আর্নেস্ট হেমিংওয়ের অগ্রন্থিত গল্প : অনুসৃতিই আনন্দ



অনুবাদ: রাজিয়া সুলতানা
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ দিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেভাবে সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছিলেন, সেই একই কিউবার উপকূল থেকে শুরু ‘অনুসৃতিই আনন্দ’, এটিতেও আছে মার্লিনমাছের ঘটনা। মিশেছে আরো অনেক ঘটনাবলি। হেমিংওয়ের গুটি কয়েক গল্পই শুধুমাত্র অপ্রকাশিত আছে, এটি তার মধ্যে একটি। এটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে। হেমিংওয়ের নাতির সূত্রে পাওয়া গেছে এই অমূল্য গল্পটি।

এই গল্পের মূল আকর্ষণ ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ উপন্যাসিকার মার্লিনমাছ এবং হেমিংওয়ের আত্মজৈবনিক উপাদান। - বিভাগীয় সম্পাদক


সে বছর কিউবার উপকূলে আমরা মাসব্যাপী মার্লিনমাছ ধরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সেই মাসটা শুরু হয়েছিল এপ্রিলের দশ তারিখ থেকে। মে মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত আমরা পঁচিশটা মাছ ধরি এবং এই সময় আমাদের মাছধরার অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আমাদের উচিত ছিল কী ওয়েস্ট(১)-এ ফিরে যাওয়ার জন্য কিছু উপহারসামগ্রী কেনা আর এদিকওদিক ঘোরার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় আরেকটু দামি কিউবান জ্বালানি অনিটায় ভরিয়ে নিয়ে, হিসেবপত্র চুকিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু তখনও বড়মাছগুলো আসা শুরু করেনি।

মি. জোসি জিজ্ঞেস করল, “আর একটা মাস কি ওকে রেখে চেষ্টা করে দেখতে চাও, ক্যাপ?” ক্যাপ অনিটার মালিক আর দিনে দশ ডলার করে ভাড়ায় টিকেট দিচ্ছিল। সে সময়ে ভাড়ায় স্ট্যান্ডার্ড টিকেটের মূল্য ছিল দিনে পঁয়ত্রিশ ডলার।

“যদি থাকতে চাও তো কমিয়ে নয় ডলার করতে পারি।”
“নয় ডলার আমরা কোথায় পাব?”
“যখন টাকা হাতে আসে তখন দিয়ো। ব্যুলোতে উপসাগর জুড়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির সঙ্গে তোমাদের লেনদেন ভালো। বিল পাওয়ার পর গতমাসের টিকেট বিক্রির টাকা থেকে ওদের পরিশোধ করতে পারব। আর আমরা যদি বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে যাই তাহলে তুমি কিছু একটা লিখে দিয়ো।”

আমি বললাম “বেশ।” এরপর আমরা আরো একমাস ধরে মাছ ধরলাম। এরমধ্যে আমরা বেয়াল্লিশটা মার্লিন ধরলেও তখনও বড় মাছগুলো আসছিল না। তখনও মরো(২)র কাছে বইছিল গভীর ভারী স্রোত। কোনো কোনো সময় একরের পর এক টোপ ফেলে রাখা হতো—উড়ন্ত মাছগুলো বোটের সামনের অংশের নিচ থেকে লাফ দিত আর সামুদ্রিক পাখিগুলো সেগুলোকে ধরতে চেষ্টা করত। প্রতিদিনই আমরা সাদা মার্লিনগুলো ধরছিলাম, কিছু কিছু আবার হাতছাড়াও হয়ে যাচ্ছিল, একদিন আমি পাঁচটা ধরেছিলাম কিন্তু একটা বিশাল মাছও আমরা ধরতে পারিনি।

তীরে পানির কিনারে আমরা খুব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, সবগুলো মাছ কেটে টুকরো করে ওখানে সবাইকে দিয়ে দিতাম আর যখন মার্লিনমাছের পতাকা উড়িয়ে মরো কেল্লা পার হয়ে খালের ওপর দিয়ে সানফ্রান্সিসকোর জেটির দিকে যেতাম তখন লোকজন পারঘাটার দিকে দৌড়ে আসত। সে বছর পাউন্ড প্রতি আট থেকে বারো সেন্ট করে কিনে দ্বিগুণ দামে বাজারে বিক্রি করতে পারত বলে জেলেদের জন্য তা ছিল লাভজনক। যেদিন আমরা পাঁচটা পতাকা উড়িয়ে তীরে এলাম, পুলিশ লোকজনদের লাঠিপেটা করেছিল। তীরে অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। সে বছরটাও ছিল মন্দ।

জোসি বলল, “শালার পুলিশ আমাদের নিয়মিত সব খদ্দেরকে তাড়িয়ে দিয়ে সব মাছ নিয়ে নিচ্ছে।” একজন পুলিশ ঝুঁকে পড়ে মার্লিনের দশপাউন্ড ওজনের একটা টুকরা তুলে নেওয়ার সময় জোসি বলল—“আচ্ছা মানুষ তো আপনি, দূর হোন।” পুলিশ বলেছিল—“এইরকম কুৎসিত চেহারা তো আমি এর আগে কখনো দেখি নাই। তোমার নাম কী হে?”

বলাবাহুল্য, পুলিশ ওর একটা নাম দিয়ে দিল।

“কমপ্রমিজো-বইয়ে ওনার নাম আছে নাকি, ক্যাপ?”

আমরা যাদের মাছ দেব বলে কথা দিতাম, তাদের নাম এই বইয়ে লিখে রাখতাম যার অর্থ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি-বই।

“আরে নাহ।”

মি. জোসি বলল, “পরের সপ্তাহের তালিকায় ছোট একটা টুকরার জন্য ওর নামটা লিখে রাখো তো, ক্যাপ।” “আর এই যে পুলিশ, আপনে এখন পাটাতন থেকে নেমে দূর হোন, জাহান্নাম বা অন্য কোথাও যান আর এমন কাউকে লাঠিপেটা করেন যে আমাদের বন্ধু নয়। জীবনে অনেক হারামী পুলিশ দেখেছি। যান, ঘাটের পুলিশ না হলে লাঠি পিস্তল দুটোই নিয়ে দূর হোন।”

শেষে সমস্ত মাছ কেটে টুকরো করে বই অনুযায়ী যার যার মাছ আলাদা করে রেখেছিলাম আর পরের সপ্তাহের জন্য প্রতিশ্রুতি-বই নাম দিয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

“আম্বুজ মুন্ডোজ-এ গিয়ে ধুয়ে টুয়ে পরিষ্কার হয়ে নাও, ক্যাপ। স্নান সেরে নাও। তারপর ওখানে তোমার সঙ্গে কথা হবে। আমরা ফ্লোরিদিতায় গিয়েও কথাবার্তা সেরে নিতে পারব। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমার মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছে।”
“তুমিও ওখানে আসতে পারো তো, শাওয়ার নিতে পারো। আমি এখানেই পরিষ্কার হয়ে নেব’খন। আজ আমি তোমার মতো অতটা ঘামিনি।”

আমি আম্বুজ মুন্ডোজ হোটেলের দিকে খোয়া দিয়ে বাঁধানো এই সংক্ষিপ্ত রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে গিয়ে কোনো চিঠি এসেছে কিনা ডেস্কে খোঁজ নিয়ে লিফটে উঠে উপরের তলায় গেলাম। আমার রুমটা ছিল উত্তর-পূর্ব কোণে আর জানালা দিয়ে আয়নবায়ু এসে শীতল করে দিচ্ছিল। আমি জানলা দিয়ে পোতাশ্রয়ের চারিদিকে পুরনো শহরের ছাদগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। দেখলাম মেক্সিকোর অরিজবা শহর তার সমস্ত বাতি নিয়ে ধীরে ধীরে পোতাশ্রয়ের নিচে নিভে যাচ্ছে। অত অত মাছ ধরে আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছিল খুব। আমি জানতাম শুলেই ঘুম এসে যাবে চোখে, তাই বিছানায় বসে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন দেখতে পেলাম বাঁদুড়েরা শিকারে নেমেছে, আমি কাপড় খুলে স্নান সেরে পরিষ্কার কাপড় পরে নিচের তলায় গেলাম। মি. জোসি তখন হোটেলের দরোজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

সে বলল—“তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত, আর্নেস্ট।”
”না”, আমি মিথ্যে বললাম।

সে বলল, “আমি ক্লান্ত। তোমার মাছ টেনে তোলা দেখতে দেখতেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের সর্বসময়ের রেকর্ড অনুযায়ী মাত্র তো দুইটা। সাত আর আট নাম্বার চোখ।” মি. জোসি আর আমি কখনোই আটনম্বর মাছের চোখ এভাবে বলতে পছন্দ করতাম না, কিন্তু সবসময় এভাবেই লিখে রাখতাম।

আমরা অবিস্পো স্ট্রিটের পাশের ছোট রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আর মি. জোসি দোকানের সমস্ত আলোকিত জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়ি ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত সে কখনো কিছু কিনত না। কিন্তু মূল্যহ্রাসের পণ্যগুলো দেখতে পছন্দ করত। আমরা দুটো দোকান পেছনে ফেলে লটারির টিকেট বিক্রির অফিসে এসে পৌঁছালে ঠেলা দিয়ে ফ্লোরিদিতার ঝুলন্ত দরজাটা খুললাম।

মি. জোসি বলল— “তুমি বরং বসো, ক্যাপ,”
“না, আমার কাছে পানশালায় দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।”

মি. জোসি বলল, “বিয়ার, কোনটা? জার্মান বিয়ার খাচ্ছো, ক্যাপ?”
“চিনিহীন হিমায়িত ড্যাকোরি খাচ্ছি।” কন্সতান্তে যথেষ্ট পরিমাণে মালমশলা রেখে গেছে। আরো দুটো বানানো যাবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম যে মি. জোসি কথা তুলবে। বিয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে সে বলতে শুরু করল।

বলল, “কার্লোস বলেছে ওদের পরের মাসে আসতে হবে।” কার্লোস ছিল আমাদের কিউবান সঙ্গী আর মার্লিনমাছের মস্তবড় ব্যবসায়ী জেলে। “এইরকম স্রোত নাকি ওরা আর কখনো দেখেনি। এবার ওরা এমনভাবে আসবে সেও নাকি আমরা কখনো দেখিনি। বলেছে পরের মাসে নাকি ওদের আসতেই হবে।”
“আমাকেও বলেছে।”
“ক্যাপ, তুমি যদি আরেকটা মাস থাকতে চাও তবে দিনে আট ডলারে অনিটাকে ভাড়া দিতে পারি আর স্যান্ডউইচ কিনে টাকা অপচয় করার চেয়ে আমি নিজেই রান্না করতে পারব। দুপুরের খাবার রান্নার জন্য ওই খাড়িতে গিয়ে ঝটপট রান্না সেরে ফেলতে পারব। গায়ে ঢেউখেলানো স্ট্রাইপঅলা বনিটো মাছগুলো তো সবসময়ই ধরছি। ছোট্ট টুনামাছের মতো খেতে দারুণ স্বাদ ওগুলোর! কার্লোস বাজারে মাছের আধার আনতে গেলে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে আনবে বলেছে। রাতের খাবারটা আমরা পার্লা অব সানফ্রান্সিসকো রেস্তোরাঁতে খেতে পারি। গতরাতে আমি ওখানে পঁয়ত্রিশ সেন্ট দিয়ে ভালো মতন খেয়েছি।”
“আমি পয়সা বাঁচানোর জন্য গতরাতে না খেয়ে ছিলাম।” “তোমাকে খেতে হবে, ক্যাপ। সে জন্যেই মনে হয় তোমাকে আজ একটু ক্লান্ত লাগছে।”
“আমি জানি, কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে আরেকটা মাস চেষ্টা করে দেখতে চাও?”
“অনিটাকে তাহলে একমাসের জন্য আর এখান থেকে বের হতে হবে না। বড় মাছগুলো এলে এই স্থান ছেড়ে কেন আমরা চলে যাব?”
“তোমার অন্য কোনোকিছু কি করার আছে?“
“না, তুমি কী করবে?”
“তোমার কি মনে হয়, মাছ সত্যি সত্যি আসবে?”
“কার্লোস বলেছে আসতেই হবে।”
“তাহলে ধরো, আমরা একটা বড় মাছ ধরলাম আর আমাদের শক্তি দিয়ে ওকে ধরে রাখতে পারলাম না।”
“পারতে হবে। ভালো মতন খাওয়া দাওয়া করলে সারাজীবনই ধরে রাখা যাবে ওকে। আর আমরা তো ভালো খাবও। আমি অন্য কিছুও ভাবছি।”
“কী?”
“তুমি যদি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও, আর কোনো সামাজিক জীবন না থাকে যদি তোমার, দিনের আলো ফুটে উঠতেই ঘুম থেকে উঠে লিখতে আরম্ভ করে আটটা পর্যন্ত লিখে সারাদিনের লেখালেখি শেষ করতে পারো যদি, তো যাবার আগে কার্লোস আর আমি সবকিছু রেডি করে রাখব, তুমি শুধু আমাদের সঙ্গে বোটে উঠে যাবে।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। মেনে নিচ্ছি আমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না।”
“ওই সামাজিক জীবনই তো তোমাকে শেষ করে দিচ্ছে, ক্যাপ। তাই বলে বলছি নে সামাজিক জীবন একেবারেই থাকবে না। শনিবার রাতগুলোতে থাকতে পারে।”
“ঠিক আছে।” আমি বললাম। “শুধু শনিবার রাতগুলোতে সামাজিক জীবন চলবে। কী নিয়ে লিখব এ ব্যাপারে তোমার কোনো পরামর্শ?”
“সে তোমার ব্যাপার, ক্যাপ। আমি এ নিয়ে কিছু বলব না। তুমি যখন কোনো কাজ করো, সবসময়ই ভালোভাবে করো।”
“তোমার কী পড়তে পছন্দ?”
“ইউরোপ বা পাশ্চাত্য নিয়ে ভালো ছোট গল্প লেখো না কেন অথবা যখন নিষ্কর্মা ছিলে বা যুদ্ধে ছিলে—এই জাতীয় বিষয় নিয়ে। শুধু তুমি আর আমি জানি এমন কোনো বিষয় নিয়ে লেখো না কেন? অনিটা যা যা দেখেছে তা নিয়ে লিখতে পারো। যথেষ্ট সামাজিক জীবন দিয়ে ভরিয়ে লিখবে যেন সবার কাছে তা আবেদন সৃষ্টি করে।”
“আমি সামাজিক জীবন একেবারে বাদ দিয়ে দিচ্ছি।”
“অবশ্যই বাদ দেবে, ক্যাপ। কিন্তু তোমার তো মনে রাখার অনেককিছু আছে। সামাজিক জীবন এখন না থাকলে কোনো ক্ষতি হবে না।”

আমি বললাম, “না। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে মি. জোসি। আগামীকাল সকাল থেকে আমি লেখার কাজ শুরু করে দেব।”
“আমি ভাবছি নতুন এই নিয়ম শুরু করার আগে আমাদের যা করা উচিত তা হচ্ছে আজ রাতে তোমার বিরল কোনো মাছের বড় একটা টুকরা খাওয়া উচিত। তাহলে কাল সকালে উঠে শরীরে অনেক শক্তি পাবে আর মাছ ধরার জন্য এই শক্তি কাজ দেবে খুব। কার্লোস বলেছে বড় মাছগুলো যে কোনো সময়ে আসতে শুরু করে দেবে। ক্যাপ, তোমার সর্বশক্তি দিয়ে ওদের ধরে রাখতে হবে কিন্তু।”
“তোমার কি মনে হয় আর একটা ড্যাকোরি বেশি গিললে কোনো ক্ষতি হবে?”
“ধূর! কী যে বলো না, ক্যাপ। এর মধ্যে রাম দেয় একটু, একটু লেবুর রস আর মেরাশচিনো। কোনো ক্ষতি হবে না।”

ঠিক তখন আমাদের পরিচিত দুটো মেয়ে পানশালায় এলো। সেই সন্ধ্যেয় খুব ফ্রেশ লাগছিল ওদের আর দেখতে খুব সুন্দরী ছিল ওরা।

ওদের একজন স্প্যানিশ ভাষায় বলল, “এরা জেলে দেখছি।”

অন্য মেয়েটা বলল, “হু, সমুদ্র থেকে আসা বিশালদেহী দুজন স্বাস্থ্যবান জেলে।”

মি. জোসি আমাকে বলল, “এন.এস.এল”।

আমিও নিশ্চিত করতে বললাম , “নো সোশাল লাইফ (এন.এস.এল)। মেয়ে দুজনার একজন বলল—“তোমাদের গোপন কোনো ব্যাপার আছে নাকি?” এই মেয়েটা ছিল অসম্ভব রূপবতী, চেহারায় কোথাও এতটুকুন খুঁত ছিল না। ওর আগের কোনো বন্ধুর ডান হাত ওর অমন সুন্দর টানটান নাকের রেখাটা নষ্ট করে দিয়েছে।

মি. জোসি মেয়ে দুটোকে বলল, “ক্যাপ আর আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছি।” এরপর তারা পানশালার দূরবর্তী কোণের দিকে চলে গেল। মি. জোসি আমাকে বলল, “ব্যাপারটা কী সহজ হয়ে গেল, দেখেছো? আমি সামাজিক দিকটার পুরোটাই সামলাব, তোমাকে শুধু ভোরবেলা উঠে লেখালেখির কাজ সেরে ফেলে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে। শারীরিকভাবে সবসময় শক্তিসামর্থ্য রাখতে হবে। বিশাল মাছগুলো, যেগুলোর ওজন হাজার পাউন্ড অথবা তার চেয়েও বেশি, সেগুলোর সঙ্গে পেরে উঠতে হবে।”

আমি বললাম—“চলো, আমরা কাজ বদল করি। আমি সামাজিক দিকটা দেখব’খন। তুমি খুব সকালে উঠে লিখবে। হাজার পাউন্ড ওজন ছাড়িয়ে যাওয়া বড় মাছগুলোকে সামলানোর জন্য শরীরটাকে তৈরি রাখবে সবসময়।”

জোসি সিরিয়াস হয়ে বলল, “তাহলে আমি তো খুশিই হই, ক্যাপ। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে তুমিই তো শুধু লিখতে পা্রো। তুমি আমার চেয়ে বয়সেও ছোট। আর মাছ সামলানোর জন্য তুমিই বেশি উপযুক্ত। যেভাবে আমি বোট চালাই, তাতে আমি মনে করি ওই মাছ আমি বোটে তোলা মানে ইঞ্জিনের বারোটা বাজানো।”

“তা জানি, আমিও চেষ্টা করব লেখালেখির কাজটা ভালো করে করতে।” আমি বললাম। মি. জোসি বলল—“আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে চাই। আর চাই যে শালার, মহাসমুদ্রে আমরা পৃথিবীর সবচে বড় মার্লিনটা ধরি, ভালোভাবে ওটার ওজন করি আর কেটে টুকরা করে ওই শালার ব্যাটা ডাণ্ডাবাজ পুলিশকে নয়, বরং গ্রামে আমাদের পরিচিত দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিই।”
“আমরা তাই করব।”

ঠিক তখন মেয়েদুটোর একজন পানশালার দূরের কোণ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। সেই রাতে ব্যবসা মন্দা ছিল। আমরা ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিল না। মি. জোসি বললেন, “এন. এস.এল।” আমিও অভ্যেসমতন পুনরাবৃত্তি করলাম। বললাম—“এন.এস.এল (নো সোশাল লাইফ।)”

“কন্সতান্তে,” মি. জোসি বললেন, “আর্নেস্তো একজন ওয়েটার চাচ্ছে। আমরা বিরল মাছের দুটো বড় টুকরা অর্ডার দিতে যাচ্ছি।”

কন্সতান্তে মৃদু হেসে আঙুল দিয়ে ওয়েটারের জন্য ইশারা করল।

মেয়েদুজনার পাশ দিয়ে ডাইনিংরুমে যাবার সময় ওদের একজন হাত বাড়িয়ে দিলে আমি হ্যান্ডশেক করলাম আর গম্ভীরভাবে স্প্যানিশ ভাষায় বললাম—“এন. এস. এল।”

অন্য মেয়েটি বলল, “হায় ঈশ্বর, এরা তো রাজনীতি করে আর এরকম একটা বছরে।” ওদের মধ্যে কিছুটা মুগ্ধতা, কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছিল।

উপসাগর জুড়ে সকালের প্রথম আলো যখন আমাকে জাগিয়ে দিল, আমি উঠে গিয়ে মি. জোসির যেন পছন্দ হয় এই আশায় একটা ছোটগল্প লিখতে শুরু করলাম। সেই গল্পে অনিটার কথা ছিল, সমুদ্রতীরের কথা ছিল, আর যা যা ঘটেছিল সেইসব কথা ছিল। প্রতিদিন আমি সমুদ্রের অনুভূতিটা, সেখানে যা যা দেখেছি, শুনেছি, যা কিছুর গন্ধ শুঁকেছি, অনুভব করেছি—তার সবই লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করেছিলাম। প্রতিদিন সকালে উঠে আমি গল্পটা লিখতাম, মাছ ধরতে যেতাম আর ভালো ভালো মাছ ধরতাম। মাছ ধরার জন্য আমি কঠিন প্রশিক্ষণ দিতাম আর চেয়ারে বসে না থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরতাম। এরপরও বড় মাছগুলো আসছিল না। একদিন আমরা এক লোককে ব্যবসায়ী জেলেদের একটা ডিঙি নৌকা দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে দেখলাম।স্পিডবোট যেমন বোটের সামনে ঢেউ তুলে পানি ছড়িয়ে চলে যায়, তেমনি করে প্রত্যেকবার লাফানোর সময় মার্লিনমাছও সেভাবে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিল। ওই ডিঙি-নৌকাটা ভেঙে গিয়েছিল।

আরেকদিন, দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে আমরা দেখলাম চারজন লোক গাঢ় বেগুনি রঙের গভীর প্রশস্ত একটা মাছ একটা ডোঙাতে তোলার চেষ্টা করছে। কেটে নাড়িভুড়ি ফেলে দেওয়ার পর সেই মার্লিনটার ওজন হয়েছিল পাঁচশ পাউন্ড আর পুরনো বাজারের মার্বেলপাথরের ফলকের ওপর কাটতে দেখেছিলাম সেই মাছের বিশাল বিশাল চাকা।

তারপর আরেক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে খুব কাছ থেকে পোতাশ্রয়ের মুখে দেখেছিলাম গভীর কালো স্রোত। পরিষ্কার সেই পানির দুই বাঁও গভীরে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। আমাদের প্রথম বড়মাছটা ধরা পড়ে মরোর পাশেই। সেইসব দিনগুলোতে পাল খাটাবার কোনো খুঁটি ছিল না, রড ধারণ করার কিছু ছিল না। খালে হালকা একটা খুঁটি দিয়ে বড় একটা মাছ ধরার আশায় ছিলাম। আর তখনই এই মাছটা ধরা পড়েছিল। বিরাট একটা ঢেউ তুলে এসেছিল সে, বিলিয়ার্ড কিউ-এর বন্ধ করাতের মতো দাঁত আর সেই দাঁতের পেছনে তার বিশাল মাথাটা ছিল ডিঙি নৌকার মতো প্রশস্ত। তারপর বোটের সমান্তরালে সুতো টানতে টানতে দ্রুত সে আমাদের থেকে দূরে চলে গেল । বড়শির রিল এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল যে ছুঁতে গেলে হাতে গরম লাগছিল। পনেরটা সুতোর প্যাঁচ দিয়ে একেকটা থ্রেড তৈরি আর রিলে ভরা হয়েছিল এই থ্রেডের চারশ গজ—আমি অনিটার সামনের দিকটায় ভেতরে আসতে আসতে যার অর্ধেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল।

বোটের ছাদের দিকে ধরার জন্য যে হ্যান্ডলক আমরা আগেই বানিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো ধরে ধরে আমি সেইদিকে এগুলাম। এইটা আমরা আগেই অনুশীলন করেছিলাম। বোটের কানসেতে পা রেখে দ্রুত ঠেলা দিয়ে পাটাতনে উঠে যাওয়া যায়। কিন্তু লোকাল স্টেশনের সাবওয়ে এক্সপ্রেসের মতো যে মাছ দ্রুত পার হয়ে চলে যায় সেই মাছের সঙ্গে তো আর প্র্যাকটিসটা করা হয়নি। একহাত দিয়ে রডটা ধরে ছিলাম কিন্তু রডের প্রান্তটা নিচে ওটা রাখার জায়গাটিতে ঘষা খাচ্ছিল, খুঁড়ছিল। আর রডের সুতোর টানে আমার অন্যহাতটি, খালি দুইপা বোটের মেঝেতে এসে ধাক্কা খেয়ে থেমে গিয়েছিল।

আমি চিৎকার করে বললাম, “হুক দিয়ে ওকে গেঁথে ফেলো, জোসি। রিলের সবটুকু সুতোই টেনে নিচ্ছে দেখছি।”
“গাঁথা হয়েছে তো, ক্যাপ, দেখো না কী অবস্থা।”

তখন অনিটার কানসের ওপর এক পা, বোটের ডানদিকে নোঙ্গরের ওপর আরেক পা দিয়ে আমি প্রতিরোধ করতে ব্যস্ত। কার্লোস আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে আর আমাদের সামনে মাছটা লাফাচ্ছে। এই অবস্থায় মাছটাকে দেখতে লাগছে মদের ব্যারেলের মতো। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ওকে রূপোলি দেখাচ্ছিল আর আমি ওর গায়ের পাথালে ওপর থেকে নিচে নেমে যাওয়া বড় বড় বেগুনি রঙের স্ট্রাইপগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার লাফানোর সময় মনে হচ্ছিল পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন কোনো ঘোড়া নিচে লাফিয়ে পড়ছে। মাছটা লাফাতেই থাকল, লাফাতেই থাকল, লাফাতেই থাকল। অনিটা পূর্ণ গতিতে মাছের পিছনে পিছনে ছুটলেও রিল এতটাই গরম হয়ে যাচ্ছিল যে হাত দিয়ে ধরে রাখা যাচ্ছিল না আর সুতোর মাঝখানটা টানের প্রবল বেগে ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছিল।

আমি চিৎকার করে মি. জোসিকে বললাম, “অনিটার গতি কি আরো একটু বাড়ানো যায়?”
“এই পৃথিবীতে তা সম্ভব নয়। আর সুতো নেই?”
“খুবই সামান্য আছে।”

কার্লোস বলল, “মাছটা অনেক বড়। এত বড় মার্লিন আমি জীবনে দেখি নি। শুধু যদি থামত একবার আর নিচের দিকে যেত, তাহলে ওর কাছে যেতে পারতাম আমরা, যথেষ্ট সুতোও পেয়ে যেতাম।”

মরো ক্যাসেল থেকে ন্যাশনাল হোটেলের বিপরীত দিকে মাছটা তখন এক পাক দেওয়া শেষ করেছে। আমরাও ওর পিছে পিছে একইভাবে গিয়েছি। রিলে তখন বিশ গজের মতো সুতো আছে। এমন সময় মাছটা থামল। আমরা সুতো উদ্ধার করতে করতে দ্রুত ওর কাছে গেলাম। আমার মনে আছে, আমাদের সামনে ছিল সুতো সরবরাহকারী একটা গ্রেস লাইন জাহাজ। কালো রঙের একটা পাইলট বোট সেদিকে যাচ্ছিল। এদিকেই যেহেতু আসছিল, আমার ভয় হচ্ছিল আমরা না আবার ওটার গতিপথের মধ্যে পড়ে যাই। রিলে সুতো পেঁচাতে পেঁচাতে আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম এবং আমাদের বোটের সামনে ফিরে এসেছিলাম। দেখেছিলাম বোটটা গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন, বেশ দূর থেকে আমাদের এদিকেই আসছিল তবে আমাদের সঙ্গে পাইলট বোটের ফাজলামো করার প্রশ্নই আসে না।

তখন আমি চেয়ারে বসে আর মাছটা সোজা উপর নিচ হয়ে আর রিলে চড়ছিল তৃতীয় সুতোটা। রিলের তাপ কমানোর জন্য ওতে সমুদ্রের পানি ঢালছিল কার্লোস; বালতিতে করে আমার মাথা আর ঘাড়েও ঢালছিল।

মি. জোসি জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো তুমি, ক্যাপ?”
“ঠিকঠাক মতন আছি।”
“বোটের সামনে লেগে কোথাও আঘাত পাওনি তো?”
“না।”
“তুমি কি ভেবেছিলে কখনো ওখানে ওইরকম একটা মাছ থাকতে পারে?”
“না।”

কার্লোস চিৎকার করে বলতে লাগল, “গ্রান্ডে গ্রান্ডে,” বিরাট শিকারী কুকুরের মতো কাঁপছিল সে আর বলছিল, “জীবনে এইরকম মাছ দেখিনি আর। কখনোই দেখিনি। কক্ষনো না, না দেখিনি।”

পরে একঘণ্টা কুড়ি মিনিট মাছটার কোনো খবর ছিল না। প্রথম যেখানে ও শব্দ করেছিল, প্রবল স্রোত সেখান থেকে আমাদেরকে ছয়মাইল দূরে কোজিমারের উল্টোদিকে টেনে নিয়ে গেল। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আমার হাত আর পায়ের অবস্থা ভালো ছিল। রিল থেকে ওকে সুতো ছাড়ছিলাম একই গতিতে, সাবধানে ছিলাম যেন জোরে টান না খায় অথবা ঝাঁকুনি না লাগে। আমি কিন্তু সরাতেও পারতাম ওকে ওখান থেকে। কিন্তু কাজটা সহজ হতো না মোটেও। তবে ব্রেকিং পয়েন্টের এইপাশে সুতো ধরে রাখতে পারলে তা সম্ভব হতো।

“ও আসবে। বড় মাছগুলো কখনো এমন করে,” কার্লোস বলল, “তবে যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠার আগেই হুকঅলা ডান্ডা দিয়ে ওকে কাবু করে ফেলতে পারো।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ও আসবে কেন এখন?”

কার্লোস বলল, “ওর মাথা আউলায় গেছে আর তুমি তো ওর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছো। কী হচ্ছে তার কিছুই কিন্তু বুঝতে পাচ্ছে না ও।”

আমি বললাম, “ওকে একটুও বুঝতে দিয়ো না কিন্তু।”

কার্লোস বলল, “নাড়িভুড়ি কেটে ফেলে দেওয়ার পর ওর ওজন নয়শ পাউন্ডেরও বেশি হবে।”

মি. জোসি বলল, “এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।”
“অন্য কোনোভাবে চেষ্টা করতে চাও, ক্যাপ?”
“না।”

আমরা যখন কাছে গেলাম মাছটার, দেখলাম বিশাল দেহ ওর। ভয়ংকর রকমের নয় তবে অসম্ভব বড় ছিল মাছটা। দেখলাম সে ধীর আর শান্ত হয়ে আছে। বলতে গেলে কাস্তে ব্লেডের মতো দেখতে বেগুনি রঙের দারুণ দুটো পাখনা নিয়ে সে পানিতে চুপ করে আছে। এরপর আমাদের বোটটা ও যেই না দেখে ফেলল, অমনি সুতো রিল থেকে প্রচণ্ড বেগে ছুটল যেন কোনো মটরগাড়ির সঙ্গে হুক দিয়ে আমাদের লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাফাতে লাফাতে ও উত্তরপশ্চিম দিকে যাচ্ছিল আর প্রত্যেক লাফের সঙ্গে গা থেকে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছিল।

আবার আমাকে বোটের ভেতরে সামনের দিকে যেতে হয়েছিল। মাছটা যতক্ষণ না শব্দ করা বন্ধ করল ততক্ষণ আমরা ওকে ধাওয়া করে গেলাম। এইবার সে মরোর উল্টোদিকের ভাটিতে চলে গেল। আবার আমাকে বোট চালিয়ে সামনে আসতে হলো।

“কোনো ড্রিংকস লাগবে তোমার, ক্যাপ?” মি. জোসি জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম, “না, কার্লোসকে বলো রিলে তেল মাখতে, তেল যেন বাইরে না পড়ে আর আমার ওপর কিছু লবণাক্ত পানি ঢালো।”
“কিছুই কি দিতে পারব না তোমাকে, ক্যাপ?”
“পারো, দুটো হাত আর একটা নতুন পিঠ দিতে পারো।” আমি বললাম।
“কুকুরীর বাচ্চাটার তেজ এখনো কমে নাই। শুরুতে যেমন সতেজ ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে।”

এরপর দেড়ঘণ্টা পর ওকে দেখা গেল কজিমা পার হয়ে বেশ খানিকটা দূরে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে। ওকে ধাওয়া করতে করতে আমাকে বোটের ভেতরে সামনের অংশে যেতে হয়েছিল।

ফিরে এসে যখন সামনে বসছিলাম তখন মি. জোসি বলল, “মাছটা কেমন, ক্যাপ?”
“সবসময় যেমন, তেমন। তবে রডের অবস্থা বেশি ভালো না।”

রডটা প্রথমে সুন্দর পূর্ণ একটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল, কিন্তু যখন তুললাম যেরকম সোজা হবার কথা ছিল, সেরকম আর হলো না।

মি. জোসি বলল, “ওর আরো কিছু শক্তি বাকি আছে। মনে হচ্ছে ওর পেছনে তোমাকে লেগে থাকতে হবে অনন্তকাল, ক্যাপ। তোমার মাথায় আরো পানি ঢালতে বলছ?”

আমি বললাম, “এখুনিই না। রডটা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওর ওজন এত বেশি যে এইমাত্র রডের শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে।”

একঘণ্টা পর মাছটা আবার এগিয়ে আসছিল, ধীর বৃত্তাকার একটা স্থির গতিতে ভালোই এগুচ্ছিল সে। বড় একটা বৃত্ত তৈরি করে শ্লথ গতিতে আসছিল।

কার্লোস বলল, “ও ক্লান্ত হয়ে গেছে। এখন গা ছেড়ে দেবে। লাফালাফি করে ওর বাতাসের থলেগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। গভীরে যাবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর পারবে না।”

আমি বললাম, “রডের অবস্থাও শেষ। বেঁকেছে তো বেঁকেছে। আর সোজা হতে পারছে না মোটেও।”

সত্যিই তাই। রডের মাথাটা পানির উপরিভাগ ছুঁয়েছে, মাছটা ওপরে তোলার জন্য রড ওঠালে, রিলে সুতো ওঠানো রড আর নিতে পারছে না। রড আর রড নেই। যেন সুতোর অভিক্ষেপ শুধু। যদিও প্রত্যেকবার উঁচুতে তোলার সময় তখনও কয়েক ইঞ্চি সুতো ফিরে পাওয়া সম্ভব ছিল। তবে ওইটুকুই, এর বেশি নয়।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


মাছটা বৃত্তাকারে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। অর্ধেক বৃত্ত পূর্ণ করে যখন বাইরের দিকে যাচ্ছিল তখন রিল থেকে সুতোর প্যাঁচ খুলে আসছিল। যখন ভেতরের দিকে আবার বৃত্তে ফিরে আসছিল তখন সুতো আবার উদ্ধার হচ্ছিল। কিন্তু রডের অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য ওকে তো আর শাস্তি দিতে পারো না। আর ওর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই বা করবে কিভাবে।

আমরা একে অন্যকে ক্যাপ বলে সম্বোধন করতাম। আমি মি. জোসিকে বললাম, “খুব খারাপ। ও যদি ডুব দিয়ে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তবে ওকে আর কখনোই ওপরে তুলতে পারব না আমরা।”

“কার্লোস বলেছে ও উপরে আসছে। বলেছে ও লাফাতে লাফাতে শরীরে এত বেশি বাতাস নিয়ে ফেলেছে যে চাইলেও অত গভীরে যেয়ে মরতে পারবে না। বড় মাছগুলো অতিরিক্ত লাফালাফি করে শেষে এসে এরকমই করে। আমি গুনে দেখেছি ছত্রিশবার লাফ দিয়েছে মাছটা, মনে হয় একবার গুনতে ভুলেও গেছি।”

আমার জীবনে শোনা সবচে লম্বা বক্তৃতাগুলোর মধ্যে এটি একটি। মি. জোসি যেভাবে বলল তাতে আমি একেবারে মুগ্ধ। ঠিক তখনই মাছটা ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে নিচের দিকে যেতে শুরু করল। আমি দুহাত দিয়ে রিলের সুতো ছাড়ছিলাম আর ব্রেকিং পয়েন্ট থেকে সুতোকে রক্ষা করায় ব্যস্ত ছিলাম। রিলে ড্রামের ধাতুটা আমার আঙুলের নিচে ছোট ছোট ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুরছিল।

আমি মি. জোসিকে জিজ্ঞেস করলাম, “সময় কেমন কাটছে? তিনঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট ধরে তো ওর সঙ্গে আছ।”

কার্লোসকে বললাম, “আমি তো ভাবলাম তুমি বলেছো ও নিচে গিয়ে মরতে পারবে না।”

“হেমিংওয়ে, ওকে যে উপরে আসতেই হবে। আমি জানি, ওকে আসতেই হবে।”

আমি বললাম, “ওকে বলো না কেন আসতে।”

মি. জোসি বলল, “ওকে পানি দাও তো কার্লোস।” “আর তুমি কথা বোলো না তো, ক্যাপ।”

বরফপানি খুব ভালো লাগছিল। কিছু পানি মুখ থেকে বের করে কব্জির ওপর ছেড়ে দিলাম আর কার্লোসকে বললাম গ্লাসের বাকি পানিটা আমার ঘাড়ের পেছনে ঢেলে দিতে। ঘাড়ে খালি চামড়ায় যেখানে হার্নেসের ঘষা লেগেছিল সেখানে ঘামের লবণ মেখে ছিল কিন্তু সূর্যের তাপ এতটাই প্রখর ছিল যে রক্তের কোনো তাপ অনুভব করিনি। জুলাই মাসের এক দুপুর ছিল সেটা।

“ওর মাথায় স্পঞ্জ দিয়ে আরো কিছু লবণাক্ত পানি ঢালো।” মি.জোসি বলল।

ঠিক তখন মাছটা সুতো টানা ছেড়ে দিল। কতক্ষণ স্থির হয়ে রইল, মনে হলো শানের কোনো জেটির সঙ্গে আমাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে সে আবার নড়তে শুরু করল। আমি শুধু হাতের কব্জি দিয়ে এমনভাবে সুতো উদ্ধার করতে লেগে গেলাম যেন রডে কোনো স্প্রিং ছিল না আর এতটাই নেতিয়ে পড়েছিল সেটা, মনে হচ্ছিল যেন ক্রন্দনরত কোনো উইলো গাছ।

পানির ওপর থেকে প্রায় একবাঁও নিচে আমরা ওর অভিক্ষিপ্ত লম্বা বেগুনি রঙের চমৎকার দাগযুক্ত পাখনা দুটো দেখতে পেলাম। মনে হলো যেন একটা ডোঙা। তখন সে ধীরে ধীরে বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করে দিল। ঘুরতে খুব যেন সুবিধা করতে না পারে সেজন্য আমি ওকে সাধ্যমতন চাপে রাখলাম। এতটাই চাপ প্রয়োগ করলাম যে সুতো ছিঁড়ে যাবার যোগাড় হলো আর এই অবস্থায় পড়লে রড ছেড়ে না দিয়ে আর কোনো উপায় থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে রড ভাঙল না বটে কিন্তু শক্তি হারিয়ে নষ্ট হয়ে গেল।

কার্লোসকে বললাম, “বড় খুঁটি থেকে ত্রিশ বাঁও সুতো কেটে নাও। বৃত্তে ঘুরে আসার সময় আমি ওকে ধরব, আর যখন এদিকে আসতে শুরু করবে তখন যথেষ্ট পরিমাণে সুতো হাতে আসবে। সুতো যেহেতু কম পড়বে না, তখন আমি রডটা বদলে ফেলব।”

রড যখন ভেঙে গেছে এখন তো আর মাছ ধরায় বিশ্ব রেকর্ড বা অন্য কোনো রেকর্ড সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মাছটা তো কাবু হয়ে গেছে, তাই এখন ওর পেছনে উঠে পড়ে লেগে ওকে ধরা উচিত। কিন্তু সমস্যা একটাই—বড় রডটা পনের প্যাঁচের সুতোর জন্য বেশিরকম শক্ত। এখন আমাকে এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে।

নামকরা হার্ডি কোম্পানির রিল থেকে কার্লোস রডে সুতো তোলার গাইড ব্যবহার করে ছত্রিশটা সাদা থ্রেড-লাইন খুলছিল আর হাত দিয়ে মাপছিল। ওর হাত থেকে রিলটা বোটের মেঝেতে পড়ে গেল। নষ্ট হয়ে যাওয়া রডটা দিয়ে যথাসাধ্য মাছটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম কার্লোস সাদা সুতো কেটে রডের গাইডের সাহায্যে অনেকখানি সুতো তুলল।

আমি মি. জোসিকে বললাম, “ক্যাপ, বেশ তাহলে এই সুতো নাও। মাছটা বৃত্তাবর্তে ফিরে আসবে যখন তখন সুতো যথেষ্ট টেনে নিলেও কার্লোস দ্রুত সুতোর দুটো থ্রেড বানিয়ে ফেলতে পারবে। আর কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। শুধু নরম আর সহজভাবে সুতো টানবে।”

ঘুরে ঘুরে মাছটা আসতেই থাকল আর মি. জোসি একফুট একফুট করে সুতো উদ্ধার করে কার্লোসকে দিচ্ছিল, কার্লোস সাদা সুতোর সঙ্গে সেই সুতোর গিঁট দিচ্ছিল। মি. জোসি বলল, “ও তো ওগুলো বেঁধেই ফেলেছে।” তখনও প্রায় গজ খানেক সবুজ রঙের পনের প্যাঁচের সুতোটা ব্যবহার করা বাকি, মাছটা ওর বৃত্ত সীমার মধ্যে এলে সে আঙুল দিয়ে সুতোটাকে ধরে রাখল। আমি ছোট রডটা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওটা নিচে রাখলে কার্লোস বড় রডটা আমার হাতে দিল।

আমি কার্লোসকে বললাম—“তুমি যখন প্রস্তুত হও, ওটা কেটে ফেলো।” মি. জোসিকে বললাম, “ক্যাপ, তুমি আস্তে আস্তে নরম করে ঢিলা দিতে থাকো। যখন সময় হবে, বুঝতে পারব, তখন আমি আস্তে আস্তে টানতে শুরু করব।”

কার্লোস যখন সুতো কাটছিল আমি তখন সবুজ রঙের সুতোর লাইন আর বিশাল মাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তখন এমন জোরে এক চিৎকার শুনলাম এর আগে কখনো কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে এভাবে চিৎকার করতে শুনিনি। যেন সমস্ত হতাশাকে জড়ো করে এমন শব্দে রূপ দেওয়া। তারপর প্রত্যক্ষ করলাম সবুজ সুতোর লাইনটা ধীরে ধীরে মি. জোসির আঙুলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এরপর দেখলাম মাছটা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই এবং একসময় সে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। কার্লোস গিঁট দেয়া সুতোয় ভুল লুপ কেটেছিল।

মি. জোসি বলল, “ক্যাপ।” তাকে ঠিক ভালো দেখাচ্ছিল না। এরপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোসি বলল, “চারঘণ্টা বাইশ মিনিট হয়ে গেছে।”

আমি নিচে কার্লোসকে দেখতে গেলাম সেখানে সে বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আমি চিন্তা করতে নিষেধ করে বললাম, যে কারো এরকম হতে পারে। তাঁর বাদামি রঙের মুখটা তখন স্নায়ুচাপে পীড়িত। অদ্ভুত নিচু গলায় কথা বলছিল সে, আমি ঠিকমতন শুনতেও পাচ্ছিলাম না।

“আমি সারাজীবন মাছ ধরে আসছি কখনো এইরকম মাছ দেখিনি। এইবারই প্রথম। আমি আমার, তোমার দুজনার জীবনই নষ্ট করে দিয়েছি।”

আমি বললাম, “কী যে বলো! বাজে বোকো না তো। আমরা আরো বড় বড় মাছ ধরব।” কিন্তু কখনোই বড় মাছ ধরতে পারিনি আমরা।

মি. জোসি আর আমি বোটের পেছনের দিকে গিয়ে বসে অনিটাকে বাতাসের টানে এগুতে দিলাম। উপসাগরে সেটি ছিল চমৎকার একটা দিন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমরা তীর আবার তারও পেছনে ছোট ছোট পাহাড়গুলো দেখছিলাম। মি. জোসি আমার ঘাড়ে, হাতে যে জায়গাগুলোতে রড আটকে গিয়েছিল, সেই জায়গাগুলোতে মারকিউরোক্রোম মালিশ করে দিচ্ছিল। আবার পায়ের পাতাও ঘষা লেগে ছিলে গিয়েছিল বলে সেখানেও মলমটা লাগিয়ে দিচ্ছিল। এরপর সে দুটো হুইস্কি গাঁজাতে নিল।

“কার্লোস কেমন আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ওর অবস্থা বেশি ভালো না। গুড়ি মেরে বসে আছে।”
“আমি বলেছিলাম নিজের ওপর দোষ না নিতে।”
“নিশ্চয়। সে তো ওখানে বসে থেকে নিজেকেই দোষারোপ করছে।”
“বড় মাছগুলোকে কেমন লাগছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মি. জোসি বলল, “আমি সবসময় এই-ই করতে চেয়েছি আসলে।”
“আমি কি ওকে ঠিকমতন সামলাতে পেরেছি, ক্যাপ?”
“পেরেছো মানে! খুব ভালো পেরেছো।”
“না। আমাকে সত্যি করে বলো।”
“আজকে তো আমাদের টিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তুমি চাইলে আমি পয়সা ছাড়াই মাছ ধরতে পারি।”
“না”
“আমি পয়সা ছাড়াই বরং মাছ ধরতে চাচ্ছি। কিভাবে যে মাছটা ন্যাশনাল হোটেলের দিকে গেল যেন কোনোদিকে হুঁশ ছিল না ওর, মনে আছে তোমার?”
“ওর সবকিছু আমার মনে আছে।”
“তোমার লেখালেখির কী খবর, ক্যাপ, ভালো চলছে? খুব ভোরে উঠে লেখা মনে হয় তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার না, তাই কি?”
“সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ভালো লিখতে।”
“তুমি চালিয়ে যাও। আর প্রতিদিন নিয়ম করে লিখলে কখনোই সমস্যা হবার কথা না।”
“আগামীকাল সকাল থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারি।”
“কেন?”
“আমার পিঠে সমস্যা।”
“তোমার মাথা তো ঠিক আছে, নয় কি? পিঠ দিয়ে তো আর লেখো না।”
“হাত ব্যথা হয়ে থাকবে।”
“ধুত্তোরি! পেন্সিল তো ধরতে পারবে। সকালে উঠে দেখবে, ঠিক হয়ে গেছে। তখন পারবে।”

ভাবতে অবাক লাগলেও পরদিন সকালে আমি লিখতে পেরেছিলাম এবং বেশ ভালোই লিখেছি। সকাল আটটায় পোতাশ্রয়ের দিকে রওনা দিয়েছিলাম। আরেকটা চমৎকার দিন ছিল সেটি। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। মরো ক্যাসেলের কাছে স্রোত ছিল আগের দিনের মতো। পরিষ্কার পানির কাছে গিয়ে পৌঁছালে কোনো খুঁটির বাতি নিভাইনি আমরা। একবারই তা করেছিলাম, আর নয়। চার পাউন্ড ওজনের বিরাট একটা সেরো ম্যাকরল ধরেছিলাম আমি, রডটা ছিল অনেক বড় আর ভারী, হার্ডি কোম্পানির রড ছিল সেটা; রিলে ছিল ছত্রিশটা সাদা সুতোর প্যাঁচের থ্রেড লাইন। কার্লোস আগের দিন ত্রিশ বাঁওয়ের যে সুতোটা খুলে নিয়েছিল, সেটা আবার যুক্ত করেছে আর পাঁচ ইঞ্চি রিল সম্পূর্ণ ভর্তি ছিল। তবে সমস্যা ছিল রড নিয়ে। রডটা খুবই শক্ত ছিল। বড় মাছ ধরার ক্ষেত্রে বেশি শক্ত রড জেলের বারোটা বাজিয়ে দেয় আর যে রড ঠিকমতন বাঁকা হয়, সেই রড মাছের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।

কার্লোসের সঙ্গে কথা বললে তবেই সে কথা বলে এবং সে তার কষ্ট নিয়েই ছিল। আমার শরীরে এত ব্যথা ছিল যে, কষ্টের কথা ভাবার সময় পাইনি আর মি. জোসি এমন শক্ত লোক যে, সে এসবকে পাত্তাই দেয়নি।

সে বলল, “শালার, সারাটা সকাল মাথা ঝোঁকাতেই গেছে ওর। এরকম করলে মাছ ধরতে পারবে না ও।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন আছো, ক্যাপ?”

মি. জোসি বলল, “আমি তো মনে করি ভালোই আছি। গতরাতে শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে স্কয়ারে মেয়েদের অর্কেস্ট্রা শুনেছি। কয়েক বোতল বিয়ার গলাধঃকরণ করে ডনোভ্যানের ওখানে গিয়েছিলাম। কী যে জঘন্য ব্যাপার ঘটেছে সেখানে।”
“কী জঘন্য ব্যাপার?”
“ভালো না। খুব খারাপ। আমি খুশি যে তুমি সেখানে ছিলে না, ক্যাপ।”

পাশে, দূরে উঁচুতে রডটা ধরে বড় ম্যাকরলটাকে পেছনে ঢেউয়ের তোড় থেকে সরে যেতে সাহায্য করতে করতে বললাম, “কী ঘটেছিল আমাকে বলো।” কাবানা দূর্গ বরাবর স্রোতের কিনার অনুসরণ করার জন্য কার্লোস অনিটাকে ঘোরাল। পেছনে উত্থিত স্রোতে মাছকে প্রলুব্ধ করার জন্য যে সাদা রঙের টিজার ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই সাদা সিলিন্ডার বোটের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছিল, স্রোতের তোড়ে মাঝে মাঝে লাফাচ্ছিল, উড়ছিল। মি. জোসি এবার বোটের পেছনে একপাশে চেয়ারে বসে মাছ ধরছিল। তার বড়শিতে বড় একটা ম্যাকরল আধার খাচ্ছে।

“ডনোভ্যানে এক লোক নিজেকে সিক্রেট পুলিশের ক্যাপ্টেন বলে দাবি করছিল। সে বলল আমার মুখটা নাকি তার পছন্দ। সেজন্য সে আমাকে একটা উপহার দেবে, আর সেই উপহার হিসেবে সে যে কোনো এক লোককে খুন করবে। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা সে, বলছিল আমাকে পছন্দ করেছে এবং এইটা প্রমাণ করার জন্য একজনকে সে হত্যা করবেই। সে ছিল মাচাদো বিশেষ নতুন মেরিন পুলিশ অফিসারদের একজন। ওই যে ডাণ্ডাবাজ পুলিশ।”
“আমি তো ওদের চিনি।”
“চিনতেও পারো, ক্যাপ। তবে আমি খুশি যে তুমি সেখানে ছিলে না।”
“কী করেছে সে?”
“আমাকে সে কতটা পছন্দ করে তা প্রমাণ করার জন্য সে কাউকে হত্যা করার কথা বলেই চলল। আমি বললাম তার কোনো প্রয়োজন নেই বরং একটু ড্রিংক করে সে কথা ভুলে যাওয়া যেতে পারে। একটু শান্ত হতে না হতেই সে আবার একই কথা বলতে শুরু করল।”
“লোকটা নিশ্চয়ই ভালো।”
“ক্যাপ, আরে নাহ। কোনো কাজের লোক না সে। আমি তাকে এসব ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য মাছের কথা বলতে চেষ্টা করলাম।”

সে বলল, “আপনার মাছের ওপর আমি পায়খানা করে দিই। তাহলে মাছ আর নাই। হলো তো?”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। মাছের ওপর হাগু। আপনার কথাই রইল। চলেন এবার দুজনেই বাড়ি যাই।”
“বাড়ি যাব? কী যা তা বলছেন? আপনার জন্য আমি কাউকে হত্যা করবই। আর মাছের ওপর কিন্তু হাগবই। তাহলে মাছ বাদ হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছেন?” সে বলল।

তো ক্যাপ, আমি তাকে শুভরাত জানিয়ে ডনোভ্যানকে টাকা দিলাম কিন্তু এই পুলিশ সেই টাকা ফট করে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তা পা দিয়ে চেপে ধরল আর বলল, “মাথা বিগড়ায় দিয়েন না, কইলাম। আপনি আমার বন্ধু, আপনি এখানে থাকবেন।” এরপরও আমি তাকে শুভরাত বললাম। ডনোভ্যানকে বললাম, “ডনোভ্যান, আমি দুঃখিত যে আপনার টাকাটা মেঝেতে।”

আমি বুঝতে পারছিলাম না এই পুলিশ কী করতে যাচ্ছে; অবশ্য সে ব্যাপারে মাথাব্যথাও ছিল না আমার। আমি বাড়ি যাবার জন্য মনস্থ করে যেই পা বাড়িয়েছি, অমনি পুলিশটা পিস্তল বের করে বেচারা গ্যালিগোর দিকে ধরে। গ্যালিগো চুপচাপ বিয়ার খাচ্ছিল। সারারাত একটিবারের জন্য একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি সে। কেউ পুলিশটাকে কিচ্ছু করেনি, বলেনি। আমিও কিছু করিনি। কী যে লজ্জা হচ্ছে বলতে আমার, ক্যাপ।”

আমি বললাম, “বেশিক্ষণ এই অবস্থা চলার কথা না।”
“আমি জানি। কারণ, তা চলতে পারে না। কিন্তু যে কথাটা আমি মোটেও পছন্দ করতে পারিনি তা হচ্ছে আমার মুখ তার পছন্দ। আমার মুখের কী শ্রী বলো তো, ক্যাপ যে একজন পুলিশ বলবে সে পছন্দ করেছে?”

মি. জোসির চেহারাটা আমিও খুব পছন্দ করতাম। আমার পরিচিত যে কোনো মুখের চেয়ে তার মুখটা আমার বেশি পছন্দ ছিল। কারণ, দ্রুত বা সহজ সাফল্য লাভের জন্য এই মুখ পাথরে খোদাই করা হয়নি। পানশালার লাভজনক দিকটায়, অন্যান্য জুয়াড়ির সঙ্গে কার্ড খেলতে খেলতে, বিরাট ঝুঁকির এন্টারপ্রাইজ বুঝতে পেরেও ঠান্ডা মস্তিষ্কের নির্ভুল বুদ্ধিমত্তায়, সমুদ্রে যার জন্ম—সেই মুখ তো পছন্দ করবই। চোখ ছাড়া মুখের আর কোনো অংশ দেখতে অমন সুশ্রী নয়; কোনো উজ্জ্বলতম ঝকঝকে পরিষ্কার দিনে ভূমধ্যসাগরের চেয়েও নীলাভ অদ্ভুত সেই চোখের রঙ। চেহারা সুন্দর নয় মোটেও শুধু আশ্চর্য দুটো চোখ—এখন ফোস্কা ওঠা চামড়ার মতো হয়ে গেছে।

আমি বললাম, “আপনার চেহারাও সুন্দর, ক্যাপ।”
“হ্যাঁ, মনে হয় ওই একটা ভালো জিনিসই ওই কুকুরীর বাচ্চাটা দেখতে পেয়েছিল।”

মি. জোসি বলল, “এখন আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক জীবন নিয়ে মাথা ঘামাব না।”
“স্কয়ারে বসে মেয়েদের অর্কেস্ট্রা আর যে মেয়েটা গাইছিল, শুনতে ভালোই লাগছিল, চমৎকার লাগছিল। সত্যি করে বলো তো কেমন লাগছে তোমার ক্যাপ?”

“আমি তো বলেছি, ভালো না, খুব খারাপ।”
“ভেতরে অন্ত্রে কোথাও লাগেনি তো? বোটের সামনে যতক্ষণ ছিলে, তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করেছি আমি।”

আমি বললাম, “না, পেছনে একদম পিঠের গোড়ায়।”
“হাত পা কোনো কাজে আসেনি, একেবারে হার্নেস পর্যন্ত পট্টি দিয়ে বেঁধে দিলাম,” জোসি বলল। “এখন আর অত ঘষা লাগবে না। তুমি কি আসলেই ঠিকঠাকমতন পেরেছিলে, ক্যাপ?”
“অবশ্যই, অভ্যেস করা যেমন কঠিন, অভ্যেসে পরিণত হলে এত্থেকে বের হয়ে আসাটাও তেমনটাই কঠিন।”

“আমি জানি, অভ্যেস খুব খারাপ একটা ব্যাপার।” মি. জোসি বলল, “আর অন্য কোনো অভ্যেস নয়, সম্ভবত কাজই বেশিরভাগ মানুষকে মেরে ফেলে। কিন্তু তোমার বেলায় সে কথা খাটে না। তুমি যখন কিছু করো তখন অন্যকিছুর তোয়াক্কা করো না।”

আমি তীরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিচের কাছাকাছি অতল গভীর পানির সন্নিকটে একটা চুনাপাথরের ভাঁটি যেখানে উপসাগরীয় প্রবাহ প্রায় তীরের কাছে এসে মিশেছে। ভাঁটি থেকে সামান্য ধোঁয়া উঠছিল। দেখতে পেলাম তীর বেয়ে ধুলো উড়িয়ে একটা ট্রাক পাথুরে রাস্তা দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কিছু পাখি বড়শির আধারের একটা দলা খুবলে খাচ্ছিল। তখনই শুনলাম কার্লোস, “মার্লিন, মার্লিন!” বলে চিৎকার করছে।

সবাই একসঙ্গে ওকে দেখতে পেলাম। পানিতে কী গভীর সেই রঙ ওর। আমি দেখলাম ওর ঠোঁটটা বিরাট ম্যাকরলটার পেছন থেকে পানির ওপর ভেসে উঠল। বেঁটে, গোলাকার, পুরু, কুৎসিত একটা ঠোঁট। তারই পেছনে পানির নিচে স্তূপীকৃত ওর শরীর।

কার্লোস চিৎকার করে বলল, “ও খাক, ওকে ওটা খেতে দাও, মুখের ভেতরে নিয়েছে তো।”

মি. জোসি রিলে আধারের সুতোটা পেঁচিয়ে আনছিল। আমি সেই তীব্র টানটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম যার অর্থ হচ্ছে মার্লিন ম্যাকরলটাকে গিলে ফেলেছে।


অনুবাদকের নোট

১.কী ওয়েস্ট—কিউবার প্রায় নব্বই মাইল উত্তরে আমেরিকার একটি দ্বীপ শহর
২. মরো—হাবানা উপসাগর প্রতিরক্ষাদূর্গ

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;