নৈতিকতা যখন জাদুঘরে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোঃ সামসুল ইসলাম | 2023-08-27 22:38:05

সকাল ১০-১১টার দিকে আমি বাসা থেকে বের হলে প্রায়ই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখি। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা বেশ কিছু ছেলেমেয়ে জোড়ায় জোড়ায় হাত ধরাধরি করে স্কুল চলাকালে বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। কখনো বা তাদের দেখি হোটেলে বা ক্যাফেতে টেবিলের কোণায়। আগে দেখতাম সাইবার ক্যাফেতে।

প্রেমের দৃশ্য যে কোনো লেখককেই হয়ত আলোড়িত করবে- আমিও যে আলোড়িত হই না তা বলব না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাদের বয়স। স্কুলপড়ুয়া ১৩-১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের যখন আপনি এ অবস্থায় দেখবেন আপনার তা মেনে নিতে কষ্ট হবে। অভিভাবকদের ফাঁকি দিয়ে বা স্কুলের পড়াশোনা বাদ দিয়ে একেবারেই অপ্রাপ্ত বয়স্কদের এই প্রেম আমাদের এতদিনের সঞ্চিত সামাজিক নীতি নৈতিকতার একেবারে বাইরের একটি ব্যাপার।

কিশোর-কিশোরীদের বা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নৈতিকতার এই অধঃপতন সবার মতো আমাকেও মর্মাহত করে। বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর সব দেশেই হয়ত এই অবক্ষয় কমবেশি দেখা যায়, কিন্তু আমদের দেশের কিছু পরিসংখ্যানে বিস্মিত হতে হয় বৈকি! যেমন বছর দুয়েক আগেকার এক গবেষণা অনুযায়ী ঢাকার স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের ৭৭% পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত। এ বছর মার্চের পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ ইয়াবায় আসক্ত আর ইয়াবা আসক্তদের বেশিরভাগই নাকি ছাত্রছাত্রী!

তবে শুধু ইয়াবা যে একমাত্র মাদক তা নয়। ইয়াবা ছাড়াও রয়েছে ফেনসিডিল, গাঁজা ইত্যাদি আরো অনেক মাদকদ্রব্য যা ছাত্রছাত্রীরা ব্যবহার করছে। আর বাংলাদেশে ধূমপানের কথা তো না বললেই চলে! পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ধূমপান কমলেও আমাদের দেশে তা নাকি বাড়ছে। সেই ২০০৭ সালের এক পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরদের কমপক্ষে দুই শতাংশ ধূমপান করে। সুতরাং এটি অবাক করা কিছু নয় যখন সাম্প্রতিক এক বিবিসির রিপোর্ট আরো জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ৪২ শতাংশই ধূমপায়ী এবং বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম সিগারেটের বাজার।

প্রশ্ন হলো উপরের এই চিত্র আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে? আমি বলবো ভয়াবহভাবে। অবাধ যৌনতা, পর্ণোগ্রাফি বা মাদকাসক্তির কালো থাবা আমাদের কিশোর-কিশোরি বা তরুণ-তরুণীদের গ্রাস করছে এবং এর ফলে অনেক পরিবারে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়। অল্প বয়স্কদের মধ্যেও খুন, ধর্ষণ, মারামারি, গ্যাংস্টার কালচার, জঙ্গিবাদ এমনকি নিজ পরিবারের সদস্যদের হত্যার মতো ঘটনাও আমরা দেখছি। পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, ডিভোর্সের হার এখন ভয়াবহ। সম্প্রতি পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় একটি ডিভোর্স হচ্ছে। আর সেপারেশনের ঘটনাতো প্রচুর, যার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

তবে নৈতিকতার অবক্ষয় যে শুধু আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে ঘটছে তা নয়। যেমন, অনলাইনে পর্ণোগ্রাফির কথাই যদি বলি, তাহলে তো এটাও বলতে হয় যে পৃথিবীজুড়েই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশই পর্ণোগ্রাফির দর্শক। বিশ্বায়ন আর যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির যুগে আমরা একটি রাষ্ট্রকে তো আলাদা করে রাখতে পারি না। ভার্চুয়াল জগতের সীমানাবিহীন পৃথিবীতে আপনি আপনার সন্তানকে বিদেশি মূল্যবোধ থেকে কীভাবে রক্ষা করবেন?

তবে শুধু বিদেশি মূল্যবোধ বললে ভুল বলা হবে। মাদকাসক্তি বা সহিংসতার প্রকোপের কারণে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নৈতিকতার অবক্ষয় এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রাচ্যের যেসব মূল্যবোধ নিয়ে আমরা এতদিন গর্ব করেছি সেসব খুব দ্রুতই আমাদের সমাজ থেকে অপসৃয়মান হচ্ছে।

এসব সমস্যা যে আমাদের দেশে কম আলোচিত তা নয়। কিন্ত যেটি আলোচনা হয় না তাহলো প্রতিকারের উপায় বা এই সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোনো কর্মপন্থা। পরিবার, বিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রাণপণ প্রচেষ্টা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে ছেলে বা মেয়েটি অপ্রাপ্তবয়সেই প্রেমে জড়িয়ে পড়ছে বা মাদকাসক্ত হচ্ছে তার কাছে পারিবারিক মূল্যবোধ একসময় অর্থহীন হয়ে যাবে। এসবের শারিরীক ও মানসিক ধকল সে কাটিয়ে উঠতে না পেরে একসময় সে পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

একই প্রসঙ্গে আমি আগেও কয়েক জায়গায় আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। শুধু যে শিক্ষাঙ্গনে তা নয়, এমনকি পরিবারে বা সামাজিকভাবে আমরা শিশু-কিশোরদের যেভাবে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা করতে বলি তা যে অকার্যকর তা দুর্নীতিসহ আমাদের দেশের বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় থেকেই বোঝা যায়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘তোমাকে ভালো হতে হবে, সৎ হতে হবে’ ইত্যাদি গুণ আমরা যেটা শিক্ষার্থীদের চর্চা করতে বলি সেগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করা প্রয়োজন। মাদকদ্রব্য খারাপ কিন্তু কেন খারাপ এটা শিক্ষার্থীরাই আলোচনা করে বের করবে, শিক্ষক তার পরামর্শ চাপিয়ে দিলে তা কার্যকর হবে না- পশ্চিমা শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এরকমই বলছেন।

পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষায় মিডিয়ার তো একটা ভূমিকা আছেই। টিভি নাটক, বিজ্ঞাপনে এখন স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা কেন্দ্রিক। এখানে পরিবারের অন্য সদস্য যেমন বয়স্কদের কোনো স্থান নেই। পশ্চিমাদের মতোই হয়ে যাচ্ছি আমরা। এক পরিসংখ্যানে দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রে টিভি বিজ্ঞাপনে সদ্য তরুণীদের দাপট- নারীদের বয়স যত বাড়ে, টিভির বিজ্ঞাপনে তাদের স্থান ততই কমে। কয়েকদিন আগেই আমাদের দেশের বয়স্ক অভিনেতারা দেখলাম একই রকম অনুযোগ করছেন। আমাদের টিভি নাটকে নাকি বয়স্কদের রোল কমে যাচ্ছে- তারা আর কাজ পাচ্ছেন না।

আর এ ধরণের নাটক বা বিজ্ঞাপন যখন শিশু-কিশোররা বারবার দেখবে তারা বুঝবে পরিবারে তো বয়স্কদের কোনো জায়গা নেই। সুতরাং তারা কেন পরিবারের প্রতি আর একাত্ম হবে?

আসলে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদের আরও চিন্তাভাবনা, গবেষণা করা উচিত এবং জাতির সামনে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মপন্থা উপস্থাপন করা উচিৎ।

এক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ মনে করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রে পরিবার ও পারিবারিক মূল্যবোধ ভেঙে পড়ার মুহূর্তে তারা কিন্তু এর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পেরেছে তারা তখন পারিবারিক সম্পর্ককে উজ্জীবিত করতে বিভিন্ন টিভি কমেডি শো বা সিনেমা তৈরির মাধ্যমে পরিবারকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেই পুরোনো মূল্যবোধ আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

তবে আমাদের কিন্তু এখনো সময় আছে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলো এখনো অটুট রাখতে পারি।

মোঃ সামসুল ইসলাম: কলামিস্ট ও সিইও, বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিসিআরসি)

এ সম্পর্কিত আরও খবর