এই সেই বঙ্গবন্ধুর কামাল

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মনোয়ার রুবেল, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-25 01:12:29

১.

১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে কারাগারে এলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। বিভিন্ন প্রসঙ্গের পরে ভুট্টোকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ড. কামাল হোসেনও এখানে আছে, তোমাদের কোনো একটা জেলে। ভুট্টো প্রশ্ন করে, আপনি কিভাবে জানলেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার ট্রায়াল চলার সময় আইনজীবী এসএ ব্রোহী বলেছিলেন, এই ট্রায়াল শেষ করে আমি ড. কামালের ট্রায়ালে যাব। কথাটা আমার কানে এসেছিল।

বঙ্গবন্ধুর কথা অনুযায়ী ড. কামালকে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন ভুট্টো।

বঙ্গবন্ধুর মূলত একজন আইনজীবী দরকার ছিল। ড. কামাল ছিলেন তার প্রিয় শিষ্য এবং একজন আইনজীবী। ভুট্টো সরকার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেশে ফেরা নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং ড. কামালকে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে আলোচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

লন্ডনের বিমানে উঠার আগে ড. কামাল এর পাকিস্তানে থাকা স্ত্রী ও সন্তানকে লন্ডনের একই বিমানে তুলে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু ।  এক ঘণ্টার মধ্যে কামালের স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেন বঙ্গবন্ধুর বিমান।

২.

১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যুগোশ্লাভিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাঙ্কফুটে আসেন ড. কামাল হোসেন। উঠেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায়। সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ধরাধরি করে বাসায় নেন ড. কামাল, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও মিসেস চৌধুরী।

১৬ই আগস্ট ড: কামাল হোসেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য বন বিমানবন্দরে যান। বিমানবন্দর থেকে বিদায় নেবার সময় ওয়াজেদ মিয়া কামাল হোসেনকে একটি অনুরোধ করেন।

কামাল হোসেনের হাত ধরে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, "খন্দকার মোশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আপোষ করে তাঁর মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করবেন না।"

কামাল হোসেন তখন ওয়াজেদ মিয়াকে যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটি ছিল এ রকম, "ড: ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপোষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না"। (তথ্যসূত্রঃ ওয়াজেদ মিয়া'র বই অবলম্বনে বিবিসি বাংলার রিপোর্ট,  ১৬ আগস্ট ২০১৮)। ড. কামাল আর বাংলাদেশে ফেরেন নি।

৩.

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ড. কামালের সংশ্লিষ্টতার কথা আলোচনা না করে তার নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে আলোচনা করা শ্রেয়। ড. কামাল হোসেন এর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে অনেকে অনেক দৃষ্টি কোন থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে প্রায় সবাই সরকার বিরোধী বলে তাঁর ভূমিকা চরিত্রায়ন করেছেন। আমার মনে হয়, বিষয়টা একটু ভিন্নভাবে দেখা যায়।

বাংলাদেশে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ দুটি ধারা বিদ্যমান। স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ, সাম্প্রদায়িক অসাম্প্রদায়িক যেভাবেই বলি না কেন সময়ান্তে আওয়ামী ও এন্টি আওয়ামী ধারাই আসল রাজনীতি। শেখ হাসিনাও তা মানেন। কামাল হোসেন এই দুই ধারা বিলোপে মধ্যমণি হতে পারে।

কিছুদিন আগে বিএনপির ওয়েবসাইটে আদর্শের বর্ণনায় যা লিখা ছিল তা এককথায়- বিএনপির আদর্শ আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করা। সমালোচনার মুখে বিএনপি এটা সরিয়ে নেয়।  বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাকালে তখনকার একমাত্র স্রোত আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করার মাধ্যমে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বলে ভেবেছিল। ক্ষণকালের কৌশল দীর্ঘকালে আদর্শে পরিণত হয়৷ বিএনপির আদর্শে বলিয়ান। বিরোধিতা এমন একপর্যায়ে পৌঁছুছে যে আওয়ামী লীগের স্লোগানে আছে বলে অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এগুলার বিরোধিতা করা শুরু করে। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক হয়, বেগম খালেদা জিয়া ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের চর বলেন।

তারা বিদ্বেষবশত হিতজ্ঞান হারিয়ে এসব বলে ফেলেন। তাদের এন্টি আওয়ামীলীগ রাজনীতি স্বাধীনতার মতো মৌলিক বিন্দুতে বিভাজন তৈরি করে।

ড. কামালের বিএনপি জোটে সংযুক্তিতে এই মৌলিক চেতনার ভাঙন রোধে কিছুটা কাজ দিবে।

যে যেখানে যখনি আওয়ামী বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে বিএনপি তাকে বুকে জড়িয়ে, অর্থ দিয়ে যেভাবে পেরেছে সমর্থন দিয়েছে। এখন দেশে দল ভিত্তিক রাজনীতি নেই, জোট ভিত্তিক রাজনীতি। ইতিপূর্বে সবগুলো এন্টি-আওয়ামী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে অপছন্দ করে,  ভারতকে শত্রু মনে করে, ধর্মকে পুঁজি মনে করে।

কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর প্রতিটি সভায় বিএনপিকে বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন শুনতে হচ্ছে ৷ যেহেতু কামাল হোসেন এখন বিএনপি জোটের নেতা সেহেতু তারা এই বক্তব্যে বাধ্যগত নীরব সম্মান দেখাচ্ছে। ডক্টর কামাল হোসেন উদ্বোধনী সংবাদ ব্রিফিং এ পাঁচ বার বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়েছেন ৷ সিলেট এবং চট্টগ্রামের সভায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনের কথা বলেছেন ৷

পত্রিকায় প্রকাশ জোটের আরেক নেতা সুলতান মনসুর আহমেদ বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি এনে তা নিয়ে বিতর্ক না করার অনুরোধ করেন সবাইকে। জিয়াউর রহমান ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই ঘোষণাপত্র পেশ করেন। তাও জনাব মনসুর উল্লেখ করেন। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সময়ে এমন বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে দুঃসাহসিক। অন্তত বিএনপির সহ সমাবেশে। বিএনপি এর প্রতিবাদ বা বিবাদ করেছে শুনিনি।

সম্প্রতি ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন অশালীন মন্তব্যের জেরে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে কামাল হোসেনকে ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিবৃতি দিতে বললে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এটা কামাল হোসেন এর রাজনৈতিক দর্শন। সব বিষয়ে রাজনৈতিক বিবৃতি দিতে হবে তা কেন? সব বিষয়কে রাজনীতির মোড়কে দেখানো ঠিক না।

কামাল হোসেনের নেতৃত্ব বাংলাদেশের অশ্রদ্ধা ও বিভাজনের রাজনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। আওয়ামী বিরোধী সমাবেশ হলেও এখনো পর্যন্ত প্রতিটি বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুই তার আদর্শ। আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে সরকার পতনের ডাক যেমন দেয়া হচ্ছে তেমনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রতি সমাবেশে। সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা হলেও, বিএনপি এতে আপত্তি করেনি ৷

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Nov/01/1541083391745.jpg -মনোয়ার রুবেল, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর