বিজয়ের বীরদের কাগজে-কলমে স্বীকৃতি দিলেও তাদের ‘মনে’ রাখিনি

, যুক্তিতর্ক

ড. এমদাদ হাসনায়েন | 2023-09-01 23:49:01

বাংলাদেশের বিজয়ের পঞ্চাশ বছর, সকলকে শুভেচ্ছা ও স্বাগতম।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল মানুষ আত্ম বলিদান করেছেন তাদের আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করি ও যে সকল মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের প্রতি জাতি কৃতজ্ঞ। আমাদের দুঃখী দেশটি আমাদের ভালোবাসার দেশ, মমতার দেশ। যারা জীবন বাজি রেখে এই স্বাধীন দেশটি আমাদের এনে দিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

মানুষের যতগুলো অনুভূতি আছে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব তার মাঝে সবচেয়ে তীব্র ভালোবাসাটুকু হতে পারে শুধুমাত্র মাতৃভূমির জন্যে। যারা কখনো নিজের মাতৃভূমির জন্যে ভালোবাসাটুকু অনুভব করেনি তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউই নয়। আমাদের খুব সৌভাগ্য আমাদের মাতৃভূমির জন্যে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল তার ইতিহাস হচ্ছে গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস এবং বিশাল এক অর্জনের ইতিহাস। যখন কেউ এই আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস জানবে, তখন সে যে শুধুমাত্র দেশের জন্যে একটি গভীর ভালোবাসা আর মমতা অনুভব করবে তা নয়, এই দেশ, এই মানুষের কথা ভেবে গর্বে তার বুক ফুলে উঠবে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঐতিহাসিক কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠে এক জনাকীর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে কুষ্টিয়ায় স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলনের দৃশ্য। ছবিঋণ. ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম

স্বাধীনতার ৫০ বছরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত শহীদের রক্ত এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ, ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা আর তার বীরত্বগাথা ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সকল ব্যক্তি দেশের জন্য কাজ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এসব বীরের চূড়ান্ত তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে ৬৭৬ জনকে খেতাব দেওয়া হয়। এই খেতাব ছিল চার স্তরের। তারমধ্যে কুষ্টিয়ার খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ১১ জন।

তারা হলেন- শহীদ শরফুদ্দীন আহমেদ বীরউত্তম, শহীদ আবু তালেব বীরউত্তম, শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন তারিক বীরবিক্রম, শহীদ দিদার আলী বীরপ্রতীক, শহীদ কে এম রফিকুল ইসলাম বীরপ্রতীক, শহীদ আবদুল আলিম বীরপ্রতীক, এজাজুল হক খান বীরপ্রতীক, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বীরপ্রতীক, শহীদ হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক, শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ বীরপ্রতীক, আতাহার হোসেন বীরপ্রতীক, মোসলেম উদ্দিন বীরপ্রতীক।

স্বাধীনতার পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শন ও তাদের গৌরবময় স্মৃতি রক্ষায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের নিমিত্তে কুষ্টিয়ার মজমপুরের ‘ঘৃণিত রাজাকার চত্বর’ বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম নির্মিত ভাস্কর্য।

২০০০ সালের বিজয় দিবসে রাত ১২:০১ মিনিটে এই ভাস্কর্যটি প্রথম স্থাপিত হয় কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সামনে। উদ্বোধন করেছিলেন ড. আবুল আহসান চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহম্মেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজামান সেন্টু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি পিনু, কবি খৈয়াম বাসার, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সেক্রেটারি আমিরুল ইসলাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শাহীন সরকার, চিত্রশিল্পী মীর জাহিদ, আলোকচিত্রী মুক্তারুজ্জামান টিপু, কামরুজ্জামান, মোফাজ্জেল হোসেন প্রমুখ।

পরবর্তীতে জাতীয়ভাবে ঘৃণিত রাজাকার ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটির উদ্যোগে ভাস্কর শিল্পী ইতি খানের ডিজাইন ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই ভাস্কর্যটি শহরের প্রবেশ মুখে ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল মজমপুর গেট চত্বরে পুনস্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত।

ভাস্কর্য নির্মাণের পর থেকে তরুণ প্রজন্মসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা ঘৃণিত ওই ভাস্কর্যটির গায়ে পাথর নিক্ষেপ করে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি প্রতীকী ঘৃণা প্রদর্শন শুরু করেন।

স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি ভাস্কর্যটি কংক্রিট ঢালাইয়ের একটি খুঁটির সাথে স্থাপন করা হয়, যার রক্তাভ জিহ্বা দেওয়া হয় ১৭ হাত! জিহ্বার মাথায় গজাল মেরে ভাস্কর শিল্পী ইতি খান বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলা ও রাজাকারদের জঘন্য অপরাধের প্রতি আমৃত্যু ঘৃণা প্রদর্শনের জন্যই তিনি ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন।’ ভাস্কর্য ইতিহাসের কথা বলে। এরপর শুরু হয় কুষ্টিয়াতে বাঙালি চেতনাভিত্তিক কাজ করা। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে সেই ভাস্কর্যটির বেহাল দশা, দেখার কেউ নেই!

যে সীমাহীন ত্যাগের মধ্য দিয়ে

স্বাধীনতা এসেছিলো, তা মানুষের মনে

কী স্বপ্ন জন্ম দিয়েছিলো!

বাস্তবে তারা কী পেলেন, এবং

কোন আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছিলো এবং

শেষ পর্যন্ত কোন পথে গেল আমাদের মা-মাটি-বদ্বীপ বাংলাদেশ কুষ্টিয়া।...

কুষ্টিয়ার যে সমস্ত বীরসন্তান শহীদ হয়েছেন, যুদ্ধাহত হয়েছেন, অংশগ্রহণ করেছেন, যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন, সবাই তারা মুক্তিযোদ্ধা, নেই ভিন্নমত, কেউ উঁচু সারির, কেউ সারণির নিম্নে, এটুকু প্রভেদে না আসে যায় কিছু। অসামান্যে সামান্য যোগেই হয়েছে সম্ভব, আজ তাই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে সুন্দর কুষ্টিয়া।

যুদ্ধ মানুষের ক্ষয় করে কিন্তু কোন কোন যুদ্ধ সৃষ্টির আনন্দে ভাস্বর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এমনই এক দৃপ্ত ইতিহাস। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাদের সেই দেশপ্রেম, সাহস ও বীরত্বের কথা আমরা ৫০ বছরেও যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এই বীরদের মুখে বা কাগজে কলমে স্বীকৃতি দিলেও তাদের কথা আমরা আজ মনে রাখিনি।

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম জানতেই পারেনি যে তারা কতো বড় বীরের জাতি! দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই উজ্জ্বল আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ইতিহাস তুলে ধরা ছিলো একটি জাতীয় কর্তব্য। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগণিত সাধারণ মানুষের অসাধারণ যোদ্ধায় পরিণত হওয়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনী। ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ও পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই দেশ-মাতৃকার ডাকে শত্রুর বিরুদ্ধে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। ১৯৭১ সালে তারা প্রশিক্ষিত ও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধ করেছিলেন, তা অবিশ্বাস্য।

অনেক ঘটনা গল্প-কাহিনীর চেয়েও রোমাঞ্চকর। এরকম একটি যুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়তেন তবে আমরা এ রকম একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেতাম না। মুক্তিযুদ্ধ যেমন শোক ও বেদনার, তেমনি বীরত্ব ও গৌরবের। এই ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলার ইতিহাসে এক মহান অধ্যায় আমাদের স্বাধীনতা।

লেখক: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন, ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর