'উল্টা চোর কতোওয়াল কো ডাঁটে'

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 17:13:27

যে কোনও দুর্ঘটনা বা সামাজিক সমস্যা তৈরি হলে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। যে কারণে মানুষের মধ্যে দুঃখ, বেদনা, দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ আসে স্বাভাবিক নিয়মে। চিরদিনের চেনা সমাজের ছন্দ পতন হয়ে বিপর্যয় এলে মানুষের মনে ছাপ পড়বেই।

হয়ত সমস্যা ও বিপর্যয় দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেলে মানুষের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া ভোতা হয়ে যায়। দেখতে দেখতে সমস্যাগুলোও স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়। তারপরেও সেগুলো মনের গহীন প্রদেশে ছাপ ফেলতে ফেলতে ঘোরতর হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন তখন আর স্বাভাবিক থাকে না। মানুষের মানসিক জীবনও সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারে না।

উদাহরণস্বরূপ যানজটের কথা ধরা যাক। ঢাকা শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকায় কেউ আর আজকাল অবাক হয় না। আধা ঘণ্টার পথ তিন ঘণ্টায় যাওয়ার পরে বিষয়টি লোকজন আলোচনা করে না। বরং আধা ঘণ্টার পথটুকু আধা ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিটে যেতে বা আসতে পারলে তা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়।

একই উদাহরণ দেওয়া যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের। স্বাভাবিক অবস্থায় এই পথটুকু পাড়ি দিতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এ পথ অতিক্রম করতে ৮/১০ ঘণ্টা সময় চলে যায়। কখনো কখনো অস্বাভাবিক যানজটের কারণে ১৫/১৬ ঘণ্টা সময়ও লেগে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।

কিন্তু এইসব হয়রানিমূলক অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা দেখতে দেখতে এবং সইতে সইতে মানুষ এতোটাই ঘাত-সহনীয় হয়েছে যে, আলাপ-আলোচনা বা ব্যক্তিগত ভাবনায় বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় না। বরং অকস্মাৎ যদি ৪/৫ ঘণ্টায় সে পথ পাড়ি দেওয়ার সুযোগ হয়, তাহলেই মানুষ তা আলোচনা করে।

এভাবে 'অস্বাভাবিক' হয়ে যায় 'স্বাভাবিক' এবং 'স্বাভাবিক' হয়ে যায় 'অস্বাভাবিক'! যেমন, একদা ঘি, মাখন, ছানা, ননী ছিল স্বাভাবিক ও নিত্যভোগ্য খাবার। এখন এগুলো সতর্কীকৃত ও সাবধানে বেছে বেছে কম খাওয়ার খাদ্যপণ্য।

এসবই হলো পরিবর্তন আর বদলের বিষয়। এভাবে এক সময়ের ভালো আরেক সময় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ব্যথা, বেদনা, কষ্ট, দুঃখ স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। এভাবে স্বাভাবিক হতে হতে যানজট স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, ভেজাল, ফেরেববাজি, ধোঁকা ও তঞ্চকতা ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে।

এমনকি, এইসব কুকর্মে পারঙ্গমরা ঘৃণা ও বিবমিষার বদলে মারহাবা-বাহাবা পাচ্ছে। ক্ষমতার পুক্ষপুটে দিব্যি হেলে-দোলে এই শ্রেণিটি সগৌরবে ও মহা সমারোহে চলছে এবং ভালোর প্রতি লোষ্ট্র নিক্ষেপ করছে সময় পেলেই। উর্দু প্রবাদের 'উল্টা চোর কতোওয়াল কো ডাঁটে' পরিস্থিতিই এখন চারপাশে মহাশক্তিতে মঞ্চস্থ হচ্ছে। বাস্তবে এসবের মানে হলো, অপরাধী বা চোর ব্যাটাই পুলিশকে ধমকে চলেছে!

রাস্তায় জ্যাম তৈরি যে করছে, সে তার অপরাধ তো মানছেই না, বরং চিৎকার করে সবাইকে শাসাচ্ছে। ভেষালকারী উঁচা গলায় নিজের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। মুনাফাখোর ও মজুদদার দল পাঁকিয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তাদেরকে এখন বলা হয় 'সিন্ডিকেট'। যে 'সিন্ডিকেট' নামধারী গ্রুপকে কেউ স্পর্শই করতে পারছে না।

সর্বত্রই উল্টস্রোত। সবচেয়ে নিকৃষ্ট সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। অপরাধী নসিহত করছে আইনের। নিয়ম, নীতি ও নৈতিকতার হননকারী একনিষ্ঠতার সবক ফেরি করছে।

এইসব অনাচার ও সামাজিক মূল্যবোধ ভাঙ্গার পর থেকেই মানুষ যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। জন্ম থেকে আজ অবধি মানুষ অনিয়ম দেখতে দেখতে হয় অনিয়মকেই নিয়ম ভাবছে, নয় বিহ্বল হয়ে আছে। এত সত্যি, এতোটা অসহনীয় মানুষের জীবন হতে পারে তা পথে-ঘাটে-সমাজে চলতে চলতে টের পাওয়া যাচ্ছে।

মানুষের দুঃখ তখনই শত গুণ বৃদ্ধি পায়, যখন অনাচার সহ্য করার পাশাপাশি অনাচারীর ধমক শুনতে হয়। অপরাধীকে অপরাধ বলা দূরস্থিত ; অপরাধীর ব্যবহারিক ও বাচনিক আগ্রাসন সহ্য করাই এখন দস্তুর!

অপ-পরিবর্তনের ছাপ পড়তে পড়তে মনে হয় মানুষের চেতনায় অশুদ্ধই শুদ্ধতার জায়গা দখল করছে। এসবের ফলে মানুষ আর চমকিত হয় না। সব কিছু অভ্যাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ-অন্যায় সহ্য করতে করতে অপরাধীর সকল দাপটও হজম করে নিচ্ছে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর