বহু প্রতিক্ষা শেষে তারেকের দণ্ড

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আনিস আলমগীর | 2023-08-31 06:13:28

 

২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা যে রাষ্ট্রীয় মদতে সন্ত্রাস তা প্রমাণিত হলো ১০ অক্টোবরের রায়ে। সুর্দীঘ ১৪ বছর সময় নিলো সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে। মিডিয়া আর ন্যায় বিচার না থাকলে হয়তো জজ মিয়া নামের একটি নিরীহ লোককে পুরোপুরি ফাঁসিয়ে দেওয়া যেত। কিংবা ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত’ নামে নাটক দিয়ে ঘটনা অন্যখাতে প্রবাহিত করাও সম্ভব ছিল। যাক, ধীরে ধীরে সব বিচারের বাধা দূর হয়েছে, সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জেল হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর জাতি সর্বশেষ প্রত্যক্ষ করলো নির্মম গ্রেনেড হত্যার বিচারও। 

২১ আগস্ট মামলার রায়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করতেই যে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তাও উঠে এসেছে। রায়ে বলা হয়, ‘শুধু আক্রমণই নয়, দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।’

বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন রায়ে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই থাকবেন, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়।’

অবশ্য প্রতিপক্ষকে হত্যার মধ্যদিয়ে বিদায় করার যে নির্মম সংস্কৃতি সেটা রাজনীতিতে এনেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। গত শতাব্দীর আট দশকে দেশের রাজনীতিতে বিএনপিকে আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক একক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জিয়াউর রহমান খন্দকার মোশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগের জনসভায় গ্রেনেড মেরে বানচাল করে দিয়েছিলেন। বায়তুল মোকাররমের সামনের ময়দানে মোশতাকের ১৪ জন নেতা কর্মী ঘটনাস্থলে প্রাণ হারিয়েছিলো। গ্রেনেডটা নিক্ষেপ করেছিলো জনসভার মঞ্চকে লক্ষ্য করে। মঞ্চের সিড়ির উপর দাঁড়ানো মোশতাকের কর্মী দুলালের গায়ে লেগে গ্রেনেডটা নিচে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছিলো এবং ১৪ জন কর্মী ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলো। সিঁড়িতে দুলাল দাঁড়ানো না থাকলে গ্রেনেড মঞ্চে বিস্ফোরিত হত এবং মঞ্চে উপবিষ্ট নেতা খন্দকার মোশতাক, অলি আহাদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, পীর দুদু মিঞাসহ বহুনেতা মঞ্চের উপরই মারা যেতেন।

‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’- এ ছিলো জিয়াউর রহমানের প্রতিপক্ষকে খতম করার চানক্য পদ্ধতি। অবয়বে তার পূত্র তারেক রহমান তারই মত। রাজনীতিতে আসার পর দেখলাম রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে মাঠে মোকাবেলা না করে দুনিয়া থেকে একেবারে বিদায় করে দেবার পদ্ধতিটাও তার বাবার অনুরূপ।

২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট তিনিও আওয়ামী লীগের জনসভায় ১৩টি আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করালেন। যে গ্রেনেডে আইভি রহমানের মৃত্যু হয়েছিলো সে গ্রেনেডটা মঞ্চ লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেছিলো। এটি যদি মঞ্চের নিচে না পড়ে মঞ্চের উপর পড়তো তবে সেদিনই শেখ হাসিনার মৃত্যু হতো।

মঞ্চে আব্দুল জলিল, সুরনজিৎ সেনগুপ্ত, জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, মেয়র হানিফ, মায়া চৌধুরী প্রমুখেরা উপস্থিত ছিলেন- তাদের মৃত্যুও অবধারিত ছিলো। এ ছিলো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করে মাতা-পুত্রের রাজবংশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। অভাগারা অতীত থেকে কিছুই শেখার চেষ্টা করে না। পিতার মৃত্যু থেকে তারেক রহমান কোনও শিক্ষাই নেয়নি।

অনেকদিন আগে আনন্দী সারাভাই সার্কাসে বাঘের ছোট বাচ্চাকে কান ধরে টেনে এনে ছাগলের সঙ্গে একপাত্রে পানি খাওয়া দেখাতেন। একদিন আনন্দীকে ওই বাঘটাই মেরে ফেলেছিলো। খেলা সব সময় ভাল নয়। ক্ষমতার খেলা পিতা-পুত্র উভয়কে কলংকিত করলো।

বিচারের পুর্ণাঙ্গ রায়টা এখনও পাইনি। যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, পিন্টুর ভাই হরকাতুল জিহাদ নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৯ জনকে মৃতু্দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ সহ ১৯ জনকে।

সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, মামলার প্রথম দিকের তদন্ত কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদকে দেওয়া হয়েছে তিন বছরের জেল। সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা ও আইজিপি শহিদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এটিএম আমিন আহমদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদারকে দেওয়া হয়েছে ২ বছরের জেল।

২০০৪ সালের এই ঘটনাকালে খালেদা জিয়া ছিলেন ক্ষমতায়। এ দুর্ঘটনায় সরকারও জড়িত। আদালত তাই বলেছে। এখনও গণভোট হলে লোকে তারেক জিয়াকেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করবে। আমি অনেক বিএনপির লোককেও সে কথা বলতে শুনেছি। জজ মিয়াকে প্রধান আসামী করে চার্জশীট প্রদানে সরকার যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল এবং সত্যকে গোপন করতে চেয়েছিল তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিচারক বয়সের কথা চিন্তা করে লঘু শাস্তি দিলেন কি না কি জানি!

সেভেন মার্ডার মামলার আসামী ছিলো শফিউল আলম প্রধান। সে হত্যা মামলার রায় যখন হয় তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। রায়ে বিচারক বলেছিলেন বয়সের কথা বিবেচনা করে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলাম। কয়দিন পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

বিএনপির বর্তমান নেতারা যথারীতি রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশ্য আগের দিনও বলেছিলেন ফরমায়েশী রায় হবে। তারা রায় নিয়ে তেমন কোনও আন্দোলনে আপাতত যাবে না বলেও বলেছিলেন। এখন কথা হবে ড. কামাল হোসেন এবং ডা. বি. চৌধুরীর বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে।

বিএনপি প্রধান তারেক রহমান এতোদিন ছিলেন মানি লন্ডারিং মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। আগের দুটি মামলায় তার যথাক্রমে ৭ ও ১০ বছর কারাদণ্ড হলেও তা ছাপিয়ে এবার তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। যে দলের প্রধানের এত গুণ তার সঙ্গে তারা যদি কোনও ফ্রন্ট গঠন করবেন তবে তারা যে ক্লিন রাজনীতির কথা বলেন, যে আদর্শবাদের কথা বলেন, তার সঙ্গে তো এ দলটার কোনও মিল নেই। তারা যদি সব কিছু জেনে বুঝে বিএনপির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন তবে তাদের নীতি আদর্শ আর ক্লিন রাজনীতির কথা তো নিছক বায়বীয়। নৈতিকতার গণ্ডি পার হতে পারলো না। এটা কি তাদের ধারণায় আছে!

৭০ বছরব্যাপীই তো আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রাম দেখলাম, বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্বের কথা শুনলাম, দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসনের কথা শুনলাম- কিন্তু কোনও সফলতাতো দেখলাম না। ৭০ বছরই তো একই অবস্থা বিরাজমান। কামাল- বি চৌধুরী এখন এমন একটা শক্তির পৃষ্ঠপোষকতার কথা চিন্তা করছেন যারা অতীতে ভাল কাজ করেছেন এমন কোনও রেকর্ড নেই। ফলে তাদের কর্মকাণ্ড সংকট দূর করবে না, সংকট আরও বাড়িয়ে দেবে। হয়তো নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করবে। ফলে জাতির অমঙ্গল করার চেয়ে তাদের বসে থাকাই ভাল।

 

আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর