ক্রান্তিকালের দিনগুলো

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 12:26:18

ক্রান্তিকাল সম্ভবত এমনই। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ট্রান্সিশনাল পিরিয়ড। ক্রান্তিকালের সময়টুকুতে অতীত ধরে ধীরে হারাতে থাকে আর আসতে থাকে নতুন দিন। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে সকল দেশ ও সমাজকে ক্রান্তিকালের সময়টুকু পেরুতেই হয়। কারণ রাতারাতি বা চট করে প্রাচীন ও পুরাতনকে বদলে নতুন ও উন্নততর অবস্থানে চলে আসা মোটেও সম্ভব নয়। ক্রান্তিকাল পেরিয়েই নতুন অবস্থানে উত্তীর্ণ হতে হয়।

বাংলাদেশে এখন উন্নয়ন আর গতির কাছে হারাচ্ছে অতীতের কাঠামো ও স্মৃতি। ক্রান্তিকালের মাঝ দিয়ে চলছি আমরা। অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রায় চারদিকে সাজ সাজ রব। বসছে উড়াল সেতু, মেট্রোরেল, পদ্মা ব্রিজ। উন্নয়নের তীব্রতায় প্রাচীন ও অতীত অল্প অল্প করে জাগছে একবিংশের নতুন নগর, নতুন যোগাযোগ পরিকাঠানো, স্থাপনা ও অবকাঠামো।

শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয়, দেশের প্রায়-সকল শহরেই বহুতলা ভবন, লিফট, প্রশস্ত সরণি, বিপণি বিতানের সারি। হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য। জীবন-যাত্রার মান আর সামাজিক গতিশীলতায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। জীবনের অনেকটুকুই হয়ে গেছে ডিজিটাল। দেশের জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ তরুণ-যুবকরা সমাজ জীবনের সামনের কাতারে এসে যাচ্ছে। প্রতিদিনই চোখে পড়ছে সমাজ ও নগরের নানা পরিবর্তন। দিনে দিনে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পোঁছে যাওয়া কিংবা নিমিষের মধ্যে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে টাকা পাঠিয়ে দেওয়ারি মতো অকল্পনীয় বিষয়ও এখন সম্ভব হচ্ছে।

বেশি দিন আগে নয়, আশি-নব্বই দশকে যারা ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে বিদেশে গেছেন, ফিরে এলে এ শহরকে আর চিনতে পারবেন না। ফিরে পারেন না পুরনো কাঠামো ও নগর বিন্যাস। সিটি লাইফের পাশাপাশি নগরের ল্যান্ডস্কেপও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মানুষের চাপ, প্রযুক্তি ও পরিস্থিতির দাবি মেনে বদলে যাচ্ছে সব কিছু। মাঝে মাঝে চোখের পলকে মনে হচ্ছে বদলাচ্ছে জীবনের বিন্যাস এবং নগরের সীমা-পরিসীমা। একদার ছোট্ট ও নিজস্ব শহর ঢাকা বা চট্টগ্রাম, যার পুরোটা রিকশায় চড়েই চক্কর দেওয়া যেতো, সে ঢাকা বা চট্টগ্রাম আর নেই। মেগাপলিশ আয়তনের শহরগুলো আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে কসমোপলিটন কালচারে।

চট্টগ্রামের কথাই ধরা যাক। প্রায়-মফঃস্বল এবং গা-ছমছমে পাহাড়ি-অরণ্যময় শহরটির পুরো চেহারাই নবরূপ পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাণিজ্যিক রাজধানীর সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিপুলায়তন ভৌত অবকাঠামোর বিন্যাস। লাইফ স্টাইল আর বৈশিষ্ঠ্যে পাওয়া যাচ্ছে বহুজাতিক ছোঁয়া। বঙ্গোপসাগরের বাতাসের পাশাপাশি বইছে বিশ্বায়নের মাতাল হাওয়া। যদিও পুরো পরিবর্তনটি এখনো দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি তথাপি পরিবর্তনের রূপ ও চরিত্র ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে।

সময় ও পরিবর্তনের তোড়ে এই পালাবদলের মধ্যবর্তী ক্রান্তিকালীন সময়টুকু কিছু যন্ত্রণা ও অসুবিধার সৃষ্টি করেছে বটে। স্মৃতির শহরের ভীষণ সুন্দর প্রতিচ্ছবিও হারাচ্ছে। অতীতের উজ্জ্বল দিনগুলোর স্মৃতিচিত্রও ক্রমেই ঝাপসা আর মলিন হয়। বরং যা আসছে, তা হলো বৈশ্বিক নগরগুলোর পাশাপাশি দাঁড়ানোর চেষ্টা। সামনে এসে হাজির হচ্ছে নতুন আরেক জীবনের স্পর্শ। বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবেগে ধেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতা পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রাধ্বনি। স্তব্ধ বিস্ময় নিয়ে আমরা দেখি অযুত পালাবদল।

কিছু কষ্টও সহ্য করি। সব কিছুই সহনীয় হবে, যদি উন্নয়ন পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে নাগরিক জীবন মানকে উন্নততর অবস্থানে নেওয়া সম্ভব হয়। মানুষ সেই সুদিনের দিকে তাকিয়ে আছে। উন্নয়নের রথযাত্রাকে সচল দেখতে প্রত্যাশা করে আছে। অপেক্ষা করছে উন্নয়নের দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের।

সমাজ ও জীবন গতিশীল বলেই মানুষ নতুন কিছু চায়। নতুন ও উন্নত পদ্ধতিকে আমন্ত্রণ জানায়। অতীতের নস্টালজিয়া অবশ্যই ভাবনা ও স্মৃতিচারণের জন্য ভালো; কিন্তু অগ্রসর জীবনের জন্য তাকে আঁকড়ে রাখার কোনো কারণ নেই। বাস্তব প্রয়োজনও আমাদেরকে বাধ্য করে অতীতের নিয়ম বা রীতি থেকে আধুনিক পন্থায় চলে আসতে। যেমন, প্রমত্তা নদীতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটার দিন আর নেই। শহরের মানুষকে এখন সাঁতার কাটার জন্য সুইমিং পুল খুঁজতে হয়। কোনো কোনো এপার্টমেন্ট ভবনের ভেতরেই রাখা হয়েছে শরীর-সহনীয় উত্তাপের জল-কল্লোলিত সুইমিং পুল, যেখানে আবাসের নারী-পুরুষ-শিশুরাও অনায়াসে ও নিরাপদে সাঁতরাতে পারছে। কুস্তির আখড়ার বদলে এসেছে এয়ারকন্ডিশনড জিম। হেলথ ক্লাব। এসেছে আড্ডার চিরায়ত আলাপচারিতার বদলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সমৃদ্ধ সাইবার ক্যাফে। চাইলেও সব কিছু আর আগের মতো পাওয়ার উপায় নেই? বরং এখন সামাজিক জীবন, বিনোদন, আচার ও অনুষ্ঠানেও লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। আসছে অভিনব নানা আয়োজন। এই বাস্তবতার বাইরে থাকাও আর মানুষের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের শৈশবে বিশ্বায়নের কথা আমরা শুনিনি। আমাদের জগত ছিল দেওয়ালে টা্ঙানো ক্যালেন্ডারের মতো স্থির ও সীমাবদ্ধ। কখনো পুরের সিলেট বা কুমিল্লা কিংবা চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত। তা-ও সারাদিনে একটি কি দু’টি ট্রেন। দিনভর জার্নির আয়োজন শেষে গভীর রাত্রে কিংবা পরদিন গন্তব্যে পৌঁছার সীমিত সুযোগ ছিল তখন। বিশ্বায়নের মতো যোগাযোগের বড় দিগন্ত তখনো আমাদের সামনে উন্মোচিত করেনি। এখন দেশের যে কোনো জায়গায় যখন খুশি যাওয়া যায়। ট্রেন, বাস অবারিত। আন্তঃজেলার সংযোগ ক্ষেত্রটিও দিন আর রাতব্যাপী সচল। পরিবর্তন ও উন্নয়নের গতি নিবিড়তায় টেনে নিয়েছে সারা দেশকে।

বিশ্বায়নের দূরত্বের যাতনা অবশ্য প্রযুক্তি কমিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছেদ ও যোগাযোগহীনতার প্রকোপ হ্রাস করেছে। ইন্টারনেট, মেসেঞ্জার, স্কাইপে, মোবাইলে প্রায়ই সবার সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি, কে কোথায় আছে, কি করছে। বছরে, দুই বছরে দেখা সাক্ষাতও হচ্ছে। সবাই একসঙ্গে না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে সংযোগ থাকছেই। যে যেখানেই থাকুক, যোগাযোগের বাইরে থাকছে না কেউই।

জানি, অনাগতকালে ছেলে-মেয়েরা এতোটা স্মৃতিকাতর হবে না। নস্টালজিয়া নামক শব্দটির অর্থই হয়ত তাদের কাছে অন্য রকম হবে। তারা হবে বিশ্বের নাগরিক। স্থানীয়ভাবে কোনো অঞ্চল বা দেশের সন্তান হয়েও তাদের প্রধান পরিচয় হবে বিশ্ব-নাগরিক। আজ ইউরোপ তো কাল অস্ট্রেলিয়ায় জীবন কাটাবে তারা। পড়বে আমেরিকায়, চাকরি করবে কানাডায়, শেষ জীবনের অবসর উপভোগ করবে ইতালির পাশে চমৎকার কাপ্রি দ্বীপে।

আরও পরে, কেউ কেউ হয়ত বিশ্বের পরিবর্তন ও গতির টানে পা বাড়াবে চাঁদে কিংবা মঙ্গলে কিংবা মহাশূন্যে খুঁজে পাওয়া কোনো মায়াবী নক্ষত্রে। ম্যাগিলানের স্নিগ্ধ ছাঁয়ায় কাটবে তাদের জীবন। সুপারনোভার অতুজ্জ্বল আলোকছটায় ভেসে যাবে তারা অনন্ত নক্ষত্রবীথির পথে-প্রান্তরে। প্রতিবেশি হিসাবে তারা পাবে জোছনা-সোহাগী একখণ্ড নিটোল চাঁদকে; তারাভরা পুরোটা আকাশকে টেনে নেবে নিজের আয়ত্ত্বে। মহাবিশ্বের রহস্যঘেরা বিবরে আলগোছে মিশে যাবে তারা। থেকে যাবে মহাজাগতিক অস্তিত্বে।

বিশ্বায়নের মাতাল সমীরণে ভেসে নিজের দিকে গভীরভাবে তাকালে অনেকেই আমরা নস্টালজিয়ার কাছে চলে যাই। তরুণ প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা দেখতে দেখতে আমরা খুঁজি ফেলে আসা পথচিহ্ন আর স্মৃতির সরণী। প্রিয় নদী, প্রিয় ফুল, প্রিয় মাঠ, উদাসী বাতাস, প্রিয়তম পাখিটির দেখা পেতে আমরা হারিয়ে যেতে থাকি অতীতের হীরন্ময় প্রকোষ্ঠে। স্মৃতি-সত্ত্বা-ভবিষ্যতকে সঙ্গী করেই মানুষ এভাবে এগিয়ে যায় জীবনের অনিবার্য পথে। গতি আর প্রগতির জন্যেই মনে হয় নতুনের আবাহনে সত্যিই সার্থক এই মানবজনম।

আমাদের ঐতিহাসিক নিয়তি এই যে, সামনে অপেক্ষমাণ অকল্পনীয় এক বৈশ্বিক জীবনের চমকময় কাঠোমোতে পৌঁছাতে আমরা পাড়ি দিচ্ছি একটি সঙ্কুল ক্রান্তিকাল। ক্রান্তিকালের মানুষ হয়ে আমরা যেন নিজেদের জীবনকালকে বিছিয়ে দিয়েছি অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝখানের সংযোগ সেতুর মতো। এটাই সত্য যে, আমাদের যাপিত জীবন, স্মৃতি আর আত্মজীবনীর পাতাগুলো পূর্ণ হয়ে থাকবে ইতিহাসের ক্রান্তিকালের দিনগুলোর বর্ণনা ও বিবরণে। সম্ভবত আমাদের পরিচয়ও হবে ‘ক্রান্তিকালের মানুষ’ নামে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর