আপনি যা ভাবেন একটা গানের অর্থ সে রকম নাও হতে পারে - পিট সিগার



অনুবাদ | রহমান রাহিম
পিট সিগার (১৯১৯-২০১৪)

পিট সিগার (১৯১৯-২০১৪)

  • Font increase
  • Font Decrease

পিট সিগার ছিলেন একজন বিখ্যাত মার্কিন লোকসংগীত শিল্পী। শুধু আমেরিকান লোকসংগীত নয়, বিশ্ব লোকসংগীতের সাথেই তাঁর ছিল এক নিবিড় সংযোগ। গীতিকার এবং বাদক হিসেবেও তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে লোকসংগীত নিয়ে রেডিও নিউইয়র্কে এ্যালান ওয়াসারকে দেওয়া তাঁর বিখ্যাত ইন্টারভিউটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রায়হান রহমান রাহি

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jan/03/1546508180161.jpg

এ্যালান ওয়াসার : অবশ্যই যে প্রশ্নটা প্রথমে করব, সেটি হলো আপনার কাছে লোকসংগীতের সংজ্ঞা কী?

পিট সিগার : সংজ্ঞা বিষয়টাই এমন যে এটি ব্যক্তি বিশেষে আলাদা আলাদা রকম হয়। একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় দুজন মানুষ একমত হবে না সম্ভবত এই ব্যাপারটিই সবচেয়ে স্বাভাবিক।
একটা সময় ছিল, যখন ঔপনিবেশিক প্রাচুর্য চারদিকে গম গম করত। ইউরোপীয় মধ্যযুগের দিকেই তাকালে দেখবেন সংগীত ছিল সেই প্রাচুর্যের ঘেরাটোপে আবৃত এক শিল্প-বিশেষ। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীরা নিজ খরচে রাজপ্রাসাদে একদল সংগীতজ্ঞকে ভরণপোষণ করছেন আর তাঁরা সিম্ফোনি অর্কেষ্ট্রা সহযোগে সংগীতকে দিচ্ছেন নতুন এক মাত্রা । ধ্রুপদী সংগীত বলতে আমরা যে বিষয়টি বুঝি, রাজ দরবারগুলোতে মূলত সেটির চর্চাই হতো।
এ তো গেল রাজা রাজরাদের আলাপ, কিন্তু সাধারণ দাস শ্রেণীর মানুষদের এমন প্রাচুর্য ছিল না যে তারা সংগীত সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য আর্থিকভাবে কাউকে কিছু দিতে পারবে। ফলে, নিজেদের মনের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেরাই নিজেদের জন্য গান বাঁধত। সেই সকল দাস শ্রেণীর মানুষদের নিজস্ব যে গান, আমার ধারণা সেটিই ‘লোকসংগীত’।
একটা কথা খুব চালু জানেন কিনা জানি না। কেউ কেউ বলেন আমেরিকায় কোনো লোকসংগীত নাকি পাবেন না, কারণ ওই সাধারণ দাস শ্রেণীর লোক আমেরিকায় ছিল না কোনোদিন।
কিন্তু, মজার বিষয় হলো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ কিন্তু এখানে রয়েছেন যারা ওই পুরনো ঘরানার বেহালার সুর, ব্যালাড, ব্যাঞ্জোর সুর, গিটারে ব্লুজ বাজনা, আধ্যাত্মিক বন্দনাগীতিগুলো দারুন পছন্দ করেন এবং এখনো অবধি ওইগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। তারা ওই গান, সুরগুলোকে না পারলেন কোনো শৈল্পিক সংগীত স্তরে স্থান দিতে, না এগুলো জ্যাজ বা অন্যান্য জনপ্রিয় ধারার মতো জনপ্রিয় কোনো ধারা। শেষমেষ তারা বললেন কী—‘চলো ভাই এর তো একটা নাম দেওয়া চাই। এর নাম আজ থেকে লোকসংগীত। ব্যস!

কিন্তু যা বললাম, সংজ্ঞায় দুজন মানুষ কখনো সব মিলিয়ে একমত হবেন না সেটিই স্বাভাবিক। সুতরাং আমি ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এটা আমার কাছে অনেকটা বিয়ারের সংজ্ঞায়ন করার মতোই। আমেরিকানদের কাছে ব্রিটিশ বিয়ার এবং ব্রিটিশদের কাছে আমেরিকান বিয়ার বিস্বাদ লাগবে এটাই চিরায়ত। এ নিয়ে ন্যূনতম কোনো বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি হোক, অন্তত আমি তা কখনোই চাইনি।

এ্যালান ওয়াসার : একেবারে প্রথম কবে, কেমন করে লোকসংগীতের প্রতি আপনার উৎসাহ সৃষ্টি হয়?

পিট সিগার : ১৯৩৫ সালের দিকে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। বাবা ছিলেন সংগীতত্ত্বের একজন অধ্যাপক, তিনি আমাকে নর্থ ক্যারোলিনার একটা স্কয়ার ডান্স ফেস্টিভলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তখনই আমি প্রথম আবিষ্কার করি আমার দেশেরই এমন এক সংগীত-ভাণ্ডার রয়েছে যা কখনো রেডিওতে কিংবা থিয়েটারে বাজানো হয় না। মনে আছে সেবারই আমি সেই সঙ্গীতের প্রেমে পড়ি। আর উঁচু ঘাড়ওয়ালা ব্যাঞ্জোর প্রতি ভালো লাগাও ঠিক তখন থেকেই। ব্যাঞ্জো মূলত আফ্রিকান একটি যন্ত্র। পরে দক্ষিণ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের দাসেরা ব্যাঞ্জো বাজানোর নতুন কৌশল আবিষ্কার করে যেটা ছিল অনেকটা অর্ধেক ইউরোপীয়, অর্ধেক আফ্রিকান ধাঁচের।
১৮৩০ সালের দিকে সাদা মানুষেরা ব্যাঞ্জোর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং আমেরিকায় ব্যাঞ্জো এমনভাবে সাড়া তৈরি করেছিল যেটা একশো বছর পর রক এন্ড রোল মিউজিক করেছে।
ব্যাঞ্জো ছিল না কোথায়? সবখানেই এর দারুণ জয়জয়কার! কেউ চাইলে নিজেই নিজের জন্য ব্যাঞ্জো বানাতে পারত। জনপ্রিয়তার এমনই অবস্থা, ততদিনে পশ্চিমের লোকজনের হাতেও ব্যাঞ্জো পৌঁছে গিয়েছিল।

এরপরই জনপ্রিয় সংগীত ধারার স্বাভাবিক পরিবর্তনের রীতি অনুসারে ব্যাঞ্জোর চল চলে যায়। ১৯৩০ সালে আমার তখন কৈশোর, মন চাইল আমি ব্যাঞ্জো বাজানো শিখব। কিন্তু শিখব কই? শেখা তো যায় একমাত্র পাহাড়ে। মনে আছে, স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আমি দু’বছর কেবল ইতিউতি ঘুরে ফিরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সে সময়টায় ব্যাঞ্জো বাজাতে পারে এমন কৃষকের দেখা পেলেই হলো, আমি তার কাছে ব্যাঞ্জো বাজানোর একটা দুটো কৌশল শিখে নিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি। এমন করেই আস্তে ধীরে একদিন ব্যাঞ্জো বাজানো শিখে গিয়েছিলাম।

এ্যালান ওয়াসার : তারপর? সেখান থেকে?

পিট সিগার : মজার বিষয় হলো, এটা যে আমার জীবিকা নির্বাহের উপায় হবে আমি কখনোই তা ভেবে চিন্তে ঠিক করে রাখিনি। ছোটবেলায় আমি একজন সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এ ধরনের কোনো কাজই পেলাম না। এক সম্পাদকের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু এ জাতীয় কাজ করবার কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতাটুকুও আমার ছিল না।
তাই চিন্তাধারায় একটা পরিবর্তন আনলাম। তখুনি বিভিন্ন স্কুল, সামার ক্যাম্প ধরনের জায়গাগুলোতে আমি গান গাইতে শুরু করি। ধীরে ধীরে সেই স্কুলের বাচ্চাগুলি কলেজে যেতে শুরু করে। এরপর কলেজ থেকেও গান গাইবার জন্য ডাক আসতে শুরু হয়।
দেখছিলাম, কেমন করে চোখের সামনেই এই বিষয়টার একটা কমার্শিয়াল ফিল্ড ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অদেত্তা, বেনেট-রিচার্ড ডায়ার, কিংস্টন ট্রায়োসহ শত শত পারফর্মার ছিলেন, যারা অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়োজিত কনসার্টে ডাক পেয়ে সেখানে গান শুনিয়ে দর্শকের মন জিতে নিয়েছেন।

শেষম্যাশ কলেজের শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে—আমাদেক কান্ট্রি পিপলরা লোকসংগীত বিষয়টি ভালোমতো মনে ধারণ করেন, গাইতে পারেন। আমার জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।

এ্যালান ওয়াসার : বিখ্যাত লোকসংগীত গায়ক লিড বেল্লি-র সাথেও তো আপনার পরিচয় ছিল।

পিট সিগার : হ্যাঁ। পেশাদার হিসেবে নিজেকে চিন্তা করবার সময়টায় আমি তাঁকে আমার শিক্ষক হিসেবেই ভেবেছি, যদিও তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন না। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, আমি কত মনোযোগ দিয়ে তাঁর বাজানো দেখতাম!
একবার একজন আমাকে বললেন—‘পিট, তোমার তো গলার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। একজন শিক্ষকের কাছে যাও , যিনি তোমাকে কণ্ঠ অনুশীলনে তালিম দিতে পারবেন।’ আমি তাকে বলেছিলাম—‘যদি কেউ লিড বেল্লির মতো গাইতে শেখাতে পারেন আমি তার জন্য জীবনের শেষ সঞ্চয় পর্যন্ত দিয়ে শিখতে রাজি আছি।’
বিষয়টা হলো কী জানেন তো, যখনি আপনি কণ্ঠের অনুশীলনের জন্যে কোনো শিক্ষকের কাছে যাবেন, তিনি আপনাকে গতানুগতিক রেওয়াজের তালিম দিতে শুরু করে দিবেন। যেন আপনাকে অপেরা শিল্পী হিসেবে প্রস্তুত করাই তার কাজ। মূলত সে কারণেই আমি আর ওমুখো হইনি।

লিড বেল্লি ১৯৪৯ সালে মারা গিয়েছিলেন। যেসব গান আমরা উনার থেকে শিখেছিলাম, আমার ধারণা সেগুলো আমাদের সারাজীবনই মনে থাকবে। গান করে বিরাট টাকা পয়সা কামাই করবেন এমন চিন্তা এই মানুষটার কখনোই ছিল না। আজকে যেসব তরুণ তাঁর—‘লাইক রক আইল্যান্ড লাইন’, ‘ওল্ড কটন ফিল্ডস এট হোম’, ‘মিডনাইট স্পেশাল’, ‘ব্রিং মি লিটল ওয়াটার সিলভি’—গাইছেন অন্তত তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় লিড বেল্লি চির অমর থাকবেন।
দ্য ওয়েভার্সের সাথে আমার প্রথম যে হিট রেকর্ডটি বের হয়েছিল সেটি ছিল তাঁরই গান—‘গুড নাইট আইরিন’। লোকে এখনো নিয়ম করে গানটি শুনতে চায়।

এ্যালান ওয়াসার : আপনার ওই বিখ্যাত রেকর্ডটি তবে দ্য ওয়েভার্সের সাথে?

পিট সিগার : এটা ১৯৫৫ সালের কার্নেগি হল কনসার্টের সময়কার। দ্য ওয়েভার্সের মেম্বারদের মাঝে দুজন ছিল নিউইয়র্কের একেবারে স্থানীয়। ভাইব্র্যান্ট এ্যাল্টো ভয়েস সেক্টরে ছিলেন রনি গিলবার্ট আর ফ্রেড হলারম্যান ছিলেন লো ব্যারিটোনে। আরকানসাসের যাজক লি হায়েস ছিল বেজ-এ। আমি ওদের সাথে স্প্লিট টেনর হিসেবে কাজ করতাম।

এ্যালান ওয়াসার : ‘স্প্লিট টেনর’— এই বিষয়টা কী?

পিট সিগার : আমি মাঝে মাঝে ফ্যালসেটো ধরনের সুরে, মাঝে মাঝে চড়া সুরে, সময়ে সময়ে গ্রাউলিংসহ তাঁদের সাথে গাইতাম। এখনকার যে কণ্ঠের কথা আপনারা সবাই বলেন, তখন কিন্তু আমার কণ্ঠ এমন ছিল না। গাইতে গাইতে আস্তে ধীরে কণ্ঠকে পরিণত করেছি।
দ্য ওয়েভার্সরাই প্রাথমিক অবস্থায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন কেমন করে লোকসংগীতও শহুরে বিনোদনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। মূলত তাঁদের দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীতে কিংস্টন ট্রায়ো, দ্য গেটওয়ে সিংগারস-সহ বাকিরা হেঁটে গেছেন। বর্তমান সময়ে পিটার, পল-ম্যারী ওরা আছেন। তাঁরা সকলেই আমাদের বন্ধু বান্ধব। আমি যখন থেকে ওদের চিনতাম তখন ওদের বয়সই বা কত? কেবল হাইস্কুলে পড়ত সম্ভবত!

এ্যালান ওয়াসার : সত্যি! এ কারণেই সম্ভবত তাঁরা আপনাকে গুরুর মতন মান্য করেন।

পিট সিগার : গুরু! নাহ। এই সম্বোধনটা আসলে বেশ বিব্রতকর। গুরু হতে হলে সম্ভবত বেশ বুড়ো হতে হয়। আমার দাড়ি দেখুন, এখনো সব ঠিকঠাক, একটাও পাকেনি। তবে, এ কথা সত্য ইদানীং অনেকেই আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন।
আমি কোনো হোমড়া-চোমড়া ধরনের কেউ নই—চেষ্টা করি সে কথাই মানুষকে বোঝাতে। জানেন, আমি পারতপক্ষে, ছেলে মেয়েদেরও উপদেশ দিতে পছন্দ করি না যদি না তাদের সেটা দরকার লাগে। সে যাই হোক, তবুও আমার মাঝে মাঝে মোড়ল, গুরু ইত্যাদিসূচক সম্বোধন শুনতে হয়। এরচেয়ে বাজে আর কী বা হতে পারে বলুন?

এ্যালান ওয়াসার : পরিবারের কথা যেহেতু এলো, একটা কথা জিজ্ঞেস করি বরং। আপনাদের গোটা পরিবারটাই তো সম্ভবত লোকসংগীতের চর্চা করছে, তাই না?

পিট সিগার : আমার বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। আমি প্রথম পক্ষের সবচেয়ে ছোট সন্তান। মাইকেল সিগার এবং পিগি সিগার ছিলেন দ্বিতীয় পক্ষের বড় দুই সন্তান। তাঁরা দুজনই অসম্ভব গুণী সংগীতজ্ঞ। আমি আমার জীবনে যে কয়জন সেরা বাদক দেখেছি মাইক তাঁদের অন্যতম। পিগির কথা নতুন করে কী আর বলব? ব্যালাডে ওর মতন দক্ষ গায়িকা খুব কমই দেখেছি।
পিগি সদ্যই বিয়ে করেছে ইবান ম্যাককলকে। তিনিও একজন ব্রিটিশ লোকসংগীত গায়ক।
আমার তিনটি সন্তান আছে। আমি, আমার স্ত্রী এবং বাচ্চারা মিলে পরিকল্পনা করেছি এই গ্রীষ্মে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াব। হয়তো কোনো দেশে আমাদের গান শুনেছে এমন কাউকে পেলেও পেয়ে যেতে পারি।

এ্যালান ওয়াসার : কোন কোন দেশে ঘুরবার পরিকল্পনা আছে যদি একটু জানাতেন।

পিট সিগার : সেপ্টেম্বর মাসটা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে কাটাব। অক্টোবর নভেম্বরের দিকে জাপানে থাকার কথা। এর মাঝে বিরতি কোথায় নেব তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে ডিসেম্বরের দিকে ভারতের দিকে যাব এ সমন্ধে নিশ্চিত। জানুয়ারিতে আফ্রিকার বেশ ক’টা দেশে এবং ফেব্রুয়ারিতে ইতালির দিকে যাত্রা করব। এরপর মার্চ, এপ্রিল, মে-র দিকে ইউরোপের বাকি দেশগুলো ঘোরার ইচ্ছে আছে। দেখি কী হয়!

এ্যালান ওয়াসার : এই ভ্রমণ সমন্ধে একটা কৌতূহলসূচক প্রশ্ন ছিল। মূলত আপনাদের এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী? বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকগান সংগ্রহের একটা চেষ্টা কি সেখানে থাকে না এমনি বায়ু পরিবর্তনের জন্যই?

পিট সিগার : ‘আমাকে সবসময়ই কিছু না কিছু শেখার মধ্যেই থাকতে হবে’—এমন ধরনের লোভ থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করি। আপনি সবসময় এমন করে শেখার মধ্যে মগ্ন থেকে পারবেনও না আসলে। নিজেকে অবশ্যই মাঝে মাঝে একটু আধটু বিশ্রাম দিতে হবে। তা না হলে দেখা যায় শেখাটা একটা সময় পর তার মান হারাচ্ছে। ‘জ্ঞান অর্জন’—এই বিষয়টির মধ্যে হয়তো একটা ভারি বোধ রয়েছে। সেটি যদি আর ভারি না থাকে তবে শেখার কী মানে?
একটা দুটো জাপানি লোকগান গাইতে চেষ্টা করব। ব্যাঞ্জোটাকে ভারতীয় সেতারের মতো বাজানো যায় কিনা দেখি। ইসরায়েলি কিছু গান এবং পূর্ব ইউরোপের বিখ্যাত লোকনৃত্য করবে সে সমন্ধেও ছোটখাটো পরিকল্পনা রয়েছে।

দ্য ওয়েভার্সের প্রথম দিককার হিটগান ‘জেনা’, এটা কিন্তু একটা ইসরায়েলি লোকগান। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান যেগুলো ওগুলোর মধ্যে একটা গান সাউথ আফ্রিকার। বার-তের বছর আগে একটা ফোনোগ্রাফ রেকর্ড শুনে শুনে আমি গানটা শিখেছিলাম। প্রচণ্ড সর্দিতে বিছানায় শুয়ে আছি, হঠাৎ গানটা সামনে এলো। তারপর এক নাগাড়ে শুনতে শুনতে একটা সময় আবিষ্কার করলাম গানটা এত কঠিন না। বেজ, টেনর একই রকমভাবে বারবার বাজছে আর তার সাথে চড়া সুরের কাজটা আমাকে বলতে গেলে মুগ্ধতায় ফেলে দিয়েছিল। তারপরই গানটা শিখতে শুরু করে দিই। চড়া সুরটাও এক পর্যায়ে আমার আয়ত্তে এসে যায়।
এই গানটা একটা নতুনত্বের কথা ভেবে তৈরি করতে বসেছিলাম, কিন্তু শেষ করার সময় একধরনের তুমুল ভালো লাগার ভেতর দিয়ে শেষ করেছি। শুধু আমার একার না, শ্রোতাদের হৃদয়েও এই গান দারুণ স্পর্শ করেছে বলে আমার ধারণা।
দ্য ওয়েভার্স গানটা বের করতে অনেক সাহায্য করেছে। গানটার নাম ‘উইমোওয়েহ’। সাউথ আফ্রিকার স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘বুবাহ’, যার অর্থ ‘সিংহ’।

এ্যালান ওয়াসার : পুরো গানটার মানে কী সেটি যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন।

পিট সিগার : মানুষজন প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে অমুক-তমুক গানের কী মানে। এটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রত্যেকটা ব্যালাড, শ্রমসংগীত কিংবা ছড়াগানেরই কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট মানে রয়েছে। কিছু গানের প্রেক্ষাপট বেশ চিত্তাকর্ষক, কোনো কোনোটা হয়তো স্বাধীনতা নিয়ে, আবার কিছু গান নিজস্ব পৃথিবীতে টিকে থাকবার সংগ্রাম গাঁথা হিসেবে রচিত হয়েছে।

আমি কখনো আফ্রিকায় যাইনি, কিন্তু এই গানটার অর্থ অনুসন্ধান করে দেখলাম, এ গানে বলছে—‘সিংহটা ঘুমিয়ে আছে’।
জুলুদের শেষ রাজা চাকা দ্য লায়ন ছিলেন দুর্দান্ত একজন সেনানায়ক। ইউরোপীয়রা তাঁকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেছিল। কিন্তু কেউ কেউ ধারণা করতেন চাকা দ্য লায়ন আসলে মরেনি। তিনি হয়তো ঘুমিয়ে আছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন কোথাও। সময় হলে ঠিকই জেগে উঠে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করবেন। সম্ভবত, এই চিন্তা থেকেই গানটা রচিত। আমি জানি না, কারণ আমি আগেই বলেছি আফ্রিকায় আমি কখনোই যাইনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার এখনকার দৃশ্যপট কল্পনা করে একবার ভাবুন তো ঠিক সেই সময়ে এই গানটা তাদের কাছে কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আশা করি, ইতোমধ্যেই উত্তর পেয়ে গেছেন।

এ্যালান ওয়াসার : ঠিক একরকমই একটা কাহিনী নিয়ে আরেকটা গান আছে । নাম সম্ভবত—‘ফলো দ্য ড্রিংকিং গউর্ড’।

পিট সিগার : ১৮৫০ সালের দিকে স্বাধীনতাকামী দাসেরা যখন দক্ষিণ থেকে কানাডায় পালিয়ে গিয়েছিল, কিছু সাহসী আমেরিকান জীবন বাজি রেখে তাদের সাহায্য করেছিলেন। এ গানটা সে প্রেক্ষাপটেই তৈরি।
ওই সময়ে ধর্মীয় গানগুলো ‘ফলো দ্য রাইসেন লর্ড’ নামে পরিচিত ছিল। গানটা এই ধাঁচের হলেও এতে স্পষ্ট রকমভাবে কিছু নতুনত্বের আভাস লক্ষ্য করা যায়।
গান গাওয়ার সময় অনেকেই শব্দের এদিক সেদিক করেছেন। বিষয় সেটি নয়, বিষয় যেটি সেটি হলো একবার ভাবুন সমবেত স্বরে সকল দাসেরা শস্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে এই গানটা গাইছে।
ওভারসিয়ার মাঝে মাঝে তার চাবুক নিয়ে এসে দেখতেন সকল দাসেরা একসঙ্গে গান গাইছে। ওভারসিয়ার ভাবতেন দাসেরা আনন্দে গান করছে এবং তা দেখেই তিনি চলে যেতেন। কিন্তু এ তো শুধু গান নয়। এটি ছিল দাসেদের দক্ষিণে পালিয়ে যাবার গুপ্ত নির্দেশনা।

‘ড্রিংকিং গউর্ড’ দ্বারা ঋক্ষমণ্ডলকে ইশারা করা হতো, যা শুধুমাত্র দক্ষিণের আকাশেই উদিত হতো।
সবসময়ই আপনি যা ভাবেন একটা গানের অর্থ সেরকম নাও হতে পারে। তবুও অর্থকে খোঁজার চেষ্টাটা আমার কাছে দারুণ লাগে।
সুনির্দিষ্ট অর্থের বিষয়ে মতবিরোধের বিষয়টি যে স্বাভাবিক, তা আমি প্রথম টের পেয়েছিলাম যখন পুরনো ব্রিটিশ ব্যালাড ‘বারবারা অ্যালেন’-এর অর্থ খুঁজতে গিয়ে অনেক তাবড় তাবড় বিশারদরা দীর্ঘস্থায়ী মিটিং করছিলেন।

এই ব্যালাড শুনলে দেখা যায় একজন পুরুষ তার প্রেয়সীকে নিঠুর সাব্যস্ত করতে চেষ্টা করছেন। কারণ কী? কারণ হলো প্রেমিকের চাই একটি চুমু। প্রেয়সী তা দেবে না। ফলে প্রেমিক তার প্রেমের সে বিরহ বুকে নিয়ে মরনের কোলে ঢলে পড়ছে। আপনার কী মনে হয়? শুধুমাত্র এই কাহিনীর জন্য ব্যালাডটি বিখ্যাত? না। আপনি যে এর মেলডি বা কথার বিন্যাস দেখে একে বিচার করতে যাবেন এমনটিও সম্ভব নয়। কারণ সুরটি সাধারণই আর কথা যেহেতু লোকে ইচ্ছেমতো গাইতে পারে একটা সুনির্দিষ্ট ফর্ম তৈরি করে একে বিচারের জো নেই। তবে? ভালো লাগার কোনো কারণ থাকে না আসলে।
গানের শেষ স্তবকে দেখা যায় বারবারা অ্যালেন, সেই নিষ্ঠুর যুবতী যার কবরে কাঁটাঝোপ ছড়িয়ে যাচ্ছে, উইলিয়াম যে প্রেমের দায়ে মরেছিল তার কবরে ফুটেছে সুন্দর এক গোলাপ—তা আরেকবার সমালোচকদের গানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খাওয়ায়।

পৃথিবীতে সবাইকেই একধরনের নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমার ধারণা এই গানটিতে এমন একধরনের উচ্চাশার বিষয় আছে যেটি সেই নিষ্ঠুরতাকে দূরে সরিয়ে নিখাঁদ সৌন্দর্যেরই গল্প বলে। যেটা এই পৃথিবীতেই হোক কিংবা পৃথিবীর বাইরে কোথাও!

এ্যালান ওয়াসার : ধন্যবাদ পিট সিগার। আমাদের অনুষ্ঠানে আপনার পদধূলি পড়েছে এতে আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

পিট সিগার : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;