বিপন্ন বনছাগল রক্ষায় যা করা প্রয়োজন



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
কক্সবাজারের ডুলাহাজরার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বনছাগল। ছবি- লেখক

কক্সবাজারের ডুলাহাজরার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বনছাগল। ছবি- লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর (১৯৯৪ সালে) আগে কাপ্তাই পাল্প উড বন বিভাগের ফরেস্টার ও খালাত ভাই মোঃ সফিকুর রহমান বলেছিলেন সেখানকার গহীন অরণ্যে বনছাগল দেখেছেন। সেবার আমি তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে চশমাপড়া ও মুখপোড়া হনুমান এবং রেসাস ও খাটোলেজী বানর ছাড়া অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা পাইনি। এরপর সময় গড়িয়েছে। যতবারই সফি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে, বনছাগলের খোঁজ নিয়েছি। তার চাকুরিকালীন জীবনে তিনি কমবেশি ২০ বার বনছাগল দেখেছেন। যখনই বনছাগল দেখেছেন বা তথ্য পেয়েছেন, আমাকে জানিয়েছেন। 

২০১১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি তার ফোন পেলাম। তিনি বললেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে কিছু উপজাতীয় লোক দু’টি বনছাগলের দেখা পেয়েছিল। খবর শুনে তিনিও রওয়ানা হয়ে যান। উপজাতীয়রা ভোররাতে পাহাড়ের নিচের দিকে বিচরণরত একটি বনছাগলকে তাড়া করেছিল। তাদের তাড়া খেয়ে সেটি কিছুটা আহত হয়েছিল। তিনি আমাকে সেটার ছবি পাঠিয়েছিলেন।

২০১১ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির গহীন অরণ্যে ধরা পড়া আহত বনছাগল। ছবি- মোঃ সফিকুর রহমান 

একদা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনে অবাধে বিচরণ করত বনছাগল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শিকার ও বনভূমি উজাড় এদেরকে করল বিপন্ন; সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেল। গত তিন-চার দশকে এদের আবাস এলাকার প্রায় অর্ধেকই উজাড় হয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা থেকে ২০১১ সালে দু’টি বনছাগল উদ্ধার করে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে রাখা হয়েছিল। খবর পেয়ে ১৫ই জুলাই ওখানে গেলাম ও ছবি তুললাম। যদিও এর আগে ২০০৬ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের রাজকীয় ডুসিত চিড়িয়াখানায় সর্বপ্রথম বনছাগল দেখি ও ছবি তুলি। কিন্তু ২০১১ সালে কক্সবাজারের ডুলা হাজরারস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রথম কোনো বন ছাগলকে স্পর্শ করলাম এবং তার বুনো স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হলাম। সে থেকেই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীনে মাঝে-মধ্যে ওদেরকে দেখার তথ্য পেতে থাকলাম। 

গাছের পাতা খাওয়ারত বনছাগল। ছবি- লেখক 

বান্দরবানের প্রত্যন্ত সাঙ্গু-মাতামুহুরী উপত্যকার স্থানীয় ম্রো বা মুড়ংদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সেখানকার বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাস সংরক্ষণে নিয়োজিত ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’ (সিসিএ)। ২০১৭ সালে তারা ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রথম বান্দরবানে বনছাগলের দেখা যান। পরবর্তীতে ২০২০ সালে আলিকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নে অবস্থিত মাতামুহুরি সংরক্ষিত বনের দুর্গম ইয়ংনং পাড়ায় গিয়ে সিসিএ-এর প্যারাবায়োলজিস্টারা মুড়ং ভাষায় ‘নিয়া’ নামে একটি বিরল তৃণভোজী বাচ্চা প্রাণীকে বাঁধা অবস্থায় দেখেন। মুড়ংরা বাচ্চাটিকে বিক্রি করতে চাচ্ছিল। সিসিএ-এর সদস্যরা এতে বাধা দেয় ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার সিজার রহমানের শরণাপন্ন হয়। পরবর্তীতে তারা বন বিভাগের সহায়তায় বাচ্চাটি উদ্ধার করেন।

এ বছরের আগস্টে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক প্রাণিবিজ্ঞানী স্নেহাস্পদ মুনতাসি আকাশের এক গবেষণায় ব্যবহৃত ক্যামেরা ট্র্যাপে বাচ্চাসহ বনছাগলের ছবি উঠে। গবেষণাটি তিনি বাংলাদেশ বন বিভাগের সুফল স্মল ইনোভেশন গ্রান্ট-এর মাধ্যমে সম্পন্ন করেন। 

ছবি তুলতে গেলে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তেড়ে আসছে বনছাগল। ছবি- লেখক 

ছাব্বিশ ডিসেম্বর ২০২৩-এ সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা বনবিটের ঢুলারা বিজিবি ক্যাম্প এলাকা থেকে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় বিজিবি সদস্যরা লালচে-বাদামি বর্ণের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী উদ্ধার করেন। এরপর তারা প্রাণীটিকে সুনামগঞ্জ বনবিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেন। সুনামগঞ্জ বন বিভাগ এটিকে ট্রাকযোগে সিলেটের বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে সে রাতেই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। 

২০২০ সালে বান্দরবানের আলিকদম থেকে উদ্ধারকৃত বনছাগলের বাচ্চা। ছবি- ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স 

পরেরদিন দুপুরে প্রাণীটিকে শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণী উদ্ধারকারী সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার অ্যান্ডেনজারড ওয়াইল্ডলাইফ (সিউ)’-এর সদস্যদের সহযোগিতায় মৌলভীবাজার বনবিভাগ কমলগঞ্জের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ছাড়ার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত এটিকে ওখানে না ছেড়ে জানকিছড়ায় ফেরত আনা হয়। সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধারণা করেন যে, কোনো অদৃশ্য হাতের ইশারায় বিরল প্রাণীটিকে সাফারি পার্কে পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। কিন্তু, সিউ-এর সদস্য ও মৌলভীবাজারের বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সন্ধ্যার দিকে এটিকে পুনরায় রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আশা করা যায় প্রাণীটি ওখানে টিকে থাকবে। 

২০২২ সালে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ক্যামেরা ট্র্যাপে ছানাসহ বনছাগী। ছবি- মুনতাসির আকাশ 

এতক্ষণ যে বনছাগলের গল্পগুলো বললাম সে হলো এদেশের একটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। বনছাগল বা পাহাড়ি ছাগল নামেই পরিচিত। ইংরেজি নাম সেরাও (Serow), রেড সেরাও (Red Serow) বা মেইনল্যান্ড সেরাও (Mainland Serow)। বোভিডি (Bovidae) অর্থাৎ গরু গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Capricornis rubidus (ক্যাপ্রিকর্নিস রুবিডাস)। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিভিন্ন দেশে বনছাগলের দেখা মেলে। 

সম্প্রতি সুনামগঞ্জ থেকে উদ্ধারকৃত বনছাগলটি। ছবি- খুকন থৌনাজাম 

আকার ও ওজনে বনছাগল গৃহপালিত ছাগলের থেকে অনেক বড়। লম্বাটে ধরনের এই ছাগলের মাথা বড়, মুখ লম্বাটে ও ঘাড় মোটা। খাড়া ও ছুঁচালো কান দুটো অনেকটা গাধার কানের মতো। কালো রঙের পেছন দিকে বাঁকানো শিং দুটো লম্বায় ২৩ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার, যার আগা চোখা। আগাবাদে শিংয়ের বাকি অংশে বলয় বা রিং-এর মতো থাকে। শক্তপোক্ত পা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অনেকটা একই রকম। দৈর্ঘ্য ১.০ থেকে ১.১ মিটার। ওজনে পুরুষ ৭০ থেকে ৭৫ ও স্ত্রী ৫০ থেকে ৫৫ কেজি। দেহের লালচে-বাদামি পশমগুলো রুক্ষ ও লম্বা। লেজ দেশি ছাগলের মতোই ছোট, তবে রোমশ। চোখের চারদিক ও খুরের উপরের পশম সাদাটে। খুর কালো।

এরা ঘন ঘাস-লতাপাতাপূর্ণ খাড়া পাথুরে পাহাড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে। ভূপৃষ্ঠের ২৭০০ মিটার উঁচুতেও বাস করতে পারে। পাহাড়ের খাড়া ঢালে একাকী বা ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। এদের চলাচলের পথ এতটাই সরু যে সরীসৃপ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর পক্ষে চলাচল করা কষ্টকর। ছাগলের মতো এরাও তৃণভোজী ও রোমন্থক প্রাণী। সচরাচর সন্ধ্যা ও ভোররাতে বিচরণ করে। সাধারণত ঘাস, বাঁশের কচি পাতা ও পাথরের গায়ে জন্মানো শেওলা খায়। দিনে পাহাড়ের চূড়ার বড় পাথরের আড়ালে বা গুহায় বিশ্রাম নেয় ও জাবর কাটে। কোনো কোনো সময় পাহাড়ের চূড়ার এমন জায়গায় বসে থাকে যেখান থেকে এদের সীমানার চতুর্দিকে চোখ রেখে বিপদ আঁচ করা যায়।

অক্টোবর থেকে নভেম্বর এদের প্রজনন মৌসুম। বনছাগী ৮ থেকে ৯ মাস গর্ভধারণের পর পাহাড়ের গুহা বা পাথরের ফাঁকে একটি বাচ্চা প্রসব করে। এদের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বর্তমানে এদেশে এদের সংখ্যা কত তা জানা যায়নি। তবে সংখ্যা যে নিতান্তই কম তা সহজেই অনুমেয়। কাজেই এদের সংরক্ষণে এখনই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অচিয়েই বিপন্ন প্রাণীটি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

ডুলাহাজরার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বনছাগলকে আদর করছেন লেখক 

গত ২৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বনছাগলটিকে ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও রাজকান্দি সংরক্ষিত এলাকা। কিন্তু বাস্তবে এর ভিতরে রয়েছে মানুষের অবাধ যাতায়াত। এখানে পানের বরজ, লেবু বাগান ইত্যাদি রয়েছে। কাজেই পুরো বনটিকেই সত্যিকারের সংরক্ষণের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। ছাগলের মাংসের লোভে যেন বনছাগল হারিয়ে না যায়। সেজন্য সরকার, বন বিভাগ ও জনগণ সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই প্রকৃতিতে বনছাগলসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী টিকে থাকবে। আমাদের প্রকৃতি হবে সমৃদ্ধ, যা প্রকৃত অর্থে আমাদেরকেই সমৃদ্ধ করবে।

 

E-mail: [email protected], [email protected]














   

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;

এক ঘরেই তিন বলী



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

  • Font increase
  • Font Decrease

চুল থেকে দাড়ি-সবই সফেদ। হাঁটাচলায় মন্থর। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় প্রথম দেখাতেই। কিন্তু তার ষাটোর্ধ্ব বয়সটা যেন কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। বয়স যতই ছোবল বসানোর চেষ্টা করুক না কেন-তিনি যেন এখনো ২৫ এর টগবগে তরুণ। সেই বলেই তো ফুসফুসের রোগবালাইকে তুড়ি মেরে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা এলেই হাজির হয়ে যান রিংয়ে। এক দুবার নয়, এবার কিনা পূর্ণ হলো সুবর্ণজয়ন্তী!

চট্টগ্রামের অন্যতম আবেগের ঠিকানা ঐতিহাসিক এই বলীখেলার বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা এই বলীর নাম খাজা আহমদ বলী। ৫০ বছর ধরে বলীখেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া এই বলীর এখন পড়ন্ত বয়স। ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে রোগ। কানেও শোনেন কম। খাজা আহমদ বুঝে গিয়েছেন, তার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বলীখেলার স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যেতে চান না। সেজন্যই উত্তরসূরী হিসেবে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন নিজের দুই ছেলেকে। বাবার পাশাপাশি দুই ভাইও এখন বলীখেলার নিয়মিত প্রতিযোগী।

খাজা আহমেদ বলীর বাবাও বলীখেলায় অংশ নিতেন। বাবার সঙ্গে বলীখেলায় এসে ১৯৭৪ সালে শখের বসে খেলতে নামেন খাজা আহমেদও। বয়স তখন ১২ বছরের আশপাশে। সেই শুরু, আর কোনোদিন মিস করেননি বলীখেলায় অংশ নেওয়া। একবার চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বহু বছর ধরে খাজা আহমেদ বলী ও সত্তরোর্ধ্ব মফিজুর রহমানের ‘বলীযুদ্ধ’ জব্বারের বলীখেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দ্বৈরথ হয়তো আর দেখা যাবে না। দুই বছর আগে উৎপত্তি হওয়া ফুসফুসের রোগটা ইদানিং যে খাজা আহমদকে বেশিই ভোগাচ্ছে। সেজন্য গতবছর অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার দুই ছেলেকে নিয়ে বলীখেলায় এসে আবেগ সামলাতে পারেননি খাজা আহমেদ। ছেলেদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রিংয়ে। সেজন্য আরও একবার মফিজুর রহমান-খাজা আহমেদের লড়াই দেখল হাজারো দর্শক। যদিওবা যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন রেফারি।

প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমানের সঙ্গে বলী-যুদ্ধে খাজা আহমদ

কেন অবসর ভাঙলেন এমন প্রশ্নে হাসি খেলা করে যায় খাজা আহমেদ বলীর মুখে। বলতে থাকেন, ‘বয়সের কারণে শরীর দস্ত। ফুসফুসও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সেজন্য অবসর নিয়েছিলাম। কিন্তু বলীখেলায় আসার পর দেখলাম দর্শকেরা সবাই অনুরোধ করছেন। সেজন্য মন বলল, না খেললে দর্শকদের প্রতি অন্যায় হবে। আর আবেগ ও ভালোবাসার কাছে বয়স-রোগ পেরেছে কবে?’

তবে এখানেই সব শেষ, বলে দিয়েছেন খাজা আহমেদ বলী। বলেছেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। মনে হয় না আর খেলতে পারব। অসুখটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেজন্য মনে মনে মেনে নিয়েছি এটাই আমার শেষ অংশগ্রহণ। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা খাজা আহমদের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়। কৃষিকাজ করেই চলে সংসার। তবে বলীখেলা এলে সব কাজ বাধ। কয়েকদিন ধরে চলে প্রস্তুতি। নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে এরই মধ্যে খাজা আহমেদ নিজের দুই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন বলী হিসেবে। ২০১২ সাল থেকে বলীখেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তার বড় ছেলে মো. সেলিম। গত বছর থেকে যোগ দিয়েছেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। এখন বলীখেলার আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে খাজা আহমদের প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমরা বলীখেলা শিখেছি। বয়সের কারণে বাবা এখন অসুস্থ। হয়তো আর খেলা হবে না। সেজন্য তার উত্তরসূরী হিসেবে আমরা বলীখেলায় অংশ নেব সামনের দিনগুলোতে। এটা শুধু পরিবারের বলীর প্রজন্ম ধরে রাখার জন্য নয়, তরুণদের মাদক-সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগও।’

বাবাকে পাশে রেখে একই কথা বললেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। বলেন, ‘হয়তো বাবা আর খেলবেন না। তবে তিনি না খেললেও যতদিন বেঁচে থাকবেন বলীখেলা দেখতে আসবেন। রিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন।’

ছেলের কথা শুনে আবেগ খেলে যায় খাজা আহমেদ বলীর মনে। কাঁধের গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না খেললেও যতদিন বাঁচি এখানে, এই বলীর মাঠ লালদীঘি ময়দানে ছুটে আসব। এটা থেকে দূরে থাকতে পারব না।’

খাজা আহমেদ যখন কথা বলছিলেন দূরে কোথাও তখন মাইকে বাজছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অক্লান্ত গলায় গেয়ে চলেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...

;