ব্রানসউইক শহরে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ আহমুদ আরবারি



মঈনুস সুলতান
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পিচঢালা সড়কের দিকে দিশা ধরে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে হলেণ আমার দিকে তুর্কি সুফি-সংগীতের একটি ক্যাসেট বাড়িয়ে দেয়। আমি তা রের্কডারে গুঁজে নভ টিপি। টয়োটা গাড়ির ভেতরকার বাতাবরণ ভরে ওঠে দরবেশী ঘরানার চ্যান্টিয়ের মতো নেশা ধরানো মূর্চ্ছনায়। দরদী এ সংগীতের রচয়িতা সপ্তদশ শতকের সুফিসন্ত হজরত নিয়াজ আল মিস্রি। এত বছরের পুরানো ক্যাসেটটি এখনো বাজছে দেখে আমি রীতিমতো তাজ্জব হই! কত বছর আগের কথা, আমরা টেপটি খরিদ করেছিলাম তুরস্কের কোনিয়া নগরীর জগতজোড়া মশহুর সুফিসন্ত হজরত জালাল উদ্দীন রুমির মাজার-সংলগ্ন মিউজিয়ামের গিফট শপ থেকে। তখন কি জানতাম, প্রায় তিন দশক পর আমরা একত্রে ড্রাইভ করে রওয়ানা হব, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ব্রানসউইক শহরের দিকে। বয়সের প্রভাবে ক্যাসেটের জিগর হয়ে এসেছে দুর্বল, তারপরও শ্রবণে লিরিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
কান ইয়ানি বুলবুল ওলডু
হার আচিলদি গুল ওলডু
গজ কুলাক ওলডু হার ইয়ার
হার নে কি ভাব ও ওলডু..

গীতল এ চরণগুলোর টোটাফাঁটা ভাব-তর্জমা হতে পারে;

হৃদয়ের তুমুল মনস্তাপ
রূপান্তরিত হয় সংগীতপ্রবণ পাখিতে ফের
আগুনে পুড়ে তৈরি হয় অজস্র গোলাপ
সৌরভে মৌতাত হয় ঢের
যেদিকে তাকাই দেখি তোমার অসংখ্য চোখ
সংবেদনশীল সহস্র্র শ্রবণ হয়ে আছে উন্মূখ.. ..

অত্যন্ত নস্টালজিক এ গীতের ভাবসম্পদ নিয়ে নীরবে তর্পণ করতে করতে আমি জর্জিয়ার সাভানা শহরে—সম্প্রতি আমাদের সাময়িকভাবে থিতু হওয়ার বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবি। আমাদের দিনযাপনে বোধকরি লং ডিসটেন্স ড্রাইভিংয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাই অত্র এলাকায় এসে আমরা হালফ্যাশনের গাড়ি-টাড়ি কেনার চেষ্টা করিনি। যে টয়োটা-করোলা গাড়িটি হলেণ ড্রাইভ করছে, তা আমরা সেকেন্ডহ্যান্ড খরিদ করেছিলাম সম্ভবত ২০০৬ সালে, সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া নগরীতে বসবাসের সময়। সে থেকে ছাই রঙের বাহনখানা আমাদের সঙ্গে সফর করেছে, মেক্সিকো সিটি কিংবা সিয়েরা লেওনের ফ্রিটাউন প্রভৃতি শহর। প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে প্রবীণ হয়েছি আমরা, ক্ষীণ হয়েছে দৃষ্টিশক্তি, গাড়িখানাও বয়োবৃদ্ধ হয়েছে, লজজড় হয়েছে তার দেহলতা, তবে সেবাদানে অক্ষমতা প্রকাশ করেনি, কৈমাছের প্রাণ নিয়ে আমাদের সঙ্গে উজিয়ে চলছে—যাপিত সময়ের ঢালে।

হলেণ স্টিকশিফ্ট টেনে গিয়ার বদলায়, বাহনখানা ঝাঁকি দিয়ে কেঁপে ওঠে, তাতে পেছনের সিটে ঝিমুনি ভেঙে ধড়মড় করে জেগে ওঠেন মিসেস মেরি মেলবো। তাঁর কণ্ঠস্বর মাস্ক ও ফেসশিল্ডের ঘেরাটেপ অতিক্রম করে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘আর উই দেয়ার?’ হলেণ ‘নট রিয়েলি’ বলে স্পিড বাড়ায়। আমরা আটলান্টিক মহাসাগরের পাড় ঘেঁষা যে সড়ক ধরে পথ চলছি, তা ওশ্যান হাইওয়ে নামে পরিচিত। রাজপথের একপাশে বৃক্ষময় নিবিড় বনানী, তার কিনার ঘেঁষে কসমস ফুলের ঘন বিন্যাস, তাতে ফুটে আছে বর্ণবিহ্বল নিযুত পুষ্পদল, যা দৃষ্টিতে ছড়ায় সতেজ সিগ্ধতা, কিন্তু মন থেকে মুছে যায় না উদ্বেগের ম্লানিমা। তামাম রাজ্য জুড়ে গেল সপ্তা দুয়েকে লকডাউন শিথিল হতে হতে উপে যেতে বসেছে। শুরু হয়েছে যানবাহন চলাচল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মিডিয়ায় ম্রিয়মান হয়ে এসেছে করোনা সংক্রমণজনিত তথ্যাদি। মানুষজন ভুগছে তাবৎ কিছু নরম্যাল হয়ে যাওয়ায় বিভ্রমে। আসলেই কি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সমস্থ-কিছু? স্থানীয় মিডিয়া থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার সংক্রান্ত তথ্যাদি মুছে গেছে। তবে, অন্তর্জালে মনোযোগ দিয়ে খুঁজলে পাওয়া যায় মৃত্যুর সপ্তাওয়ারি উপাত্ত। যে কাউন্টির অন্তর্গত আমাদের শহর, ওখানে সপ্তা দুয়েক আগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল নয়, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২৯। ব্রানসউইক নামে যে মফস্বল শহরের দিকে আজ আমরা মেলা দিয়েছি, ওখানেও পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে জোরেশোরে এলান দেওয়া হয়েছে, তবে মৃত মানুষের সংখ্যার দিকে তাকালে ধারণা ভিন্ন হয়, যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান। রিপাবলিকান প্রশাসনের কেউ কেউ বলছেন, এরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে না, তাই এড়াতে পারছে না মৃত্যুর করাল ছোবল।

ব্রানসউইক শহরটি আমাদের অচেনা, তা বলা যাবে না। আগেও ওখানে বার তিনেক এসে ঘুরপাক করে গেছি। ওখানকার মেরি রস ওয়াটারফ্রন্ট্র পার্কে ফিবৎসর অনুষ্ঠিত হয় ‘রিদম অন দি রিভার কনসার্ট’ শিরোনামে নদীভিত্তিক সংগীতের জলসা। বছর দেড়েক আগে পুরো এক সন্ধ্যা—মাঝরাত অব্দি আমরা কাটিয়েছি নৃত্য-ঝংকারের রীতিমতো হিপনোটিক পরিবেশে। আরেকবার আসা হয়েছিল, মেফ্লাওয়ার নামে একটি নৌযান-কেন্দ্রিক প্রদর্শনীতে। ইউরোপ থেকে অভিবাসী হিসাবে আগত শ্বেতাঙ্গ সেটলারস্—মূলত পুর্তগিজ নাবিকরা তাদের মাছ ধরার বহরকে খ্রিস্টীয় রীতিতে আশির্বাদ করার প্রক্রিয়া হিসাবে বন্দরনগরীতে আনেক বছর আগে এ সমুদ্রমেলাটি চালু করেছিলেন। মেফ্লাওয়ারের পর্বে পুষ্প-দীপাবলিতে সজ্জিত অনেকগুলো সুদর্শন বোটের ভেসে যাওয়া এখনো চোখে ভাসে।

পেছনের সিট থেকে মিসেস মেরি মেলবো খোনা গলায় বলেন, ‘সুফি-সঙ ইজ সুপার লাভলি, ইউ গাইজ ডিজারভ্ সাম ফুড।’ তিনি চকোলেটের প্রলেপ দেওয়া গ্রোনলা-বার ও আইসটির ক্যান বাড়িয়ে দেন। আমি অ্যালকোহল রাব দিয়ে ঘঁষামাজা করে গ্রোনলা-বারের মোড়ক খুলি। সাভানা থেকে ব্রানসউইকের দূরত্ব বেশি না, তবে যে রকম থেমে থেমে—ব্যাকরোড ধরে আস্তে-ধীরে চলছি, পৌঁছতে মনে হয় ঘণ্টা দুয়েক লেগে যাবে। আমরা রওয়ানা হয়েছি কাকভোরে, মিসেস মেলবো ঘণ্টাখানেক দূরের একটি এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বসবাস করেন, তাঁকে পিকাপ করে আনা-নেওয়ার তুলতবিলে ব্যয় হয়েছে পুরো দুই ঘণ্টা, যুতমতো চা-পানি মুখে দেওয়ার ফুরসত হয়নি। মিসেস মেলবো ফের আওয়াজ দেন, ‘মিউজিক ইজ মেকিং মি ফিল লাইক ডু অ্যা দরবেশ ড্যান্স।’ অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ছাড়া মিসেস মেলবোর চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামান্য কিছুতে উদ্দীপ্ত হওয়া। মানুষটি গাত্রবর্ণে শ্বেতাঙ্গ, বয়স ৭৯, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ ও বাথে কব্জি কমজোর। ইনি আজকাল আর লং ডিসটেন্স ড্রাইভ করতে পারেন না, তবে পেশাগত কাজ থেকে অবসর নিতে পারেননি, এখনো জর্জিয়া স্টেট ইউনিভারসিটিতে ছোটখাট কী একটা চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কাজ না করেও মিসেস মেলবোর উপায় নেই, বয়সের ভাটিতে পৌঁছে স্টুডেন্ট লোন নিয়ে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভারসিটিতে পিএইচডি করেছিলেন, এখন সে ঋণ মাসওয়ারি পরিশোধ করে চলছেন। এক কামরার একখানা এপার্টমেন্টও কিনেছিলেন—সে দেনা তাঁকে শোধ করতে হচ্ছে কিস্তিতে। তাঁর ত্রিসংসারে বিত্তবান খেশকুটুম আছেন প্রচুর, সঙ্গত কারণে মেরি তাদের ঘৃণা করেন, এদের প্রসঙ্গ ওঠলে অশোভন জবানে খিস্তিখেউড় করতে ছাড়েন না।

বছর দশেক আগে মিসেস মেলবোর নিঃসঙ্গ দিনযাপনে জুটেছিল একজন জেন্টোলম্যান ফ্রেন্ড। হল্যান্ডের বয়স্ক এ নৃবিজ্ঞানি স্টেট ইউনিভারসিটিতে এসেছিলেন ভিজিটিং স্কলার হিসাবে। তাঁদের অন্তরঙ্গতার এক পর্যায়ে তিনি শ্বেতাঙ্গ মেরি মেলবোর দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে, ভুরু কুঁচকে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফর সাম রিজন আই বিলিভ ইউ হ্যাভ সাম আফ্রিকান ব্লাড ইন ইউ..।’ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, চেহারা-সুরতে মেরি মেলবো পুরোদস্তুর হোয়াইট ওয়োম্যান হলেও তাঁর দেহসৌষ্ঠবে আছে পশ্চিম আফ্রিকার নারীদের কাঠামোগত আদল। নৃবিজ্ঞানি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় তাঁকে এনকারেজ করে বলেছিলেন, ‘ইউ মাইট ওয়ানা ডু অ্যা ডিএনএ টেস্ট, আই অ্যাম শিওর ইউ উইল ফাইন্ড সামথিং ইন্টারেস্টিং আবাউট ইয়োরসেল্ফ..।’ ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গায় হরেক কিসিমের মানুষজন—তাঁদের পুর্বপুরুষদের জিনিওলজি বা নৃতাত্ত্বিক শিকড় সম্পর্কে বিশদ জানতে অ্যানসেস্টার ডটকম নামক ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হচ্ছে। মিসেস মেরি মেলবো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেন। সপ্তা তিনেকের ভেতর রেজাল্ট আসে, ডিএনএ পরীক্ষা করনেওয়ালারা কনফার্ম করেন যে, তাঁর শরীরে সত্যিই প্রবাহিত হচ্ছে—পশ্চিম আফ্রিকান অজ্ঞাত কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শোণিত।

খুব যে অবাক হয়েছিলেন মিসেস মেলবো, তা নয়। পারিবারিক গালগল্পে জানতেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের মালিকানায় ছিল কটন ফার্ম। তারা তুলাচাষে ব্যবহার করতেন আফ্রিকার পঞ্চিমাঞ্চল থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিতদাসদের মেহনত। এঁদের কন্যা-সন্তানরা বিবেচিত হতেন শ্বেতাঙ্গ ফার্ম-মালিকদের সম্পত্তি হিসাবে। এঁরা ধর্ষণের শিকার হতেন আকসার। এ প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সন্তাদি জন্মানোরও সামাজিক প্রমাণ আছে প্রভূত পরিমাণে। মিসেস মেলবোর সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ বিশ্বাস করে, হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র অধিপত্য প্রতিষ্ঠায়। পারিবারিক দলিলপত্র খুঁজে তিনি আরো অবগত হন যে, তাঁর এক পূর্বপুরুষ নাকি ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের বিরুদ্ধে ওকালতি করে অনেক বছর আগে ছাপিয়েছিলেন একটি পুস্তিকা। তা বিতরণ করা হয়েছিল সাদার্ন ব্যাপটিস্ট চার্চের শ্বেতাঙ্গ উপাসনাকারীদের মধ্যে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, প্রফেট আব্রাহাম নিজে ছিলেন ক্রীতদাস মালিক। খ্রিস্টের জীবদ্দশায় জেরুজালেমের রোমান প্রশাসকরা ব্যবহার করত ক্রীতদাসদের শ্রম, যীশু নাকি এ প্রক্রিয়ার কোনো প্রতিবাদ করেননি। তাই ক্রীতদাস প্রথা ধর্মীয় বিধানে অনুমোদিত।

দরবেশী মিউজিক বাজতে বাজতে ক্রমশ সুরলয় মিহি হয়ে আসে। তার সাথে মিশে যায় পেছনের সিট থেকে ভেসে আসা নাক-ডাকার শব্দ। হলেণ মৃদু হেসে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে আমার দিকে তাকায়। কাকভোরে জাগার আরেক সমস্যা, গাড়ির দ্রুত সঞ্চালনে মিসেস মেলবো ঘুমিয়ে পড়েছেন। মুখে মাস্ক ও ফেসশিল্ড থাকার ফলে কাচের বন্ধ শার্সিতে আটকে পড়া বোলতার মতো ফড়ফড়িয়ে আওয়াজ হচ্ছে। নাক-ডাকা করোনার আলামত নয়, এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া নিষ্প্রয়োজন। তবে পেছন দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া সমুদ্রপাড়ের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আমার ভাবনায় ফের চলে আসে মিসেস মেলবোর পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ।

ক্রিসমাসের ফ্যামিলি রিইউনিওনে সাত-পাঁচ ভেবে তিনি সামিল হয়েছিলেন। তখন বয়সে তরুণ দুজন সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ কাজিনের সঙ্গে তাঁর তুমুল বসচা হয়। তারা ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের শার্লটভিলে অনুষ্ঠিত হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের মশাল মিছিলে যোগ দিয়েছিল। তারা মিসেস মেলবোর সুয়েটারে আটকানো বর্ণবাদবিরোধী স্লোগান ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ আঁকা বোতামটি খুলে ফেলতে বলে, তিনি তাতে বিরক্ত হয়ে রিইউনিওন ত্যাগ করেন। নিজের নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর থেকে মিসেস মেলবো কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের পার্টি-পর্ব ও কনসার্ট-থিয়েটারে যাচ্ছিলেন। ওয়েস্ট আফ্রিকা থেকে শিকল পরিয়ে এদেশে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজনদের ওপর লেখা বইপত্রও পড়ছিলেন সঙ্গোপনে। কিন্তু ক্রিসমাস রিইউনিওনের ঘটনার পর, তিনি বন্ধু-বান্ধবদের তাঁর শরীরে যে আফ্রিকান রক্তের মিশ্রণ আছে—তা ডিএনএ টেস্টের রেফারেন্স দিয়ে প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন। বিষয়টি স্যোশাল মিডিয়া অব্দি গড়ালে, তাঁর পরিচিত আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষজন তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের পালাপার্বণে দাওয়াত দিতে শুরু করেন।

আমাদের সঙ্গে মিসেস মেলবোর দেখা হয় সাভানা শহরের আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের পরব কোয়ানজো সেলিব্রেশনে। আমরা দুজনে সিয়েরা লেওনে ইবোলা সংকটের সময় আমাদের পেশাদারি কাজবাজ গুটিয়ে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছি, সাভানাতে বাস করছি সাময়িকভাবে। কোয়ানজোতে গিয়েছিলাম কৃষ্ণাঙ্গ গায়কদের লাইভ উপস্থাপনায় সৌল মিউজিক শুনতে। সাক্ষাতের শুরুতেই মিসেস মেলবোর সঙ্গে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দ্রুত আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । মিসেস মেলবো সেনেগালের কৃষ্ণাঙ্গ সুফিসন্ত শেখ আহমাদু বমাবা সম্পর্কে কৌতূহল দেখিয়ে আমাকে তাজ্জব করে দেন! তিনি অতঃপর নিজেকে শ্বেতকায় দেহে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের রক্ত বহনকরা নারী বলে পরিচয় দিয়ে জানান, ক্রীতদাস প্রথার সমর্থনকারী যে ব্যাপ্টিস্ট চার্চে তাঁর শ্বেতাঙ্গ পুর্বপুরুষরা উপাসনা করত, ওখানে যাওয়া তিনি বাদ দিয়েছেন। বিকল্প হিসাবে সংখ্যালঘু আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে প্রচলিত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। নামাজ-রোজা প্রভৃতি রীতি-রিচ্যুয়েলের কড়াকড়ি তাঁর পছন্দ হয়নি, তবে শেখ অহমাদু বামবা প্রবর্তিত তারিকা মৌরিদ সুফি ব্রাদারহুডের সংগীত-ভিত্তিক জপ-তপ তাঁর মনে ধরেছে।

এরপর মিসেস মেলবোর আমন্ত্রণে নগরীর আফ্রিকান-আমেরিকান নেইভারহুডে আয়োজিত মৌরিদ তরিকার বাদ্যযন্ত্র-ভিত্তিক জপ-তপের একাধিক জলসায় আমরা শরিক হই। তাঁর সঙ্গে ফের আমাদের নিবিড়ভাবে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ হয়, কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের পদপিষ্ট হয়ে বেপানহভাবে খুন হওয়ার পর প্রতিবাদ মিছিলে। দেখি মিসেস মেলবো আফ্রো কেতার মোটিফ আঁকা বাটিকের রঙচঙে লেবাস পরে, ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ লেখা প্লেকার্ডটি উঁচিয়ে বর্ণবাদবিরোধী আওয়াজ দিচ্ছেন। পর পর বেশ কয়েকটি প্রতিবাদী জমায়েতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। প্রতিটি মিছিলে তাঁকে দেখি উদ্যোগ নিয়ে তরুণদের বিনীতভাবে বলছেন, জটলা না করে সামনে এগিয়ে যেতে, যাতে নানাবিধ আন্ডারলায়িং কন্ডিশনস্-এ ভোগা আমাদের মতো বয়স্ক মানুষরা সামাজিক দূরত্ব মেনটেইন করে প্রতিবাদে সামিল হতে পারে।

প্রতিবাদ কর্মকাণ্ডে এসে মিসেস মেলবোর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, ব্রানসউইক শহরের যে স্থানে জগ করতে গিয়ে দুজন শ্বেতাঙ্গ পিতাপুত্রের যোগসাজশে গুলিবিদ্ধ হন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক আহমুদ আরবারি, ওখানে বর্ণবাদবিরোধী নাগরিকরা আজ জড়ো হয়ে পুষ্পমণ্ডিত করবেন ক্রুশকাঠ। পঁচিশ বৎসর বয়সের টগবগে তরুণ আহমুদ নিহত হন ২৩শে ফ্রেব্রুয়ারি। ঘটনাটি সাথে সাথে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় সংবাদ হয়নি। মাস খানেক পরে যখন স্যোশাল মিডিয়ায় তাঁর হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চাউর হয়, লকডাউনের ক্লেশে আমরা ছিলাম বিশেষভাবে ব্যতিব্যস্ত, মনোযোগ দেওয়ার মতো মানসিক অবকাশ ছিল না। তারপর নিউইয়র্ক টাইমসে ভিডিওটি সার্কুলেট হলে, প্রতিবাদীদের চাপে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ব্যুরো অব ইনভেশটিগেশন তদন্তের উদ্যোগ নেয়। বলতে দ্বিধা নেই, মৃত্যুর চার মাস পরও খুনি পিতা-পুত্রকে গ্রেফতার না করার উল্লেখ করে টেলিফোনে মিসেস মেলবো আমাদের এ জুলুম সম্পর্কে সচেতন করেন।

আহমুদ আরবারি

বর্ণবাদবিরোধী লাগাতার আন্দোলনের আজ ঊনিশতম দিন, আমরা যে এ মুহূর্তে ব্রানসউইকের দিকে যাচ্ছি, তার পেছনেও আছে মিসেস মেলবোর উৎসাহ। তিনি স্যোশাল মিডিয়ার হিল্লা ধরে—কোথায় কী হবে, যাবতীয় তথ্যদি সংগ্রহ করেছেন। লকডাউন উঠে গেছে বটে, তবে আন্ডারলায়িং হেল্থ কন্ডিশনসের কারণে আমাদের গৃহে অন্তরিন থাকতে বলা হয়েছে। তাই, প্রথমে লংরেঞ্জ ডিসটেন্স আমাদের দ্বিধা ছিল, কিন্তু মিসেস মেলবো পাল্টা যুক্তি হাজির করেন, তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে ‘আই অ্যাম নট আ রেসিস্ট’ বলাই যথেষ্ট না, প্রয়োজন বর্ণবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে শরিক হওয়া।’ তো আমরা আজ তাঁকে নিয়ে রওয়ানা হয়েছি ব্রানসউইকের দিকে। মফস্বলী শহর-ভিত্তিক আন্দোলনটি সম্পর্কে আরো কিছু খুঁটিনাটি জানার প্রয়োজন আছে, কিন্তু পেছনে সিটে মিসেস মেলবো ঘুমিয়ে কাদা।

হলেণ চুপচাপ ড্রাইভ করছে। পথের এক পাশে নোনাজল-প্রিয় বাদামী ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তার ভেতরে দিয়ে সর্পিল ভঙ্গিমায় সমুদ্রের দিকে চলে গেছে খাড়ি, তাতে উর্মি তুলে আগুয়ান হচ্ছে জোয়ারের জল। মেঘভাসা আসমানের তলায় দীর্ঘ ঘাসের প্রান্তরটি লো-কান্ট্রি নামে পরিচিত। জলাভূমির এখানে সেখানে ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে রুপালি জলের পাশ ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে গ্রীবা সর্বস্ব শুভ্র সারস। সেলফোনে বিং করে এলান হয় ভাইরাস আপডেটের এ্যালার্ট। আর্টিফিসিয়েল ইন্টলিজেন্সের কেরেসমাতিতে মনে হয়, সেলফোনও জেনে গেছে যে, আমরা আগুয়ান হচ্ছি লো-কান্ট্রি মাড়িয়ে। চোখকোণ দিয়ে দেখি, রিঅপেনিংয়ের প্রতিক্রিয়ায় অত্র এলাকায় নতুন করে ভাইরাস আউটব্রেকের সংবাদ। এসব জায়গায় ঔপনিবেশিক যুগের আউটপোস্টের মতো গ্রাম ও মফস্বলী শহর আছে বেশ কয়েকটি। কোনো কোনো জনপদে হাসপাতাল বলে কিছু নেই, শহরে অবশ্য হেলথ সেন্টার আছে, খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে একটি-দুটি আইসিইউ ইউনিট, তবে শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট নিরসনের হাতিয়ার ভেন্টিলেটার প্রায় সর্বত্রই অনুপস্থিত। ঠিক বুঝতে পারি না, প্রশাসন এবার কোন প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাবে? নাকি এ যাত্রায়ও কিছু না করে মুমুর্ষ মানুষজনকে সুযোগ করে দেবে মৃত্যুর।

রাজসড়কটি বেঁকে চলে এসেছে সমুদ্রের কিনারে। সামান্য ফাঁক করা জানালা দিয়ে আসে নোনাজলের গন্ধ। হলেণ জানতে চায়, ‘ইউ রিমেমবার.. ভিজিটিং কোনিয়া ইন টার্কি উইথ মি?’ আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি, ‘অহ্ ইয়েস, ইট ওয়াজ ইনডিড মিনিংফুল টু ভিজিট হজরত জালাল উদ্দীন রুমিজ্ শ্যারাইন উইথ ইউ।’ সে এক হাতে খুটখাট করে ক্যাসেটটি বদলায়। এ ক্যাসেটের ধ্বনি পুরানো দিনের মতো মূর্চ্ছনা ছড়াচ্ছে দেখে খুশি হই। সুফিসন্ত রুমির মাজার সংলগ্ন মিউজিয়ামের গিফট শপ থেকে আমরা এ ক্যাসেটটিও কিনেছিলাম। গাড়ির চলমান আবহ ঘূর্ণায়মান দরবেশদের নৃত্যছন্দময় স্যামা পালনের নেপথ্য সংগীতে ভরপুর হয়ে ওঠে। সৈকতের কাছে আধডোবা হয়ে উল্টে পড়ে আছে বিরাট আকারের একটি জাহাজ। লকডাউনের দু-তিন সপ্তা আগে শত শত মোটরকার নিয়ে সেইল করা জাহাজটি কী কারণে জানি আগুন লেগে উল্টে গিয়েছিল। ঠিক মনে পড়ে না—রফতানীর পথে ডুবে যাওয়া ব্র্যান্ড নিউ গাড়িগুলোকে উদ্ধার করা হয়েছিলো কি?

দরিয়ার জলে ভেসে আসে একটি বিরাট বাণিজ্য জাহাজ। তার উত্তাল তরঙ্গ সংঘাতে আকুল হয়ে দোলে খানিক তফাতে ভাসা পালতোলা কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন সেইলবোট। হংসমরালের বন্ধনী হয়ে বাঁকানো একটি ঝাঁক চক্রাকারে ঘুরে ঝুপ ঝুপ করে ঝরে পড়ছে বালুচর সংলগ্ন জলে। হলেণ ড্রাইভ করতে করতে চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে আছে সিস্ক্যাপের দিকে, বুঝতে পারি—অনেক বছর আগে আমাদের কোনিয়া ট্রিপ নিয়ে এখনই সে কিছু বলতে চাচ্ছে না। ১৯৯২ সালের ঘটনা, আমি আঙ্গুলের আঁকে বৎসরের হিসাব কষি। হলেণ কানসালটেন্সির কাজ করছিল তুরষ্কে, তার সঙ্গে সপ্তা দুয়েক কাটানোর জন্য আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলে গিয়েছিলাম ইস্তাম্বুলে। ওখানে পৌঁছার আগে আমি বিগতভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম ওয়ার্কপ্লেসে বর্ণবাদী আচরণ সম্পর্কে। আমি পর পর তিনটি ওভারসিজ কন্সালটেন্সিতে ফাইনালিস্ট ছিলাম। আমার দু-একজন শ্বেতাঙ্গ সতীর্থরাও একই সাথে অ্যাপ্লাই করেছিল। তারা কোনো রকমের ফিল্ড এক্সপিরিয়েন্স বা পাবলিকেশনস্ ছাড়াই কাজ পেয়েছিল, প্রাসঙ্গিক কাজে ছয় বছরের মাঠ পর্যায়ের কাজ ও অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার অভিজ্ঞতা ছিল আমার, কিন্তু আমি নির্বাচিত হইনি। টেলিফোনে বিষয়টা জেনে হলেণই বর্ণবাদী আচরণ সম্পর্কে আমাকে সচেতন করে তোলে।

ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ডবাজার ও বসফরাস সংলগ্ন ওয়াটারফ্রন্ট প্রভৃতি জায়গায় ঘুরেফিরে আমাদের দিন কয়েক ভালোই কাটে। তবে কথাবার্তায় বারবার ফিরে আসতে থাকে ওয়ার্কপ্লেসে আমার বর্ণবাদী অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ। আমি যেখানে বসবাস করছিলাম, ম্যাসাচুসটেসের মফস্বল শহর অ্যামহার্স্ট, তা ছেড়ে বিরাট আকার মেট্রোপলিটান লস এ্যাঞ্জেলসে রিলকেট করার সম্ভাবনা হলেণ আমাকে ভেবে দেখতে বলে। তার যুক্তি ছিল—কসমোপলিটান নগরীতে নানা গাত্রবর্ণের মানুষজন বাস করছে কাছাকাছি, ওয়ার্কপ্লেসেও গাত্রবর্ণের বৈচিত্র প্রচুর, ‘আই গেজ, ইউ উইল ফিট ইন অ্যা বিগ সিটি রাইট অ্যা ওয়ে, বড় শহরে ভিন্ন গাত্রবর্ণের মানুষদের কর্মপ্রাপ্তির সম্ভাবনা অঢেল।’ সে লসএঞ্জেলসে তার সঙ্গে একত্রে লিভ টুগেদার করতে উৎসাহ দেয়।

ইস্তাম্বুল থেকে পুরো আটঘণ্টা বাস জার্নি করে আনাতোলিয়ার কোনিয়া শহরে পৌঁছে আমরা এত ক্লান্ত ছিলাম যে সকালে আর গেস্টহাউস থেকে বেরোইনি। আধশোয়া হয়ে শর্টওয়েভ রেডিয়ো শুনছিলাম। খবরে লসএঞ্জেলস্ নগরীতে রডনি কিং রায়টের কথা বিস্তারিতভাবে শোনা যায়। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ রডনি কিংকে গ্রেফতার করে চারজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে সড়কের ওপর ইলেকট্রিক শক দিয়ে বেধড়কভাবে পেটায়। ঘটনাটি ক্যামকর্ডারে ভিডিও করেন একজন পথচারী। তা মিডিয়ায় প্রচারিত হলে প্রতিক্রিয়ায় আদালতে বিচার বসে। তাতে জুরি অনেক বিচার-বিবেচনা করে অতঃপর পুলিশ অফিসারদের বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে লসএঞ্জেলস্ জুড়ে চলছে অগ্নিকাণ্ড, মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু মানুষের, পুলিশ গ্রেফতারও করেছে অনেক নাগরিককে, যাদের বেশিরভাগই হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষ।

সেলজুক সুলতানদের হাতে গড়া কোনিয়া নগরীতে পর্যটনের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা বিস্তর। ভেবেছিলাম, একটু বিশ্রামের পর প্রথমে ‘আলেদিন টেপে’-তে যাব পুরানো দিনের কেল্লা সংলগ্ন নগর প্রাচীর দেখতে, যেখানে এক জামানায় শানশওকতে দাঁড়িয়ে ছিল আলেদিন কায়কোবাদের বিপুল এক প্রাসাদ। তারপর গেস্টহাউসে ফেরার পথে সুলতান সেলিমের নির্দেশে তৈরি মসজিদটির পাশের গলিতে কোনো ক্যাফেতে ঢুকে এক পেয়ালা টার্কিশ কফি পান করতে করতে স্রেফ তাকিয়ে থাকব মিনার-গুম্বুজে চিত্রার্পিত আকাশের দিকে। কিন্তু লসএঞ্জেলসে রায়টের সংবাদ আমাদের করে তুলে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। রিল্যাক্স হালতে পর্যটন করার উৎসাহ আমরা হারিয়ে ফেলি। বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকার পর হলেণ প্রস্তাব করে মেভলানা মিউজিয়ামে যাওয়ার। মিউজিয়ামটি হজরত রুমির মাজারের কমপাউন্ডে তৈরি করা হয়েছে তুরষ্কে কামাল আতাতুর্কের সংস্কার-প্রবণ জামানায়। ট্যাক্সিতে বসে কথাবার্তায় জানতে পারি, সংকট দেখা দিলে, কিংবা উদ্বেগ বিপুল হয়ে উঠলে, ইস্তামবুলের দরবেশী তরিকার কোনো মাইফেলে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসা হলেণের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেভলানা স্কোয়ারে এসে ট্যাক্সির ভাড়া মেটানোর সময় দেখতে পাই পরিসর মহিমান্বিত করে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিমিয়া মসজিদের গুম্ভুজ ও মিনার। হজরত রুমির দরগা, যা তুর্কি জবানে ‘তাকে’ নামে পরিচিত, তার কমপাউন্ডে ঢোকার মুখে পড়ে দারুণভাবে অলংকৃত ‘দারভিশান কাপিসি’ বা দরবেশদের তোরণ। কাছেই হজরত রুমির মাজার, মানসিক প্রস্তুতি না নিয়ে এসে পড়েছি, তাই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জিয়ারত করে আমরা চলে আসি ‘সেমাহেইন’ বা ঘূর্ণায়মান দরবেশদের নৃত্যের পরিসরে। ওখানকার কার্নিশে বসে এক জোড়া ঘুঘু কেবলই ডেকে চলছে। সামান্য সময় জাদুঘরে কাটিয়ে আমরা চলে আসি গুলবাগে। ফোয়ারার ঝিরিঝিরি শব্দের সাথে গোলাপের সৌরভ মিশে ওখানে তৈরি হয়েছে আশ্চর্য এক পরিবেশ। তরুণ এক দরবেশ এসে আমাদের দিকে গোলাপপাশ বাড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যাবেলা ঘূর্ণায়মান দরবেশদের স্যামা মাহফিলে সামিল হওয়ার দাওয়াত দেন। হলেণ ধর্মে মুসলমান নয়, এ তথ্যটি সে জানালে, তিনি মৃদু হেসে তার কব্জি স্পর্শ করে ক্যালিওগ্রাফিতে হজরত রুমির ইংরেজিতে অনুবাদসহ মসনবী লেখা একটি লিফলেট বাড়িয়ে দেন। গুলবাগে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা ফিরে আসি গেস্টহাউসে। বিকালে ফের লিফলেটটি পড়ি, সাথে সাথে অনুধাবনের সুবিধার জন্য মার্জিন টুকে রাখি আমার ভাবতর্জমা। অনেক বছর পরও গাড়িতে ব্রানসউইকের দিকে যেতে যেতে রুমির কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে ফের ভাবি; ধর্ম, গোত্র ও বর্ণ-ভিত্তিক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে, সবাইকে একই কাফেলায় দাওয়াত দেওয়ার নির্দশন আজও আমার স্মৃতিতে বেনজীর হয়ে আছে। ভাবি, কোনো এক সুযোগে নিচে উল্লেখিত হজরত রুমির কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ খুঁজে বের করে তা মিসেস মেলবোর সঙ্গে শেয়ার করতে হয়।

এসো তুমি—ডাকছি আবার
এসো—আমাদের কাফেলায় আজ
পৌত্তলিক! পরিচয়ে কিবা কাজ,
অগ্নি উপাসক,
না হয় হলেইবা তপস্বী বক!
নাহকে নিমজ্জিত হয়ে—
করেছো বুঝি হাজারো পাপ,
আর ওয়াদার বরখেলাফ।

কিছু যায় আসে না—এসো
এসো, দাওয়াত হেঁকে যাই
হরেক কিসিম মানুষের কাফেলায়
তোমারও হবে যে ঠাঁই।

বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;