশঙ্কুর এই হাল থেকেই তৈরি হয়েছে বাংলা প্রবচন 'ত্রিশঙ্কু অবস্থা'। এ অবস্থা হলো অনিশ্চিত অবস্থা। কোন দিকে যে যাবে, তা স্থির করতে না পেরে অনেকেই ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকে। এটা ব্যক্তি মানুষের বেলাতেও ঘটে, রাজনীতির বেলাতেও ঘটে, সমাজে, সংসারে, সর্বত্র কখনো কখনো ঘটে।

প্রশ্ন হলো, আপনার কি কখনো এমন হয়েছে জীবনে? যে আপনি এমন কিছু একটা নিয়ে আটকে গেছেন, যা আপনি উপভোগ করতেও পারছেন না, আবার ছাড়তেও পারছেন না। কারণ, এই বিষয়ে আপনি অনেক টাকা, সময় অথবা মানসিক ভাবে নিজেকে invest করে ফেলেছেন ? আর এখন যদি মাঝপথে ছেড়ে দেন তাহলে আপনার এতদিনের সব কষ্ট বৃথা হয়ে যাবে? এমন অচলাবস্থা বা দোদুল্যমানতা জীবনে হয়ে থাকে বা হতেই পারে।

আপনার ক্ষেত্রে ঘটনা যদি এরকম হয়, তাহলে আপনি এমন একটি অবস্থায় আছেন, বিশেষায়িত পরিভাষায় যাকে বলে 'Sunk Cost Fallacy'। Sunk Cost মানে হলো, যে সম্পদ আপনি অলরেডি খরচ করে ফেলেছেন, যেমন  টাকা অথবা সময় যেটা  আপনি ব্যয় করে ফেলেছেন, তা কিন্তু আর কোনোভাবেই ফেরত আসবে না।  তাই এই Cost টা অলরেডি sunk মানে ডুবে গেছে এবং ফেরত পাওয়া যাবে না ! আর Fallacy মানে হলো ভ্রান্ত বিশ্বাস -মানে আপনি পুরো ব্যাপারটা উপভোগ না করলেও এর পেছনে আরো সময়, টাকা অথবা মানসিক ভাবে নিজেকে invest করে যাচ্ছেন শুধুমাত্র এই ধারণা থেকে যে, লেগে থাকলে হয়তো ভালো কিছু হতেও পারে অথবা আপনি নিজের এতটা সম্পদ ব্যয় করার পর মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়াকে নিজের পরাজয় বলে মনে করছেন।

মানসিকভাবে এরকম ভাবার পেছনে কাজ করে আপনার বাল্যকালের শিক্ষা, যেখানে বলা হয়েছে, 'একবার না পারিলে দেখো শতবার', 'সবুরে মেওয়া ফলে' অথবা 'Persistence is the key to success'! এই কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রে সত্যি হলেও সর্ব ক্ষেত্রে সত্যি নয়।  বরঞ্চ এই থিওরি ফলো করে এই কাজের প্রতি লেগে থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আপনি আপনার জীবনের অমূল্য সম্পদ নষ্ট করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন।  বুঝার সুবিধার্থে একটু উদাহরণ দিয়ে বলি:

ঘটনা ১: রহিম ১২ বছর ধরে লন্ডন থাকছে illigally, কিন্তু এখনো তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট হয়নি, হবার সম্ভাবনাও খুবই কম। কেননা পাসপোর্ট পেতে যে নিয়মকানুন মেনে থাকতে হয়, সেসব সে পালন করেনি। সে আসলে খরচ ও শক্তি ব্যয় করে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশ থেকে টাকা এনে চলছে। কিন্তু পাসপোর্টের আশা সে ছাড়তে পারছে না ! সে যেহেতু তার জীবনের মূল্যবান অনেকটা সময় এর পেছনে ব্যয় করে ফেলেছে, তাই সে দেশে ফিরেও যেতে পারছে না  এবং এই পাসপোর্টের আশায় তার জীবনের বাকি সময় গুলোও নষ্ট করছে !

ঘটনা ২: সুমি  তার বিয়ের পর থেকেই বুঝতে পারছে সে ভুল মানুষের সাথে আছে। তার স্বামী তাকে নানা ভাবে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করে চলেছে।  তার কাছে এ জীবন দুর্বিষহ মনে হয়।  কিন্তু তারপরেও সে এ ভুল সম্পর্ক থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারছে না। কারণ সে এই সম্পর্কে জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছে, তাই ভাবছে আরেকটু ধৈর্য্য ধরে দেখবে তার স্বামীর ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা!

ঘটনা ৩: আসিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে টপ সাবজেক্টে চান্স পেয়ে পড়া শুরু করার কিছুদিন পরেই বুঝতে পারে যে, এই বিষয়ে সে কোনো ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না, কিন্তু যেহেতু অনেক পরিশ্রম  করে পড়াশুনা করে এই সাবজেক্টে চান্স পেয়েছে তাই সে মাঝপথে ছাড়তেও পারছে না, ভাবছে আরেকটু সময় দিলে হয়তো ভালো লেগে যাবে !

ঘটনা ৪. ইমতিয়াজ একজন শিল্পপতি , যার বিশাল ব্যবসা তাকে অনেক স্ট্রেস দিচ্ছে। সে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অসুস্থ্য অনুভব করছে। কিন্তু ব্যবসার পরিধি কমিয়ে আনতেও পারছে না কারণ এই ব্যাবসাকে এ পর্যন্ত আনতে তাকে অনেক টাকা ইনভেস্ট এবং মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম করতে  হয়েছে। তাই সে মনে করছে এখন ব্যবসার পরিধি কমিয়ে আনলে তার পরাজয়। 

ঘটনা ৫. রিনা একটা traumatic রিলেশনশিপের মধ্যে ছিল। যেটা থেকে অবশেষে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু তার মনের মধ্যে সারাক্ষণ অতীতের  চিন্তা আসতে থাকে ঘুরে ফিরে। যে কারণে সে ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা করতে পারে না।  তার কেবলি মনে হতে থাকে তার জীবনের এতগুলো সময় নষ্ট হয়ে গেলো। আর এটা  সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না ! এগুতেও পারে না, পেছাতেও পারে না।

উপরোক্ত ঘটনাগুলো সবই 'Sunk Cost Fallacy'র উদাহরণ। খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন যে, উপরোক্ত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই তাদের জীবনের যে সময়, টাকা অথবা মানসিক investment করেছেন, সেটার কারণে তারা ওই পুরো ব্যপারটা  উপভোগ না করলেও সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না।  আর এই কারণেই তারা এখান থেকে তাদের ভালো কিছু হবে না জেনেও জীবনের বাকি সময়টা এর পিছনেই আবর্তিত হয়ে ব্যয় করে দিচ্ছেন ! কিন্তু তারা একবারও  ভাবছেন না যে, যে সময়, টাকা অথবা মানসিক investment এতদিন করেছেন, সেটা কিন্তু অলরেডি sunk cost, যা আর কোনোদিন ফিরে  আসবে না। বরং এই sunk cost এর মায়ায় তারা জীবনের বাকি সময়, টাকা সব নষ্ট করছেন!

এখন প্রশ্ন হলো এটা  থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই Sunk Cost Fallacy থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে carefully ভবিষ্যতের পর্য্যবেক্ষণ করা, ভেবে দেখা যে এই ইনভেস্টমেন্ট থেকে আপনি আদৌ ভবিষ্যতে সত্যি কিছু পজিটিভ ফলাফল পাবেন কিনা।  এবং এই পর্য্যবেক্ষণ হতে হবে বর্তমানের বাস্তবতার ভিত্তিতে।  আপনি যদি আপনার বাস্তব লজিক দিয়ে ভাবেন, তাহলে দেখবেন যে এই ঘটনাগুলোয় আপনি যতটাই ইনভেস্টমেন্ট করে থাকেন না কেন, এর থেকে এখনই বেরিয়ে আসলেই কেবল মাত্র আপনি আপনার ভবিষ্যতের সময়, টাকা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের শরীর-স্বাস্থ্য সব কিছুকে অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন। 

আমাদের সবারই মনে রাখা উচিৎ যে, জীবন একটাই, তাই জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ জীবনকে পজিটিভ ভাবে উপভোগ করা, আর এজন্যে জীবনে যা কিছু আপনাকে স্ট্রেস, মানসিক অথবা শারীরিক অশান্তি দিচ্ছে তার থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবেন ততই আপনার জন্যে মঙ্গল। কখনো কখনো যুদ্ধের ময়দানের 'কৌশলগত পশ্চাদপসরণ' করার মতোই জীবনেও অনেক কিছু ছেড়ে, ফেলে সামনে এগুতে হয়। চিন্তার অন্ধ প্রকোষ্ঠে বা কর্মের দ্বিধায় আবর্তিত হলেই আসে হতাশা ও অনুশোচনা। ফলে এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থার ক্ষতিকর পরিস্থিতি থেকে থেকে যত দ্রুত বের হয়ে ইতি ও গতির লাভজনক ও উপভোগ্য অবস্থায় আসা যায়, ততই ভালো। এতে জীবনে ক্ষতির মাত্রা কমে এবং সাফল্যের দিগন্ত উন্মোচিত হয়।  

. হাসিন মাহবুব চেরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাইক্রোবায়োলজিস্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর