পেশীর বেষ্টনী ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয় এক নয়

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 05:47:43

 

একটি বড় দেশ আমাদের আইন-শৃংখলায় নিয়োজিত কিছু বড় কর্তাকে তাদের দেশে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞার কথা প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। কেউ বলছেন এটা নিছক রাজনৈতিক ব্যপার কেউ বলছেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা। তবে যাই হোক না কেন, কোন দেশে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার অর্থ নানা বিশ্লেষণে নেতিবাচক। একজন প্রতিমন্ত্রীর এয়ারপোর্টের বেঞ্চে শুয়ে থেকে দেশে ফেরত আসার বিষয়টি আমাদের জাতির জন্য বড় অপমানজনক ব্যাপার।

সারা বিশ্বে পুলিশ দেখলে মানুষ ভয় পায় না, দৌড়ে পালায় না। বরং বিপদে পড়লে পুলিশের দ্বারস্থ হয় খুব দ্রুত। সেসব দেশে পুলিশ বিপদের বন্ধু। আমরা মুখে বলি এক, কার্যত: ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না।’

তবে এই পেশায় কাজ করা সবার সহ্য হয় না। কারণ, এটা খুব কঠিন পরিশ্রমের পেশা। মহান ব্রতের পেশা -যা কঠিন ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে প্রতি পদে পদে প্রমাণ করে জনসেবার স্বাক্ষর রাখতে হয়। এই পেশায় লোভ-লালসা থাকতে নেই। নিজের জীবনকে উজাড় করে দিয়ে জনগণের জান-মাল রক্ষা করাই এই পেশার উদ্দেশ্য। অনেক দেশে তাই এই পেশা অনেকে পছন্দ করে না। তবে অনেক দেশে এই ধরনের সেবাদান নির্দিষ্ট বয়সের নারী পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক। দক্ষিণ কোরিয়ায় ছাত্রত্ব শেষ করার পূর্বে অথবা চাকরিতে ঢোকার আগে একজন নাগরিককে তার দেশের জন্য সামরিক, পুলিশ বা ফায়ার ব্রিগেডে কমপক্ষে দু’বছর সেবা দিতে হয়। সেটা ওই দেশের সব নাগরিকের জন্য এ ধরনের সেবাধর্মী ট্রেনিংও বটে। এতে দেশ সেবার প্রতি মনোভাব যাচাইয়ের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাও সম্পন্ন করা হয়ে যায়। দেশের প্ররিক্ষার প্রয়াজেনে যেন সবাই যুদ্ধে বা উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সেজন্য এটা আগাম প্রস্তুতি।

আর আমাদের দেশের আপদকালে অদক্ষ মানুষ মুদু জটলা করে ও হা করে তাকিয়ে থাকে। দেশে একটি চাকরি পেতে কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত যার কপালে যা জোটে তাই নিয়ে জীবিকার অনুসন্ধান চলে। এভাবে নিজের পছন্দ হোক বা না হোক কেউ হন পুলিশ, কেউ শ্রমিক, কেউ হন ডাক্তার, কেউ বা মাস্টার বা অন্যকিছু-যা তিনি মনে মনে হতে চাননি। বিশেষ করে আগে সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষা না করে লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকে গার্মেন্টস্ শ্রমিক, সৈনিক বা পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিতে চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্য এক বিশেষ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় অনেককে। সেগুলো ওপেন সিক্রেট। তাই তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক সময় সুঠাম দৈহিক গড়ন, সঠিক উচ্চতা সম্পন্নজন বাদ পড়ে যান। পরিবর্তে নিয়োগ পান স্বজন অথবা টাকাওয়ালা মাতবরের বেঁটে ছেলে। উন্নত বিশ্বে এমনটি ঘটতে দেখা যায় না। সেখানে সার্বিক দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতাই মুখ্য।

আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাই। কিছুদিন আগে সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার লিখেছিলেন, “সুষ্ঠু নির্বাাচন নির্বাসনে চলে গেছে।” জনাব রাশেদ খান মেনন আরেক কলামে লিখেছেন, “গণতন্ত্র মুক্তির আকাঙ্খা এখনও অধরা।” (আজকের পত্রিকা ১০.১১.২০২১)। এই নির্বাচন শুধু ইউপি বা সংসদ নির্বাাচনই নয়- জীবন-জীবিকা বাঁচানোর জন্য কর্মক্ষেত্র বা চাকরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরো বেশী প্রযোজ্য। গণতন্ত্র না থাকায় মানুষ মানুষকে ভয় পায়। মানুষ ভোট কেন্দ্রে যেতে ভয় পায়। কারণ মানুষের জন্য সেবাদাসদের সাথে মানুষের সখ্য নেই। তাদের সখ্য আছে পেশীশক্তির সাথে। পেশীশক্তিও চায় মানুষ ভোটকেন্দ্রে না আসুক।

নমিনেশন পাওয়া মানেই ক্ষমতা হাতে পাওয়া-এই হলো এখনকার গণতন্ত্রের বাস্তবতা। এজন্যই ভোট করতে ইচ্ছুক সবাই। তাইতো পরিবার, আত্মীয়, পেশী, অর্থ সবকিছু নিয়ে ভোট কারার ইচ্ছায় ব্যাকুল সব মানুষ। অধুনা ভোটের জন্য মানুষ সহিংস হয়ে উঠেছে এই বিশেষ কারণে। আর এই অবৈধ কাজের সহযোগিরা মহাখুশী। উপঢৌকন পেলে তারা দিনকে রাত আর রাতকে দিন করে নির্বাচনী বৈতরণী পার করিয়ে দিতে পারঙ্গম। সেটা কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়ে হোক না কেন। ক্ষমতাধর এখন তারাই। তারা যার পক্ষে, লাভের হিসাব তার ঘরেই উঠে যায়।

আর যারা নির্বাচনের জন্য খরচ যোগাতে জমি-জমা, গরু-মহিষ বিক্রি করে কোমর বেঁেধে নেমে পড়েন তারাই পরবর্তীতে সামাজিক উন্নয়নের জন্য বড় বরাদ্দ্ পেতে মরিয়া হয়ে মহারথীদের দুয়ারে ধর্ণা দিতে থাকেন। সেভাবে যোগাড় হয়ে যায় বরাদ্দ। সেসব সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ কাজ শুরুর পূর্বেই ভাগাভাগি হয়ে গেলে নির্মানাধীন বসতঘর কি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে? অনেকগুলো বাস্তব উদাহরণ এবার জাতি টিভিতে দেখেছেন- আশ্রয়ণ প্রকল্পের ধ্বসে পড়া নতুন ঘরের মধ্যে এবং নদীভাঙন ঠেকানোর নামে প্রবল স্রোতের মধ্যে জিআই ব্যাগ ছুঁড়ে নদী ভাঙন ঠেকানার প্রহসনের ভিডিও সংবাদ অবলোকন করে। কেউ কেউ আবার ভাঙনের জায়গায় লোক জড়ো করে মানব বন্ধন করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। আসলে নদীভাঙন কি বর্ষাকালে গর্জে উঠা প্রবল স্রোতের সামনে মানববন্ধন বোঝে? এসব মানববন্ধনকারীরা চৈত্র মাসে কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান? ন্যায্য দাবীগুলো সময়মত তুলে ধরতে না পারলে মানুষের উপকার হবে কীভাবে?

পৃথিবীর বড় বড় ক্ষমতাধর দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও বড় বড় ঘটনা ঘটিয়ে বিশ্বসংবাদের শিরোনাম হন। যারা মরণাস্ত্র বিক্রি করে নিজেরে বার্ষিক বাজেটের সংকুলান করেন তারা এসব ব্যাপারে আরো বেশী চালাকি করতে সিদ্ধহস্ত। কারণ, তাদের পোষা বিড়ালরা চতুরতার সাথে পৃথিবীর কোন দুর্বল জায়গায় আঘাত করে বা সংঘাত লাগিয়ে অস্ত্র বিক্রি বাড়াতে হবে তার হিসেব-নিকেষ করে দেন। সেখানে তাদের লাভটা অতি বেশী। আমাদের দেশেও সেই ঢেউ লেগেছে। তবে সেটা ভিন্নভাবে ভিন্ন জায়গায়।

উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে চিন্তা করার কাজটা বহুযুগ আগেই সেরে নেয়া হয়েছে। ফলে তাদেরকে আমাদের দেশের মতো হতদারিদ্র পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়না। আমাদের মতো এত বেশী চরম বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, অভাব, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয় না। আয়বৈষম্য, সম্পদের মেরুকরণ, আমলা-মন্ত্রীদের বিদেশভ্রমণ, ভোগ-বিলাসিতা ওদের মধ্যে শোনা যায় না। ওরা নিজেরা কম্পিউটার, গাড়ি, ট্রেন বানায়, আমরা কেউ কেউ সেই গাড়ি, ট্রেন কিনি। সবাই কিনতে পারি না। চড়তেও পারি না।

আমাদের নেতারা কাঁচের ঘরে পুলিশের বেষ্টনীতে থেকে অনলাইনে বসে বড় বড় বক্তৃতা দেন। কেউ কেউ রাস্তায় বের হলে বিরাট ট্রাফিক পুলিশের বহরের জন্য শুরু হয় যানজট। সেই যানজট খুলতে কয়েক ঘন্টাও লেগে যায়। অনেক সময় এ্যম্বুলেন্স সেই যানজটে পড়ে প্যাঁ প্যাঁ করে কান্নাকাটি করে। রোগী মারা যাবার ভয়ে স্বজনরাও আহাজারি করে। আমাদের পুলিশ তবুও তাদের বসদেরকেই প্রটোকল দেয়, জনগণ ওদের নতুন গাড়ির বহর দেখে চেয়ে চেয়ে। অথচ অনেক উন্নত দেশের মন্ত্রীরা ট্রেনে-বাসে চড়ে অফিসে যান।

অপরদিকে হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণে হাতে নেয়া গুটি কয়েক প্রকল্পের অর্থ সেবাগ্রহীতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে নিঃশেষ হয়ে যায়। সকাল বেলা বাসার কলিং বেলের সামনে এত ভিক্ষুক ভিড় করে যে তাদেরকে সেইসব সরকারী সেবা বা অর্থপ্রাপ্তির কথা জিজ্ঞেস করলে তারা সে বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানায়। কেউ কেউ কান ধরে কসম করেও বলে- তারা সেসব কিছুই শোনেনি, কিছুুই পায়নি । তাহলে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের জন্য বরাদ্দকৃত এত অর্থ যায় কোথায়? এতগুলো নিত্য কড়া নাড়া অভাবী মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তো আর মিথ্যে কথা বলতে পারে না।

আসলে কাজীর গরু খাতা-কলমে আছে, গোয়ালে নেই এই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে তো অতীতের কথায় ফিরে যেতে হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিরাপত্তা বেষ্টনীর সেবাদানের ক্ষেত্রে ডিজিটাল কারচুপি ধরার জন্য কোনরুপ ব্যবস্থা এখনও নেয়া হয়নি। কেউ নিজে পুলিশী বেষ্টনীতে থেকে জনকল্যানে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর চিন্তা করাটা নিতান্তই অমূলক। এজন্য সেবাদানকারীদেরকে যথেষ্ট সময় ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত শ্রম দিতে হবে আরো অনেক বেশী। তা না হলে যতই সাফাই দিন না কেন- যারা দেশের কেন্দ্রে এসব কাজ করে চিহ্নিত বড় মহারথী তাদেরকে বিদেশিরা চোখ রাঙিয়ে তাদের দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকবে এবং যারা মাঠ পর্যায়ে এসবের জন্য দায়ী তাদেরকে সচেতন গণমানুষ ইউপি নির্বাচনের মতো বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা শুরু করবে। তাই বিবৃতিদান ও বিলাসিতা পরিহার করে প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষের পাশে আসুন, তাদের কথা শুনুন, তাদেরকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তা না হলে স্বতন্ত্র মানুষ বৈরী পরিবেশের বেষ্টনী ঠেলে নতুন নিরাপত্তা বলয় নিজেরাই তৈরি করতে থাকবে।

লেখক: সমাজর্কম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক ডীন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর