ঢাকাই ফুটবলের সেকালের উন্মাদনা



সাইফুল মিল্টন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলই ছিল ‘প্রথম প্রেম’

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলই ছিল ‘প্রথম প্রেম’

  • Font increase
  • Font Decrease

নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী কোনো সময়ের কথা। আমরা থাকতাম পূর্ব বাসাবোর পাটোয়ারী গলিতে। মহল্লার বড়ভাইদের নেতৃত্ব বিশাল প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। উপলক্ষ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবলে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের শিরোপা জয়ে সমর্থকগোষ্ঠীর খাওয়া দাওয়া। আমার আবাহনীর লোগো খচিত নীল রঙের একটা টিশার্ট ছিল। এই টিশার্টের বদৌলতে আমি এলাকার আবাহনী সমর্থকগোষ্ঠীর কমিটির কনিষ্ঠতম সদস্য। তাই সেদিন আমার ব্যস্ততা ছিল দেখার মতো।

ক্রিকেট দাপুটে ক্রীড়াঙ্গনের এ যুগে কোনো তরুণের কাছে হয়তো উপরের ঘটনাটা কল্পনামিশ্রিত কোনো গল্পের শুরু বলে মনে হবে। কারণ আজ দেশীয় খেলাধুলায় ফুটবলের জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায়। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলই নাকি ছিল ‘প্রথম প্রেম’। আজকে আমরা ঘরোয়া ফুটবলের সেই স্বর্ণযুগের উন্মাদনা নিয়েই কিছুক্ষণ আলাপ করব।

আবাহনী গ্যালারি-মোহামেডান গ্যালারি : আশি-নব্বইয়ের দশকে ঢাকার ঘরোয়া ফুটবল হতো ঢাকা স্টেডিয়াম (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) ও মিরপুর-২ নং জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমান শেরেবাংলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম)। সেখানে ছিল দেশের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডানের সমর্থকদের জন্য পৃথক গ্যালারি। দুই দলের সমর্থকরা ব্যানার ফেস্টুন পতাকাসহ নিজ নিজ গ্যালারিতে অবস্থান নিত। গ্যালারি থেকে দুই দলের সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি গগনবিদারী চিৎকারে প্রতিটি আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ হয়ে উঠত প্রাণবন্ত। কোনো একটা দলের সমর্থকের ভুল করে অন্য দলের গ্যালারিতে ঢুকে পড়ে ধরা পড়লে জুটত উপহাস ও তিরস্কার। এভাবে প্রতিটি আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ ছিল উত্তেজনার পারদে ঠাসা।

ব্রাদার্স আইলো : ঘরোয়া ফুটবলে তৃতীয় শক্তি ছিল ব্রাদার্স ইউনিয়ন। গোপীবাগের এই দলটি ২০০৩-২০০৪ মৌসুমের আগে কখনো লিগ শিরোপা জিততে না পারলেও শিরোপা-প্রত্যাশী আবাহনী বা মোহামেডানের জন্য ছিল আতঙ্কের নাম। ব্রাদার্সের সাথে পয়েন্ট না খোয়ানোই ছিল শীর্ষ দুই দলের লক্ষ্য। তবে বৃষ্টির সাথে ব্রাদার্সের খেলার একটি যোগসূত্র জনশ্রুতিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেটি হচ্ছে, বৃষ্টি আসলে আবাহনী বা মোহামেডান যেই আসুক ব্রাদার্সের কাছে তার পরাজয় অনিবার্য। এজন্যই বৃষ্টিস্নাত দিনে ব্রাদার্সের সাথে বড় দুই দলের কারো খেলা থাকলে বিপক্ষ গ্যালারি থেকে ‘ব্রাদার্স আইলো’, ‘ব্রাদার্স আইলো’ ধ্বনি শোনা যেত।

মহসিন না কানন : আবাহনী ক্রীড়াচক্রের গোলরক্ষক ছিলেন মোঃ মহসিন আর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের গোলরক্ষক ছিলেন সাইদ হাসান কানন। কানন ঢাকার ফুটবলে সংগঠক হিসাবে সরব থাকলেও, মহসিন দীর্ঘদিন কানাডায় প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। সেসময় বড় দুই দলের এই তারকা গোলরক্ষকের মধ্যে সবসময় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই চলত। দুইজনই দীর্ঘদিন জাতীয় দলের গোলবার আগলানোর দায়িত্ব পালন করেছেন।

মোনেম মুন্নার রেকর্ড পারিশ্রমিক : বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুপারস্টার সাকিব আল হাসান তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্ম হয়তো দেখেনি ৯০ দশকের ফুটবল সুপারস্টার সুদর্শন ও অকালপ্রয়াত ফুটবলার মোনেম মুন্নার খেলা। আবাহনী ও জাতীয় দলের একসময়ের অটোম্যাটিক চয়েস এই ডিফেন্ডার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতসহ এশিয়ার অনেক দেশের লিগেই খেলেছেন। আবাহনীর ঘরের ছেলে মুন্নাকে দলে ভিড়াবার জন্য এক দলবদলে মোহামেডান অনেক চেষ্টা করেছিল। স্টেডিয়াম পাড়ায় কানাঘুষা শুরু হল, মুন্না বোধহয় এবার আবাহনী ছেড়ে শত্রু শিবিরেই ঘাঁটি বানাচ্ছেন। অবশেষে সে সময়ের রেকর্ড পারিশ্রমিক ১৮ লক্ষ টাকায় আবাহনী মুন্নাকে রেখে দেয়। পরের দিন একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল, “মুন্না আবাহনীতেই, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে”। মুন্নার কথা আসলেই বলতে হবে মোহামেডানের তারকা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদের কথা। জাতীয় দলের দীর্ঘদেহী এই সাবেক ডিফেন্ডারের রক্ষণ কাজের পাশাপাশি কর্নার থেকে হেড করে গোল করারও দক্ষতা ছিল।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/31/1564579187026.jpg

◤ মোনেম মুন্না ┇কায়সার হামিদ ◢

 

বাংলাদেশের ম্যারাডোনা সাব্বির ও গোলমেশিন আসলাম : আশি ও নব্বই দশকে বিশ্বফুটবল ছিল আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনাময়। দেশে দেশে এসময় আক্রমণভাগের কুশলী খেলোয়াড়দের নাম দেয়া হতো ম্যারাডোনা। বাংলাদেশেও কিন্তু একসময় একজন ম্যারাডোনা ছিল। তিনি জাতীয় দল ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক মিডফিল্ডার রুম্মন বিল ওয়ালি সাব্বির। মধ্যমাঠের এই সৃষ্টিশীল ফুটবলারের ক্রীড়াশৈলি এখনো সেসময়ের ঘরোয়া ফুটবল অনুরাগীদের চোখে লেগে আছে। তবে ইনজুরির জন্য এই মেধাবী খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার সময়ের অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। মোহামেডানের সাব্বিরের বিপরীতে ছিল আবাহনীর স্ট্রাইকার নন্দিত ফুটবলার শেখ মোহম্মদ আসলাম। ডিবক্সের মধ্যে হেড করার সুযোগ পেলে আসলামের গোল অনেকটাই অনিবার্য ছিল। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ইরান ও দঃ কোরিয়ার বিরুদ্ধে আসলামের দুটি গোল এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। দুটি গোলেই এসিস্ট করেছিলেন বাংলাদেশের ম্যারাডোনা সাব্বির।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/31/1564579319241.jpg

◤ সাব্বির┇আসলামের বিদায় মুহূর্ত ◢

 

ঢাকাই ফুটবলের বিদেশিরা : সেসময় ঘরোয়া ফুটবলের অনেক মানসম্মত বিদেশিরা খেলে গেছেন যারা আমদের ফুটবলকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। মোহামেডানের চিমা ও এমেকার কথা নিশ্চই ফুটবলমোদীদের মনে আছে, এই দলে আরো উল্লেখযোগ্য ফরেন রিক্রুট ছিল ইরানের নালজাকের ও নাসির হেজাজি, রাশিয়ান রহিমভ, কুজনেসভ, আন্দ্রে কাজাকভ প্রমুখ। নব্বই দশকের আবাহনীর রাশিয়ান প্লে মেকার ঝুকভকে দেশের ফুটবলবোদ্ধারা দেশীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা বিদেশি খেলোয়াড় মানেন। আবাহনীর অন্যান্য ফরেন রিক্রুটের মধ্যে রাশিয়ান স্ট্রাইকার পলিনকভ ও উজবেক মিডফিল্ডার ভ্লাদিমির, শ্রীলঙ্কান পাকির আলী ও প্রেমলাল, ইরাকি নজর আলী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

সবশেষে বলি, দর্শক ও ক্রীড়ামোদীরাই কোনো একটি খেলার প্রাণ। সমর্থকদের উন্মাদনা না থাকলে সে খেলাটি কিন্তু উৎকর্ষতা পায় না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলের সেই স্বর্ণযুগের সূর্য আজ অস্তমিত প্রায়। দেশের ক্রীড়ামোদীদের প্রথম প্রেম ফুটবল আবার প্রাণ ফিরে পাবে, আবারও ফুটবল স্টেডিয়াম কানায় কানায় পরিপূর্ণ হবে এটাই কামনা।

   

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;

এক ঘরেই তিন বলী



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

  • Font increase
  • Font Decrease

চুল থেকে দাড়ি-সবই সফেদ। হাঁটাচলায় মন্থর। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় প্রথম দেখাতেই। কিন্তু তার ষাটোর্ধ্ব বয়সটা যেন কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। বয়স যতই ছোবল বসানোর চেষ্টা করুক না কেন-তিনি যেন এখনো ২৫ এর টগবগে তরুণ। সেই বলেই তো ফুসফুসের রোগবালাইকে তুড়ি মেরে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা এলেই হাজির হয়ে যান রিংয়ে। এক দুবার নয়, এবার কিনা পূর্ণ হলো সুবর্ণজয়ন্তী!

চট্টগ্রামের অন্যতম আবেগের ঠিকানা ঐতিহাসিক এই বলীখেলার বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা এই বলীর নাম খাজা আহমদ বলী। ৫০ বছর ধরে বলীখেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া এই বলীর এখন পড়ন্ত বয়স। ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে রোগ। কানেও শোনেন কম। খাজা আহমদ বুঝে গিয়েছেন, তার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বলীখেলার স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যেতে চান না। সেজন্যই উত্তরসূরী হিসেবে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন নিজের দুই ছেলেকে। বাবার পাশাপাশি দুই ভাইও এখন বলীখেলার নিয়মিত প্রতিযোগী।

খাজা আহমেদ বলীর বাবাও বলীখেলায় অংশ নিতেন। বাবার সঙ্গে বলীখেলায় এসে ১৯৭৪ সালে শখের বসে খেলতে নামেন খাজা আহমেদও। বয়স তখন ১২ বছরের আশপাশে। সেই শুরু, আর কোনোদিন মিস করেননি বলীখেলায় অংশ নেওয়া। একবার চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বহু বছর ধরে খাজা আহমেদ বলী ও সত্তরোর্ধ্ব মফিজুর রহমানের ‘বলীযুদ্ধ’ জব্বারের বলীখেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দ্বৈরথ হয়তো আর দেখা যাবে না। দুই বছর আগে উৎপত্তি হওয়া ফুসফুসের রোগটা ইদানিং যে খাজা আহমদকে বেশিই ভোগাচ্ছে। সেজন্য গতবছর অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার দুই ছেলেকে নিয়ে বলীখেলায় এসে আবেগ সামলাতে পারেননি খাজা আহমেদ। ছেলেদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রিংয়ে। সেজন্য আরও একবার মফিজুর রহমান-খাজা আহমেদের লড়াই দেখল হাজারো দর্শক। যদিওবা যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন রেফারি।

প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমানের সঙ্গে বলী-যুদ্ধে খাজা আহমদ

কেন অবসর ভাঙলেন এমন প্রশ্নে হাসি খেলা করে যায় খাজা আহমেদ বলীর মুখে। বলতে থাকেন, ‘বয়সের কারণে শরীর দস্ত। ফুসফুসও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সেজন্য অবসর নিয়েছিলাম। কিন্তু বলীখেলায় আসার পর দেখলাম দর্শকেরা সবাই অনুরোধ করছেন। সেজন্য মন বলল, না খেললে দর্শকদের প্রতি অন্যায় হবে। আর আবেগ ও ভালোবাসার কাছে বয়স-রোগ পেরেছে কবে?’

তবে এখানেই সব শেষ, বলে দিয়েছেন খাজা আহমেদ বলী। বলেছেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। মনে হয় না আর খেলতে পারব। অসুখটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেজন্য মনে মনে মেনে নিয়েছি এটাই আমার শেষ অংশগ্রহণ। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা খাজা আহমদের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়। কৃষিকাজ করেই চলে সংসার। তবে বলীখেলা এলে সব কাজ বাধ। কয়েকদিন ধরে চলে প্রস্তুতি। নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে এরই মধ্যে খাজা আহমেদ নিজের দুই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন বলী হিসেবে। ২০১২ সাল থেকে বলীখেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তার বড় ছেলে মো. সেলিম। গত বছর থেকে যোগ দিয়েছেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। এখন বলীখেলার আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে খাজা আহমদের প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমরা বলীখেলা শিখেছি। বয়সের কারণে বাবা এখন অসুস্থ। হয়তো আর খেলা হবে না। সেজন্য তার উত্তরসূরী হিসেবে আমরা বলীখেলায় অংশ নেব সামনের দিনগুলোতে। এটা শুধু পরিবারের বলীর প্রজন্ম ধরে রাখার জন্য নয়, তরুণদের মাদক-সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগও।’

বাবাকে পাশে রেখে একই কথা বললেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। বলেন, ‘হয়তো বাবা আর খেলবেন না। তবে তিনি না খেললেও যতদিন বেঁচে থাকবেন বলীখেলা দেখতে আসবেন। রিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন।’

ছেলের কথা শুনে আবেগ খেলে যায় খাজা আহমেদ বলীর মনে। কাঁধের গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না খেললেও যতদিন বাঁচি এখানে, এই বলীর মাঠ লালদীঘি ময়দানে ছুটে আসব। এটা থেকে দূরে থাকতে পারব না।’

খাজা আহমেদ যখন কথা বলছিলেন দূরে কোথাও তখন মাইকে বাজছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অক্লান্ত গলায় গেয়ে চলেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...

;