মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়



তোফায়েল আহমেদ
মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর জাতীয় জীবনে ‘মুজিবনগর দিবস’ ফিরে আসে এবং এবছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের ৫৩তম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে কতো কথা আমার মানসপটে ভাসছে। পঁচিশে মার্চ  দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।’

পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা ছিলাম মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে। রাত বারোটায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচ- গোলাগুলি। এক রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ছাব্বিশে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরো আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি।’ ‘দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিস্ড।’ তারপর কারফিউ জারি হয় এবং ছাব্বিশে মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র কথা বারবার প্রচার করে বলছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।”

এরপর দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানিগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব; মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি সহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী সাহেব এবং কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাবো। আমাদের এই যাত্রাপথ আগেই ঠিক করা ছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে নির্বাচিত এমসিএ (গবসনবৎ ড়ভ ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) ডাক্তার আবু হেনাকে বঙ্গবন্ধু যে পথে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন, সেই পথেই আবু হেনা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টাল-বাহানা শুরু করে তখন ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাসভবনে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানে  তোমরা থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানিগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ এপ্রিল আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন-পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী-জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরো যা ঘোষিত হয় তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় ‘ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’, ‘একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করিলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের’ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়। এছাড়াও যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, ‘কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।’ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক জাতীয় নেতা উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী. জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ছাব্বিশে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেই দিন থেকে কার্যকর হবে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ১০ এপ্রিল ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।

সে-সময় তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন সেখানে পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন, এককাতারে দ-ায়মান। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, একটা গাড়িতে করে রাত তিনটায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওয়ানা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আ¤্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা আমাদের সাথে সমস্বরে গগনবিদারী কণ্ঠে মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহন করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে মুক্তির বাণীসমূহ পাঠ করা হয়।

আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সকলেই তাদের সাথে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তাঁর পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড়ো জাতির বন্ধুত্ব।’ ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয়বাংলা।’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তাঁরা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত এমসিএ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকগণ, পাবনার জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে, সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত করে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন নিয়ে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দু’টোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু’ লক্ষ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।

প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এই মহান দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের অমর স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জাতীয় চার নেতা জীবনে-মরণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু বেঈমানী করেননি। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে আত্মদান করেছেন সেই আত্মদানের ফসল আজকের এই স্বাধীন ওসার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয় নেতৃবৃন্দের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সর্বত্র স্মরণ করা উচিত। জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

   

আলো ঝলমলে শহর ও বাইক চালকের অসহায় মুখ



আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুই। কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে হেটে কর্মস্থলে আসছিলাম। বাংলামটর মোড়ে রাস্তা পেরিয়ে পা বাড়াতেই মোটরসাইকেলে বসা এক তরুণ ডাক দিলেন, ‘ভাই যাবেন?’

অপ্রস্তুত ও খানিকটা বিরক্ত হয়েই জবাব দিলাম, ‘আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি?’

ওই তরুণ নিরুত্তর থাকেন, মলিন মুখে অন্যদিকে তাকায়। খানিকটা এগিয়ে থমকে দাঁড়াই এই ভেবে যে, মনে হয় তাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলাম। ভাবলাম, এভাবে না বললেও হতো। অনুশোচনায় ফিরে এসে, ‘দুঃখিত’ বলে জানতে চাইলাম, ‘অনেকক্ষণ যাত্রী পাচ্ছেন না বোধহয়?’

বেশ কষ্ট নিয়েই বাইক চালক জানালেন প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, নিয়ে যাওয়ার মতো কাউকেই পাচ্ছেন না। অনেক অপেক্ষার পর কেউ যেতে চাইলে তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকচালকদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। সেই সুযোগ নেন যাত্রীও। কম ভাড়ায় যেতে সম্মত হয়ে যান কেউ, তাই পথচারী কাউকে হেটে যেতে দেখলেও যেচে তাকে জিজ্ঞেস করেন বাইক চালকরা। ওই চালক জানালেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে চাকুরি জুটাতে পারেননি, তাই বাধ্য হয়ে বাইক চালাতে নেমেছেন। বললেন, ‘এভাবে কাউকে ডাকতে যে সংকোচ হয় না তা নয়, তবে ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার চেয়ে কিছুই বড় নয়।’

কর্মস্থলে আসতে রোজ একইভাবে বাইকচালকদের এভাবে মলিনমুখে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। বলতে গেলে গোটা ঢাকা শহরজুড়েই তাদের এভাবে বেকার বসে থাকা চোখে পড়ে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকা শহরে ১০ লাখেরও বেশি মোটরবাইক চলে। ধারণা করা যায়, তাদের একটি বড় অংশই বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং অ্যাপে সংযুক্ত হয়ে পথে নেমেছেন ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের জন্য। রাইড শেয়ারিং অ্যাপে কানেক্ট হলেও অধিকাংশ বাইকচালক এখন পথেই আগ্রহী যাত্রীদের সঙ্গে দরকষাকষি করে কাঙ্খিত গন্তব্যে যেতে সম্মত হয়ে যান।

২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩২ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত মোটর সাইকেল রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মোটর সাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়ে মোংলায় এক বাইকে দু’জন-তিনজন নিয়েও চলতে দেখেছি। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বৃহৎ অংশ কাঙ্খিত চাকুরি না পেয়ে কিংবা চাকুরির আবেদন করে অপেক্ষায় থেকে থেকে জীবিকার প্রয়োজনে এই মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহণে নেমেছেন। কিন্তু এই হুজুগে জাতির একজন কিছু করতে দেখলে বা কোন একটা সম্ভাবনার খবর পেলে সবাই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। চিরাচরিত এই রেওয়াজে প্রয়োজনেরও অনেক বেশি বাইক চালক যাত্রী পরিবহণে নেমেছেন। তাই জীবিকার আশায় পথে নামলেও যাত্রীর দেখা পাচ্ছেন না, কাঙ্খিত আয় করতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। তরুণ জনশক্তির একটি বড় অংশ এভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অনেক সময় পথ দুর্ঘটনায় পড়ছেন। কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ছেন নানা সামাজিক অপরাধেও।

দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতিতে জনজীবনে যে নাভিশ্বাস তা নীতিনির্ধারকরা অনেকেই আমলে নিতে চান না। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘বাজারে তো কোন জিনিসের সংকট নেই’ কিংবা ‘মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এখন বেড়েছে’ ইত্যাদি। কিন্তু সমাজে যেই মানুষেরা শিক্ষা অর্জন করে এক ধরণের আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হয়েছেন, যাঁরা চরম দারিদ্রেও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশে কুণ্ঠিত-সেই শ্রেণীর জন্য বর্তমানে টিকে থাকা কতটা কঠিন তা দীর্ঘসময় যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাইকচালকের মুখাবয়ব দেখে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে সমাজের ভেতরকার ক্ষোভ-উত্তাপ আন্দাজ করা যায় কঠিন নয়। আমরা লক্ষ্য করি, উঠতি ধণাঢ্য হয়ে একটি শ্রেণির বেপোরোয়া চাকচিক্যময় জীবনযাপন অন্যদিকে চরম হতাশায় দিনশেষে ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতে না পারার দুঃখ কিংবা মাস শেষে মেসের সামান্য কয়টা টাকা দিতে না পারায় ম্যানেজারের গঞ্জনা।

বাইকে যাত্রী পরিবহণ করে জীবন চালাতে না পারা এমন তরুণদের মতো বিভিন্ন পেশার আরও বহু তরুণদের আমরা দেখি যাদের অবস্থার আরও করুণ। ক’দিন আগে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে মূলধারার সংবাদপত্রেও খবর হতে দেখেছি-কাওরানবাজারে বড় মাছ কিনে কাটিয়ে নেওয়ার পর মাছের অন্ত্রনালী, পাখনাসহ অন্যান্য ফেলে দেওয়া যেসব অংশ থাকে তাও ভাগা দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। মুখ ঢেকে তাও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণির মানুষ। প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, তারা ভিখারি কিংবা ছিন্নমূল কেউ নন। যারা মাছের ওইসব ফেলে দেওয়া অংশের ভাগ কিনে নিচ্ছেন তারা অবস্থার পাকে পড়ে জীবনসংকটে থাকা শিক্ষিত বেকার মানুষ। ৭-৮শ’ টাকা কেজিতে মাছ কেনার সমার্থ্য তাদের নেই।

বর্তমানে দেশের অকাঠামোগত ও কিছু মানুষের বিপুল প্রতিপত্তি দেখে তথাকথিত ‘উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা’র সরলীকরণ করা যাবে না। এই উন্নয়ন যে সামগ্রিকভাবে আর্থ-সমাজিক অসমতাকে দূর করতে পারেনি তা আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলতে পারি। বাংলামটর মোড়ে দেড় ঘন্টা ধরে যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষিত ওই তরুণটির কাছে এই আলোঝলমলে এই শহর যেমন একরাশ হতাশা ছাড়া কিছুই নয় তেমনি প্রত্যন্ত কোন গ্রামে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকের কাছেও ধূসর জীবনের সবই নিরানন্দ।

;

প্রতিষ্ঠার ১০ বছর সময়কাল দেশীয় বিমানসংস্থার জন্য ‘অশনি’ না ‘শুভ’ সংকেত!



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দশ বছর খুব কি বেশী সময় এভিয়েশনের কিংবা এয়ারলাইন্সের ইতিহাস বলার জন্য? কিন্তু বাংলাদেশ এভিয়েশনের জন্য ১০ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইল ফলক হয়ে আছে। এই সময়টা সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে পেরেছে কয়টি এয়ারলাইন্স? যার ফলাফল খুঁজতেই বাংলাদেশ এভিয়েশনের ছোট্ট অধ্যায়ের পাতা উল্টালেই খুব বেশি সুখকর স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্মৃতির পাতায় মোড়ানো বাংলাদেশ এভিয়েশনের ইতিহাসে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর ১০ বছর সময়কাল কি ‘অশনি না শুভ সংকেত’ তা বোঝার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ এভিয়েশনে উত্থান আর পতনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হওয়ার গল্প লুকিয়ে আছে। এক ঘণ্টার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট করে এসে ২ থেকে ৩ ঘণ্টার অপেক্ষা লাগেজের জন্য, নয়টার প্লেন কয়টায় যাবে যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, এয়ারক্রাফট এসি নাকি নন-এসি, ফ্লাইট আদৌ যাবে তো ইত্যাদি ইত্যাদি, যা হরহামেশা শুনা যেত যাত্রীদের কাছ থেকে। সেই সব বাক্যগুলো আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আর সেই বাক্যগুলোকে ইতিহাসের পাতায় স্থান দিতে সহায়তা করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

আজ বাংলাদেশ এভিয়েশনের প্রায় ৫২ বছরের গল্প, যেখানে সুখকর গল্পের স্থান খুবই সামান্য। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ইতিহাস তো আরো নাজুক। জিএমজি, ইউনাইটেড, রিজেন্ট, বেস্ট এয়ারের মতো প্রায় ৮ থেকে ৯টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হওয়ার মিছিলে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে মাত্র তিনটি বেসরকারি বিমানসংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার ও এয়ারঅ্যাস্ট্রা জাতীয় বিমানসংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর সাথে বাংলাদেশে আকাশ পরিবহন ব্যবসায় জড়িয়ে আছে।

১০ বছর সময়কাল বাংলাদেশের বেসরকারি বিমানসংস্থার জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং বছর। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ১০ বছর অতিক্রমকালীন সময়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। জিএমজি এয়ারলাইন্স ১০ বছর পর ব্যবসায় নিম্নমূখী প্রবণতা দেখা গেছে যা ১৪ বছরের সময় একেবারেই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে নভোএয়ার ১১ বছরের অধিক সময়কাল অতিক্রম করছে।

পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু করার পর থেকেই ব্যবসা থেকে সেবাকেই প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ইউএস-বাংলা। ইতিমধ্যে যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ১৭ জুলাই ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে ১০ বছর সময় অতিক্রম করছে। যাত্রা শুরুর পর থেকে দেশের মানুষকে আকাশ পথে সেবা দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো। সেই প্রতিজ্ঞাকে বাস্তবে রূপ দিতেই ইউএস-বাংলা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। লক্ষ্য একটাই সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকরা বিশ্বের যেসকল গন্তব্যে অবস্থান করছে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে, সেই সকল রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সেবা দেয়ার মানসে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিমূহুর্তে বিমানবহরে নতুন নতুন উড়োজাহাজ যোগ করছে, যোগ করছে দেশের নাগরিকদের কাছে আকর্ষণীয় সকল গন্তব্য।

বেশ কিছু রুট পরিচালনার জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে বাংলাদেশ এভিয়েশন সব সময়ই মনে রাখবে। বিশেষ করে ভারতের চেন্নাই, চীনের গুয়াংজু, মালদ্বীপের রাজধানী মালে রুটগুলো অন্যতম। যেখানে জাতীয় বিমানসংস্থাও পরিকল্পনা সাজাতে পারেনি, সেখানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। ইউএস-বাংলাকে অনুসরণ করে অন্য এয়ারলাইন্সগুলো সেইসব রুটে ফ্লাইট শুরু করেছে। কিন্তু মালেতে দেশীয় একমাত্র ইউএস-বাংলাই ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া কলকাতা, দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি, মাস্কাট, দোহা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী বাংলাদেশিরা অবস্থান করছে, যার মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রবাসী তথা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বাস করছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ। উল্লেখিত প্রতিটি দেশেই ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। সম্প্রতি সৌদি আরবের জেদ্দায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাচ্ছে।

২টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলার বহরে বর্তমানে রয়েছে ৪৩৬ আসন বিশিষ্ট দুইটি এয়ারবাস ৩৩০-৩০০, নয়টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, দশটি ব্র্যান্ডনিউ এটিআর ৭২-৬০০ ও তিনটি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট। এখানে উল্লেখ্য সংখ্যার বিচারে দেশের সরববৃহৎ এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে সর্বপ্রথম ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

দেশের এভিয়েশনের অগ্রযাত্রায়, বেকার সমস্যা দূরীকরণে, অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে।

প্রতিষ্ঠার ১০ বছর সময়কাল যেন বাংলাদেশ এভিয়েশনে বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলো নিকট অশনি সংকেত না হয়ে শুভ সংকেত রূপে স্থায়ী হয়, তা সকলের কাম্য।

লেখক
মো. কামরুল ইসলাম
মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

অপ্রতিরোধ্য আরাকান আর্মি-রাখাইন পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা সংকট



ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন (অবঃ)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আরাকান আর্মি (এ এ) রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে অপ্রতিরোধ্য গতিতে যুদ্ধ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে এ এ জান্তার সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। ব্রাদারহুড এলায়েন্স ২০২৩ সালের অক্টোবরে, অপারেশন ১০২৭ নামে জান্তার ওপর সমন্বিত আক্রমণ শুরু করার পর এ এ চুক্তি লঙ্ঘন করে ১৩ নভেম্বর রাখাইন রাজ্যের রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। রাখাইনে সেনাবাহিনীর ওপর এ এ’র আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে এবং দিন দিন এর তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৭ এপ্রিল অ্যানে ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল কমান্ডের সদর দফতরের কাছের দুটি কৌশলগত অবস্থানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ এ অ্যানসহ আরও তিনটি শহরতলীতে আক্রমণ চালাচ্ছে।

পরবর্তীতে এ এ ৩০ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের বুথিডং টাউনশিপে হামলা চালিয়ে তিনটি আউটপোস্ট দখল করে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের ১৭টি শহরতলীর মধ্যে আটটি এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য চীনের পালেতোয়া শহর এখন এ এ’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জান্তা স্থলপথে শক্তিবৃদ্ধি করতে সেনা পাঠাতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং এ এ তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাচ্ছে। অ্যান টাউনশিপের গ্রামগুলোর কাছেও লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। চলমান সংঘর্ষের কারণে আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অ্যান পর্যন্ত রাস্তা ও নৌপথ অবরোধ করে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ায় খাদ্য ও ওষুধের সংকটের কারণে মানুষ ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে।

এ এ সিটওয়ে এবং চকপিউ শহর ঘিরে ফেলেছে এবং সিটওয়ে এবং চকপিউ বন্দরের কাছাকাছি চীনা-অর্থায়নকৃত তেল ও গ্যাস টার্মিনালের খুব কাছের এলাকায় যুদ্ধ করছে। সমগ্র আরাকান পুনরুদ্ধার করাই এ এ’র উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। দক্ষিণ রাখাইনের আন ও থান্ডওয়ে টাউনশিপের পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর রাখাইন, বুথিডং ও মংডুতেও লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া ট্রাইজংশন থেকে শুরু করে মংডু সংলগ্ন পুরো এলাকা বর্তমানে এ এ’র নিয়ন্ত্রণে। রাখাইন রাজ্যে এ এ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার লড়াইয়ের তীব্রতার কারনে বিজিপি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নেয়া বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ মিয়ানমারের ৩৩০ নাগরিককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ও পরবর্তীতে ২৮৮ জনকে ২৫ এপ্রিল বিজিপির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ এ’র আক্রমনে বি জি পি সদস্যদের প্রান ভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অব্যাহত রয়েছে।

২০১৭ সালে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতারনের পর ২০১৮ সালের শেষের দিকে এ এ’র সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। সে সময় আরাকানে ২,৩০,০০০ এরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। সংঘাতের সময় ইয়াঙ্গুন থেকে খাদ্যপণ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে রাখাইনে মানবিক সমস্যাগুলি গুরুতর হয়ে ওঠে। রাখাইনে মানবিক সাহায্যের অনুমতি দেওয়া, এ এ’র প্রশাসনিক কাজে এবং রাখাইনে বিচার প্রক্রিয়ায় জান্তা বাহিনীর বাধা না দেয়ার শর্তে, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর এ এ জাপানের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত সাসাকাওয়ার নেতৃত্বে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি রাখাইনে ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউ এল এ) কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন সু চি-সরকার এ এ’কে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করে রেখেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাখাইন রাজ্যে আপাত শান্তি বজায় ছিল। সেসময় দেশব্যাপী চলমান প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে এ এ’কে দূরে সরিয়ে রাখতে জান্তা সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সাথে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। এ এ ও ইউ এল এ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে এবং রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। সেসময় রাখাইনের অনেক এলাকায় তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ও তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে আনে এবং ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীদের একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে উঠে। এ এ রাখাইনে একটি শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। জান্তা বিষয়টি ভালভাবে গ্রহন না করায় ২০২২ সালের আগস্ট এ এ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আবার তীব্র লড়াই শুরু হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে পুনরায় অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধ বিরতিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।

এ এ মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নতুন হওয়া সত্ত্বেও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সফল সংগঠনগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এ এ’র ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারনে উত্তর ও দক্ষিণ রাখাইনে তাদের প্রভাব ও সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। রাখাইনে এর আগে কোন সশস্ত্র গোষ্ঠীর এভাবে সুসংগঠিত নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এ এ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ এ’র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার জননিরাপত্তা। বিমান হামলা এবং ল্যান্ডমাইন থেকে নিজেদের রক্ষা করার বিষয়ে তারা বাসিন্দাদের ক্রমাগত সচেতন করছে। তারা ল্যান্ডমাইন পরিষ্কার করা, খাদ্য, ওষুধ, কৃষিখাতে সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। এ এ বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নাফ নদীসহ এই সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে তবে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে তারা বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চায়। সম্প্রতি এ এ’র মুখপাত্র থেকে জানা যায় যে, তারা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভবিষ্যতে আরাকানের সব নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। তারা আরাকানের সব নাগরিকের জন্য কাজ করছে এবং নিজেদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এ এ লড়াই চালিয়ে যাবে।

এ এ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে ভবিষ্যতে আরাকান রাজ্য গড়ে তুলতে চায়। এ এ’র মূল শক্তি হলো রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। এ এ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। কিছু কিছু প্রশাসনিক কাজেও রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনে ওদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো আর কেউ থাকবে না। এ এ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং আরাকানে নাগরিক মর্যাদাসহ তাদের বসবাসের বিষয়ে মিয়ানমার জান্তা সরকারের চেয়ে অনেক নমনীয়। অতীতে সেনা-সরকার ও এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখালেও এ এ রোহিঙ্গাদেরকে সাথে নিয়েই এগোতে চায়। এ এ রাখাইনে নিজস্ব প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন টেকসই এ নিরাপদ করতে হলে এবং রাখাইনে যে কোন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনায় তাদেরকে সম্পৃক্ত করতেই হবে। বাংলাদেশ প্রান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে যাবার বিষয়ে মানসিক ভাবে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি তাদেরকে স্বাবলম্বী বানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

রাখাইনে চলমান সংঘাত একটা দীর্ঘ মেয়াদী সংকটের জন্ম দিতে পারে। জান্তা রাখাইনে ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’ ব্যবহার করে সংঘাত পূর্ণ এলাকায়, খাদ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা, যোগাযোগ বিছিন্ন করে এ এ’কে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান সংঘাতে রাখাইনের সাধারণ মানুষ চরম দৈন্যদশার রয়েছে এবং রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা এবং উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যহত ও ধীর হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ আরও তীব্র হলে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত জনগণের বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ আর কোন মিয়ানমারের নাগরিককে প্রবেশ করতে দিবে না বলে জানিয়েছে। তাই বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে ধরনের মানবিক করিডোরের পরিকল্পনা করা হয়েছে রাখাইনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় সে ধরনের করিডোর তৈরির পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যটি ভু-কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখানে আঞ্চলিক দেশ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটি সহজে হাতছাড়া করবে না। রাখাইনের দখল নিয়ে এ এ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। মিয়ানমার সরকার এবং এ এ’র সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, সীমান্ত নিরাপত্তা ও চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশেরকে আরো কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ)
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

তাপমাত্রা, পাপমাত্রা ও এসি-ফ্যান হাতপাখা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গোটা এশিয়া জুড়ে এবার উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের উচ্চতাপমাত্রা যেমন নজর কেড়েছে তেমনি প্রাণ ওষ্ঠাগত করে বিপদে ফেলেছে মানুষকে। কেউ কেউ মজা বা উপহাস করে বলে বেড়াচ্ছে, মানুষের পাপ কাজের মাত্রা বেড়েছে। পাপ কাজকে কেউ এখন আর তেমন ঘৃণা করেনা, ভয়ও পায় না। কারণ এদেশের মানুষ সিংহভাগই ধর্মপ্রাণ। এদেশের মতো এত বেশি মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। মানুষ পাপ কাজ করে আর ধর্মীয় উপাসনা করে প্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের ভারসাম্যতা এনে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

কিন্তু সেই আত্মতৃপ্তি সবার ক্ষেত্রে টেকসই হয় না। কারণ, মানুষ বার বার তওবা করে আবার বার বার পাপ কাজ করতে উদ্যত হয়ে ওঠে। ফলে সীমা লঙ্ঘণ করার অপরাধেপ্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের পাপ বিদূরিত হয় না। বরং আরো বেশি কালিমা লেপন হয়ে যায়। ফলত: পাপের বোঝা ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠায় বর্তমানে পাপমাত্রা বেশি ভারী হয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে!

এছাড়া শুধু প্রার্থনা না করলেই পাপ হয় অথবা প্রার্থনা না করলেই মার্জনা হয় এমন ধারণা সব ধর্মের সবাই মানতে নারাজ। ইসলামে ধর্মীয়ভাবে হয়তো সীমা লঙ্ঘণকারীদের জন্য এই ধারণা সঠিক কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে সীমালঙ্ঘণকারীদের বেলায় কি হবে?

মানুষ নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্বিচারে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সবুজ গায়ের চামড়া তুলে কালো পশমি চাদর ও জামা পরিয়ে দিয়েছে। গরমের মৌসুমে মানুষ বা কোনো প্রাণী কি কালো পশমী কোট পায়ে দিয়ে থাকতে পারে?

আধুনিকতার নামে শহরের ব্যাপ্তি ঘটছে প্রতিটি দেশে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির নামে গোটা পৃথিবীর বুক জুড়ে কংক্রিট ও কালো পিচের ঢালাই এঁকে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতার লোভে যুদ্ধের দামামা চালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে বোমা বারুদ ফাটিয়ে পৃথিবীর শান্ত সুন্দর পরিবেশকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আরাম আয়েশের জন্য এসি, কুলিংফ্যান, ফ্রিজ নামক কীট মানুষের গাড়ি, বাড়ি, অফিস, আদালত, রিসোর্ট প্রভৃতিতে খামচে বসে অনর্গল উচ্চ তাপমাত্রা ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে উপহাস করছে। কার্বন কমানোর নামে সেমিনার, কনফারেন্স, কনভেনশন করতে গিয়ে বেটো দিয়ে ওয়াক আউট করে চলে যাচ্ছে স্বার্থের সংঘাতের কারণে। মারণাস্ত্র বিক্রি করে যাদের জাতীয় ও বার্ষিক আর্থিক বাজেট নিরুপণ করা হয় তারা এ ব্যাপারে শুধু ভণিতা ছাড়া আর কি করতে পারে? তাই পাপমাত্রা শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষকে কেন্দ্র করে প্রার্থণার উপর নির্ণীত করাটা বড় ভুল হবে। পাপের মাত্রাটা নির্ভর করছে বড়বড় অর্থনীতির বড় বড় মেগা কর্মকান্ডের ফলে প্রকৃতির উপর ব্যাপক হারে নিষ্ঠুরতা চালানোর মধ্যে।

আসলে যুদ্ধের উন্মাদনায় পড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। কিছুদিন আগে বলা হতো- পৃথিবী আর দেড় বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবে। হঠাৎ করে এখন বলা হচ্ছে, দেড় বছর নয় আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পৃথিবীর ভাগ্য জানা যাবে (বিবিসি)। কারণ, আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে যে বিশ^ পরিবেশ সম্মেলন হতে যাচ্ছে সেখানে বড় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর ভূমিকা কি হবে তা দেখার মতো বিষয়। সেখানে নির্ধারিত হবে কার্বন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতিমালা।

রাশিয়া গ্যাস সরবরাহে ইউরোপের উপর থেকে অবরোধ তুলে না নেয়ায় গোটা ইউরোপে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বেড়ে গেছে। তাই ইউরোপে অতি বেশি কার্বণ নির্গমণ হতেই আছে। এটা আরো কতদিন বা বছর কলবৎ থাকবে তা বোঝা মুষ্কিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলছে। ইরান, লেবাননসহ গোট মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি। সবার সামরিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং দ্রব্যমূল্য আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।

বিশ্ববাণিজ্য ও জরুরি খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ আরো বেশি সংঙ্কুচিত হয়ে পড়লে বিশ্বমন্দা নিয়ে মানুষ আরো বেশি হতাশ হয়ে যাবে। তখন ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের জন্য কোনরুপ অর্থ ব্যয় করতে মোটেও রাজি হবে না। ফলে গোটা বিশ্ব অচিরেই একটি চরম ক্রান্তিকালের মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। সেখান থেকে অচিরেই কোন মুক্তির পাবার আশা করা বৃথা।

এতো গেল ইউরোপের ধনী দেশগুলোর কথা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট,বন্যা, দাবানল, ডেঙ্গু, মরুর দেশ আমীরাত ও ওমানে আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও ফ্লাশফ্লাড, ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবীতে কঠিন অর্থনৈতিক আঘাত লেগে গেছে। বড় আঘাতে ইতোমধ্যে আফিকা ও এশিয়ার ছোট ছোট ১৬টি দেশ নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে জ্বালানী সংকট ও উচ্চদ্রব্যমূল্য চোখে পড়ার মতো অবস্থায় জানান দিচ্ছে সামনের ভয়াবহ আশঙ্কার কথা।

আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ষোল হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মাত্রা সফলভাবে প্রচারিত হলেও সাম্প্রতিক ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও জরুরি এলার্টের ফলে মানুষ ঘরে বসে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসময় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘন ঘন লোড শেডিং মানুষকে জানান দিচ্ছে- এটাই যথেষ্ট নয়। এখন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা কত কোটি হয় তা কারো জানা নেই। অটোর চার্জ, সেচ মেশিনের অতি ব্যবহার ও অতি গরমে গ্রামের মানুষও দেশীয় তৈরি সস্তা এসি কিনে ঘরে ঘরে লাগাচ্ছে। তাই বিদ্যুতের সংকট আরো বেশি ঘণীভূত হচ্ছে।

আমি একজন আশাবাদী মানুষ। চিরকাল আশা ও ভরসার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সকল হতাশাকে জয় করে মানুষ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাক সেই চেষ্টা করি। এখনো করছি এবং ভবিষ্যতে সেটা করেই যাব। কিন্তু মানুষের কাজের গতি বন্ধ হয়ে গেলেই তো সম্ভাব্য বিপদের হাতছানি চলে আসে।মানুষের দেহে যেমন রক্তপ্রবাহ সঠিক থাকা জরুরি ঠিক তেমনি একটি দেশের সারাদেহে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্দুৎপ্রবাহ থাকাটা খুব জরুরি।

সমস্যাটা এখানেই অনুভব করছি। পড়াশুনা ও গবেষণার জন্য দীর্ঘদিন জাপানে ছিলাম। প্রথমদিকে দেশ থেকে জাপানে গিয়ে মনে হতো সেখানে কি রাত হয় না? রাতের রাস্তায় কারো ঘুম নেই। সেটা গাড়ি, ট্রেন বা মানুষের। কোনো শব্দ নেই শুধু আলো আর আলো। সবাই শিফট বদল করে নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। ওর মধ্যেই বিরাম, বিশ্রাম চলছে। কেউ কাউকে কোনভাবেই বিরক্ত করছে না। ওরা তো গ্যাস, তেল সবই কিনে আনে। নিজের কিছুই নেই। তবুও ওদের অভাব নেই। ও হ্যাঁ, এখনো ঢাকার চেয়ে টোকিও বা পাশের শহরতলির নির্মাণ খরচ ও জমির দাম অনেক কম। ওদের তো বিদ্দুৎ রেশনিং করতে হয় না। ওখানে এক মিনিট কেন, এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্দুৎ কোথাও চলে যায় যায় না। কারণ ওরা খুব সৎ ও কর্মঠ। ওরা মুখে প্যাঁচ প্যাঁচ করে বাহুল্য কথা বলে না। কথায় ও কাজে সততাকে প্রমাণ করে দেখায়। আমরা চোরের খনিতে বাস করি। এটা নতুন কথা নয়। রেন্টাল বিদ্দুৎ-এর প্রভাবে টাইকুনরা এই চরম বিপদের সময় চুপ করে আছেন কেন?

এপ্রিল শেষ হলো কোনা বরিষণের দেখা নেই। আবাদী জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্চে। সেচ দেবার উপায় নেই। কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাথে চরম অভাব লেগেছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।

গতবছর প্রথম দেশে জানা গেছে লোডশেডিং-এর প্রাতিষ্ঠানিকিীকরণ করার কথা। সেটা সরকারিভাবে রাখঢাক না করে সময়সূচি ধরে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী লোডশেডিং-এর ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে সারা দেশের জনগণ অভিযোগ করে চলেছেন।চাহিদা অনুযায়ী দুরে থাক্, এমনিতেই তো বিদ্দুৎ থাকে না। চাহিদা মতো ভোক্তাকে বিদ্দুৎ দিতে না পারলে তো ক্ষমা চাইতে হয়। এটা আমাদের কৃষ্টিতে নেই অথচ, ক্ষমা চাওয়াটাই ভাল উপায়। তা না করে লোডশেডিং-এর অনিয়ম কথাটা শুনতে ও বুঝতে গিয়ে অনেকে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন।

এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাইমারি স্কুল খোলা। দেশে এসি সম্বলিত ক্লাসরুম কয়টি বিদ্যালয়ে আছে? এই ভয়াবহ গরমে সবার আগে কোমলমতি শিশুদের জন্য স্কুল বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা বলবৎ করা হচ্ছে না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই হলে থাকে না। ফলে অনলাইনের খরচে কারণে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সংকটে পড়ে অনুপুস্থিত থাকছে।

এগুলোই আমাদের দেশের সেবাদানকারীদের সাথে উন্নত কোন দেশের সেবাদানকারীদের তফাৎ। কেউ কি সেটা বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করতে পারবেন? জোড়াতালি দেয়া জীবনে আমাদের সবাইকে কেন বিদ্যুৎ কষ্টে থাকতে হবে? অভিজাত এলাকা ও বস্তি বা দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় বাস করা সবাই তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদের কারো শরীরে কি ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে অনুভূতির কি কোন পার্থক্য আছে?

লোডশেডিং-এর জন্য যাদের চারতলার চৌবাচ্চায় কৃত্রিম পানি তুলে শিং-মাগুর মাছের প্রজেক্ট আর চলছে না, যাদের ছাদবাগানের গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। রাজধানীর কোনো কোনো রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের কতটি গাড়ি পানি ছিটাচ্ছে বস্তি এলাকার কলসি কাঁখে খাবার পনি সংগ্রহ করতে যাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর নিকট সেটাও খুব বাহুল্য বা কৌতুক মনে হচ্ছে। যাদের প্রিয় ছেলের কিনে দেয়া এসিটাও চালানো যাচ্ছে না,আইপিএসে চার্জ না হওয়ায় সিলিং ফ্যানও ঘুরছে না তাদের জন্য সবকিছু হতাশার মধ্যে নিপতিত হলেও তালের হাতপাখা দু’টো কিন্তু চালানো যাবে। কারণ, আমি আশাবাদী মানুষ। মরুশহর দুবাইয়ে হঠাৎ তীব্র বন্যার মাত্রা ওদের অধিবাসীদের পাপমাত্রার কারণে ঘটেছে তা বলা মুষ্কিল। কারণ সেখানে শত শত ভিন্নধর্মাবলম্বী লোকের বাস। কিন্তু আমাদের দেশের ওপর কি হলো? বিপদ বার বার আসে এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। আর এজন্য আগাম বড় পরিকল্পনা এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। 

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;