দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌন্দর্য ও দ্রৌপদী মুর্মুর অভূতপূর্ব আতিথেয়তা



এম এ আমিন রিংকু
দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌন্দর্য ও দ্রৌপদী মুর্মুর অভূতপূর্ব আতিথেয়তা

দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌন্দর্য ও দ্রৌপদী মুর্মুর অভূতপূর্ব আতিথেয়তা

  • Font increase
  • Font Decrease

হেমন্তে দিল্লির আকাশ মোহনীয় থাকে। অক্টোবরের চোদ্দ তারিখ সেদিন। ফ্রেন্ডস কলোনির হোটেল সুরিয়ায় সকালে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে টিভিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নিচ্ছিলাম। সারাদিনের আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য থাকবে বলে জানলাম। আবহাওয়া দারুণ হলেও সহযাত্রীদের মধ্যে একটা চাপা উদগ্রীবতা দেখতে পেলাম। উদগ্রীবতা থাকারই কথা। আমরা একশ তরুণ ভারতে এসেছি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন প্রকল্পের আওতায় ভারতের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে। আমাদের ট্যুর শিডিউল অনুসারে আজ রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হওয়ার কথা।

পড়ন্ত বিকেলে আমাদেরকে বহনকারী গাড়ি বহর এসে থামল ফোরকোর্টে। গাড়ি থেকে নেমে বামে ঘুরতেই চোখে পড়ল ক্লাসিক ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন; রাষ্ট্রপতি ভবন! হলুদাভ বেলে পাথরে নির্মিত এ ভবনের সৌন্দর্য আর বিশালতা দেখে বিস্ময়ে আমার মত সতীর্থ অনেকেরই মুখ 'হা' হয়ে গিয়েছিল।

এডউইন লুটিয়েনস ও হার্বার্ট বেকারের নকশায় তৈরি এ প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসটি পৃথিবীর সুন্দরতম ভবনগুলোর অন্যতম। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সাংবিধানিক প্রধানের এই বাসভবনটি আকারে আয়তনে সারা দুনিয়ার যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবনের চাইতে বড়। রাষ্ট্রপতি ভবন কমপ্লেক্সটি ৩৩০ একরের সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। চারতলা ভবনটিতে কামরা আছে ৩৪০টি। এ কমপ্লেক্সের ১৯০ একরের বাগানে আছে হাজারও প্রজাতির গাছ।

১৯২৯ সালে যখন ভবনটি তৈরি হয়, তখন এর নাম ছিল ভাইসরয়’স হাউস। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই ভবনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় গভর্নমেন্ট হাউস। পরে রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সময় এর নাম হয় রাষ্ট্রপতি ভবন। ২৯ হাজার লোক ১৭ বছর ধরে এই ভবনটি তৈরি করেন। সাম্রাজ্যিক আধিপত্য এবং ক্ষমতার প্রতীক থেকে, ভবনটি আজ ভারতীয় গণতন্ত্র এবং এর ধর্মনিরপেক্ষ, বৈচিত্র্যময় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐতিহ্যের প্রতীক।

বাংলাদেশ থেকে আগত ইয়ুথ ডেলিগেটসদের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হবে দরবার হলে। ফোরকোর্ট থেকে দরবার হলে ঢোকার জন্য মাড়াতে হবে প্রশস্ত ৩১ খানা সিঁড়ি। লাল বেলে পাথরের সিঁড়িতে গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের জন্য। জীবনের প্রথম লাল গালিচা দিয়ে হেঁটে যাবার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। ভবনের বেদীতে উঠে খানিকটা হেঁটে গেলেই দরবার হল। এই বৃত্তাকার দরবার হলেই রাষ্ট্রপতি উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করা হয় এ দরবার হলেই।

দরবার হলে পা রেখেই একটা অন্যরকম প্রশান্তির পরশে যেন বুকটা শীতল হয়ে গেল। ভবনের সুউচ্চ ছাদ থেকে ঝোলানো মখমলের লাল পর্দার নিচে পাতা আছে রাষ্ট্রপতির জন্য আসন। তার সামনে সারি ধরে পাতা হয়েছে আমাদের জন্য চেয়ার। রাজকীয় চেয়ারে টান হয়ে বসলাম আমরা। কিছুক্ষণ পরেই আসল রাজকীয় ইউনিফর্ম পরা প্রেসিডেন্ট গার্ড। এরপরে পিন পতন নীরবতা। খানিক পরেই ঘোষণা করা হল 'মহামান্য রাষ্ট্রপতি দরবার হলে প্রবেশ করছেন'। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্মান জানালাম। প্রবেশদ্বারের পরে দ্বিতীয় সারিতে আমার আসন। ঠিক পাশ দিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু হেঁটে গেলেন; এ অনুভূতিটা একেবারেই ভিন্নরকম।

আমাদের এ সফরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত ছিল চমকে পরিপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি ভাষণ শুরুর পূর্বে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন 'কেমন আছেন'। ছোট দুটি শব্দ। প্রতিদিন শতবার শুনি আমরা। কিন্তু রাষ্ট্রপতি মুর্মুর মুখে থেকে শব্দ দুটি শুনে আবেগপ্রবণ হয়েছি। কর্ণ ইন্দ্রিয় যেন পুলকিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণের পুরোটা সময় জুড়ে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির প্রশংসা করলেন। জানালেন বাংলাদেশের তরুণদের অগ্রযাত্রায় তার মুগ্ধতার কথা।আগামীতে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় যাবে দৃঢ়তার সাথে সে আশাবাদও ব্যক্ত করলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিনয়ী মানুষটির বক্তব্য শুনছিলাম। আট মিনিটের মোহনীয় বক্তব্য যেন নিমেষে শেষ হয়ে গেল।

দরবার হলের অনুষ্ঠান শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় অশোকা হলে। লং ড্রইংরুম আর ব্যাঙ্কুয়েট হলের সামনের করিডোর দিয়ে যাওয়া যায় অশোকা হলে। রাষ্ট্রপতি ভবনে যতগুলো করিডোর আছে তা একসাথে হিসেব করলে লম্বায় হবে আড়াই কিলোমিটার! করিডোরের দুপাশের দেয়াল জুড়ে বিখ্যাত সব শিল্পীদের চিত্রকর্ম ঝোলানো। পৃথিবীতে কিছু অভিজ্ঞতা নিজে পরখ না করলে সেই অভিজ্ঞতার সুখানুভূতি অন্যকে ঠিকঠাক বোঝানো যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ঠিক এমনই। করিডোরের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা প্রেসিডেন্ট গার্ড। মিষ্টি করে মুচকি হেসে আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন তারা।

আশোকা হলে প্রবেশের পরে হলের দেয়ালে আর ছাদের সুনিপুণ কারুকার্য ও শিল্প কর্ম দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমাদের। রাষ্ট্রপতি ভবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুসজ্জিত হলগুলোর মধ্যে একটি এই অশোকা হল। সুবিশাল ও শৈল্পিকভাবে তৈরি হলটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয়। এখানেই ভারতে অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস প্রধানেরা রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের পরিচয়পত্র পেশ করেন। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজ শুরুর আগে সফররত বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এবং ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরিচিতির জন্য আনুষ্ঠানিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই আশোকা হল। এই হলেই রাষ্ট্রপতির সাথে ছবি তোলার সুযোগ পেলাম আমরা! হলের দুপাশে একসারি চেয়ার আর তার পেছনে দাঁড়াবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সামনের সারির ঠিক মাঝে রাষ্ট্রপতির জন্য আসন, তার দুপাশের দুই চেয়ারে বসবেন দুজন সচিব। আমাদের মেয়েরা প্রথমে সামনের সারিত বসল পরে বাকি ফাঁকা চেয়ারে বসল ছেলেরা। পেছনের সারিতে দাঁড়ালাম আমরা বাকি ছেলেরা। দু গ্রুপের দাঁড়ানো শেষ হলে রাষ্টপতি এলেন। ছবি তোলা শেষে সামনে দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করলেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে ব্যাঙ্কুয়েট হলে বিকেলের নাস্তার আমন্ত্রণ করে জানতে চাইলেন আমাদের এই সফরে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। মানুষের সুখস্মৃতি নাকি ব্রেনের হিপ্পোক্যাম্পাসে সংরক্ষিত হয় পরবর্তী সময়ে বারবার মনে করে পুলকিত হওয়ার জন্য। আমাদের এ ক্ষণটা যেন হিপ্পোক্যাম্পাসের বড় একটা অংশ দখল করে নিল মুহূর্তেই।

অশোকা হলে থেকে বেরিয়ে লুটিয়েনস গ্র্যান্ড স্ট্যায়ারের পাশের করিডোর ধরে খানিক হাঁটলেই আসে ব্যাঙ্কুয়েট হল। লম্বায় ১০৪ ফুট, ৩৪ ফুট চওড়া আর ৩৫ ফুট উচ্চতার এ হলের জৌলুষ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বার্মিজ সেগুন কাঠের প্যানেলিং কার্নিশ থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। আর দেয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড: রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, ড: জাকির হোসেন, ভি.ভি. গিরি, ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ, সঞ্জীব রেড্ডি, গিয়ানি জৈল সিং, আর ভেঙ্কটারমন, ড: শঙ্কর দয়াল শর্মা এবং কে আর নারায়ণন এর বিশাল আকৃতির তৈলচিত্র।

রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধান ও তাদের সফর সঙ্গীদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করা হয় এখানেই। হলের মাঝ বরাবর পাতা আছে লম্বা টেবিল। দুপাশে পাতা রাজকীয় চেয়ার। একসাথে ১০৪ জন এ টেবিলে খেতে পারেন। রানী এলিজাবেথসহ বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্র প্রধানেরা ভারতের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসে খেয়েছেন এ টেবিলেই। আজ আমাদের জন্য এ টেবিল-জুড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা ধরণের খাবার! ব্যাঙ্কুয়েট হলে পুরোটা সময় রাষ্ট্রপতির সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের অমায়িক ও বন্ধুবৎসল ব্যাবহারে বিমোহিত হয়েছে আমাদের সকলেই।

ইয়ুথ ডেলিগেশনের ফ্ল্যাগ অফ ইভেন্টে পূর্বে ভ্রমণ করে যাওয়া ডেলিগেটরা বলেছিলেন, 'জীবনের সেরা অভিজ্ঞতার অর্জন করতে যাচ্ছেন আপনারা'। তাদের প্রতিটি কথার মিল পেয়ে যাচ্ছি নিখুঁতভাবে । এ ট্যুরের প্রতিটি ধাপে যে সন্মান আর সমীহ পেয়েছি সেটা কোন কিছুর সাথে তুলনা হয় না।

খাবার পরে আমরা আট দশজন মিলে ব্যাঙ্কুয়েট হল ঘুরে দেখছি এমন সময় এগিয়ে এলেন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাঞ্জিভ রাই। হাত বাড়িয়ে কুশল বিনিময় করলেন। বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। শুনতে চাইলেই ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। জমে উঠল দারুণ আড্ডা। উঠে এলো দু-দেশের অভিন্ন কৃষ্টি - সংস্কৃতি আর ইতিহাস - ঐতিহ্যের চমৎকার মেলবন্ধনের কথা। প্রাণবন্ত এ আলোচনা ছেদ পড়ল সন্ধ্যায়। ফেরার সময় হয়েছে। চারপাশে চোখ মেলে দেখলাম ভবনের বাসিন্দাদের চোখগুলো যেন বলছিল ' আর কিছুক্ষণ থেকে যাও'।

'অতিথি দেব ভব' তথা অতিথি দেবতার মত। এ কথাগুলো শুধু ভারতীয় শাস্ত্রে নয় বাস্তবে প্রমাণ পাওয়া যায় সারা ভারত জুড়েই। ভবন থেকে বের হবার সময় করিডোর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার সময় অনুভব করতে পারছিলাম মানুষ গুলোর সাথে এ অল্প সময়ে তৈরি হওয়া আত্মার সম্পর্ক। শুধু দুটি লাইনই মনে পড়ছিল বারবার, 'একটি মুহূর্ত বেঁচে থাকে একটি ক্ষণের তরে, স্মৃতি থেকে যায় আবহমান কাল ধরে'। রাষ্ট্রপতি ভবনের এই সুখ স্মৃতি চিরসবুজ থাকবে আজীবন।

লেখক: সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মী

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;