জৈব জ্বালানি খাদ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-09-01 08:37:01

 

জৈব জ্বালানি সম্পর্কে সর্বসাধারণের ধারণা তেমন একটা নেই। আমরা জানি, জৈব জ্বালানি বা বায়োফুয়েল হচ্ছে এক ধরনের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকটি চিন্তা করে জৈব জ্বালানি সম্প্রসারণের সুপারিশ করেছেন পরিবেশবিদরা।

জৈব জ্বালানি ইথানল ও ডিজেলের সমন্বয়ে তৈরি নতুন ধরনের জ্বালানি। যার উপাদান হচ্ছে চাল, ডাল, গম, ভূট্টা ও তেলবীজ জাতীয় খাদ্যশস্য। এ সব খাদ্যশস্যকে বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে জৈব জ্বালানি প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর ভালো-মন্দ দিক দুটিই বিদ্যমান। তবে সার্বিক বিবেচনায় পরিলক্ষিত হচ্ছে জৈব জ্বালানির ব্যবহার ভালোর চেয়ে মন্দ দিকটাই বেশি বয়ে আনছে। এটি বর্তমানে শুধু উন্নত বিশ্বেই ব্যবহৃত হচ্ছে। অপরদিকে তাদেরকে অনুসরণ করছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। তারা তাদের দেশের ব্যাপক উৎপাদিত পামবীজ দিয়ে জৈব জ্বালানি প্রস্তুত করছে।

এ ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের অন্য কোনো দেশ দারিদ্র্রের অজুহাতে এ পর্যন্ত জৈব জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ পায়নি। তার প্রধান কারণই হচ্ছে এ জ্বালানি প্রস্তুত করা সহজ সাধ্য নয়, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। ফলে জৈব জ্বালানি পরিচিতি পেয়েছে ‘উন্নত বিশ্বের জ্বালানি’ নামে। দেখা যাচ্ছে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিল্পোন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশের মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে যানবাহনের ট্যাঙ্কে তুলে দিতে। যা চরম মানবতাবিরোধী কাজের একটি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে অনায়াসে। আগেই জানানো হয়েছে যে, এ জ্বালানি প্রস্তুত করতে প্রয়োজন অধিক খাদ্যশস্যের। যার ব্যবহার হচ্ছে ডিজেল ও গ্যাসোলিনের পরিবর্তে। এতে করে কোনো ধরনের বায়ূদূষণ ঘটছে না সত্য এবং এও সত্য যে জৈব জ্বালানি আবিস্কার মানবজাতির জন্য সুখবর বটে। কিন্তু সে সুখবরটির আড়ালে রয়েছে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক। যার শিকার বিশ্বের নিম্ন আয়ের ৮২টি দেশ।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, শিল্পোন্নত দেশের এ অমানবিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বে চরমভাবে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার কারণে দাম বেড়ে গেছে যাবতীয় খাদ্য সামগ্রীরও। তৎসঙ্গে বেড়ে গেছে ভোজ্যতেলের দামও। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এ থেকে রেহাই পায়নি সয়াবিন, সরিষা, তিল, তিশি ও পামবীজসহ নানা ধরনের তেলবীজ।

অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে ২৫ গ্যালন জৈব জ্বালানি উৎপাদনে যে পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আফ্রিকার একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের এক বছরের আহার। তার চেয়েও বেশি অবাক করা তথ্যটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে প্রায় ১০ কোটি টন খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাত করে জৈব জ্বালানি উৎপাদন করছে। এতে যে পরিমাণ খাদ্য সামগ্রীর ব্যবহার হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের মতো ৪টি দেশের মানুষের ৩ বছরের খাদ্য বিনষ্ট হচ্ছে। অবিশ্বাস্য এ বিষয়টি ভাবতে কেমন লাগছে, একবার চিন্তা করে দেখুন।

অর্থনীতিবিদদের অভিমত ২০১৮ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র একাই জৈব জ্বালানি উৎপাদন ১২ গুণ বাড়িয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। উল্লেখ্য ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নও গম দিয়ে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। অপরদিকে ব্রিটেন জৈব জ্বালানি প্রস্তুতের জন্য ইতোমধ্যে ১১৩ বিলিয়ন টন ভূট্টার ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। তার আগে থেকেই অবশ্য ব্রিটেন জৈব জ্বালানি তৈরি করতে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড ভুর্তকি দিয়ে আসছে।

উল্লেখ্য, জৈব জ্বালানি প্রস্তুতের কারণে অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য প্রচুর বনভূমি ও জলাশয় উজাড়ের প্রয়োজন দেখা দিবে। ইতিমধ্যে উন্নত দেশগুলো কাজটি করছেও। যার ফলে খনিজ তেল ব্যবহারের দুষণের চেয়েও মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র বিশ্বের পরিবেশ। বিষয়টি নিয়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় একটি প্রতিবেদনও পেশ করেছে ‘দি সায়েন্স’ পত্রিকা।

সামান্য উদহারণ টানলে বিষয়টা আমাদের কাছে আরো পরিস্কার হয়ে যাবে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাকশন এইড’-এর জারিপ মতে ইউরোপের ওই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অন্তত ৬৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার জমিকে শস্য ক্ষেতে রূপান্তরিত করতে হবে। যা কিনা বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ড এর আয়তনের চেয়ে বেশি।

সূত্রমতে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বে উৎপাদিত ৪০ বিলিয়ন লিটার ইথানলের শতকরা ৯০ ভাগই প্রস্তুত করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল। বাদবাকি উৎপাদন করছে বিট্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে ভূট্টা উৎপাদন হয়েছে ৫১ মিলিয়ন টন। অথচ ওই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ইথানল তৈরিতে ব্যবহার করেছে ৫০ মিলিয়ন টন ভূট্টা।

এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮ কোটি শিশুর আগমন ঘটছে। সে সুত্রে বলা যায়, ৮ কোটি মানুষ পর্যায়ক্রমে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে খাদ্যশস্যের ওপর ভাগও বসাচ্ছেন। হিসাব মতে জৈব জ্বালানি উৎপাদন এবং নতুন মুখের আবির্ভাবের ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বিশ্বে বছরে প্রায় ১০ কোটি টনে গিয়ে ঠেকবে। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সন্মুক্ষীন হবে নিশ্চিত। আমরা জানি, যুক্তরাষ্টের অধিক জ্বালানির চাহিদার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে।

সেই নির্ভরশীলতা কমাতে এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণের বিষয়টি মাথায় এনে তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে বেছে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট ইতিমধ্যে জৈব জ্বালানি প্রস্তুতের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উৎপাদনের পুরোটাই তারা জৈব জ্বালানি বা বায়োফুয়েল তৈরিতে ব্যবহার করবে। এই প্রেক্ষিতে বলতে হয় পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই কিন্তু তার আগে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বিশ্বের অনাহারী মানুষের পেটের আহার যোগানো। যে মানুষের কল্যাণে জৈব জ্বালনির সম্প্রসারণ; পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় মনোযোগী হওয়া, সে মানুষই যদি না খেয়ে দিন যাপন করেন, তাহলে ওই আবিষ্কার মানবকল্যাণে আসলই বা কি!

আমরা আশাবাদী সেই দিকটি বিশ্বের কর্তা ব্যক্তিগণ ভেবে দেখবেন আগে। না খেয়ে থাকা মানুষের যন্ত্রণা অনূভব করবেন। এসব ঠিকঠাক থাকলে অথবা এর সঠিক সমাধান হলে এ আবিস্কার সার্থক হবে বলে মনে করছি আমরা। 

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর