সংলাপ: তবু আশা বেঁধে রাখি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-29 10:16:26

সংলাপকে চূড়ান্তভাব সফল বা ব্যর্থ বলার সময় এখনও আসেনি। সংলাপ থেকে কে কতটা অর্জন করতে পারলো সেটি নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে দেশে সংলাপের রুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত হলো। এই সংলাপের এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন। কারণ, সরকার ও বিরোধী জোট সংলাপের বিষয়ে তাদের কট্টর অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। ফলে, আপাত: সংলাপের মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার পুরোপুরি সমাধান না হলেও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সময়েই তা সমাধান হতে পারে। ফলে, আসন্ন নির্বাচন পর্যন্ত এই সংলাপের একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়ে যাবে। তবে, ভবিষ্যতে সে সুযোগটি গ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি নির্ভর করবে সে সময়ের বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানের ওপর এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মন-মানসিকতার ওপর।

মনে রাখতে হবে, সংলাপ এক রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। রাজনীতিতে এ কৌশলের ব্যবহার, অব্যবহার ও অপব্যবহার-তিনটিই জাস্টিফাইড। ২০১৪ সালে সরকার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিরোধীদলকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। হয়তো সে সময় সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার একটা সমাধান হতেও পারতো। কিন্তু বিরোধীদল সংলাপের ব্যবহার করতে পারেনি। এবারও সংলাপের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। দুই পক্ষেরই এখান থেকে অর্জন করার মতো উপাদান ছিল। সেটি না করে যদি স্রেফ কৌশল হিসেবেই সংলাপকে ব্যবহার করা হয় তবে তা সংলাপের অপব্যহার ছাড়া আর কি! স্বীকার করি, সংলাপ একটি রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এটিকে শুধুই একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখলে সংকট সমাধানের পথ কঠিন হয়ে যায়। এতে করে ভবিষ্যত সংকট উত্তরণের এক্সিট ওয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপি যেমন ২০১৪ সালে সংলাপের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে তাদের রাজনীতির পথকে আরো কঠিন করে ফেলেছে। এখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে তারা নিজেরাই আবার সে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সবার জন্যই ভালো যে সরকার এটিকে গ্রহণ করেছে। না হলে দেশ হয়তো উত্তপ্ত রাজনীতির মধ্যে পতিত হতো। যদিও সে সম্ভাবনাকে এখনও নাকচ করা যায় না। তবে আমরা আশাবাদী-কৌশল যা-ই হোক-জনগণ একটা সুফল পাবে।

মানি যে রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই। এ লড়াইয়ে ক্ষমতাশীলরা আরো এগিয়ে থাকে। ফলে তাদের পক্ষে ঐক্য করা সহজ। বড় তালুকদারে সাথে সবাই আত্মীয়তা করতে চায়। প্রয়োজনে দু’চারটা গালমন্দ সহ্য করেও হজম করে। ফলে, ক্ষমতাশীলদের ঐক্যে সাধারণত ফাটল ধরে না। কিন্তু রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষের সে অবস্থান থাকে না, তাই ঐক্য করাও তার জন্য কঠিন। সে ঐক্য ধরে রাখা আরো কঠিন। ড. কামাল হোসেন ঐক্য করেছেন, সেটি তিনি কতদিন ধরে রাখতে পারবেন সেটি বড় প্রশ্ন। কারণ, এখানে বেশিরভাগই ঘরছাড়া, সাবেক আওয়ামীল লীগার ও জাসদের একাংশের নেতা। এছাড়া নানা পথ ও মতের সন্যাসীরা এক বটবৃক্ষের ছায়াতলে কতদিনই থাকতে পারেন?

বদহজমের ওষুধেরও মেয়াদ আছে, কিন্তু রাজনীতিতে ঐক্যের কোনো মেয়াদ নেই। আর নির্বাচন এলে রাজনৈতিক আদর্শের বদহজম আরো বেড়ে যায়। সবাই তখন ঘাটে-অঘাটে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে। বদু চাচার দোয়াও তখন অনেক কাজের। বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেসরকারি ট্রেন (ঐক্যের ট্রেন) মিস করে সরকারি ট্রেন ধরেছেন। এরশাদ ভাই হয়ে বোনের সাথে একহয়ে নির্বাচন করবেন ও এবার ইউটার্ন না নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ দল থেকে দুইজন বের হয়ে সরকারি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। কাদের সিদ্দীকি তলে তলে বোনের সুনজরে আসার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সাড়া না পেয়ে বড় ভাইয়ের কাছে বায়াত হয়েছেন। এটাই রাজনীতি। শুরু আছে, শেষ নাই। শমশের মবিন চৌধুরী জীবনের প্রান্ত বেলায় বিকল্পপথে গদির গরম পেতে বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সামরিক শাসনের রাহুগ্রাস গ্রাস করেছে আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা ও আদর্শকে। জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতাদের নিয়ে বিএনপি গঠন করেছেন। এরশাদ আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বিএনপির নেতাদের নিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেছেন। সামরিক শাসনামলের ডিগবাজীর বৃত্তান্ত এখানে বলে শেষ করা যাবে না। সেই ডিগবাজী এখনও চলছে। নির্বাচন এলে তা আরও বেড়ে যায়। হালে যে যেখানেই যোগ দিয়েছেন, ঐক্য গঠন করেছেন- তাতে এটা মনে করার কারণ নেই যে এটাই তাদের শেষ ডিগবাজী।

ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ব্যক্তি ইমেজ ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। জীবনের একটি সময় তাদের সবোর্চ্চটাই দেশের জন্য দিয়েছেন-একজন মানুষ যতোটা দিতে পারে। ড. কামাল সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে কারাবরণ করেছেন। আ স ম রবের হাতেই দেশের পতাকাটি প্রথম উড়েছিল-ভাবা যায় এটি কতবড় একটি বিষয়। তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করার সময় আমরা ভুলে যাই দেশের জন্য তাদের অবদান। সব কিছুতেই আমাদের দৈন্যতা পেয়ে বসেছে।

ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে, সংলাপও করেছে। তা করতেই পারে। গতকাল দ্বিতীয় দফা সংলাপ হয়ে গেলো। এ সংলাপের ফল কী হলো তা এখনও জানা যায়নি। রাজনীতিতে সব সংলাপ প্রকাশ্যে হয় না। পর্দার অন্তরালেও সংলাপ দেন-দরবার হয়। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, বল এখন সরকারের কোর্টে। গতকাল সংলাপ শেষে নেতাদের মুখে একরকম কথা শোনা গেছে। কিন্তু গণমাধ্যমে কিছু ছবি দেখে আবার মনে হয়েছে হয়তো জনগণকে তারা ভালো কিছুই উপহার দিতে পারবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার আজকের সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করেছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন ইসির ভাষণের জন্যই এই সিদ্ধান্ত। এদিকে ঐক্যফ্রন্টও লংমার্চের বদলে জনসভার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বল যদি সরকারের কোর্টে হয় তবে সরকার সেই বল কতটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে খেলে তারই ওপরই নির্ভর করে খেলার গ্রহণযোগ্যতা ও মান। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দল বারবার একই পথে হাঁটবে এটি আশা করা ঠিক হবে না। তাই সরকারও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই দিতে চায়।

ঐক্যফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকে সংলাপের মাধ্যমে কতটুকু কী আদায় করে নিতে পারলো সেটিই বড় প্রশ্ন। কিন্তু এটাও ঠিক কোনো দলই ক্ষমতায় গেলে পরাজয়ের পথ রচনা করতে চায় না। তাই ঐক্যফ্রন্টকে হয়তো নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠেই থাকতে হবে। রাজনীতি একটি প্রেসার গেম-মাইন্ড গেম। সংলাপ যেমন রাজনৈতিক কৌশল তেমনি মাঠ গরম রেখেও সংলাপের ফল নিজের দিকে আনা আরেকটি কৌশল। তবে মাঠ গরম রাখা মানে জ্বালাও-পোড়াও নয়। তাতে হিতে বিপরীত হয়। জ্বালাও-পোড়াও করে বিএনপি বদনাম ছাড়া আর কিছু আয় করতে পারেনি।

এবার বিএনপির নির্বাচন থেকে সরে আসা কোনো মতেই উচিত হবে না। একই সাথে সে নির্বাচনে জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির দায়ও সরকারের ওপর। আবার বিএনপিকে সে দাবি আদায় করে নিতে হবে সরকারের কাছ থেকে। সংলাপই দাবি আদায়ের শ্রেষ্ঠ পন্থা। এতে দু’পক্ষের জয় হয়। আর আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিনপক্ষ-সরকার, বিরোধী দল ও জনগণ তথা রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমরাও বঙ্গবন্ধু কন্যার ওপর সে বিশ্বাস রাখতে চাই। জাতির জনকের কন্যার কাছে জনগণের এ আস্থা, বিশ্বাস ও দাবি কি খুব বেশি কিছু চাওয়া? রাজনীতির থেকে জনগণের কিছু চাওয়া-পাওয়া নেই। জনগণ গণতান্ত্রিক আবহে শান্তি-সমৃদ্ধি থাকতে চায়। দুধে-ভাতে না হোক-ডালে ভাতেই খুশি। এটুকু চাও কি খুব বেশি কিছু? জানি না, তবু আশা বেঁধে রাখি।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম, আইনজীবী ও কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর