ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-৪

, শিল্প-সাহিত্য

মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 18:00:18

[চতুর্থ কিস্তি]

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দিনরাতের তফাত বোঝা যায় না। ফোনটা বেজে যাচ্ছিল। অন্ধকারে হাতড়াতে-হাতড়াতে একসময় হাতে ঠেকল ফোন। চোখের কাছে নিয়ে ম্যারি দেখেন, ফোনের পর্দায় ভাসছে অচেনা নাম্বার। তিনি সচরাচর অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোন রিসিভ করেন না। আজ করলেন। কারণ রাতের শেষ প্রহর যখন ভোরের মুখোমুখি হচ্ছে, তখন কেউ নিশ্চয় রসিকতা করার জন্য ফোন করবে না। দ্বিধা জড়ানো গলায় তিনি কথা বলেন,

‘হ্যালো!’

‘আমি ক্যাভিন। কেমন আছো তুমি?’

জীবন থেকে আচমকা ও নাটকীয়ভাবে হারিয়ে গেলেও এবং স্মৃতি ও অনুভূতির কাছ থেকে আপাত অপসৃত হলেও সমুদ্রের জোয়ারের প্রবলতর স্পর্শে ক্যাভিনের কণ্ঠস্বর তাড়িত করলো ম্যারিকে। ক্যাভিন নামের অদ্ভুত ও অ্যাডভেঞ্চারিস্ট মানুষটি আবার আচমকা সাত বছর পরে তাকে তছনছ করে দিল।

‘তুমি? বেঁচে আছো?’

‘আছি। তবে মরতে মরতে বেঁচেছি কয়েক বার। এজন্য তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো।’

‘কিন্তু এতো দিন বাদে? আমাদের ভুলে থাকতে পারলে তুমি?’

‘এতো কথা ফোনে বলা যাবে না। আমি একটি চিঠি পাঠিয়েছি একজনের হাতে। পড়লে সব জানতে পারবে। আর তোমার সঙ্গে অচিরেই আমি দেখা করবো। বড় চমৎকার রঙধনু দেখা যায় এমন একটি আকাশের খোঁজ পেয়েছি পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। তোমাকে নিয়ে এক সঙ্গে দেখবো।’

ফোনের সংযোগ কেটে দিয়েছেন ক্যাভিন। অকস্মাৎ ফোনকলের মতোই হঠাৎ উবে গেলো তার কণ্ঠ। ম্যারি জানেন, কলব্যাক করলেও ক্যাভিন আর ধরবেন না। মানুষটাই আলাদা। অন্য কারো সঙ্গে মেলানো যায় না। ও কেবলই ওর মতো।

কিছুক্ষণ বিমূঢ় বসে থেকে ম্যারি ধাতস্থ হলেন। ক্যাভিন চলে যাওয়ার প্রথম দিকের কথাগুলো তার মনে পড়লো। বিষন্ন ম্যারি তখন প্রায়ই জানলার ধারে বসে বসে সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। তার মনে হতো, এই বুঝি হৈচৈ করতে করতে ক্যাভিন এসে হাজির হবে। বাড়িতে ডোরবেল বাজলে তীরবেগে ছুটে যেতেন তিনি। হয়ত ক্যাভিন এসেছে। আশাহত হতে হতে এক সময় হাল ছেড়ে দেন তিনি আর তখনই এসেছে ক্যাভিনের ফোন। পরদিনই একটি রুশ ছেলে ক্যাভিনের নাম করে বেশ বড় পার্সেলটি তার জন্য রেখে যায় বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির রিসিপশানে।

অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে পার্সেলটি নেড়েচেড়ে দেখেন ম্যারি। ব্যক্তি ক্যাভিনের অগোছালো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুসংগঠিত বিষয় হলো তার কথা ও লেখা। যুক্তি ও পরিচ্ছন্নতায় মেশানো পরিশীলিত মনোভাব কখনোই হারিয়ে যেতে দেয় নি ক্যাভিন তার কথা ও লেখা থেকে। কম্পিউটারের যুগেও ঝকঝকে অক্ষরে হাতে লিখেছে ম্যারির নাম। প্যাকেটটি পাঠিয়েছে নান্দনিক অবয়বে। লাইব্রেরিতে কাজের ব্যস্ততায় ক্যাভিনের পাঠানো পার্সেল খোলাও হয় নি। খুলতে ইচ্ছেও করেনি। বাড়িতে একান্তে পড়ার জন্য পার্সেলটি হ্যান্ডব্যাগে ভরেন ম্যারি।

বাড়িতে এসেও পার্সেলটি পড়ার ফুসরত পান না ম্যারি। মায়ের সামনে ক্যাভিসের চিঠি পড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। তিনি লঙ্কাকাণ্ড শুরু করে দেন ক্যাভিনের প্রসঙ্গ এলেই। ম্যারি অপেক্ষা করেন কখন পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হবে আর তিনি একান্ত নিভৃতিতে ক্যাভিনের প্রতিটি অক্ষর স্পর্শ করে করে চিঠিটি পড়বেন। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত বাড়তে থাকে এবং নির্জনতার সঙ্গী হয়ে ক্যাভিনের পার্সেল হাতে বাগানের পাইন গাছের তলে চলে আসেন তিনি।

পার্সেল খুলে ম্যারি দেখলেন একপ্রস্ত চিঠি আর একটি পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা থেকে ক্যাভিনের চারটি বই বের হয়েছে, যেগুলোর কপিরাইট ম্যারিকে দেওয়া আছে। প্রকাশনা কর্তা উইলিয়ান জন তিন মাস অন্তর অন্তর রয়্যালটি বাবদ সম্মানির টাকা ম্যারির অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেন। টাকাটা নেহাৎ কম নয়। ছোট্ট পরিবার চলার জন্য যথেষ্ট। ম্যারি কখনো সেই টাকায় হাত দেন না। টাকাগুলো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে জমছে। ম্যারি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, টাকাগুলো টমাস যখন বড় হবে, তখন তার হাতে তুলে দেবেন।

প্রকাশনা কর্তা উইলিয়ান জন দেখা হলেই বলেন, কোন বইয়ের কত কপি বিক্রি হয়েছে কিংবা কোন বইয়ের পরবর্তী মুদ্রণ করতে হবে। তখন ম্যারিকে কিছু চুক্তি ও কাগজ-পত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। আর কাজ শেষে ফিরে আসার আগে একটি কথা উইলিয়াম বলবেনই বলবেন, “জানি না, ক্যাভিনের সঙ্গে তোমার দেখা বা কথা হয় কিনা। আমরা তার কোনো ঠিক-ঠিকানা পাই না। তাই তোমাকে একটি অনুরোধ করি। কখনো দেখা বা কথা হলে তুমি তাকে আমাদের হয়ে অবশ্যই বলবে যে, সে যেন আমাদের নতুন কোনো পাণ্ডুলিপি দেয়।”

হয়ত উইলিয়াম এমন অনুরোধ ক্যাভিনের পরিচিত আরো অনেককেই করেছেন। কিংবা এমনিতেই পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে বলে পাঠিয়ে দিয়েছে ক্যাভিন। ম্যারি এই ভেবে খুশি যে, ক্যাভিন যেখানে, যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সে তার সৃষ্টিশীলতা বজায় রেখেছে। মননের দিক থেকে সে এখনো জীবন্ত।

পাণ্ডুলিপিটি খামে ভরে ম্যারি চিঠিটি হাতে নেন। এক পাতার সংক্ষিপ্ত চিঠি। তবু তার কাছে কতো কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত। পড়ার আগে কাঁপা হাতের আঙুলে চিঠির অক্ষরগুলোকে গভীর মমতায় স্পর্শ করেন তিনি। তার ভেতরটা ছলছল করতে থাকে।

ক্যাভিন লিখেছে, “এতগুলো বছর পর চিঠি লেখায় তুমি মোটেও অবাক হবে না, তা আমি জানি। পৃথিবীতে তোমার চেয়ে বেশি আমাকে কেউ বুঝবে না, বুঝতে পারবে না। এটা আমার ধারণা নয়, বিশ্বাস যে, আমার নিরবতাকেও তুমি অনুবাদ করে পাঠ করতে পারো। কিছু কথা আছে, মুখোমুখি না হলে বলা যায় না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কথাকারও এমন কথাগুলো লিখে বোঝাতে পারেন না, যেগুলো চোখে চোখ রেখে বলতে হয়। আমি নিশ্চয় সেভাবেই তোমাকে সব কথা বলবো কোনো একদিন যদি সুযোগ হয়। আজ শুধু একটা কবিতার ভেতরকার গল্পের আখ্যা্নভাগ নিয়ে কয়েকটি কথা কলি। ওয়ালটার ডি লা মারের বিখ্যাত কবিতা ‘‘Listener’’-এ এক অশ্বারোহী পুরুষ, টগবগ করে ঘোড়া চড়ে উপস্থিত হলেন এক প্রাসাদের সামনে, এবং উচ্চস্বরে বললেন, ‘‘কেউ কি আছেন?’’ চারদিকে নিস্তব্ধতা। এবার অশ্বারোহী বললেন, ‘‘আমি এসেছিলাম’’। তারপর ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে ফিরে গেলেন। এই কবিতাটিতে দু’টি স্বর আছে, এবং আছে দু’জন শ্রোতা (Listener)। প্রথম কণ্ঠস্বরটি অশ্বারোহীর, যিনি জীবনের প্রতীক। কিন্তু শ্রোতা হলো জীবনহীন প্রাসাদটি। এই জীবনহীন প্রাসাদটিও নিজের ভাষায় উত্তর দিল, যে ভাষা হলো নিস্তব্ধতার। এবং অশ্বারোহী এই নিস্তব্ধ প্রাসাদের নিস্তব্ধ ভাষাটি নিজের মতন করে শুনে ফিরে গেলেন।”

কিছুটা স্পেস দিয়ে চিঠিতে শেষ কয়েকটি লাইন লিখেছে ক্যাভিন, “কথা অবশ্যই বলে, কেউ কেউ, সবই। শোনে কেউ কেউ বা সকলেই। কিন্তু সব শ্রোতা কখনো উত্তর দেন না। কখনো নিস্তব্ধ থাকেন। নিস্তব্ধতাও এক ধরনের উত্তর! আমি আমার উত্তর বা ব্যাখ্যা হিসাবে তোমাকে নিস্তব্ধতা পাঠাচ্ছি।”

চিঠিটি শেষ করে ম্যারি নিজেও নিস্তব্ধ ও বাকহীন বোধ করলেন। তার মনে হলো, মানুষ থেকে তিনি যেন আচমকা নৈঃশব্দে আচ্ছাদিত এক মর্মর প্রতিমায় পরিণত হলেন। 

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-৩

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-২

ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১

এ সম্পর্কিত আরও খবর