শরণার্থী সাংবাদিক ও দেশের ভাবমূর্তি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

টুটুল রহমান, এডিটর, বিজনেস অ্যান্ড ফাইন্যান্স, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 08:47:09

২০১০ কি ১১ সালে আমাদের এক সাংবাদিক কলিগ জলবায়ু সম্মেলন কাভার করতে গেলেন তো গেলেন আর ফিরলেন না। না তিনি কোনো স্থায়ী ভিসায় যাননি। সম্মেলন কাভার করার পর তিনি ফরাসি দেশে লুকিয়ে-ছাপিয়ে ছিলেন। তারপর ওই দেশের দূতাবাসে নিজের পাসপোর্ট আর মান ইজ্জত জমা দিয়ে শরণার্থী হয়ে গেলেন এবং বললেন, বাংলাদেশ খুব খারাপ জায়গা ওখানে সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। অতএব আমাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হোক।

২০১৪ সালে আরও এক কলিগ জার্মান রেডিও ডয়েচে ভেলের তিন মাসের একটা ফেলোশিপ পেলেন। যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবে ফিরছেন? তিনি শুধু মুচকি হাসলেন। তার অর্থ আমি আর ফিরছি না। সত্যিই আর ফিরলেন না। অফিসের হাজিরা খাতায় দীর্ঘদিন তার নামটা ছিল কিন্তু স্বাক্ষর করতে তিনি আর ফেরেননি। এখন বউ বাচ্চা নিয়ে জার্মান প্রবাসী ওই সাংবাদিকের ফেসবুকে নানা রং-ঢংয়ের ছবি দেখি।

এসব ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, জাতিসংঘ কাভার করতে গিয়ে গত বছর ফেরেননি আরেক সাংবাদিক। এক টেলিভিশনের সাংবাদিকের খোঁজ করেছিলাম কয়েকদিন আগে তার অফিসে। অফিস সহকারী গর্বভরে বলেছিল, ‘স্যার তো আমেরিকায় গেছে গা।

তো ভাগ্য গড়তে আমেরিকা-ইউরোপ যাবেন এটা তো দোষের কিছু না। আপনারা রেমিটেন্স পাঠাবেন তা দিয়ে তরতর করে বেড়ে উঠবে আমাদের অর্থনীতি। বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো আমরা। এটা আমাদের জন্য গর্বের বৈকি।

কিন্তু শুরুতেই তো আপনারা দেশের মাথা নিচু করে দিচ্ছেন। যারা এমন শরণার্থী সাংবাদিক হয়ে বিদেশে আশ্রয় ভিক্ষা করছেন, তাদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে মনটা খারাপ হয়ে যায় আরো বেশি।

কিছু দিন আগে জার্মান প্রবাসী ওই কলিগ একটি ভিডিও দিয়ে তাতে ক্যাপশন দিলেন, এই হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা। পচে নষ্ট হয় গেছে। শুধু তাই নয়, তিনি প্রায়ই সরকারের কঠোর সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেন। তার বিষয় হচ্ছে- মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ, ক্রস ফায়ার, বাক স্বাধীনতা, কোটা এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিয়েও তিনি অবাধে মন্তব্য করেন- যা আমাদের বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে যায় না। তিনি মন্ত্রীদের নিয়ে ফেসবুকে রং তামাশা করেন প্রায়শই। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও তিনি ছাড়েন না।

আমি বুঝতে পারি তিনি এসব কেন করেন। জার্মানিতে তার থাকার ব্যবস্থাটা যাতে পাকাপোক্ত হয় সে কারণে তিনি এসব করেন। তিনি সাংবাদিক হিসেবে নির্যাতিত, তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশে নেই- এটা বোঝাতে তিনি এসব করেন।

আমি ফেসবুকে মন্তব্য করেছিলাম, ভাই! সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে বসে বিপ্লবী সেজে লাভ কি? দেশে এসে এসব কথা বলেন না কেন? তিনি আমাকে ‘ব্লক’ করে দিলেন। তার আগে একটি ‘স্কিনশট’ দিলেন যেখানে আমি বলেছিলাম, এদেশে আর থাকা যাবে না। কেন বলেছিলাম তার ব্যাখা তিনি দেননি। দিলে মানুষ জানতে পারতো ২০১৪ সালে জামায়াত-বিএনপির যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল তাতে জান বাঁচাতে আমার মতো অনেকের এই কথা ভাবা স্বাভাবিক ছিল।

টিভি টকশোতে এক সাংবাদিককে সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে দেখেছি। যুক্তি ছাড়াই তিনি নানা কথা বলে সরকারকে চটানোর চেষ্টা করতেন। অনেকদিন পর জানতে পারলাম ওই সাংবাদিক এখন শরণার্থী হয়ে আমেরিকায় বাস করছেন।

আরও এক প্রবাসী সাংবাদিকে দেখছি ক’দিন হলো- সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়ে বেশ মাতামাতি করছেন। তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ‘সিনহা বাবু’র সাক্ষাতকার প্রচার করছেন। ইউটিউব থেকে পয়সা কমানোর ধান্দায় একজন বিতর্কিত ব্যক্তির ‘ মিডিয়া কর্মকর্তা’ এখন ওই শরণার্থী সাংবাদিক।

এরকম প্রায় শ’খানেক সাংবাদিকের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যারা বাংলাদেশ ছেড়েছেন ছলে-বলে কৌশলে। দেশে শ্রম দিতে ‘শরমিন্দায়’পড়বেন- এই ভাবনা থেকে তারা মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করতেই পারেন। মানুষ হিসেবে এটা তাদের অধিকার। আমেরিকার তেলের পাম্পে কাজ করে, ফরাসি দেশে সুপারসপে কাজ করে, কানাডার হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেই পারেন। এটা নিয়ে তো বলার কিছুই নেই। কিন্তু আমরা প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশে ঢুকেই পাসপোর্টটা জমা দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে একগাদা ‘সত্য-মিথ্যা’অভিযোগ তুলে আপনি যে আশ্রয় চাইলেন, সেটাতে দেশের ভাবমূর্তি কি দাঁড়াচ্ছে একবার ভেবেছেন কখনো? সাংবাদিক হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশন কাভার অথবা জলবায়ু সম্মেলন কাভার অথবা ফেলোশিপ নিয়ে আর যে এলেন না এতে নিজের আত্মসম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো ভেবেছেন কি? তারপর তো শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিষোদগার করেন সেফাত উল্লাহর মতো। আপনি ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবেন হয়তো, আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশি বংশদ্ভুত ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিক হওয়ার পথটা বাগালেন ঠিকই কিন্তু দেশের ভাবমূর্তির তো রাখলেন না। এই নৈতিকতা নিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় না এসে আদম ব্যবসা করলে ভালো করতেন।

সর্বশেষ বার্তা২৪.কম এ রিপোর্ট হয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানীকারকদের সংগঠন বিজিএমইর ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে চট্টগ্রামের এক সাংবাদিক আর ফেরেননি। তিনি এখন ওই দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ফেসবুকে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে তো মনে হয় না দেশে তার সাংবাদিকতায় কোনো বাঁধা ছিল। তাকে প্রাণে মেরে ফেলার কোনো হুমকি আছে। তবুও তিনি মিথ্যে গল্প সাজিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।

শুধু তাই নয়, যে ক’জন সাংবাদিক দেশে ছেড়েছেন তারা এমন কোনো রিপোর্টার বা সাংবাদিক ছিলেন না যে, সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

নিজের একটা গল্প বলি, চোখের চিকিৎসার জন্য ভারত যাবো বলে ঠিক করলাম। ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। ওই ভদ্রলোক বললেন, আপনি তো সাংবাদিক ইউরোপ আমেরিকার কোনো দেশে থেকে একটা ইনভাইটেশন জোগাড় করেন ভিসা করে পাঠিয়ে দেই। গিয়ে আর আসবেন না। তারপর পুলিশের হাতে ধরা দেবেন, রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবেন। আমি বললাম, পুলিশে ধরে তো সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেবে? তিনি বল্লেন, আরে ভাই! ওখানকার জেলখানা কি জেলখানা? আমার পরিচিত একজন আছেন। তার অবস্থা রাজকীয়। হাত খরচের জন্য ডলারও পাবেন। তারপর আইনি প্রক্রিয়া শেষে ওই দেশের নাগরিক হয়ে যাবেন।
প্রস্তাব নিয়ে ভাবলাম। এই দেশের জল-হাওয়া, কাঁদামাটির গন্ধ, রাজধানীর অবাধ বিচরণ ছেড়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিতে হবে? চোরের মতো পালিয়ে থাকতে হবে? দেশে দুর্নাম করে আশ্রয় নিতে হবে? এটা কি করে সম্ভব? দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সামান্য মায়া থাকলে এটা করা সম্ভব নয়।

আমেরিকায় আছেন এমন এক শরণার্থী সাংবাদিকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে এমন এক বন্ধু সাংবাদিক জানালেন, বরফ পরুক আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক না কেন সে যে কাজটা আমেরিকায় করে প্রতিদিন সেটা করতেই হবে। তবে হাতে যখন কাজ শেষে ১৫০ বা ২০০ ডলার পায় তখন আর খুশির সীমা থাকে না। খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন, এত টাকা? শুধু ডলার পাওয়ার আশায় তিনি দেশের আর নিজের মান-ইজ্জত বিসর্জন দিলেন?

পরিশেষে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার অনুরোধ হচ্ছে, এসব ছদ্মবেশী, ভণ্ড শরণার্থী সাংবাদিকদের ফিরিয়ে আনা হোক। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য শাস্তি দেওয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরণের কাজ করতে সাহস না পায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর