জুঁই



তানিম কবির
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

দশ বছর আগের চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে আমি পৌঁছাই ঠিকই, তবে তা কোনোভাবেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নয় যে, সত্যিই জুঁইও সেখানে, এমনকি আমার আগে থেকেই উপস্থিত থাকবে। আর, আবারও সত্যিই ওকে আমি দেখতে পাব। বরং এরকম যে হতে পারে, অন্তত পাঁচ বছর ধরে সেই সম্ভাবনাটাকে নাকচ করতে করতেই আমি বড় হচ্ছিলাম। ফলে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের ওভারব্রিজের নির্ধারিত কোনায় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল আমার বড় হতে থাকা।

জুঁইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৫ সালে। হঠাৎই একদম হুট করে। তখন কত বয়স আমার, সবেমাত্র কলেজে যাই, সতের, বা তারও কম? অবশ্য জুঁই বয়সে আমার বড় ছিল, তিন বছরের। ফোনে পরিচয়। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ। হুট করে একগাদা মোবাইলফোন কোম্পানি এসে পাড়া-মহল্লার ছাদেই, কলেজ যাবার রাস্তার মোড়েই ঘটতে পারত প্রেমগুলোকে বেশ একটা জাতীয় মানের রাত জেগে কথা বলা প্রেমে রূপান্তর করে দিল তো? বলতে গেলে পরিবর্তিত বা নবগঠিত ওই সংস্কৃতির প্রথম জেনারেশনের প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম আমরা। ডিজুস টু ডিজুস দুই টাকায় সারারাত কথা বলার একটা অফার ছাড়ে গ্রামীণফোন। মূলত ওই সময়ই একটা ফালতু নাম্বার পাজলিং থেকে জুঁইয়ের সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে যায়।

আমরা তখন সারারাত জেগে ফোনে কথা বলতাম। এমনও হয়েছে, ভোর হয়ে গেছে জন্য এখন আর সারাক্ষণ ফোনে ‘লাইনে’ থাকতে পারব না ভেবে শেষরাত থেকেই আমাদের কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। এতই রাতজাগা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম আমরা। সত্যি বলতে, আমাদের তুলনা ছিল না। আমার, এবং জুঁইয়েরও, পরিচিত এমন একজন কেউ ছিল না, যে অন্তত আমাদের সিকি পরিমাণ প্রেমও ওইসময় করতে পারত। আমরা জানতাম যে, আমরাই সেরা।

তবে আমরা কেউ কাউকে দেখিনি কখনো। শুধু কথা বলে প্রেম করি। একদিন তাই ভয় হলো, মনে হলো, আমাকে দেখে যদি ওর পছন্দ না হয়। কিংবা আমারই যদি পছন্দ না হয় ওকে! কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জিভ কামড়ে আমি অনুতপ্ত হই। ছিঃ এ আমি কী ভাবছি। জুঁই দেখতে যেমনই হোক না কেন, ও তো জুঁই। আমি ওকে কখনোই ছেড়ে যেতে পারি না, কারণ সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের একবার দেখা তো হোক? দুজনেই রাজি। আমি আমার আশঙ্কার বিষয়ে ওকে বললাম, ‘আমি তো দেখতে অতো ভালো না, তোমার যদি পছন্দ না হয়!’ তুড়ি মেরে আশঙ্কাটাকে উড়িয়ে দেয় জুঁই। উল্টো ওকে এরকম অগভীর আর চেহারা দেখে প্রেমে পড়া টাইপ থার্ডক্লাস ভাবার কারণে রাগ করে ওই রাতে আর কথাই বলল না আমার সাথে।

এমনিতে কথা না হওয়া রাত, ওই সময় আমার জন্য ভয়াবহ যন্ত্রণার বিষয় ছিল। কিন্তু ওকে ‘চেহারা দেখে প্রেমে পড়া’দের কাতারে ফেলবার শাস্তি হিসেবে পাওয়া ওই কথা না বলা রাতটা আমার জন্য বলতে গেলে স্বর্গসম ছিল। বরং আমি চাইছিলাম, এ রাগ আরো দীর্ঘ, আরো গাঢ় হোক। কেননা তাতেই আমার নিরাপত্তার বোধটা আরো বলিষ্ঠ হয়।

পরদিন গর্ব করে ক্লাসের বন্ধুদের, জুঁইয়ের এমন উদার মন-মানসিকতার গল্প শোনাতে গিয়ে এক ব্যাখ্যাতীত বিবমিষায় আক্রান্ত হই। গল্প শুনে মোস্তফা বলে, “দেখ গিয়ে পাতিলের কালির মতো কালো আর কঙ্কালসাড় হাড়গোরসর্বস্ব এক পেত্নী হবে সে। তার তো একটা পেনিস হলেই হয়। ফলে নিজের উদারতার বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করে সে আসলে তাকে দেখার পর তোর উদারতাটাকে কনফার্ম করতে চাইছে।” উপস্থিত বাকিরা হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। এত বিশ্রী লাগল দৃশ্যটা যে আমি উঠে এলাম। বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছি যখন, জানালা দিয়ে শুনতে পেলাম জিকু বলছে, “এ জীবনে আমি জুঁই নামের কাউকে সুন্দরী হতে দেখিনি। সবগুলোকেই দেখেছি দুঃস্বপ্নের মতো ভয়ঙ্কর হতে।” আর এতেও অন্যরা সশব্দে হেসে উঠল। আমি দৌড়ে পালালাম। জুঁইকে এমন বাজারী আলোচনার বিষয় করে দেওয়ায় খুব রাগ হলো নিজের ওপর। দোষটা তো আমারই।

কিন্তু যা হলো, সে রাতেই ভয়ঙ্করদর্শন এক জুঁইকে স্বপ্ন দেখলাম। ড্রাকুলা মার্কা দাঁত, নোংরা চুল আর আশি বছরের কোনো ডাইনি বুড়ির এক বিকট প্রতিকৃতি। এটাই ছিল স্বপ্নের জুঁই, আমি থরোথরো ভয়ে যার খসখসে হাত ধরে পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছি। লাফ দিয়ে ঘুম ভাঙে আমার। মনে পড়ে, মাইগ্রেনের ব্যথার জন্য জুঁই রাত দুটোর দিকেই শুয়ে পড়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো, ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? মুহূর্তেই আবার মনে হলো, এ কথা ভাবছি কেন! তার মানে সত্যি হলে, অর্থাৎ জুঁই দেখতে সত্যিই ওরকম হলে আমার তবে আপত্তি? এই তবে ভেতরকার আমি! নিজের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সবচেয়ে গোড়ার দিকের আমার স্বরূপ তবে এই! প্রতিটা রক্ত কণিকায় আত্মধিক্কারের তীব্র আলোড়ন আমাকে পাগল করে ছাড়ল। নিজেকে শাস্তি দিতে ছুরি দিয়ে আমি হাত কাটতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই টের পেলাম না। কেননা, কী করে আমার এত সাহস হয় যে, এমনকি ভয়ঙ্কর দেখতে হলেও জুঁইকে আমি ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবি!

ঢাকায় গেলাম। আমাদের দেখা হলো। একটা ভোরের ট্রেন আমাকে বিমানবন্দর স্টেশনে নামিয়ে দিল। আর তরতর সিঁড়ি ভেঙে আমি উঠে গেলাম ওভারব্রিজে। কেননা ওখানে নির্ধারিত একটা কোনে দাঁড়িয়ে জুঁই দাঁত মাজছে। এটাই ওকে চিনবার কোড। সারারাত আমরা ‘লাইনে’ই ছিলাম। আমি ট্রেন থেকে আর জুঁই ওর বাসা থেকে। ভোর পাঁচটায় ফোন রেখে ও চেঞ্জ করল। আর আবার কথা বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে। ও যখন সিএনজিতে উঠল, আমার ট্রেন তখন ঘোড়াশাল ব্রিজ পার হচ্ছে। কিন্তু ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে এ কাকে আমি দাঁত মাজতে দেখছি! পরী বললেও ভুল হবে। পরীর চেয়েও পরী দেখতে ও। হা হয়ে গেলাম। ঠোঁটের কোণে মোস্তফা জিকুদের জন্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি না চাইতেও ফুটে উঠল। আর নিজের জন্য হলো করুণা। এই তো, ট্রেন থেকে নামার ঠিক আগেও বাথরুমে ঢুকে নিজের চেহারার মুখোমুখি হলাম। একে কি চেহারা বলা যায় কিনা কে বলবে! আর এই বেহেশতী হুর, বলা চলে, বিভ্রান্ত হয়ে আমার মতো এক চামারের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একবার ভাবলাম, আমাকে চিনতে পারার তো কোনো কোড নেই, পালিয়ে যাব নাকি! কিন্তু হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে পড়া আমার কাছে এসে জুঁই-ই প্রথম কথাটা বলল, “দাঁত মাজবে?”

একবারের জন্য মনে হলো, যাক! আমি দেখতে অন্তত আমারই মতো তাহলে। নয়তো জুঁই আমাকে চিনতে পারল কিভাবে? ওভারব্রিজে আরো তো মানুষজন ছিল। আমার বয়সীই আরো দুয়েকজন ছিল, নিজের চোখে দেখা। নিশ্চয়ই এমন হয়নি যে, সেকেন্ড কিংবা থার্ড অফারে ও সত্যিকারের আমাকে খুঁজে পেয়েছে! সেরকম হলে আমার দেখা আমার বয়সীগুলোর কারো মুখে ঠিকই টুথপেস্টের ফেনা লেগে থাকত। যেমন আমি ওর মাজতে থাকা ফেনাসুদ্ধই ব্রাশটা নিজের মুখে পুরে নিলাম। ও বলল, “ওয়াক থু!” পরবর্তী এক বছর নিয়মিত আমি কোলগেট টুথপেস্টটাই ব্যবহার করতাম, ওর মুখের ফেনার স্মৃতি জাগিয়ে রাখার জন্য।

ও বলল, “জেগে থাকতে সমস্যা হবে না? সারারাত তো একটুও ঘুমাওনি।” কী জানি, ভাবিনি এ বিষয়ে। সাধারণ অর্থে তো সমস্যা একটু হবারই কথা। কিন্তু সঙ্গে জুঁই থাকা সত্ত্বেও এটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না যে, পাশেই নাক ডেকে আমি ঘুমাচ্ছি! জুঁই বলল, “চলো কোথাও গিয়ে দু-মুহূর্ত একটু ঘুমাই।” স্বপ্নের মতো লাগল কথাটা। বিশেষত ‘দু-মুহূর্ত’ ঘুমানোর ব্যাপারটা। অবশ্য ওর মধ্যে আগে থেকেই ব্যাপারটা ছিল, খানিকটা কবি কবি ভাব! এই তো সেদিন আকাশে একটু মেঘ করল বলে মেসেজ পাঠিয়েছিল ‘আজকে আমার মেঘলা দিন, আজকে আমার একলা দিন।’ বুঝলাম ওই ঔদাসীন্যই এখানে দু-মুহূর্তের ঘুম হিসেবে হাজির হয়েছে। বললাম, “আমার তো চেনা কেউ নেই ঢাকায়। কোথায় ঘুমাব? আর তুমিই বা কোথাও আমাকে নিয়ে ঘুমাতে যাবে কী করে!” দু-মুহূর্ত ভেবে ও বলল, “চলো আমরা একটা ইয়োলো ক্যাব ভাড়া করে ফেলি, তারপর ক্যাবের ভেতর ঘুমাই।” আইডিয়া খারাপ না। নয়টা দশটার দিকে জেগে উঠে ফ্রেশ একটা দিন শুরু করা যাবে। ভাবলাম আমি।

অচেনা ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোয়, কখনো জ্যামে আটকে, কখনো ফাঁকা রাস্তার দ্রুতটানে, টানা সাতদিন এক নাগাড়ে হালচষে ক্লান্ত মহিষের মতো গায়ের জোরে আমি ঘুমালাম। ঠিকই সেই ওর পাশে বসে! কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে সেই ঘুমও ভাঙল। চোখ খুলে, কিছুই বুঝে উঠতে না পারা দৃষ্টিতে ক্যাবের জানালা দিয়ে আড়াআড়িভাবে কত যে সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। একবার দেখলাম আজাদ প্রোডাক্টসের সাইনবোর্ড। এরা কী কারণে যেন বিখ্যাত? ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। দেখলাম তোতা পাখি কাঁধে নিয়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে। ক্যাবল লাইনের জঞ্জালে কাকেদের পুরনো হাগু। জুঁইও ঘুমাচ্ছে আমার পাশে। আমাদের দূরে কোথাও পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। পৌঁছে ড্রাইভার আমাদের ডেকে দেবে। দূরে কোথাও পৌঁছাতে সত্যিই অনেক দেরি হয় আমাদের।

শহরের প্রায় আরেকটা কোনো প্রান্তে, নাকি শহর ছাড়িয়ে, কোথায়, তা আমার মনে নেই। এরমধ্যে আমরা প্রায় তিন ঘণ্টার কাছাকাছি সময় ধরে ঘুমিয়েছি। ভাবলে এখনো অবাক লাগে, এর আগে যে আমার কোনো যোগ্যতাই ছিল না, কোনো একটা এমনকি মাঝারি মানের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসেও কথা বলবার, সেখানে পরীরও পরীর মতো একটা মেয়ের পাশে আধশোয়া হয়ে, বিশ্রীভাবে হা করে আমি ঘুমাতে পারলাম কী করে। কিন্তু আজ বুঝি, ক্লান্তিই সেই মহান মনোযোগের যথার্থ দাবিদার, যার দাবি না মেটালে আদতে আর কোনো দাবিই মেটানো সম্ভব হয় না। ‘আজকে বুঝি’র ভারিক্কি চালটার ব্যাপারে একটু ব্যাখা দেওয়া প্রয়োজন, জানানো প্রয়োজন, সেদিনের সেই বেকার ও নির্ভার লোকটা, আমার মধ্যে কোথাও আজ আর বেঁচে নেই। পারিবারিক দারিদ্র্য আর বাস্তবতার অনিবার্য ঘাঁয়ে লোকটার গলিত অবয়বটিও এখন বাষ্পাতীত। গত চার বছর ধরে একটা পত্রিকা অফিসে কম্পোজিটরের চাকরি করি আমি। টোলারবাগে সরকারি কোয়ার্টারগুলোর একটায় ছোট একটা রুম ভাড়া করে থাকি। সে যাই হোক, নিজের দরিদ্রতার বর্ণনা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। মোটকথা আগের মতো নিশ্চিন্ত নির্ভার জীবনটা আর নেই।

আমরা যেখানে গেলাম, দেখতে অনেকটা গ্রামের মতো। ব্যস্ততম দালানগুলোর ফাঁক ফোকর দিয়েও পেছনের ধানক্ষেত উঁকি দিচ্ছে। আমরা একটা ধানক্ষেতের মধ্যদিয়ে ঢুকে মুহূর্তের মধ্যেই আরো অসংখ্য ধানক্ষেত পার হতে থাকি। সিনেমার দৃশ্যের মতো জুঁই আমাকে টেনে নিয়ে যায়। যেন এক গোপন সংকেত মান্য করে করে একটা আঁল থেকে পরবর্তী দুটো আঁলের একটাকে বাছাই করতে করতে এগোয় ও। যেন একেবারে শেষে, সবচেয়ে অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনাটা ঘটবে। আর হলোও তাই, একমাঠ সমান ঝকঝকে মেঝের একটা ধানের কলে গিয়ে আমরা উঠলাম। এখানে ওখানে টুকরো টুকরো মেঘের মতো শুকোতে দেওয়া ধান।

জুঁই জানাল, সেদ্ধ ধানের গন্ধ ওর খুব পছন্দ। আমার মনে হলো, এ পছন্দের কথা তো ফোনে কখনো বলেনি আগে! কিন্তু আবার ভাবলাম, হয়তো সব পছন্দের কথা ফোনে বলতে হয় না। জুঁই যেমন কবি স্বভাবের, এমন আলাদা কোনো সিদ্ধান্তও যদি সত্যিই ওর থেকে থাকে, মোটেই অবাক হব না।

সারাটাদিন আমরা সেদ্ধ ধানের গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাটিয়ে দিলাম। আর যা মনে পড়ে, ধানের কলের পাশেই একটা পুকুর ছিল, আর কবুতরের বিষ্ঠায় ভরে থাকা একটা ঘাট। কবুতরগুলোকে ধানের কলের সবটা জুড়েই সহাস্যে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছিল। দুপুরে ধানের কলের ম্যানেজার তার অফিসরুমে ডেকে নিয়ে আমাদের ডিমের সালুন দিয়ে ভাত খাওয়াল। তারপর বিস্তীর্ণ মেঝের ছায়া ঢাকা একটা অংশে গিয়ে বসবার পর জুঁই বলল, দুপুরের পর নাকি কবুতর এমনভাবে ডাকে, যাতে করে মানুষের ঘুম পায়। ও বলার কারণেই কিনা কে জানে, কবুতরগুলোর নিরবচ্ছিন্ন বাক্ক্-বাকুম্ম শব্দে সত্যিই একটা ধান ভাঙানোর হাত-মেশিনের কাছে গিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। একদমই ঘুমিয়ে পড়বার মুহূর্তে মেশিনটাকে আমি সাব্যস্ত করলাম ‘ঘুরন্ত কোলবালিশ’ বলে।

যখন উঠলাম, পরিপূর্ণ বিকেল। টের পেলাম এবং স্বচক্ষেও দেখলাম যে, আমার মাথার নিচে জুঁইয়ের কোল। ঈষদুষ্ণ, খুব পুরনো নয় একটা রঙের গন্ধভরা ওর কোলটাকে আমার এক টুকরো মাতৃগর্ভের মতো লাগল।

কিন্তু এবার ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পর আমার ট্রেন। দুটো বাসে চড়ে আমাদের ফিরতে হলো। প্রথম ফাঁকা বাসটার একদম পেছনের কোনায় বসে জীবনে প্রথম কাউকে ঠোঁটচুমু খেলাম। সমস্ত শরীর, পরিস্থিতির তুলনায় অপর্যাপ্ত পুষ্টির কারণে ঠাঁ ঠাঁ করে কাঁপল। জীবনে প্রথম যখন কারো জিভ চাটছি, নুন ছিটানো কাঁচা ঝিনুকের স্বাদে আলোড়িত হচ্ছে মগজ। ফলে চুমুর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেও পরবর্তীতে নুন ছিটানো কাঁচা ঝিনুক খেতে হয়, তবে, ব্যাপারটা চূড়ান্ত রকমের হতাশাজনক, অর্থাৎ চুমুর স্মৃতির তাতে কানাকড়িও ফিরে আসে না। মনে পড়ছে ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইয়ে মার্গারেটকেসহ বা ছাড়া সুনীলের কাঁচা ঝিনুক খাওয়ার বর্ণনা। আমরা আরো পাগল হয়ে উঠি এবং একপর্যায়ে অন্য যাত্রীদের আপত্তি সাপেক্ষে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মাঝপথে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বাসের প্রয়োজন পড়ে মূলত এ কারণে। নেমে দেখি সূর্য ডুবছে। তারপর হাইওয়ের অল্প দূরে একটা গির্জা পেয়ে ওটায় ঢুকে পড়ি। আর দুজনে মিলে অসহ্য সব চুমু খাই।

যখন ট্রেন ছাড়ল, আমার জানালা ঘেঁষে প্লাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথাটা ও বলল। “যদি আর খোঁজ না থাকে, ঠিক দশ বছর পর এই তারিখে এই স্টেশনের ওভারব্রিজে থেকো, বিকেল পাঁচটায়।” সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত বাক্যটাকে যে আবার আমাকে সাজিয়ে মনে করতে হবে কখনো, বুঝতেই পারিনি। উল্টো বোকার মতো হাসি হাসি মুখে হাত নাড়তে থাকি। বলতে গেলে, তার কিছুক্ষণ পর থেকেই দশ বছরের জন্য ও হারিয়ে গেল। ট্রেন যখন টঙ্গী স্টেশন পার হচ্ছে তখনই ফেরার কিছু পেল কিনা জানতে ওকে কল দেই, আর নাম্বার বন্ধ পাই।

অবশ্য তাতেই যে আমি বুঝে ফেলি, অন্তত দশ বছরের জন্য ও হারিয়ে গেছে, তা নয়। প্রথমত ভাবি, হয়তো ফোনের চার্জ শেষ। আর সেটা স্বাভাবিকও ছিল, কারণ সারারাত কথা বলার পর দিনে আর ফোন চার্জে দেওয়ার সুযোগ হয়নি। এ ধারণা আরো মজবুত হয়, যখন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার নিজের ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেল।

এরপর ট্রেনের মধ্যে, জানালায় মাথা এলিয়ে সারাটা পথ আমি একটা খামচে থাকা ঘুমের সঙ্গে লেপ্টে রইলাম। পরবর্তী দুয়েকদিনেও যখন ফোনটা আর অন হলো না, তখন, জানালার পাশে প্লাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে ওর বলা, প্রায় ভুলে যাওয়া কথাটা মনে পড়ল। যেন অনেক ঘুমের নিচে চাপা পড়ে ছিল কথাটা। কিন্তু তাই বলে এরকম ছেলেমানুষি একটা কথাকে ও সত্যিই বাস্তবায়িত করতে চাইবে, এটাই বা মেনে নিই কী করে! তার মানে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমি আর কিছুই ভাবতে পারলাম না।

মোস্তফা বলল, ওর আসলে আমাকে পছন্দই হয়নি, সরাসরি কথাটা বলতে না পেরে এখন ফোন অফ রেখে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাহলে বাসের মধ্যে, হাইওয়ের পাশের গির্জায় আমাদের যে মুহূর্তগুলি, ওগুলোর কী ব্যাখ্যা? জিকু বলল, ঢাকায় ওরকম পার্টি নাকি অনেক আছে। মূলত বেশ্যা, মাঝেমাঝে একটু রিলেশনশিপের ওম লাগে, এরকম আরো অনেকের কথাই নাকি সে জানে। ঘুষি মেরে আমি জিকুর নাক ফাটিয়ে দিলাম। বুঝতে পারিনি, এতটা রক্তারক্তি হবে। সবাই ওকে ধারেকাছের কোনো একটা ফার্মেসিতে নিয়ে গেল। আমি আগ বাড়িয়ে ওর বাসায় চলে গেলাম, বাসায় গিয়ে ওর মাকে বলে আসলাম, “এটা কী করে সম্ভব যে, আপনার ছেলে ঢাকার অনেক বেশ্যাদের সম্পর্কে হুবহু অনেক কিছুই জানে!” বলেই বেরিয়ে এসে রিকশা ভাড়া করে শহরের বাইরের একটা মাঠে নিয়ে নিজেকে শুইয়ে দিলাম।

আসলে ওই সময়টায়, পরবর্তী একটা বছর পর্যন্ত, কখন কোথায় আমি জেগে ছিলাম বা ঘুমাচ্ছিলাম, তার কোনো হিসেব আমার কাছে ছিল না। আমাদের প্রেম ছিল মাস কয়েকের, তাই সবাই ভেবেছিল, পরবর্তী মাস কয়েকেই ব্যাপারটা চুকে যাবে। কিন্তু আমি সবার সংঘবদ্ধ ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে এক জুঁইয়ের ব্যাপারেই নিজেকে আরো আরো পাগল করে তুললাম। আর উঠতে বসতে, কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারলাম না এজন্য যে, একজন অন্তত কোনো বন্ধুবান্ধব অথবা পরিচিত কারো ফোন নাম্বারও কখনো আমি চাইনি জুঁইয়ের কাছে! আমি শুধু জানতাম ও ঢাকায় মাটিকাটা নামের একটা জায়গায় থাকে। মা-বাবা আর একটা বোনসহ ও থাকে, ও বলেছিল।

কোন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে যেন পড়ত। আশ্চর্য যে, ইউনিভার্সিটির নামটাও কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। জুঁইয়ের সম্পর্কে আমার বাহ্যিক জানাশোনা যে এত কম, আমি নিশ্চিত, ও হারিয়ে যাওয়ার আগেই কখনো যদি এটা আমি টের পেতাম, তখনও এ নিয়ে আমাকে লজ্জিত হতে হতো।

ছয় মাস পর আবারও একটা রাতের ট্রেনে চেপে আমি ঢাকায় চলে যাই। আগেরই মতো খুব ভোরে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে, দৌড়ে গিয়ে ওভারব্রিজে উঠে আগেরবারের মতো ওকে আর কোথাও না পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে আমি কাঁদতে থাকি। চারপাশে লোক জমে যায়। জিজ্ঞেস করে, আমার সমস্যা কী। আমি কিছুই না বলে দৌড়ে পালাই, আর স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা ইয়োলো ক্যাব দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, এখান থেকে এখন রওনা দিলে তিনঘণ্টা পর ঢাকার অন্য কোন কোন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব? ড্রাইভার ক্যাবের গতি বাড়িয়ে দেয়। দিনভর মাটিকাটা এলাকায় ঘুরে বেড়াই। বিকেলে খেতে বসে মাটিকাটারই একটা খাবার হোটেলের ক্যাবিনে ঘুমিয়ে পড়ি। কেউ ডিস্টার্ব করে না। যখন জেগে উঠি, রাত হয়ে গেছে। বের হয়ে সিএনজি নিয়ে আবার স্টেশন এবং সেখান থেকে আবার ট্রেন।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


প্রথম এক বছরের মধ্যে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সবচেয়ে বড় কথা, এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম যে, ব্যাপারটা আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয় ঘটানো। আর তাতেও নিজের ওপর বিরক্তি বাড়ে। আমি তো জানতাম, কখনো জুঁই না থাকলে, আমিও আর বাঁচব না। কিন্তু সত্যিই যখন নেই, মরতে গিয়েও মরতে পারা যাচ্ছে না। এ সময় মোস্তফার একটা একদমই হাসিচ্ছলে বলা কথাকে আমি আকড়ে ধরি। ও বলেছিল, “আরে মরবিই যদি, দশ বছর পর ওইদিন ওভারব্রিজে যাবে কে, আমি? গিয়ে বলব, বহু আগে, অন্তত নয় বছর আগেই তুই মরে ভূত?” তাই তো। দশ বছর পর তো ও থাকবে। একই তারিখ, বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু এত দীর্ঘ অপেক্ষার ভার নিয়ে কিভাবে একজন মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন যাপন চালিয়ে যেতে পারে, যে জীবনের প্রতিটা ফাঁক ফোকরেই আসলে ওই এক অপেক্ষাই নাক গলিয়ে থাকে!

এত আয়োজন সত্ত্বেও পরবর্তী একবছরে জুঁইকে আমি পুরোপুরি ভুলে যাই। এই ভুলতে পারার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে, বাবার মৃত্যু। আর সেই সূত্রে হঠাৎই আমার একটু তাড়াহুড়ো করে বড় হয়ে যাওয়া। এরমধ্যে নতুন আরেকটা প্রেমও হয় আমার। একই শহরের, সংস্কৃতিকর্মী টাইপের একটা মেয়ের সঙ্গে। বাংলা বর্ষবরণ, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তীর মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় একক ও দলীয়ভাবে গান গাইত। নাম, শোভা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মেয়ে। বাবার চাকরির সুবাদে আমাদের শহরে থাকত। সত্যি বলতে, এ প্রেমটাও খুব জমে যায়। আর একপর্যায়ে তো এমনও মনে হয় যে, কোথাকার কোন জুঁইয়ের জন্য কিনা মরতে বসেছিলাম!

শোভা একদিন জানতে চাইল, এখনো আমি জুঁইকে মনে রেখেছি কিনা। চমকে উঠি প্রশ্ন শুনে। আর জানতে চেয়েছিলাম বিষয়টা ও জানল কিভাবে। বলল, এ ব্যাপারে জানে না, এমন লোক নাকি খুব কমই আছে। ব্যাপারটাকে একটা ফালতু প্রসঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি শোভার হাত ধরি। ওকেসহ রিকশায় শহর ঘুরে বেড়াই। সন্ধ্যার পর চুমুও খাই। এভাবে বছর খানেকের মধ্যে আমরাই আমাদের সবচেয়ে মেইনস্ট্রিম প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠি। ফলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চাপা পড়ে যায় একদিনের জুঁই।

বছর খানেকের শোভাও অবশ্য অনিবার্যভাবেই একদিন নিজের বিয়ের কথা জানিয়ে যায়। আর খুব অনুরোধ করে, এ ব্যাপারে আমি যেন কোনো পাগলামি না করি। আসলে সব মিলে আমি খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই শোভার এমন প্রতারণার জবাবে আমি প্রায় কিছুই করলাম না। শুধু মাসখানেকের জন্য দূরসম্পর্কের এক খালার বাড়িতে, অন্য আরেকটা শহরে গিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলাম।

তারপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমভাবে ছিলাম। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে গত চার বছর ধরে ঢাকায়। এরমধ্যে জুঁইয়ের কথা খুব একটা আর মনে পড়েনি। আবার একেবারেই যে পড়েনি, তাও নয়। কিন্তু আমি ধরে নিয়েছিলাম, জুঁইয়ের ব্যাপারে জিকুর করা মন্তব্যটাই হয়তো ঠিক। মনে হয়েছে, হয়তো এমন হয়ে থাকবে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, প্রেম করিয়ে মফস্বল থেকে কাউকে ঢাকায় নিয়ে আনতে পারা না-পারা বিষয়ে ধরা কোনো বাজির অংশ ছিলাম আমি। অবশ্য সেসব নিয়েও আলাদা কোনো দুঃখের অনুভূতি এতদিনের ব্যবধানে আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট ছিল না।

তবে একদমই অভ্যেসবশত এ দশ বছরের পুরোটা সময় জুড়েই ওর নাম্বারে আমি মাঝেমাঝেই ডায়াল করে গেছি। কিন্তু তা কোনোভাবেই ওকে ফিরে পেতে চেয়ে নয়, বা এমনকি আবার কোনো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হোক, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেও নয়। আগাগোড়াই অভ্যেসবশত। এমনও হয়েছে, দিনের পর দিন আমি ওই নাম্বারে ডায়াল করেছি, অন্তত এই ব্যাপারেও সতর্ক না থেকে যে, মূলত এ নাম্বারটা কার। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এরমধ্যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম দশ বছর পর, কোন মাসের ঠিক কত তারিখে আবার আমাদের দেখা হবার কথা! মোটকথা এটা একটা পরিত্যাক্ত প্রসঙ্গ হিসেবে জীবনের কোনো এক কোনে পড়ে ছিল।

তবু চুক্তি অনুযায়ী দশ বছর পরের নির্ধারিত দিনে আমি যে ওভারব্রিজে এসে হাজির হতে পারি, এটা সম্ভব হয় শুধু এ কারণে যে, ঠিক একদিন আগেই লন্ডন থেকে ফোন করে মোস্তফা আমাকে, কালকে ওভারব্রিজে যাচ্ছি কিনা জিজ্ঞেস করে। ওকে অবশ্য বিশ্বাস করানো যায়নি, নিজে আমি তারিখটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বেশ অবাকই হতে হলো, এতদিন ধরে তারিখটা ওর মনে রেখে দেওয়ার ঘটনায়। এমনকি তারপরও বিকেল পাঁচটায় বিমানবন্দর স্টেশনের ওভারব্রিজে আমি যাব কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যাতীত একধরনের কৌতূহল আমাকে গ্রাস করে ফেলল। বিকেল তিনটার দিকে জরুরি ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। আর জ্যামেধরা শহরের এক মাথা থেকে রওনা দিয়ে আরেক মাথার বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছাতে সোয়া পাঁচটা বেজে যায়। ওভারব্রিজে উঠে, দশ বছর আগেকার সেদিনের মতোই জুঁইকে আমি দেখতে পাই আবার। ওই যে বললাম, হঠাৎই থমকে দাঁড়ায় আমার বড় হতে থাকা? আসলেই ব্যাপারটা তাই। জুঁই এগিয়ে এসে বলল, “এখন বোধহয় এ শহরেই থাকো?” আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। ওকে ঘিরে সেই আবেগ, সেই উত্তেজনা তো আর নেই, উল্টো দশ বছর পর ওর এমন উপস্থিতি খানিকটা ভূতুড়েই ঠেকল।

যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে আমি বললাম, “তুমি তো একটুও বদলাওনি! ঊনিশ বছরের তুমিই রয়ে গেছো।” ও হাসল, বলল, “আমি তো একই রকম থেকে যাই!” আমিও হাসলাম, কবি স্বভাবটা আর গেল না ওর। ওকে বলি, “আমি জানি, তুমি কারো সঙ্গে বাজি ধরেছিলে।”

“যেমন?” জানতে চায় ও। সব ওকে খুলে বলি, ওর জন্য আমার প্রথম এক বছরের পাগলপ্রায় দশার কথা, ছয় মাস পর ঢাকায় এসে ওকে খুঁজে বেড়ানোর কথা, ওকে নিয়ে জিকুর মন্তব্য, আর এক পর্যায়ে ওই মন্তব্যেই নিজের বিশ্বাস স্থাপনের কথা। সব শুনে বিস্ময়করভাবে ও কাঁদতে শুরু করল। বুঝলাম আমার করুণ দশা শুনেই এ কান্না। সুতরাং ঔদার্যে আমি হৈ হৈ করে উঠি, “আরে! কাঁদছো কেন? ওসব ফিলিংস এখন তো আর নেই। কত আগের কথা সেসব!” আর এও জানাই যে, মোস্তফা ফোন না করলে আমার যে আজকে আসাই হতো না।

“বরং এবার বলো, কী ধরনের বাজি ছিল সেটা, এখন কোথায় আছো, বিয়ে করেছো?” জানতে চাই আমি। হতভম্ব মুখে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার নিজেকেই শুনিয়ে বলে, “তার মানে”... তার মানে? কী তার মানে? “তারমানে তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না? চাও না এখন আর?” সত্যি না রসিকতা বোঝার চেষ্টা করি। বুঝতে না পেরে বলি, “মানে এটা কী ধরনের রসিকতা হচ্ছে, তুমি নিশ্চয়ই বলবে না যে, সত্যিই তুমি আমার সঙ্গে সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায় কাটাতে এখানে এসে হাজির হয়েছো? দশ বছর পর!” জুঁই কাঁদল, সে কান্না থামাতেও পারল। বলল, “আমি তো সত্যিই তোমার কাছেই এসেছি। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না?” দিশেহারা হয়ে আমি ওর দুই বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় ছিলে এতদিন!”

“নিয়ে যাবে না তোমার সঙ্গে?” বারবার একই কথা জানতে চায় ও। আমার মধ্যে কী হলো, বলে বোঝানো যাবে না। হঠাৎ করে না চাইতেই, আরো ভালোভাবে বললে, চাওয়া যে যেতে পারে, সেই ধারণারও অনেক দূরে থেকেই সব পেয়ে যাওয়ার যে আনন্দ আর উত্তেজনা, আমার মধ্যে তার সবটা এসে ভর করল। একেবারে পাগল হয়ে গেলাম আমি। প্রকাশ্যে, ব্যস্ত স্টেশনে চড় থাপ্পড় দিতে দিতে ওকে আমি চুমু খেতে লাগলাম।

সে রাতেই বিয়ে করতে আমরা কাজী অফিসে যাই। কিন্তু রেজিস্ট্রি খাতায় পিতা-মাতার নাম, স্থায়ী ঠিকানা ইত্যাদি লিখবার প্রসঙ্গ যখন আসলো, জুঁই বলল ও এসব তথ্য দিতে চায় না। কেন, জানতে চাই না। কাজীকে বলে দুটো ফেইক নাম আর একটা ফেইক স্থায়ী ঠিকানা সেখানে বসানোর ব্যবস্থা হয়। আর জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্ট কোনোটাই ওর না থাকায় সে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে ভালো অংকের ঘুষ দিতে হয় কাজীকে। ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেসে থাকাকালে বন্ধুত্ব হওয়া রুমমেটদের ডেকে এনে কাউকে উকিলবাপ, কাউকে সাক্ষী ইত্যাদি বানিয়ে আমাদের বিয়ে হয়। হুট করে ভয়াবহ রকমের সুখী হয়ে, সুখানুভূতির ব্যাপারটাই আমার অবশ হয়ে গেল। সবকিছু যে এতটা স্বপ্নের মতো আসলেই হয়ে উঠতে পারে কারো জীবনে, বহু বইপত্র পড়েও আগে এ ব্যাপারে জানতে পারিনি। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল সবকিছু।

কিন্তু জগত্ সংসারের কিছু কমন প্রশ্ন এসে আমার মাথায়ও গুঁতো দিল, যেমন, জুঁই এ দশ বছর কোথায় ছিল, কিভাবে, কাদের সঙ্গে ছিল, এরকম নানা প্রশ্ন। কিন্তু আবার নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম, যতদিন না নিজে থেকে ও কিছু বলবে, আমিও এ ব্যাপারে কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করব না।

করলামও না। এমনকি, ওভারব্রিজে এসে দাঁড়ানোর আগেই ও কোন এলাকা থেকে বেরিয়ে এসেছে, ওর ওই মা-বাবা আর বোন তারা কোথায় থাকে এখন, বিয়ের খবরটা তাদের দেওয়া উচিত কিনা, কিংবা কেনই বা রেজিস্ট্রি খাতায় বাবা মায়ের ফেইক নাম দিতে হলো, এসব কোনো ব্যাপারেই কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করলাম না। যেন ও যদি একটা ধূমকেতুও হয়ে থাকে, আর ওর কাজ যদি হয় দশ বছর পর পর পৃথিবীতে এসে দুয়েক মাস আমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে যাওয়া, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। আর কী অবাক, কত কিছু নিয়েই আমাদের কথা হলো, কতখানেই আমরা বেড়াতে গেলাম, কিন্তু কোনোভাবেই নিজে থেকে জুঁই ওর নিজের অতীত, বা শেষ দশ বছরের জীবন যাপন সম্পর্কে কিছুই বলল না। নিজের কাছেই একদিন অস্বাভাবিক লাগল বিষয়টা, তার কারণ হয়তো এই যে, ততদিনে বিয়ের প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেছে।

“আবার কবে উধাও হচ্ছো?” আপাত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে, কিন্তু এ প্রশ্নে ওর চেহারার স্বল্পতম পরিবর্তনটুকুও আমাকে বুঝে নিতে হবে, আগে থেকেই ঠিক করে রাখা এমন পরিকল্পনায়, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় প্রতিবিম্বিত ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করি। ও হাসে, নিঃশব্দে। প্রতিবিম্বিত চেহারার ব্যাপারে অসচেতন বলেই কি? “বললে না?” আবারও জানতে চাই। এবার ও সশব্দে হাসে। যেন খুব ছেলেমানুষি কোনো প্রশ্ন। বলল, “কেন, যে কোনো মুহূর্তেই তো!”

“হুঁম, আমারও তাই ধারণা।” বলি আমি। জুঁই বলল, “আচ্ছা তুমি কি আমার অতীত, এ দশ বছর কোথায় ছিলাম, এসব জানতে চাচ্ছো? ভাবছো খুব অন্ধকার কোনো জগতে আমি ছিলাম কিনা?” এবার আমিই লজ্জিত হই। বলি, “অন্ধকার জগতের কথা ভাবিনি।” কিছু ভাবল ও। আর বলল, “ধরো অন্ধকার জগতেই যদি ছিলাম, ভালোবাসবে না আর, অপেক্ষা করবে না?” আমার আশঙ্কার অ্যাঙ্গেলগুলো ও বুঝে ফেলছে, আর তাই খানিকটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ফেরানোর মতো করে আমি বলি, “বাদ দাও এসব। যেখানে ইচ্ছে সেখানে ছিলে, এখন আমার সঙ্গে আছো, এটাই যথেষ্ট।” মজা করতে চেয়েই মূলত, যোগ করি, “আবার হারিয়ে গেলে কোথায় খুঁজব?” ও হেসে বলল, “কেন, বিমানবন্দর স্টেশনের ওভারব্রিজ!” আর এ জবাবে দুজনেরই খুব হাসি তামাশা পায়।

তবু ও আবার চলে যাবে এ আশঙ্কাটাকে আমি তাড়াতে পারি না। করুণ চোখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, ও চোখ নামিয়ে নেয় না, আবার কিছু জিজ্ঞেসও করে না। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকার একপর্যায়ে আমি টের পাই ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক আর স্বাভাবিক নয়। নিজেদের মধ্যে গল্প করারও কোনো বিষয় আমরা খুঁজে পাই না। জুঁই যেহেতু ওর অতীত বা গত দশ বছরের জীবনের ব্যাপারে একেবারেই মুখ খোলে না। ফলে ও যা বলে ওঠে মাঝেমাঝে, তাও এই গত চার মাসের বিবাহিত জীবন আর দশবছর আগে ফোনে বলা আমাদের কথাবার্তা এবং ওই দফার শেষদিনের বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিচারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

এমনকি ওর থুতনিতে বছর কয়েকের পুরনো একটা কাটা দাগ দেখেও এটা জানার উপায় থাকে না, কিভাবে এমনটা হয়েছিল বা ও যখন শাকিরার ওয়াকা ওয়াকা গানটা গুনগুন করে কখনো, জিজ্ঞেস করা হয় না ওই বছরের বিশ্বকাপের সময় কোথায় ও ছিল। আমি বলি, “গানটা খুব ভালো ছিল, ওই বিশ্বকাপের সময়ই আমি ঢাকায় চলে আসি।” ও উৎসাহিত হয়, বলে, “বিশ্বকাপ চলার সময়, নাকি শেষ হয়ে যাওয়ার পর?” বলি, “চলার সময়। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচের দিন।” জুঁই হাসে, ইনফর্মড হওয়ার ভদ্র ও মাপা হাসি। কিন্তু নিজের বিশ্বকাপের ব্যাপারে নীরব থাকে।

সে রাতে শাকিরাকে স্বপ্ন দেখি। সেদ্ধ ধানের স্যাম্পল নিয়ে শাকিরা আমার অফিসে আসে। আর নিজেকে দশ বছর আগের ওই ধানের কলের বর্তমান ম্যানেজার দাবি করে ওয়াকা ওয়াকা বলতে বলতে একটা দুইটা করে ধান ছিটাতে থাকে। রেগে গিয়ে বলি, ‘ফাইজলামি করো! আমি জানি তুমি কে।’ শাকিরা হাসে। বলে, “সবাই যা জানে তুমিও তাই জানো কেন?” আমি দাবি করি, “সবাই যা জানে আমি তা জানি না, আমি অন্যকিছু জানি।” জিজ্ঞেস করে, “কী জানো তুমি?” বলি, “তুমি শোভা, দুই পয়সার রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী”, এবং আমি ইংরেজিতেও বলি, “ইউ আর নট শাকিরা।” ঘুষি দিয়ে আমি নকল শাকিরার নাক ভেঙে দিই। আর স্বপ্নের মধ্যেই একটা রিকশা ঠিক করে আমি শোভাদের বাসায় গিয়ে শোভার মাকে বলি, “এটা কী করে সম্ভব যে দুই পয়সার দলীয়সংগীত শিল্পী নিজেকে শাকিরা বলে দাবি করে!”

পরদিন জুঁই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “শোভা কে গো?” আমি ভালো করে ওর দিকে তাকাই। বলি, “তুমি এ দশ বছর কলকাতায় ছিলে?” চমকে ওঠে ও। কিন্তু আবার হাসে, বলে, “আমার তো পাসপোর্টই নেই।”
“সে তো আমাকে ওরকম জানানো হয়েছে বলে নেই, বাস্তবে থাকতে পারে না?” ঠান্ডা মাথায় বলার ভঙ্গিতে বলি। মুহূর্তেই কালো মেঘের মতো হয়ে যায় ও, নাটকীয়ভাবে পানি বেরোয় ওর চোখ দিয়ে। “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না” কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমি বোঝাতে পারি না, এখানে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কিছু নেই। বিশ্বাস কিংবা এমনকি অবিশ্বাস করতে গেলেও ন্যূনতম ইনফর্মেশন থাকা লাগে, অর্থাৎ ব্যাপারটিকে তো থাকতে হবে, যেটাকে বিশ্বাস করব, অথবা করব না। “তোমার তো কোনো ব্যাপারই নেই!”

তারপর নিয়ম করে প্রায় প্রতিরাতে আমি শোভাকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। হঠাৎ শোভাকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করার কোনো ব্যাখ্যা আমি নিজেকে দিতে পারলাম না। শুধু টের পেলাম, জেগে ওঠার পরও ওই রেশ থেকে যায়। জুঁইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা পুরোপুরি ফর্মাল হয়ে ওঠে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথাই আর হয় না আমাদের। বরং, জুঁইয়ের চলে যাওয়ার আশঙ্কাটাকেই কেমন যেন সম্ভাবনার মতো লাগতে শুরু করে। মনে হয়, ও এখনো যাচ্ছে না কেন? দশ বছরের জন্য ওর কি কোথাও যাওয়ার নেই আর! যেন এবার আমি শোভার ব্যাপারে একান্তে কিছু ভাববার অবসর চাই। শোভার চলে যাওয়ায় না-জাগা বিরহটাকে জাগিয়ে দেখতে চাই ওটা কেমন। যেন আমি নিশ্চিত হতে চাই, যে কখনো ফিরে আসবে বলেনি, তার চলে যাওয়া বা তার না থাকাই বেশি দামি ছিল কিনা।

অল্প সময়ের মধ্যেই এই চাওয়া এত তীব্র হলো, আর সেইসূত্রে আমার বদলে যেতে থাকাও এত স্পষ্ট হলো যে, আমি নিশ্চিত, ঘাবড়ে গিয়ে জুঁই এখন ওর অতীত এবং গত দশ বছরের সব ঘটনা আমাকে খুলে বলতে রাজি। কিংবা যে কোনো কারণেই হোক, রাজি। বিভিন্নভাবে সে এটা বোঝায় আমাকে। বোঝায় যে, আগ বাড়িয়ে প্রসঙ্গটা ও একা একা তুলতে পারবে না সত্যি, তবে আমি যদি তুলি, ও বলবে। কিন্তু কী অদ্ভুত, প্রেম বলি, থাকা বলি, কী নাটকীয়তা, বা নিদেনপক্ষে স্বাভাবিক কৌতূহল, কোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই প্রসঙ্গটা আমি আর তুলতে পারি না। যেন এবার উল্টো আমিই হারিয়ে গেছি ওর থেকে, আর তা, কোথায় আবার আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, না বলেই।

   

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;