"দ্য গুড ফিজিশিয়ান ট্রিটস দ্য ডিজিস, দ্য গ্রেট ফিজিশিয়ান ট্রিটস দ্য পেশেন্ট হু হ্যাজ দ্যা ডিজিসেজ" স্যার উইলিয়াম অসলারের উক্তিটি আর যে কোনোভাবেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়, তা বলা বাহুল্য। এখানে হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসক পর্যন্ত পৌঁছাতেই জেরবার হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে পদে পদে হতে হচ্ছে হয়রানি আর প্রতারণার শিকার। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পরপর দুই দিন সরেজমিন দেখে এর প্রমাণ মিলেছে।
১৫ মে বুধবার সকাল ১১টা। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন শিউলি বেগম। এখানে এসে রীতিমতো বিপাকে পড়তে হয়েছে তাকে। প্রথমে দীর্ঘ সিরিয়াল দাঁড়িয়ে টিকেট কেটেও দীর্ঘ অপেক্ষা। অবশেষে ডাক্তার দেখাতে পারলেও তার দেয়া টেস্টের একটি বড় তালিকা নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন শিউলি। এতসব নানা রকমের টেস্ট! কোথায় করবেন কিভাবে করবেন তার কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া তিনি পাননি হাসপাতাল থেকে। কিন্তু হাজির আনসার সদস্যরা। হাসপাতালের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাই এখন টেস্ট বাণিজ্যের দালাল। রোগীর হাতে টেস্টের কাগজপত্র দেখলেই আনসার সদস্যরা শুরু করে দেয় ডাকাডাকি- টানাটানি।
নিজেদের মধ্যেই চলে পাল্লাপাল্লি। কোন রোগীকে কে কব্জা করবে। যেখানে রোগীর লাইন, সেখানেই আনসারের দৌরাত্ম। টিকেট কাটতে আসা রোগীদের ভীর ঠেলে আনসার ঢুকে যাচ্ছে কারো জন্য লাইন ভেঙ্গে টিকেট কেটে দিয়ে টুপাইস কামিয়ে নিচ্ছে। ডাক্তার দেখানোর সিরিয়ালেও তারা হানা দিচ্ছে। টাকা নিয়ে পড়ে আসা রোগীকে আগে সিরিয়াল পাইয়ে দিচ্ছে। ইমার্জেন্সি বিভাগে আসা রোগীদের ক্ষেত্রেও তাদের দৌরাত্ম দেখা গেলো। গুরুতর অসুস্থ রোগীদেরও পেছনে ফেলে আনসারের আনা রোগীদের আগে দেখা হচ্ছে। আর এসব দেখার কেউ নেই।
কোন কোনো রোগীর স্বজনদের দাবি, আনসার সদস্যদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করলে কটাক্ষ আর গালাগাল শুনতে হয় তাদের।
এখানেই শেষ নয়, হাসপাতালের কর্মচারী আর আনসারদের যোগসাজশে চলছে ট্রলি কিংবা হুইলচেয়ারের বাণিজ্যও। সরকারের এসব সামগ্রী রোগীর জন্য বিনামূল্যে ব্যবস্থা করা হলেও তা চলে গেছে এইসব অসাধুদের দখলে। তারা সেগুলো কব্জায় রেছে রোগী বুঝে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে ছাড়ছে। রোগী পৌঁছালেই তারা শুরু করে দেয় ট্রলি নিয়ে দরকষাকষী। কেউ টাকা না দিলে তাদের রোগীকে ছুয়ে পর্যন্ত দেখে না কর্মচারীরা। আর যদি কোনো রোগীর স্বজন সামান্য প্রতিবাদও করে তাহলে তাদের কপালে জোটে দুর্ব্যবহার।
পরিচয় গোপন রেখে ইমার্জেন্সি বিভাগে দায়িত্ব পালন করা আনসার সদস্য আ: হাই এর সাথে কথা বলে জানা যায় এম্বুলেন্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল টেস্টসহ প্রায় সকল সার্ভিস তিনি দিতে পারবেন।
অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা যাবে কি-না? এমন প্রশ্নে বললেন, হাসপাতালের মাত্র একটা এম্বুলেন্স সেইটা কই আছে জানিনা। তবে যদি কেউ প্রাইভেট এম্বুলেন্স চায় তাহলে যেকোনো সময় তিনি ম্যানেজ করে দিতে পারি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলের ভাড়া কতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৫০০-১৬০০ টাকা হলেই চলবে।
আনসার সদস্য আ: হাইকে দেখা গেলো একজন রোগীর আত্মীয়র সঙ্গে তার ব্যস্ত সময় কাটছে। রোগীর ব্যবস্থাপত্র /টেস্টের তালিকার ছবি তুলে হাসপাতালের কোন একজন প্যাথলজিষ্টকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেন। উল্টো দিক থেকে জেনে নিচ্ছেন তার খরচ কতো ইত্যাদি। যেনো তিনিই রোগীর সবকিছু।
হাসপাতালে কি এসবের ব্যবস্থা নেই? এমন প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ল্যাবের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মীর সাথে কথা হয়। তিনি জানালেন, প্রতিদিন সকালে মাত্র ৫০ জন রোগীর আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হয় হাসপাতালে। তবে নানা রকমের সংকট ও সীমাবদ্ধতার কারণে হাতে গোনা কয়েকটি ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট ছাড়া বাকি সব টেস্ট বাইরে থেকেই করতে হয়।
ভুক্তভোগী শিউলি বেগম জানালেন, তার সন্তানের বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর ও বমি। সকালে হঠাৎ জ্বরের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কিছু টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালে টেস্ট করতে নানা রকমের ঝক্কি-ঝামেলা ও রিপোর্ট পেতে একদিন দেরি হবার কথা জানায় হাসপাতালের দায়িত্বরত কর্মচারীরা। এ সুযোগে একজন আনসার সদস্য তার হাতে থাকা টেস্টের কাগজপত্র দেখে ছবি তুলে নেন। এবং সকল টেস্ট তিনি করিয়ে দেবার আশ্বাস দেন।
হাসপাতালে নিরাপত্তার দায়িত্বে অবহেলা করে টেস্ট বাণিজ্যের সাথে আনসার সদস্যদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে এবং টেস্ট এর রেজাল্টের দীর্ঘসূত্রিতার কারণ জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান বার্তা ২৪ কে বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে তা স্বীকার করছি। তবে সংকট কাটিয়ে উঠতে আমরা কাজ করছি। এছাড়া আনসার সদস্যদের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও টেস্ট বাণিজ্যের যে অভিযোগ উঠেছে তাও আমরা খতিয়ে দেখছি। যদি কোন আনসার সদস্য এমন কাজে জড়িত তাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আমাদের প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সাধ্য অনুযায়ী সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবে খুব শীগ্রই আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স যুক্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। আশাকরি এম্বুলেন্স যুক্ত হলেই এই সংকটেরও সমাধান হবে, বললেন ডা. শফিউর।
এক পর্যায় প্রতিবেদকের দেয়া তথ্য ও ছবি হাতে পেয়ে পরিচালক ডা. শফিউর রহমান তাৎক্ষণিক অভিযুক্ত আনসার সদস্যকে ক্লোসড করেন। সেই সাথে এমন অনিয়মের কোন খবর চোখে পরলে সংবাদকর্মীদের জানানোর অনুরোধ করেন।