দৈনিক পত্রিকার প্রচার সংখ্যার তালিকার আষাঢ়ে গল্প

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

টুটুল রহমান, এডিটর, বিজনেস অ্যান্ড ফাইন্যান্স, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:39:09

ছেলেবেলায় স্কুলে প্রবাদ-প্রবচনে পড়েছিলাম ‘আষাঢ়ে গল্প’। অর্থ কম বয়সে বুঝতে না পারলেও বড় হয়ে কত আষাঢ়ে গল্প শুনেছি। চাক্ষুস করেছি আষাঢ়ে গল্পকারদের। বিশেষ করে সাংবাদিকতায় তো বহু আষাঢ়ে গল্পকার রয়েছেন।  যাদের গল্প শুনলে আকাশ থেকে পড়বেন না মঙ্গল গ্রহে চলে যাবেন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হবে। আমার এক  সিনিয়র কলিগ ছিলেন কথায় কথায় হাতি ঘোড়া মারতেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার গল্প অফিসে প্রায়ই শোনাতেন। তার গল্পশুনে মনে হতো ‘ইস্ মন্ত্রীদের সঙ্গে তার এত ভাব অথচ ১৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে বেচারা কত কষ্ট করে সাংবাদিকতার চাকরি করছেন। অন্য কিছু করলেই তো পারেন।’ তিনি মাঝে-মধ্যে গল্প শোনাতেন কোন ব্যাংকের কোন  এমডি তার সরাসরি ক্লাসমেট, কে ডিনারে রোজ দাওয়াত করেন। লোন পাওয়া কোনো ব্যাপার না। ফোন করলে ব্যাংকের লোক বাসায় এসে লোন দিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার কত কাছের। তার এসব ‘আষাঢ়ে গল্প’ আমরা বেশ উপভোগ করতাম।

কদিন হলো সাংবাদিক বন্ধুদের ফেসবুক ওয়ালে একটি তালিকা দেখে আমার আষাঢ়ে গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। তালিকাটি হলো চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের দৈনিক পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও  ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন সংক্রান্ত। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তালিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাংবাদিকরা নানা মন্তব্য করছেন, সমালোচনা করছেন। এই তালিকা প্রকাশের পর অনেক সাংবাদিক যে ক্ষুদ্ধ সেটা তাদের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, মিথ্যাচারের একটা শেষ আছে,  কেউ বলছেন পত্রিকা অফিসগুলোতে দুদকের তদন্ত করা উচিত, কেউ বলছেন, যে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা  এক লাখ ৬০ হাজারের ওপরে  এবং অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়িত হয়েছে  সেই পত্রিকার সাংবাদিকরা তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। অনেকেই তো বলেছেন, এসব মিথ্যাচারের কারণে সাংবাদিকদের পাবলিক আর বিশ্বাস করেনা, পরিচয় দিতে ঘেন্না হয়। 

এমন অনেক কড়া আর তেঁতো মন্তব্য পাওয়া যাবে ওই পোস্টের নিচে। যা পড়ে আপনি সাংবাদিক হিসেবে বিব্রত হবেন।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি সর্বশেষ যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেখানে আমার কোনো নিয়োগপত্র ছিল না। আমার পরিচয় পত্রে লেখা ছিল সিনিয়র রিপোর্টার। বেতন দু‘বছরে বাড়তে বাড়তে হয়েছিল ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। তালিকায় দেখলাম ওই পত্রিকার প্রচার সংখ্যা এক লাখের ওপরে। ৯০০ টাকা কলাম ইঞ্চি সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপছে তারা। আর দেখা গেল পত্রিকাটি অষ্টম ওয়েজ বোর্ড পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছে। পত্রিকাটি কাকে কত বেতন দেয় সেটা ঈদের সময় বোনাস তুলতে গেলে হিসাব বিভাগের তালিকা দেখে বোঝা যেতো। সে প্রসঙ্গে যাবো না। তবে ওই পত্রিকায় কাজ করার সময় তো প্রেসেও কয়েকবার গিয়েছি, পত্রিকা উৎপাদন আর সার্কুলেশন বিভাগের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনিও তো আমাকে জানিয়েছিলেন,  পত্রিকা ছাপা হয় বড় জোর ৫ থেকে ৬ হাজার। এবার বোঝেন আষাঢ়ে গল্প কাকে বলে।

ডিএফপির করা ৫২টি পত্রিকার তালিকার মধ্যে বেশির ভাগ অর্ধমৃত পত্রিকার প্রচার সংখ্যা লাখের ওপরে। কিছু পত্রিকার যেগুলো ধুঁকে ধুঁকে চলছে সেগুলোর প্রচার সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার।  আর  যে পত্রিকার নাম জানেন না অনেক পাঠক সেগুলোর সার্কুলেশন ৩০ থেকে ৪০ হাজার দেখানো হয়েছে।

বিশেষ করে এক জনের মন্তব্যে পাই ‘দৈনিক বাংলা’ এখনও ছাপা হয়। এর প্রচার সংখ্যা ৪০ হাজার। জেনে খুশির সীমা নাই।’

প্রিয় পাঠক  আপনারা জানেন গত কয়েক বছর ধরে অনলাইন নিউজ পোর্টালের অগ্রযাত্রার কারণে প্রিন্ট পত্রিকার কি ভয়াবহ ধস নেমেছে। বিশ্বের নামি দামি অনেক পত্রিকা তাদের প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে দিয়েছে। গবেষনায় দেখা গেছে প্রতি বছর  প্রিন্ট পত্রিকার পাঠক সংখ্যা কমছে ১০ শতাংশ করে। এশিয়াতেও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাংলাদেশেই এর ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে প্রিন্ট পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রিন্ট পত্রিকা পড়েন।

তালিকার দিকে যদি  তাকান তাহলে দেখতে পাবেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে ৫লাখ ৫৩ হাজার ৩০০ কপি, প্রথম আলো ৫ লাখ ১ হাজার ৮০০ কপি। এগুলোর প্রচার সংখ্যা নিয়ে তেমন প্রশ্ন হয়তো অনেকেই করেন না। কিন্তু তালিকার একটু নিচের দিকে তাকান, ভোরের কাগজ এক লাখ ৬১ হাজার ১৬০ কপি, জনকণ্ঠ দুই লাখ ৭৫ হাজার, সমকাল ২ লাখ ৭১ হাজার, আমাদের সময় ২ লাখ ৭০ হাজার, মানবকন্ঠ ১ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ কপি। এরা সবাই অস্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করেছে। ভোরের পাতা পত্রিাকার সার্কুলেশন দেখানো হয়েছে এক লাখ ৫১ হাজার ২১০ কপি। পত্রিকাটি আপনার চোখে পড়ে কিনা আমি জানি না।

তালিকা দীর্ঘ করবো না  নাম না শোনা ‘আজকের বিজনেস বাংলাদেশ’ ছাপা হয় ৫০ হাজার, ভোরের দর্পন, নবচেতনা, সংবাদ প্রতিদিন, ঢাকা প্রতিদিন,  বাংলাদেশের খবর-এসব পত্রিকা ছাপা হয় ৫০ হাজারের ওপরে।

আষাঢ়ে গল্পের শুরুটা কিন্তু এখানেই। এতো পত্রিকার সার্কুলেশন? এত পাঠক। এত জনপ্রিয় প্রিন্ট মাধ্যম? এসব পত্রিকা কর্তৃপক্ষ অষ্টম ওয়েজ বোর্ড  বাস্তবায়ন করেছে? তাহলে মাসের পর মাস সাংবাদিকরা বেতন পাচ্ছেন না কেন? কেন সাংবাদিকদের অনেকেই প্রতিদিন ফোন করে জানান, ভাই আর পারছি না একটা অন্য কোনো জব দেখেন।

এই আষাঢ়ে গল্পের প্রণেতারা কিন্তু মহা সুখেই আছেন। শূন্য শুল্কে কাগজ পাচ্ছেন, সরকারি ৯০০ টাকা ইঞ্চিতে সরকারি বিজ্ঞাপন ছেপে বছরে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফর সঙ্গী হচ্ছেন। পাঁচ তারকা হোটেলে বহুজাতিক কোম্পানির টাকায় সেমিনার করছেন। প্রেসক্লাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য বক্তব্য দিচ্ছেন।  বেতন চাইলে অনেককে চাকরিচ্যুত করা ও লাঞ্চিত করার অভিযোগও পাওয়া যায়।

যারা তার পত্রিকায়  দিনরাত পরিশ্রম করে জীবনকে যাতা কলে পিষছেন মাস শেষে দুটো পয়সা পেয়ে ঘর ভাড়া দেবেন, সন্তানের স্কুলের বেতন দেবেন, চিকিৎসার খরচ মেটাবেন, সেই সাংবাদিকের নাম হয়ে যাচ্ছে ‘দু:স্থ সাংবাদিক।’ কোটি টাকার তহবিলের তালিকায় কার কার নাম ঢুকবে সেটা নিয়েও চলছে রাজনীতি।

এই আষাঢ়ে গল্প প্রণেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক- এই দাবি ন্যায্য।  তারা কয়টা পত্রিকা ছাপেন, কয়জনকে ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন  দেন তার স্বচ্ছ তালিকা প্রকাশিত হোক। তদন্ত কমিটিতে  সরকারের তল্পিবাহক কোনো সম্পাদককে যেন রাখা না হয়। সেই কমিটি হোক খেটে খাওয়া সাংবাদিকদের দ্বারা। যারা সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছেন। সততা আর নৈতিকতা রক্ষায় বছরের পর বছর অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছেন।  আমার বিশ্বাস তাহলে  আসল আর ভয়াবহ  এক সত্য বেরিয়ে  আসবে।  ধরা পড়বে এই আষাঢ়ে গল্পের রহস্য। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর