গৌরবের দীপশিখা হয়ে ফিরছেন খাসিয়া বীর



আশরাফুল ইসলাম, ইতিহাস গবেষক ও পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বনাঞ্চল ও পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত উপমহাদেশের বহু জনপদে মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন করেন যেই আদিবাসীরা, সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় তারাই ছিটকে পড়েন সবার আগে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের পথ ধরে বহু প্রাণের বিনিময়ে আসে কাঙ্খিত যে স্বাধীনতা সেখানে গৌরবের বরমাল্যে তাদের আমরা ভূষিত করিনি। যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতেই পারেনি আমাদের উপভোগ করা স্বাধীনতার চড়া মূল্য আসলে কারা পরিশোধ করে গেছেন! প্রকৃত বীরদের পশ্চাতে রেখে কপটতা আর চাতুর্যের দৌলতে অনেকেই মেকি বীরের ভেক ধরেছেন যুগে যুগে। কিন্তু অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ পটভূমিকায় যে অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমরা ভুলে গেছি, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ তাতে আরও ছায়া ফেলেছে।

ইউ তিরৎ সিং তেমনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাকে আমরা আমরা ভুলে গেছি। বর্তমান ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় অঞ্চলের রাজা তিরৎ সিং নিজ রাজ্যকে রক্ষায় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে চার বছরব্যাপী এক রক্তাক্ত সংগ্রামে পরাজিত ও আহত অবস্থায় আটক হয়ে ঢাকাতে কারাবন্দি হন। এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে-১৮৩৫ সালের ১৭ জুলাই ঢাকায় কারাবন্দি অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। খণ্ডিত স্বদেশে ম্রিয়মান স্বাধীনতার চেতনায় ‘খাসিয়া বীর’ ইউ তিরৎ সিং নামটি প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল! সাম্প্রতিক দশকে মেঘালয়-আসামের প্রজন্মের কাছে তিরৎ সিংয়ের বীরোচিত উপাখ্যান প্রেরণা ও জাগরণের বিষয় হয়ে ফের ধরা দিয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের আনুকূল্যে তা হয়ে উঠে সার্বজনীন আগ্রহ ও আবেগের বিষয়। গড়ে ইউ তিরৎ সিংহের নামে সৌধসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো। আঞ্চলিক সাহিত্য ও সঙ্গীতেও উৎকীর্ণ হয়েছে তার বীরত্বগাঁথা।

সেই সঙ্গে দাবি উঠে, অকুতোভয় এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনের শেষ দিনগুলির স্মৃতিবিজড়িত ঢাকায় তার স্মৃতি রক্ষায় কিছু প্রচেষ্টা নেওয়ার। জনাকাঙ্ক্ষার সেই প্রতিফলনও অবশেষে বাস্তব হতে চলেছে। আমরা জানতে পেরেছি, মেঘালয় সরকারের আগ্রহে এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ও আনুকূল্যে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ব্যবস্থাপনায় ধানমন্ডিতে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে স্থাপিত হয়েছে খাসিয়া বীর ইউ তিরৎ সিংয়ের পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য। আরও আনন্দের খবর যে, মেঘালয়ের উপমুখ্যমন্ত্রী স্নিয়াভলং ধরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তিরৎ সিংয়ের ভাস্কর্য উন্মোচনে ঢাকায় আসছেন। তাদের এই সফর যেমন খাসিয়া জনগোষ্ঠীর আবেগকে স্পর্শ করবে তেমনি বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে। কেননা মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী জনপদে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসী ও ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে যে অকৃত্রিম সাহায্য ও সহযোগীতা করা হয়েছে তা আজও মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এই সফর নাগরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিকে আরও নিবিড় করে তুলতে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করা যায়।

সফরকালে মেঘালয়ের প্রতিনিধি দলের পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কে অবস্থিত পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার (যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তর করার কাজ চলমান) পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের গৌরবের নাম তিরৎ সিংয়ের বন্দিদশার বেদনাবিদূর স্মৃতিকে ছুঁয়ে দেখার ব্যাকুলতা নিয়ে আসা মেঘালয়ের প্রতিনিধিরা হয়ত দেখার মতো কোন স্মৃতিই আজ আর অবশিষ্ট পাবেন না। কেননা শাসনতান্ত্রিক পালাবদলে প্রায় দুশো বছরের পুরনো সেই ঘটনার কিছুই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি পরবর্তীতে। কিন্তু আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ ইউ তিরৎ সিংহের স্মৃতিকে ধরে রাখতে কারা জাদুঘর হিসেবে উন্মোচিত হতে চলা জাদুঘরে তার একটি ভাস্কর্য লিখিত ইতিহাসসহ স্থাপনের দাবি জানাতেই পারি।

কেবল তিরৎ সিং নন, এই কারাগারে অন্তরীণ থাকা ও ফাঁসি কার্যকর হওয়া ব্রিটিশবিরোধী অন্য সকল স্বাধীনতা সংগ্রামীর সচিত্র বিবরণ উৎকীর্ণ করারও দাবি জানাব। আমরা জানি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাকিস্তান শাসনামলে বহু বরেণ্য রাজনীতিক অন্তরীণ ছিলেন; আমরা এও জানি এই কারাগারেই জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সকল বীরদের আত্মত্যাগের মহিমা ভাস্বর হয়ে উঠুক সংস্কারাধীন এই কারা জাদুঘরে, এটি আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা। 

সাম্প্রতিক বছরে দেখে এসেছি, কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গৌরবদীপ্ত ও বেদনাসিক্ত আখ্যান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কিভাবে মূর্ত করে তোলা হয়েছে।  গেল বছর আরও দেখে এসেছি পশ্চিমবঙ্গের খড়কপুরে হিজলী বন্দিশালা, যা বর্তমানে আইআইটি, খড়কপুরের অভ্যন্তরে অবস্থিত। সেখানে বন্দিশালায় স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত মেরে ফেলার সেই নিষ্ঠুর কারাকুঠুরি! নূন্যতম আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ না রেখে কিভাবে তথাকথিত ‘সভ্য জাতি’ ব্রিটিশরা স্বাধীনতার আকাঙ্খা পোষণের ‘অপরাধে’ এমন নিষ্ঠুর কারাপ্রকোষ্ঠ বানাতে পারেন দূরকল্পনাকেও হার মানাবে। 

গেল ২৩ জানুয়ারি (২০২৪) ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশের জামশেদপুরের আদিত্যপুরে গিয়েছিলাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মোৎসবের এক মহা আয়োজনে যোগ দিতে। সেই আয়োজনের পুরোধা দেশভক্ত ও বিপ্লবীদের অনুরাগী পি কে নন্দী অরণ্যবেষ্টিত ঝাড়খ-ে অরণ্যচারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্বর ব্রিটিশ বাহিনীর অন্যায় করারোপের প্রতিবাদে রুষে উঠার আখ্যান মেলে ধরেছিলেন তাদের স্থানীয় ‘ছৌনাচ’ এর মাধ্যমে। যেখানে আমরা জানতে পারি, পশ্চাদপদ জনপদের আদিবাসীরাও কিভাবে প্রাণপণে লড়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য, তাদের স্বাধীকারের জন্য। সেখানকার মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর বীরযোদ্ধা বিরসা মুণ্ডা তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিরসা মুণ্ডার সেই বীরোচিত আখ্যান আজ নানা লোকজ সাংস্কৃতিক মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বিরসা মুণ্ডা আজ এক শক্তি ও প্রেরণার নাম।

পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর ক্রমান্তরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ ব্রিটিশশাসনের করতলে আসতে থাকে। আসামসহ ও উত্তর-পূর্ব ভারত অধিকারে আনতে তৎপর ব্রিটিশ বাহিনী সিলেট থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত দুর্গম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণে খাসিয়া রাজা ইউ তিরৎ সিংয়ের শরণাপন্ন হন। ১৮২৭ সালে সড়ক নির্মাণের জন্য ব্রিটিশদের অনুমতি দিলেও অচিরেই তাদের অভিসন্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই অনুমতি যে খাসিয়াদের শোষণের হাতিয়ার হতে চলেছে, তিরৎ সিং তা বুঝতে পারেন এবং সড়ক নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেন।

যদিও ইংরেজরা তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলশ্রুতিতে নিজস্ব স্থানীয় সমরশক্তি ও খাসিয়া অধিবাসীদের অপরিসীম মনোবল সঙ্গী করে তিরৎ সিং ১৮২৯ সালের ৪ এপ্রিল ইংরেজদের হটাতে প্রবল আক্রমণ শুরু করেন। এতে বহু ইংরেজ সেনাদের সঙ্গে প্রাণ হারান দুই ইংরেজ সেনাকর্তা লেফট্যানেন্ট বার্লটন ও লেফট্যানেন্ট বেডিংফিল্ড। রক্তাক্ত এই যুদ্ধ চলে চার বছর ধরে। কিন্তু ইংরেজদের আধুনিক সমরাস্ত্র ও সমরকৌশলে এক পর্যায়ে খাসিয়াদের পরাস্ত হতে হয়, যদিও খাসিয়া যোদ্ধাদের গেরিলা সমরকৌশলে নাস্তানাবুদ হওয়া ব্রিটিশ বাহিনীকে অনেক মূল্য দিতে হয় এই খন্ড যুদ্ধে। আহত খাসিয়া রাজা তিরৎ সিং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেও বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ৯ জানুয়ারি ১৮৩৩ সালে ধৃত হন।

মেঘালয়ের সরকারি নথিপত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, রাজা ইউ তিরৎ সিংকে গুয়াহাটি নিয়ে বিচারের প্রহসন সাজিয়ে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। বন্দিদশায় অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতো এই খাসিয়া বীরকেও কি ধরণের বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। ঢাকায় বন্দিদশায় আরও ২ বছর বেঁচে ছিলেন তিরৎ সিং। ১৮৩৫ সালের ১৭ জুলাই মাত্র ৩৩ বছর বয়েসে মৃত্যু হয় এই অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামীর। গবেষক হারুন হাবিবের লেখায় আমরা জানতে পারছি, প্রথমে ঢাকা কারাগারে অন্তরীন করা হলেও পরবর্তীতে ঢাকার  কোতোয়ালিতে বরকন্দাজের প্রহরায় একটি বাড়িতে বন্দি রাখা হয় তিরৎ সিংকে, বাড়িটির অবস্থায় পুরান ঢাকার গীরদকিল্লায় বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। যা বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরির পাশে।

পরবর্তী সময়গুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মাটিচাপা দেওয়ার যে প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি তাতে ইউ তিরৎ সিংয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, মেঘালয়ের সরকার ও জনগণ যেভাবে তাদের হৃতগৌরকে উচ্চে তুলে ধরতে তৎপর হয়েছে তা খণ্ডিত স্বদেশের অপরাপর অংশকেও জাগিয়ে তুলুক। কেননা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের যে গৌরব এই অঞ্চলের রয়েছে তা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত। গৌরবের পরম্পরাকে এগিয়ে নিতে ব্রাত্য করে রাখা ইতিহাসের চর্চা খুবই জরুরি।

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;