তাপদাহ থেকে প্রাণীদের রক্ষায় করণীয়



ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
-গরমের সময় পোষা পাখি সান কনিউরের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। ছবি: লেখক

-গরমের সময় পোষা পাখি সান কনিউরের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২০ এপ্রিলের (২০২৪) ঘটনা। পাখিসংক্রান্ত একটি প্রকল্পের কাজে উত্তরা, দিয়াবাড়ি ও আশেপাশে ঘুরছি। প্রচণ্ড খরতাপ। তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। মাথায় হ্যাট থাকায় অন্তত কিছুটা রক্ষা। প্রচণ্ড রোদ্রতাপে ক্যামেরা গরম হয়ে উঠেছে। পাখির খোঁজে হাঁটছি। হঠাৎই উঁচু ঘাসের ভিতর থেকে একটি কুকুর বেড়িয়ে এলো। এরপর মুখ হা করে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে লাগল। মনে মনে বললাম ‘ঘাসের ভিতর ছিলি তো ভালোই ছিলি, কেনই-বা এই খরতাপে বেরিয়ে এলি, আর কেনই-বা জিব বের করে হাপাচ্ছিস’?

পাখির খোঁজে আরেকটু সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটাপথে বেশকিছু ভাতশালিককে খাবার মুখে হন্তদন্ত হয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। বাসায় নিশ্চয়ই ওদের ছানা রয়েছে, তাই এতো তাড়াহুড়ো। একটি গোশালিককে লেকের পাড়ে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আর দুটিতে দ্রুত পানিতে ঝাঁপ দিয়ে যেন প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে বাঁচল। খানিকটা এগুনোর পর আরেকটি শালিককে সানশেড দেয়া বিদ্যুতের কোন একটি যন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে হা করে থাকতে দেখলাম। স্পষ্ট বোঝা গেল সানশেডের ভিতরে থেকেও সে হাঁপাচ্ছে। এরপর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে একটি মরা গাছের সামনে এলাম। গাছে একটি সাদা চিল বসে ছিল। ওর ছবি তুলতে তুলতে সামনে এগুচ্ছি। এক সময় সেও দেখলাম মুখ হা করে আছে।

প্রচণ্ড গরমে কুকুর হাঁপাচ্ছে

তারপর আরেকটু সামনে এগুলাম। বেশ গরম, সহ্য করার মতো নয়। শার্ট পুরোপুরি ঘামে ভিজে গেছে। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে হঠাৎই একটি শিয়াল বেরিয়ে এল। আর যায় কোথায়? ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সেও মুখ হা করে হাঁপাতে লাগল। এরপর ধীরে ধীরে সামনের ঘাসবনের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরাও আর গরম সহ্য করতে না পেরে গাড়িতে উঠে ফিরতি পথ ধরলাম।

এতক্ষণ বিভিন্ন পাখি-প্রাণীর হা করে থাকা বা হাঁপানোর যে গল্প বললাম তা আর কিছু নয়, গত ক’দিনের প্রচণ্ড তাপদাহের ফল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী দেশে আগামী আরও বেশকিছু দিন মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস), মাঝারি (৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও তীব্র (৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপদাহ চলমান থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই তাপদাহ থেকে বাঁচার জন্য আমরা মানুষেরা কত কিছুই না আবিষ্কার করেছি। বৈদ্যুতিক পাখা, এয়ার কন্ডিশনার, ছাতা, ঠাণ্ডা পানীয় এবং আরও কত কি!

অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হাঁপাচ্ছে ভাত শালিক

তীব্র গরমে মানুষের মতো প্রাণীদেরও অনেক কষ্ট হয়। তবে সে কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তারাও নিজস্ব কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি হলেই মানুষ ঘামতে থাকে; তবে শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে গেলে দেহ শীতল হয়ে যায়। কিন্তু মহিষ ও শুকরের ঘামগ্রন্থি কম থাকায় ওরা শরীর ঠাণ্ডা করতে কাদায় গড়াগড়ি করে। সাহারা মরুভূমিতে ফেনেক নামে এক ধরনের খেঁকশিয়াল বাস করে। আকৃতিতে এটি আমাদের দেশের খেঁকশিয়াল থেকে বেশ ছোট। কিন্তু ওর কানগুলো দেহের তুলনায় বেশ বড় হয়। আর এই বিশাল আকারের কান ওদের দেহ থেকে তাপ নিঃসরণে সাহায্য করে।

মুখ হা করে গরমের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টারত সাদা চিল

প্রাণীদের দেহের পশম বা লোম সাধারণত দেহ উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু বিশালদেহী হাতির দেহের ছোট ছোট লোম দেহ শীতল রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, কুকুর তার দেহের তাপমাত্রা কমায় জিহ্বার মাধ্যমে। তবে এতকিছুর পরেও অতিরিক্ত এই তাপদাহ থেকে খামারভিত্তিতে বা কৃষকের ঘরে পালিত গবাদি প্রাণী, হাঁসমুরগি (পোল্ট্রি), পোষা পাখি ও প্রাণীদের রক্ষা করতে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। 

তাপদাহে কাতর শিয়াল

এগুলো সঠিকভাবে মেনে চললে এসব পাখি-প্রাণীরা প্রচণ্ড তাপদাহজনিত পীড়ন বা চাপ থেকে রক্ষা পাবে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

০১. গবাদিপ্রাণী, পোল্ট্রি ও পোষা পাখি-প্রাণীর ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পাখি-প্রাণীর ঘরের চাল টিনের তৈরি হলে চলের উপর ভেজা কাপড়, চট বা বস্তা বিছিয়ে দেয়া যেতে পারে ও মাঝে মাঝে তাতে পানি ছিটিয়ে ভেজা রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেসঙ্গে ঘরের ভিতরে ভেজা কাপড়, চট, বস্তা ইত্যাদি ঝুলিয়ে রেখে ঘরের তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে।

০২. পাখি-প্রাণীর ঘরের ভিতর পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে, এজন্য প্রয়োজনে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

০৩. গবাদি বা পোষা প্রাণীকে দিনের মধ্যে একাধিকবার গোসল করানো যেতে পারে অথবা পানি ছিটিয়ে শরীর ভিজিয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে প্রাণী বেশ আরাম পাবে।

০৪. পাখি-প্রাণীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে। পানির সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে লবণ/ভিটামিন সি/ইলেট্রোলাইট/গ্লুকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে।

 গরম কমানোর চেষ্টায় হাতি

০৫. গবাদিপ্রাণী বা গরু-মহিষকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আবদ্ধ ঘর বা খোলা মাঠে না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়ায় রাখা যেতে পারে।

০৬. তাপদাহের সময় গবাদিপ্রাণীদের খড় ও অতি পরিপক্ক শক্ত আঁশযুক্ত খাবারের পরিবর্তে নরম ও কচি ঘাস প্রদান করা যেতে পারে। খাদ্য হজমের সময় যাতে তাপমাত্রা বেড়ে না যায় সেজন্য দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাবদিপ্রাণীকে কম আঁশযুক্ত ও উচ্চ শক্তিসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করলে তা তাপদাহজনিত পীড়ন (হিট স্ট্রেস) কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

বড় আকারের কানের মাধ্যমে গরম কমায় মরুভূমির ফেনেক খেকশিয়াল

০৭. অতিরিক্ত গরমের সময় গবাদিপ্রাণীকে খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে দিনের শীতল সময়ে খাদ্য সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।

০৮. সম্ভব হলে খণিজ মিশ্রণ ব্লক সরবরাহ করা যেতে পারে।

০৯. প্রচণ্ড গরমের সময় কৃমিনাশক ও টিকা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া অতিরিক্ত গরমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রাণী পরিবহন বন্ধ রাখা উচিত। এ কাজগুলো দিনের অপেক্ষাকৃত শীতলতম সময়ে করা যেতে পারে।

খামারে লাল চাঁটগেয়ে গরুর খাদ্য ব্যবস্থাপনা

১০. যে কোন ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রাণীসম্পদ দপ্তর অথবা ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজি ল্যাব গাইনিকোলজি, অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ বিভাগ, বশেমুরকৃবি, সালনা, গাজীপুর-১৭০৬।
E-mail: [email protected] 

   

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও প্রতিকার জানালেন ড. তপন দে



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনার সাম্প্রতিক ছবি

সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনার সাম্প্রতিক ছবি

  • Font increase
  • Font Decrease

গত শনিবার দুপুর থেকে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় অগ্নি দুঘটনায় তিন দিনব্যাপি আগুনে ৫ একরের বেশি বন পুড়ে গেছে। এনিয়ে ২২ বছরে ২৪ বার অগ্নিকাণ্ডে ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অংশ এই বন। এতবার ধুর্ঘনার পরও কেন রোধ করা যাচ্ছে এই প্রবণতা, জানতে বার্তা২৪.কম কথা বলেছে সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে’র সঙ্গে।

বনবিভাগে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকালে তিনি কর্মরত ছিলেন সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশেও। সুন্দরবনে করমজল ও হারবাড়িয়ায় বনবিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নেও ছিলেন মুখ্য দায়িত্বে। সেইসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জানিয়েছেন সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের কার্যকারণ ও করণীয় সম্পর্কে। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম। 

বার্তা২৪.কম: সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনা আসলে কি কারণে ঘটে? অতীতে দুর্ঘটনাগুলো তদন্তে কি কারণ বেরিয়েছে এসেছে...

ড. তপন কুমার দে: আপনি জানেন যে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে খালগুলি নাব্যতা হারিয়েছে। আগে সুন্দরবনের সঙ্গে মেইনল্যান্ড ডিটাচ ছিল, এখন নাব্যতা হারিয়ে একত্র হয়ে গেছে। অতীতে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করতে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে আমরা চেষ্টা করেছি। যেহেতু নাব্যতা সংকটে এখন জোয়ার-ভাটার পানি ঢুকে না সেকারণে সুন্দরীর মতা গাছগুলো কমে গেছে। তাতে ছন জাতীয় ঘাসের আধিক্য বেড়েছে। স্থানীয়রা নিজেরা ছন সংগ্রহ করে আর এটাকে গোচারণ ভূমি বানিয়ে ফেলেছে। আমার ধারণা, তারাাই আগুনাটা লাগিয়ে থাকতে পারে-যাতে ছনটা পুড়ে নতুন ঘাস হয়, তাতে গরু-ছাগল চরাতে সুবিধা হবে। এটাই মেইন কারণ। ওদের একটা ইলমোটিভ আছে। আগেও অনেকবার হয়েছে। অনেকবার বৈঠক করেছি, যাতে আগুন না দেয় কিন্তু তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। এটা ইন্টেনশনাললি। মৌচাকে মৌমাছি তাড়াতে আগুন দেওয়া থেকে অগ্নিকাণ্ড হলেও হয়ে থাকতে পারে-তবে ওই এলাকায় এর সম্ভাবনা কম।

বার্তা২৪.কম: তাহলে কিভাবে নিরাপদ করা যাবে সুন্দরবনকে?

ড. তপন কুমার দে: সুন্দরবানকে বাঁচাতে হলে খালগুলোর গভীরতা বাড়াতে হবে এবং মেইনল্যান্ডের সঙ্গে বনকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। এতে বাঘের লোকালয়ে আসার প্রবণতা কমবে। কমবে স্থানীয়দের গরু চরাতে সুন্দরবনে ঢোকার অত্যাচারও। চারদিকে খাল ও নালার নাব্যতা থাকলে কোনভাবে আগুন লাগলেও ফায়ারলাইন কাটা যাবে। খালে নাব্যতার কারণে বেশিদূর ছড়াতে পারবে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শরণখোলা রেঞ্জে ঢোকার মুখে বলেশ্বরে আমরা নতুন করে অনেক গাছ লাগিয়ে বনায়ন করেছি। যেখানে সুন্দরী হয় না। লোনা পানি আসে না। অন্যখানে এরকম থাকলে সেখানেও এভাবে বনায়ন করা দরকার। ঘনবন থাকলে অনেক সমস্যাই নিরসন হবে। ইতিমধ্যে সেখানে ভালো বনায়ন হচ্ছে। খাল খনন করে যদি উঁচু জায়গাতে গাছ লাগিয়ে ঘনবন সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক পার্টিশন (খাল প্রবাহমান করে) করা য়ায় তবে লোকজন আর ঢুকবে না। ইলমোটিভগুলো আর চরিতার্থ করতে পারবে না। এটা বনের জন্যও ভালো আর আমাদের সবার জন্যও ভালো।

বার্তা২৪.কম: এ ধরণের অগ্নিদুর্ঘটনা দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের জন্য কি ক্ষতির কারণ হতে পারে?

ড. তপন কুমার দে: যেকোন ফায়ার হ্যাজার্ড হলে তো ছোটবড় বিভিন্ন প্রাণিদের জন্য ক্ষতির কারণ। পুরো ইকোসিস্টেম এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনজ খাদ্যশৃঙ্খলে বড় রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বারবরই এখানে ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিটা প্রটেকশন দিতে হবে। ফায়ার হ্যাজার্ড কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়। এ এলাকায় যেহেতু অনেক আগে থেকে রেকর্ড আছে ..মূলকারণ যেটা বললাম লোকজন সেখানে গরু চরায়। লতাপাতা থাকলে যেখানে যাতায়াতে সমস্যা। বাঘের থেকে মুক্ত থাকার জন্য, গরু চরানোর জন্য স্থানীয় লোকজন এগুলো করে লাকড়ি সংগ্রহ করতে পারে। অনেকটা রামরাজত্ব কায়েমের মত ব্যাপার। আমি যখন ছিলাম তখন অনেক মামলা মোকাদ্দমা হয়েছে।

তবে এই আগুনে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে তা নয়। যদি নতুন ঘাস উঠে আর প্রটেকশন থাকে তাহলে হরিণের জন্য ভালো। যেমন জামতলা, কচিখালী-হরিণ সেখানে ঘাস খেতে পারে, ঘুরতে পারে। এই অগ্নিকাণ্ড হরিণের চারণ ভূমি হবে।

বার্তা২৪.কম: বনের ঘনত্ব বাড়াতে এই মুহূর্তে আর কি করণীয়?

ড. তপন কুমার দে: যেসব গাছে ফায়ার হ্যাজার্ড হয় না, বন্যার পানিতেও ক্ষতি হয় না যেমন রেইনট্রি, জারুল-এগুলো এখানে লাগানো যেতে পারে (আমরা আগেও ট্রাই করেছি)। এতে বনেরও উন্নতি হবে, ফায়ারহ্যাজার্ডও হবে না। এই দুইটা কাজ করতে হবে। আমি থাকলে তাই করতাম। বনের ভেতরে করমজল, হারবাড়িয়া-প্রকল্পগুলো আমার করা। আমরা গবেষণা বেশি করি, কথা বেশি বলি-কিন্তু কাজ করি না। কাজে বেশি মনযোগী হতে হবে।

;

কটিয়াদীতে ২ বছরে ৫০ পুকুর ভরাট, পরিবেশে বিরূপ প্রভাব



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

কয়েক বছর আগেও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার পৌর এলাকায় ছিল ২৫টির বেশি পুকুর। বর্তমানে সেখানে চার থেকে পাঁচটি পুকুর টিকে আছে। এর মধ্যে দুটি অর্ধেক ভরাটের পথে। সবগুলো পুকুরের বয়স শতবর্ষ ছুঁইছুঁই!

এছাড়াও উপজেলা জুড়ে সেই একই অবস্থা। দুই বছরে প্রায় ৫০টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। পুকুর কমতে থাকায় পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। এ কারণে পানি সংকটে পড়েছে প্রাণীকুল।

অপরদিকে, গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল এ বাজার ও আবাসিক এলাকায় আগুন লাগলে পানির সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে, ক্রমশই সমস্যার গভীরতা বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইন অমান্য করে অবাধে একের পর এক পুকুর ভরাট করে সেখনে বাণিজ্যিক প্লট ও বহুতল আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে।
গত দুই বছরে পৌর এলাকায় কম করে হলেও ১০টি পুকুর ভরাট হয়েছে। জমির মালিকেরা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে এসব পুকুর ভরাট করছেন। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও পৌরসভার তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি।

কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালের সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

এলাকাবাসী সূত্রে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, যে পুকুরগুলো ভরাট হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে কটিয়াদীর পৌর এলাকার ভোগপাড়া কুড়িবাড়ি, পশ্চিমপাড়া মেতির বাড়ি, কান্তিবাবুর বাড়ি সংলগ্ন, লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন (ভরাট চলমান), ত্রিরত্ন মন্দির সংলগ্ন, বাসট্যান্ড পুকুর, লালিবাড়ি, রাধানাথ সাহা বাড়ি মোড়, বীরনোয়াকান্দি মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় দুটি পুকুর, পশ্চিম পাড়া দুটি), বীরু সাহার পুকুর (ভরাট চলমান)।

এছাড়াও অর্ধশত ছোট জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরো অনেক পুকুর ভরাট হয়েছে ও হচ্ছে। তাদের কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দফতরেও নেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য।

উপজেলার সবকটি ইউনিয়নগুলোর চিত্র সেই একই রকম। প্রতিনিয়ত অনেক পুরনো পুকুর ভরাট হচ্ছে। জালালপুর কুটির বিল, দুর্গা বিলসহ আরো অনেক বিল প্রতিদিন বেদখল হচ্ছে।

কটিয়াদীর (কিশোরগঞ্জ) পৌর এলাকায় চলছে পুকুর ভরাটের কাজ, ছবি- বার্তা২৪.কম

এমন কী পৌর এলাকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ নদের চড়িয়াকোনা অংশে মাটির বাঁধ দিয়ে ও স্থাপনা করে দখল করে রাখা হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করে এবং সংশ্লিষ্টদের তদারকির গাফিলতি ও অদক্ষতার সুযোগে এভাবেই জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।

পৌরসভার পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা সুজিৎ ঘোষ ও আব্দুর রহিম বলেন, এলাকায় কয়েকটি পুকুর ছিল। কিন্তু রাতারাতি সেগুলো ভরাট করে চড়া দামে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন মালিকেরা। তাদের কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।

কটিয়াদী সরকারি ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক শাহ্ আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'পানি ও প্রকৃতি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। জলাধার না থাকলে প্রাণীকুল ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও আগুন লাগলে পানির অভাবে বড় সমস্যার কারণ হবে। প্রশাসনসহ এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। পুকুর-জলাশয়গুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

কটিয়াদী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসার আতিকুল আলম বলেন, ‘পুকুর ভরাটের খবরটি আসলেই দুঃখজনক! পানির অভাবে আগুন নেভাতে গিয়ে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের যে গাড়ি, তাতে ১৮শ লিটার পানি ধারণ করা সম্ভব। এটা দিয়ে ২০ মিনিট পানি দিতে পারবো। বাকি পানির জন্য পুকুর বা জলাশয়ের প্রয়োজন পড়বে। স্থাপনা করার সময় ফায়ার সেফটি বিষয়ে সবাইকে খেয়াল রাখা জরুরি’।

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মতিন জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পুকুর ভরাটের কথা জানতে পারেন না। জেলা শহরে কয়েকটি পুকুর ভরাট বন্ধ করে দিয়েছেন।

তিনি জানান, কটিয়াদীর বিষয়টি খোঁজ নিয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে এভাবে ভরাট করতে দেওয়া হবে না।

তবে তিনি এটাও জানান যে, লোকবল সংকটের কারণে তাদের রুটিন তদারকি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ঘটনা জানতে পারলে তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন বলে জানান এই পরিচালক।

 

 

;

তাজিয়াকাটা চরের রাজকাঁকড়া



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি ও বন্যপ্রাণী চিকিৎসা ও প্রজনন বিশেষজ্ঞ
-কক্সবাজারের মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরে রাজকাঁকড়া।

-কক্সবাজারের মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরে রাজকাঁকড়া।

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশেষ কিছু বিরল পরিযায়ী পাখির খোঁজে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। কিন্তু কুমিল্লায় এসে হাইওয়ে রেঁস্তোরায় বিরতির পর গাড়ি মহাযানজটে পড়ল। রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। এত রাতে কেন এত যানজট তা বোধগম্য হলো না। অনেক চেষ্টার পর জানা গেল কিছুক্ষণ আগে একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকার কারণে জানজটের সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এগুলো না সরানো পর্যন্ত যানজট বাড়তেই থাকবে। অতএব, কোনো দুঃশ্চিন্তা না করে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। বাস জার্নিতে ঘুম দেয়া আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। ভালোই ঘুম হলো। আর সেই ঘুম ভাঙ্গল চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতু পার হওয়ার পর বাস যখন জ্বালানি নিতে পেট্রোল পাম্পে থামল তখন। কিন্তু আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল নয়টা বাজে। অথচ সকাল আটটায় কক্সবাজার পৌঁছার কথা ছিল। এর ফিশারি ঘাটে গিয়ে স্পিড বোটে ওঠার কথা। অথচ এখনও আমরা মাত্র চট্টগ্রাম পার হয়েছি।

যা হোক, শেষমেষ বাস কক্সবাজার পৌঁছল দুপুর ঠিক একটায়। ফলে সোনাদিয়া যাওয়া হলো না। কাজেই বিরল পরিযায়ী সৈকত পাখি দেখার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা ফিশারি ঘাটে চলে গেলাম। হাতে মাত্র দু’ ঘন্টা সময়। গাইড গিয়াস উদ্দিনকে ফোন দিয়ে তার পরামর্শে বেলা তিনটায় মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরের দিকে স্পিডবোট ছোটালাম। পথে বদরকৈতর (Brown-headed Gull), ছোট পানকৌড়ি (Little Cormorant) ও গোতরা (Common Green Shank) দেখে আধ ঘন্টা পর তাজিয়াকাটা চরে পৌঁছুলাম।

তাজিয়াকাটা চরে নেমেই গোতরা, লাল-পা পিউ (Common Redshank), বড় ও ছোট টিটি জিরিয়া (Greater & Lesser Sandplover) ইত্যাদি সৈকত পাখির ছবি তুলে যে যার মতো চরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লাম নতুন পাখির সন্ধানে। প্রায় ঘন্টাখানেক পাখি খোঁজার ও ছবি তোলার পর আমাদের সঙ্গে আসা অপু নামে একজনের মোবাইল ফোনের মেসেজ পেয়ে ওর দিকে ছুটলাম।

মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরে জীবিত জীবাশ্ম রাজকাঁকড়ার পার্শ্বচিত্র

অপুর কাছাকাছি আসতেই সে বলল- ‘স্যার, কচ্ছপের মতো দেখতে এটা কী?’ কাদা পানিতে পড়ে থাকা প্রাণীটিকে পরীক্ষা করেই আনন্দে ফেটে পড়লাম! আরে, এ যে দেখছি এক জীবিত জীবাশ্ম! নতুন পাখি খুঁজতে এসে এমন এক প্রাণীর দেখা পাব ভাবতেই পারিনি! জীবিত জীবাশ্মটির ছবি তুলে ও ভিডিও করে সূর্য ডোবার আগে বাকি সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানেও পেলাম আরেকটি জীবিত জীবাশ্ম। সেটির ছবি তুলতে তুলতে আলো পড়ে এলো। এরপর আমরা সবাই স্পিড বোটের দিকে এগিয়ে গেলাম।

তাজিয়াকাটা চরে দেখা জীবিত জীবাশ্মটি আর কেউ নয়, এদেশের এক সংকটাপন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী রাজকাঁকড়া। সাগর কাঁকড়া বা অশ্বক্ষুরাকার কাঁকড়া নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Mangrove Horse-shoe Crab, Round-tail Horse-shoe Crab বা Sunderban Mangrove Horse-shoe Crab। নামে যদিও কাঁকড়া, আদতে এটি কাঁকড়ার চেয়ে বরং কাঁকড়াবিছা (Scorpion) ও মাকড়সার (Spider) নিকটাত্মীয়।

জীবিত জীবাশ্ম রাজকাঁকড়ার সামনের অংশ

সন্ধিপদী (Arthropods) পর্বের ম্যালাকোস্ট্রাকা (Malacostraca) শ্রেণীর জিফোসুরা (Xiphosura) বর্গের লিমুলিডি (Limulidae) গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Carcinoscorpius rotundicauda। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে প্রাণীটির দেখা মেলে।

রাজকাঁকড়ার দেহ মূলত তিন ভাগে বিভক্ত, যেমন- প্রোসোমা বা মাথা (ঘোড়ার ক্ষুরাকারের সামনের অংশ যাতে মস্তিষ্ক, মুখ, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও গ্রন্থিতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে; এছাড়াও মাথায় রয়েছে দুটি যৌগিক চোখসহ মোট নয়টি চোখ এবং আরও কিছু লাইট রিসিপটর), অফিস্তোসোমা বা উদর (প্রোসোমার পিছনের কাঁটাযুক্ত ত্রিকোনাকার অংশ যা প্রাণীটির চলাফেরা, নিরাপত্তা ও শ্বাসপ্রশাসের কাজ চালায়) ও টেলসন বা লেজ (লম্বা, চোখা ও গোলাকার লেজটি দেখতে যতই ভয়ংকর হোক না কেন, আদতে এটি না বিপদজনক, বিষাক্ত বা কাঁটা ফুটানোর জন্য ব্যবহার করা হয়; বরং লেজের মাধ্যমে এরা পিঠে চাপ দিয়ে উল্টে যাওয়া দেহকে সোজা করে থাকে)।

তাজিয়াটায় প্রাপ্ত প্রথম রাজকাঁকড়াটি উল্টে যাওয়ার পর নিচের অংশগুলো দেখা যাচ্ছে

যুগ যুগ ধরে জীববিজ্ঞানীদের কাছে এটি জীবিত জীবাশ্ম হিসেবে পরিচিত। কারণ, এর শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তিত হলেও শারীরস্থানিক গঠন অর্থাৎ বহিঃকংকালের তিনটি অংশ প্রোসোমা, অফিস্তোসোমা ও টেলসন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন সময় ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। রাজকাঁকড়ার ৪০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো জীবাশ্ম দেখতে হুবহু বর্তমানকালের রাজকাঁকড়ার মতোই।

পৃথিবীতে রাজকাঁকড়ার যে চারটি প্রজাতি রয়েছে তাদের মধ্যে আমাদের দেশেরটি ক্ষুদ্রতম। অন্যান্য প্রজাতির মতো এটিরও স্ত্রী পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয়। স্ত্রী ও পুরুষের প্রোসোমা যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ সেন্টিমিটার (সেমি) চওড়া হয়ে থাকে। আর গোলাকার লেজটিও প্রায় ১২ থেকে ১৪ সেমি হতে পারে। এদের ছয় জোড়া পা রয়েছে। সামনের একজোড়া পা খাবার ধরার কাজে ও বাকি পাঁচ জোড়া পা চলাফেরার কাজে ব্যবহার করে। দেহের উপরের রং জলপাই-বাদামি ও নিচের অংশের রং খয়েরি।

তাজিয়াকাটা চরের পাড়ে প্রাপ্ত দ্বিতীয় রাজকাঁকড়াটির দেহের উপরের অংশ

রাজকাঁকড়া দেশের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল, যেমন- কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপপুঞ্জ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল, যেমন- সুন্দরবনে দেখা যায়। এরা জীবনের বেশিরভাগ সময় সাগর বা নোলাজলের তলদেশে কাটায়। নিশাচর এই প্রাণীটি উপকূলীয় অগভীর জলের পলিময় নরম ও বেলে মাটিতে বাস করে। সচরাচর জলজ কীটপতঙ্গের শূককীট, ছোট মাছ, ক্ষুদে কাঁকড়া, পাতলা খোসার ঝিনুক, শ্যাওলা ইত্যাদি খায়। এদের কোনো চোয়াল বা দাঁত না থাকায় পিছনের পায়ের মাধ্যমে খাবার ভেঙে সামনের পা দু’টি দিয়ে মুখে পুরে।

বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শুরু এদের প্রজননকাল। এরা পূর্ণিমার রাতে ভরা জোয়ারের সময় প্রজনন করে। এ সময় এরা নিজেদেরকে জড়িয়ে ধরে সমুদ্র সৈকতে আসে। স্ত্রী নরম বালি খুড়ে বাসা তৈরি করে তাতে ডিম পাড়ে। আর পুরুষ সেই ডিমের উপর শুক্রাণু ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলো নিষিক্ত করে। এভাবে স্ত্রীটি কয়েকবারে প্রায় ১০ হাজার ডিম পাড়ে। এদের ডিম সরীসৃপ, পাখি ও মাছের প্রিয় খাবার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খুব কম ডিমই ফোটার সুযোগ পায়। যাহোক, ডিমগুলো এসব শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেলে ডিম ফুটে শূককীট বের হতে প্রায় দু’সপ্তাহ সময় লাগে।

দ্বিতীয় রাজকাঁকড়াটির দেহের নিচের অংশ

শূককীটগুলো দেখতে হুবহু বয়স্ক রাজকাঁকড়ার মতো, শুধু আকারেই ছোট এবং এদের লেজ থাকে না। এরপর এই শূককীটগুলো সমুদ্রে চলে যায় ও সমুদ্রের বালুময় তলায় টাইডালে ফ্ল্যাটে অবস্থান করে এবং এভাবে প্রায় বছরখানেক থাকে। এরপর খোলস পাল্টিয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে আকারে বড় হয় ও সমুদ্রের আরও গভীরে চলে যায়। প্রায় দশ বছরে ১৬ থেকে ১৭ বার খোলস পাল্টে এরা প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীতে পরিণত হয়। এদের আয়ুষ্কাল প্রায় ২০ বছর।

যদিও এদেশে রাজকাঁকড়ার সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, তথাপি বিজ্ঞানীর মনে করেন নানা কারণে, যেমন- অতিরিক্ত শিকার, পরিবেশ দুষণ, আবাস ধ্বংস ইত্যাদি কারণে গত ২৫ বছরে দেশের ৩০% রাজকাঁকড়া বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। আর একারণেই এরা বর্তমানে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। কাজেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই জীবিত জীবাশ্মটিকে রক্ষায় আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।

;

মোংলা-ঘোষিয়াখালী ক্যানেলের তীরভূমি দখলের মহোৎসব: নাব্যতা হারানোর শঙ্কা



মনিরুল ইসলাম দুলু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বাগেরহাট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

মোংলা-ঘোষিয়াখালী ক্যানেলের তীর ও প্লাবনভূমির হাজার একর সরকারি চরভরাটি জমি দখল করে মাছ চাষের মহোৎসব চলছে।

এসব জমি দখলে নিয়ে বড় বড় খামার করে মাছচাষ করাসহ বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেছেন অনেকেই। এতে সরকারের হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চ্যানেলের তীর ও প্লাবনভূমির পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নতুন করে হুমকিতে পড়েছে চ্যনেলটি। এতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ও মোংলা বন্দরও হুমকিতে পড়ার ফের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাগেরহাট জেলা কালেক্টর, বাগেরহাটের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্টদের উদাসিতা ও নজরদারির অভাবে এত বিপুল পরিমাণ মূল্যবান জমি বা তীরভূমি বেহাত হতে চলেছে বলে পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন মহল অভিযোগের আঙুল তুলেছে।

মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেল

জানা গেছে, মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেলটি ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে এটি নাব্যতা হারায়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে প্রায় ৫ শত কোটি টাকা ব্যয়ে চ্যানেলটি খনন করে উম্মুক্ত করা হয়।

চ্যানেলটির নাব্যতা রক্ষায় মূল চ্যানেলটির ৫ কিলোমিটার এলাকা বাদ দিয়ে রোমজাইপুর পয়েন্টে লুফ কাট দিয়ে আলাদা করা হয়। ৫ কিলোমিটার এলাকা লম্বা ও প্রায় ৩শ মিটার চওড়া নদীর মূল অংশ খনন না করায় এটি এখন শীর্ণকায় খালে পরিণত হয়েছে, যা মুজিবনগর ও রোমজাইপুর পয়েন্টের বড়দিয়া, ছোটদিয়া, কুমারখালী মৌজার কালিগঞ্জ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।

পাঁচ কিলোমিটার চ্যানেলের অংশে ৬০-এর দশক থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নদী ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে প্রায় হাজার একর জমি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এটি রক্ষণাবেক্ষণেও সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের নানান অসামঞ্জস্যতা রয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নদী ভাঙনের পর চরভরাটি জমি এক শ্রেণির কথিত ভূমিহীন ও ভূমিদস্যুরা রামপালের সেটেলমেন্ট অফিস ও রামপালের সহকারী কমিশনারের অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে তঞ্চকি কাগজপত্র তৈরি করে রেকর্ড করে নেন। এমনকী তারা কেউ কেউ আদালতে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে জমি হাতিয়ে নিয়েছেন। ব্যক্তি মালিকানার জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে অপর পাড়ে চর পড়লে সেটিও ভূমিদস্যুরা কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানায় নিয়ে নেয়, যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে বলে সচেতন মহল মনে করেন।

নতুন করে মুজিবনগর পয়েন্টে ভূমিদস্যুরা আবারও নদীর তীরভূমি ও প্লাবনভূমি দখল করে বেড়িবাঁধ দেওয়া শুরু করেছে।

গিলাতলার মিজান মল্লিকের নেতৃত্বে মুজিবনগর গ্রামের শেখ ইলিয়াসের ছেলে শেখ বেলাল, রুস্তুম শেখের ছেলে শেখ মুকুল, শেখ শরিফুল, শেখ সাইফুল ও শেখ সোলাইমানের ছেলে শেখ আরিফ এবং মৃত শেখ মাহাতাবের ছেলে মোজাফফর হোসেন বেড়িবাঁধ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ের মল্লিক মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।

শেখ বেলাল, মুকুল, আরিফ ও শরিফুল বলেন, সবাই সরকারি খাস জমি দখল করে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। আমরা বাঁধ দিতে গেলে মিজান মাস্টারের লোকজন বাধা দিচ্ছে। সবাই জমি ঘিরেছে। আমরা ঘিরলে দোষ হচ্ছে!

মোংলা-ঘোষিয়াখালী ক্যানেল

এ ব্যাপারে ‘মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র সদস্য সচিব মোল্লা আব্দুস সবুর রানা অভিযোগ করে বলেন, বাগেরহাট জেলা কালেক্টর, সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএ’র নজরদারির অভাবে হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি বেহাত হয়েছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়েছে চ্যানেলটি।

এ বিষয়ে রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা বলেন, মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় সব কিছু করা হবে। সরকারি জমি অবৈধভাবে দখলকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জনবল সংকটের কারণে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

;