সংসদ ভেঙে দিয়ে কি নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ইকতেদার আহমেদ | 2023-09-01 16:41:01

আমাদের বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সরকারের শীর্ষ নির্বাহী। প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রযুক্ত হয়। মন্ত্রিসভার সদস্যরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হলেও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী এ নিয়োগ কার্যগুলো সমাধা করেন। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি পদে বহাল থাকেন এবং তার সাথে তার মন্ত্রিসভার অপরাপর সদস্যরাও পদে বহাল থাকেন।

বর্তমানে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ক কোনো বিধান না থাকলেও এক সময় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবির সমর্থনে বিএনপি কর্তৃক ৬ষ্ঠ সংসদে একতরফাভাবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সন্নিবেশিত হয়েছিল। অতঃপর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ৭ম ও ৮ম এ দু’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রথমটিতে আওয়ামী লীগ এবং পরেরটিতে বিএনপি বিজয়ী হয়।

সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন পরবর্তী নির্বাচন বিষয়ক যে বিধান করা হয় তাতে বলা হয়- মেয়াদ অবসান অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রধান প্রবক্তা হলেও এ দলটি ২০১১ সালে নবম সংসদে বিএনপির তীব্র বিরোধীতার মুখে সংসদে তাদের একক দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ক যে বিধান করা হয় তাতে বলা হয়- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন পরবর্তী প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে ৫ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যায়। মেয়াদ পূর্তির আগেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। সংসদ নির্বাচন বিষয়ক সংবিধানের বর্তমান বিধান অবলোকনে প্রতীয়মান হয় সংসদ বহাল রেখে এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে উভয় ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান সংবিধানসম্মত।

সংসদ বহাল থাকাবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি সকল প্রার্থীর জন্য সমসুযোগ সম্বলিত মাঠের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হয় না।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী সংসদ বহাল রেখে যে ১০ম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে নির্বাচনটি তৎকালীন প্রধান বিরোধীদল বিএনপির বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনটিতে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কখনো দলীয় সরকার পরাভূত হয়নি অপরদিকে দলীয় সরকার বহির্ভূত সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার কখনো বিজয় লাভে সমর্থ হয়নি।

১৯৯১ সাল পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের সরকার পরিচালনার সুযোগ ঘটে। এ দু’টি দল সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকাবস্থায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে অনাগ্রহী হলেও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় এরূপ সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমভাবে আগ্রহী।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ ও ১০ম সংসদ নির্বাচন একই মাত্রায় অনিয়ম ও কলুষতায় ভরপুর হলেও এ দু’টির মধ্যে পার্থক্য প্রথমোক্তটি অনুষ্ঠান পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক বিধানের প্রবর্তন করে সংসদ অবলুপ্ত করা হয় অপরদিকে শেষোক্তটি নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও এবং এটিকে নিছক নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে অচিরেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এমন আশ্বাসের কথা বলে পরবর্তীতে এ সংসদটিকে মেয়াদ পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পঞ্চম সংসদ বহাল থাকাকালীন বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এবং নবম সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় যথাক্রমে কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ান এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত ফারনান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়। স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের প্রস্তাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল হতে ৫ জন করে মোট দশজন সদস্য সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সে প্রস্তাবে বিএনপি সম্মত হলেও আওয়ামী লীগ সম্মতি দেয়নি। ফারনান্দেজ তারানকো আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না দিলেও আলাপচারিতায় তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপরেখার আভাস দিয়েছিলেন তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উভয় দলের সমসংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের চিত্র পাওয়া পায়। এ রূপরেখা বিষয়ে আওয়ামী লীগ সম্মত থাকলেও বিএনপির পক্ষ হতে অসম্মতি জ্ঞাপন করা হয়।

তারানকোর সফর ব্যর্থ হওয়ার পর ১০ম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ প্রধানের পক্ষ থেকে তার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সমসংখ্যক সদস্যসহ স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার কথা ব্যক্ত করলেও শেষ অবধি তা কার্যকর রূপ পায়নি।

বিএনপি জনমতের অবস্থানে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল হলেও বর্তমান সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে বিএনপির অন্তর্ভুক্তিতে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধান সম্মতভাবে সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্বে অথবা মেয়াদ অবসানের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। উভয় দল ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় পরস্পরের দলীয় প্রধানের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে উভয় দল সম্মত না হলেও বর্তমানে বিএনপির স্থলে ঐক্যফ্রন্টের আবির্ভাব ঘটায় প্রেক্ষাপট ভিন্নতর।

ঐক্যফ্রন্ট প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সম্মত হলে মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় ঐক্যফ্রন্টকে অন্যূন এক-দশমাংশ মন্ত্রিত্ব দেয়ার অবকাশ আছে। এ বাস্তবতায় মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা ১০ জন হলে ঐক্যফ্রন্টের ১ জন অথবা ২০ জন হলে ঐক্যফ্রন্টের ২ জন সে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ঐক্যফ্রন্টের সদস্যদের কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে সেটি সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী লীগ ও ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে সমঝোতার ওপর নির্ভর করে।

আমাদের সংবিধান সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর ভেঙে যাওয়া সংসদের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনে কোনো বাধা নয়। এরূপ মন্ত্রিসভায় সংসদ সদস্য বহির্ভূত এক-দশমাংশের অন্তর্ভুক্তিও বাধা নয়।

এ দেশে ইতোপূর্বে একক ব্যক্তির অভিলাষ পূরণে একাধিকবার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশের বড় দুটি দলের মূল রাজনৈতিক বিরোধ নির্বাচনকালীন কোন ধরণের সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এর স্থায়ী সমাধান করা গেলে মেয়াদ অবসানজনিত কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সকল ধরণের অরাজক ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।

বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি যেনো উদ্ভব না হয় সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে দলটি সংবিধানে সংশোধনী এনে অথবা সংবিধানসম্মতভাবে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সমঝোতায় উপনীত হতে পারলে একটি রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। সুতরাং রাজনীতিকরা আবারো কি ভুল করবেন নাকি ভুলের পুনরাবৃত্তিরোধে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিবেন এ সিদ্ধান্তটি একান্তই তাদের নিজের।

ইকতেদার আহমেদ: সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর