তারা গুনতির দেশে



অহ নওরোজ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

চরিত্র :
নিরি (ছয় বছরের বালিকা, চঞ্চল)
মা (বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, মধ্যবিত্ত মুখ),
বাবা (বয়স চল্লিশ প্রায়, কাঁচাপাকা চুল আর চেহারায় আভিজাত্য)
বৃক্ষ (মাঝারি সবুজ নারিকেল গাছ, চিরল-বিরল পাতা তার)
ব্যাঙ (বেশ বড়সড় কোলাব্যাঙ)

কথক :
বহুদিন আগে,
পাতালের অন্ধকারে অন্য এক জগৎ ছিল
কেবল যেখানে শুধু উন্মুক্ত প্রান্তর, আর শীতল রাতের গন্ধ
সারাদিন ওম ধরা ম্লান রোদে সব যেন হৃদয়ের কাছে নুয়ে আছে।

ওইখানে মানুষের মনে কোনো ব্যথা নেই;
দিনে কোনো তাড়া নেই।
সব ছিল সুনশান—পরমায়ু উৎসব—

কিন্তু একদিন রাতে অজানা কারণে,
কিংবা হয়তো কারণ নেই কোনো—
কৌতূহলী শরীরে কেবল
গোলাপের ভাঁজে উড়ে, জোছনায় নিঝুম লুকিয়ে
চিহ্নহীন হয়ে গেল এক পাতালকুমারী।

বাইরে প্রথম...
পৃথিবীর আলো তাকে অন্ধ করে দেয়—
উড়ে যায় স্মৃতিগুলো।
দুইদিন পর তাকে মরে যেতে হয়।
তবু তার পিতা বিশ্বাস করত
একদিন সে আবার ফিরে আসবে কোথাও
সম্ভবত অন্য কোনো দেহে,
অন্য কোনোখানে,
অন্য কোনো ইতিহাসে।

..................

দৃশ্য : ০১
[গাড়ি চলছে, মায়ের সঙ্গে
বালিকা একটা মেয়ে।
পুরাতন গাড়ি—মাটির সরল পথ,
গাড়ি দোলার অভ্যাসে মনে হয়
নিচে যেন জলাভূমি।
পথের দুধার ঘেঁষে ঘন বনভূমি]
—মা, আমরা কোনখানে যাচ্ছি? শহর ছাড়ছি কেন?
—আমরা চলেছি তারা গুনতির দেশে, সেখানে মেঘের পরে মেঘ
আর সবুজের ঘ্রাণ মহাকায় মেলে আছে।
—রূপকথার মতন কোনো কিছু আছে?
—তুমি সারাদিন এসব আজব ভাবো কেন? এসব শুধুই গল্প ভেবো।
বলো যেন গাড়ি থামে—আমাকে নামতে হবে—কিছুটা হাঁটতে হবে।
ঝাঁকুনিতে বাড়ছে ব্যথাটা—কিছুদিন বাদে আসবে তোমার ভাইটা।

[গাড়ি থামে, থেমে থেমে হেঁটে হেঁটে, কুসুম নরম স্বস্তি আসে।
পেটে ব্যথা কমে,
নিরি এ সময়ে বনের ভেতর গিয়ে
যেন কিছু দ্যাখে]
—নিরি, আর যেও না ওদিকে, ফিরে এসো। আমরা এখন যাত্রা শুরু করবো আবার।
—মা, একটা পরী দেখেছি ওখানে।
—এসব চোখের ভুল। মন দিয়ে শোনো—আমরা একটু পরে যেখানে তোমার বাবা থাকে, সেখানে পৌঁছাব।
তাকে বাবা ডাকবে, বুঝেছো? আমি চাই তুমি বাবা ডাকো। সেটা তোমার জন্যই ভালো। এটা কেবল একটা শব্দ।
—তিনি আমার বাবা নন। আমার বাবার এরকম ধনী নন। তিনি মারা গেছেন অনেক আগে।
—যা বলেছি সেটা শোনো মা আমার।

[নিরি চুপ থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা
একটি সুন্দর খোলা, মাঠ-ঘেরা বাড়ি পৌঁছে।]
—প্রিয়তমা স্বাগতম। আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না তোমার। আমার সন্তান, ও তো ভালো আছে?
[গর্ভবতী-পেটে হাত রেখে] এইতো নড়ছে, সম্ভবত বাবাকে চিনেছে, আহা! হয়তো গাইছে।
—ভেবো না, ও ভালো আছে।
—নিরিকে কোথায় রেখে এলে?
ওকে তো দেখছি না।
[নিরিকে গাড়ির অন্য পাশ থেকে দেখা যায়]
—এই যে বালিকা কেমন আছো?
[নিরি ভ্রূক্ষেপ করে-না। মাঠের ভেতর দিয়ে বনের নিকটে দৌড় দেয়।
সেখানে পুরোনো কুঠিবাড়ি—পরিত্যাক্ত। ধীরে ধীরে সে ভেতরে ঢোকে।]

দৃশ্য ০২
[নিরি চোখ খোলে। বিছানায় শুয়ে আছে। তার দিকে মা তাকিয়ে]
—আমাকে না বলে ওদিকে গিয়েছো কেন?
—মা, একটা পরী দেখেছি ওখানে।
—চুপ করো। সেখানে অজ্ঞান পড়ে ছিলে।
তোমাকে রহিমা খালা না-দেখলে হতো কী-যে!
এখন দরজা আর আলো বন্ধ করো, যাও সোনামনি।
[নিরি মায়ের আদেশ শোনে]
—এবার আমার কাছে এসো। লেপের তলায় ঢোকো। তোমার পা জমে গিয়েছে দেখছি।
মা আমার—আমাকে না বলে, এভাবে কোথাও আর যাবে না, বুঝেছো?
তোমাকে খুঁজতে কষ্ট হয়। আমি এই দেহ নিয়ে হাঁটতে পারি-না।
তুমি কি শুনছো?
[নিরির দু’চোখ জানালার ফাঁক গলে বাইরের অন্ধকারে ওড়ে।
সেখানে চাঁদের আলো, আর সাদা কিছু নড়ে]
—ভয় পাচ্ছো তুমি?
—বাইরে কিসের শব্দ, কেউ কি ওখানে থাকে মাগো?
—কিছু না, বাতাস হবে। শহরের রাত থেকে এখানে গ্রামের রাত কিছুটা আলাদা। শহরে প্রচুর গাড়ি চলাচল করে। এখানে সেসব শব্দ নেই। এখানের বাড়িগুলো বেশ পুরাতন। হাওয়ায় টিনে শব্দ হয়। কখনো দরজা ক্যাচ-ক্যাচ করে। ঘুম দাও। সকালে অনেক কিছু নতুন দেখবে। খেলার অনেক সাথি পাবে। এখন ঘুমাও।
—মা একটা গল্প বলো—
—অনেক দূরের দেশে, বিরাট পর্বত ছিল।
সেইখানে পাথর কেবল কালো।
সূর্য অস্ত যেত ঠিক পাহাড়ের মাথার ওপরে—
সেখানে ফুলের গাছ ছিল হাজারে হাজারে—
একটা জাদুর ফুল প্রতি রাতে ছড়াত মধুর ঘ্রাণ।
সে কখনো শুকাত-না। যেন অমর হয়েছে—ম্লান
কিন্তু কেউ এর কাছে যেতে সাহস পেত না—
তার কাঁটা ছিলো বিষে ভরা।
—তারপর কী মা?
[নিরি দেখে মা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। সে বিছানা ছেড়ে ওঠে।
বাইরে জোছনা, জলের মতন ঘন হয়ে ঝরছে যেনবা।
সে আবার কিছু দ্যাখে, বাইরে উড়ছে। তার পিছু পিছু কুঠিবাড়ির ভেতরে চলে যায়]
—কেউ কি এখানে আছে?
[কুঠিবাড়ির ভেতরে সাদা উঠানে তখন দেখা যায় একটি মাঝারি বৃক্ষ। চিরল-বিরল পাতা তার।
পাতা দুলিয়ে দুলিয়ে সে কথা বলছে]
—ভয় পেয়ো-না-গো মেয়ে। আবার এসেছো ফিরে?
কী নাম তোমার? তাকাও, আমার দিকে।
[নিরি গাছটির দিকে দ্যাখে]
—আমি নিরি। তুমি?
—আমার অনেক নাম ছিল...অনেক পুরনো নাম। কেবল বাতাস আর গাছ সেইসব নাম উচ্চারণ করতে পেরেছে।
আমার আসল পরিচয় হলো আমি একজন দাস। তোমার বাবার দাস।
অনেক আগের কথা। সে আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।
তুমি পৃথিবীর আলোতে মরেছো, আমি বেঁচে গেছি অলৌকিক, কিংবা গাছ হয়ে গিয়ে।
—মিথ্যা বলছো এগুলো।
আমার বাবার কোনো দাস নেই। তিনি ছিলেন গরীব লোক।
বরং দাস অভ্যাসের জীবন তারই ছিল।
—আমি মিথ্যা কখনো বলি-না।
চেয়ে দেখো তোমার বামের কাঁধ।
সেখানে রয়েছে উল্কি আঁকা চাঁদ।
এটাই প্রমাণ। তুমি পাতালপুরির রাজার প্রাণ।
—আসলেই তাই—বাম পাশে উল্কি আঁকা,
চাঁদ আর দুটো তারা।
—চলো তবে ফিরে যাই।
তুমি গেলে রাজা খুশি হবে যারপরনাই।
তোমার আসল বাবা সে-ই। চলো দ্রুত, চলো যাই।
—কিভাবে সেখানে যাব?
—সবকিছু এত সোজা নয়, কোরো-না রাতের অপচয়।
—কী এমন সে কঠিন কাজ।
—এই বই নাও।
[নিরি নেয় এবং খোলে]
—এখানে তো কিছু লেখা নেই। বইজুড়ে সাদা পাতা।
—একা থাকলে খুলবে—তোমাকে দেখাবে ভবিষ্যত।
বই খুলে বলবে সকল কিছু, যা জানতে চাও।
[বইটি জামার মধ্যে নিয়ে, নিরি হেঁটে আসে কুটির প্রান্তরে।]

দৃশ্য ০৩
[চারদিকে ঝলমলে আলো।
গ্রামের সবুজ দিন। শীতের আভাস নেই যেন।
শান বাঁধানো পুকুর—স্বচ্ছ টলোমলো।]
—আজ ভালো করে স্নান সেরে নাও নিরি। তারপর এই জামা পরো
[নিরি দ্যাখে একটি সবুজ জামা—দারুণ মখমলের]
—মা, এখানে স্নান করব না। পুকুরে আমার ভয়। তাছাড়া এখানে শীত।
—আচ্ছা। ঘরে যাও। গরম পানির আয়োজন করতে বলি।

দৃশ্য ০৩ (০১)
[গোসলের ঘর—
গরম পানির ধোঁয়া সারাঘরে—
নিরি গোসল করে না
কিংবা দেরি করে—
এক কোণে লুকিয়ে বইটি খোলে—
তার চারপাশে ঝুঁকে যেন কুয়াশারা
যেন বকুল গাছের নিচে কেউ একা
মুখ নামিয়ে গুনছে ফুল।]
—আমাকে জানাও পাতালপুরিতে ফিরে যাবার উপায়।

[ধূসর পাতায় আঁকা লাল দীর্ঘ পথ
হয়ে উঠছে সতেজ—
সেই পথে আহ্নিকের ভিড়
আর হলুদ হাওয়া চলে গেছে
সবুজ বনের ধার ঘেঁষে।
সে দেখতে পায় সবকিছু
জেনে যায় বহুকিছু।
এই বাড়ির অদূরে, বনের ভেতর গিয়ে
মরা পথটির প্রান্তদেশে, নিঝুম গহিনে
আছে এক গাড় সবুজ পানা-পুকুর,
তার কাছে বাদামী একটি গাছ আছে
তাতে কয়েকটা সজনে হয়েছে।
সেই গাছের গোড়ায় জল ছেড়ে উড়ুক্কু মাছের মতো
মাঝে মাঝে শ্বাস নেয় একটি গোলাপি ব্যাঙ
তার গলার ভেতরে চাবিটি বাঁকানো।
ওই চাবি নিতে হবে
কুটিরের ভেতরের ঘরটি খুলতে হবে
তারপর পাতালপুরে যাওয়া যাবে।]
—নিরি স্নান করা হলো?
—এইতো হয়েছে প্রায়।
[বই বন্ধ করে, স্নান সারে নিরি। তার চোখে এক অজানা ভাবনা দেখা দেয়]

দৃশ্য ০৪
[আবছায়া অন্ধকার
জনশূন্য যেন গোলাঘর
সেখানে একাকী এক কোণে বসে আছে নিরি
বাইরে নেমেছে সন্ধ্যা, হালকা ঝরছে বৃষ্টি।
নিরি আবার বইটি খোলে]
—পাব কিভাবে ওই কুটিরের চাবি?

[এখন সে দ্যাখে অফুরন্ত মাঠ—
আর জেনে যায়—
অনেক বছর আগে পৃথিবীর ফুলগুলো আরো সাদা ছিল।
এই বন তখন অনেক ছোট,
এখানে অদ্ভুত সব প্রাণী বসত করত
তারা একে অপরের জীবন বাঁচাত
আর ঘুমাত বিশাল এক বট গাছের ছায়ায়।
সেই বট গাছ এখনো রয়েছে
শুধু শাখাগুলো শুকিয়ে গিয়েছে—
গাছটির ডানদিকে—সূর্য যেদিকে সন্ধ্যায় হেলে
শিকড়ের পাশে পোতা আছে জাদুর দুইটি মুক্তাদানা
ওই দানা তুলে নিলে গাছ আবার সবুজ হবে।
বাসা বাঁধবে পাখিরা। লাল লাল ফল হবে।
আর যদি মুক্তদুটো হাতে করে যাও
সেই পানা পুকুরের সজনে গোড়ায়—
ব্যাঙটাকে খুঁজে পাও
তার সামনে রাখবে
দেখবে সে খেয়ে নেবে মুক্তদুটো
তারপর গলগল করে বমিতে ভাসাবে
বেরিয়ে আসবে চাবি]
—এসব কি আসলেই সত্যি? কিভাবে বুঝব সব সত্যি?
[নিজ মনে ভেবে ভেবে, বইয়ের অন্য পাতা খোলে]
—বলো আমার মা, কী করছে এখন?

[বইয়ের পাতাগুলো ধূসরতার নিকটে চলে যায়।
মাঠ ছাপানো বৃষ্টিতে চাঁদ ঢেকে গেছে
লণ্ঠনের চারপাশে লাফাচ্ছে কাদুলে পোকা
একটি কেবল ছায়া একা, যেন আরো ঘোলা হয়ে যায়।
নিরির মা কাতরাচ্ছে পেটের ব্যথায়।
আরও জানতে পারা যায়—
পূর্ণিমার আগে মারা যাবে সন্তানসম্ভাবা
যদি তাকে বাঁচাতেই হয়,
যেতে হবে কুটিরের পাশটায়
জমে ওঠা অন্ধকার কিংবা দিনের সবুজে
বেঁচে রয়েছে সেখানে—বুনো হলুদের শটিবন
গোলাপের কাঁটার অভ্যাস রয়েছে তাদের—
তবু
দিনে কিশোর পাখিরা ওইখানে পোকা খুটে খায়
আর রাতে ঝুঁকে পড়া অন্ধকারে
নীল পাখনার ফসফরাসের আলোতে জোনাকি জ্বলে।
যে কোনো সন্ধ্যায় সবথেকে রোদে-পোড়া শটিগাছ তুলে ফেলে
তার মূল যদি, দুধে ভিজিয়ে খাটের নিচে, রাখা যায়
গর্ভব্যথা হবে উপশম, পাবে পরমায়ু।]

দৃশ্য : ০৫
[বিছানার চারপাশে মহিলারা। সন্তানের অপেক্ষায় বাইরে পুরুষ।
চাদর ভিজছে রক্তে। তবু কোনো সমাধান নেই। বেড়ে যাচ্ছে ব্যথা
লুকিয়ে ভেতরে ঢোকে নিরি।
বিছানার নিচে রাখে দুধভরা বাটি।
তাতে হাসছে শেকড়। যেন সহসা থিতিয়ে যায় কান্নার চিৎকার।
...
নিরি বেরিয়ে আসছে। কে বলছে যেন, ভাই এলো তার।]

দৃশ্য : ০৬
[আজ আলোর আঘাত নেই কোনো
মধ্যদিনে বনের ভেতরে সন্ধ্যা উঁকি মারে যেন।
পানাপুকুরের ‘পরেও আলোর দেখা নেই
চারপাশের গাছেরা জড়ো হয়ে
অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টির ফারাক
ভুলিয়ে দিয়েছে।
সজনে গাছের গোড়াতেই
ভুস করে ভেসে ওঠে বিশাল কোলাব্যাঙ]

—এই যে গোলাপি ব্যাঙ। তাকাও আমার দিকে।
আমি পাতালপুরির রাজকুমারী, শুনছো?
আমি তোমাকে পাই না ভয়।
খাবার এনেছি দেখো।
[নিরি মুক্তাদুটো ছুঁড়ে দেয়,
শুকনো পাতার ’পরে ঝিকিমিকি করে মুক্তাদুটো
ব্যাঙ শুধু চেয়ে যায়—অতঃপর গিলে ফেলে—অনায়াসে।
যেন গোলমরিচ খেয়েছে খালি মুখে—
এরপর বিশাল হা করে উগরে দিয়েছে
পেটের সকল জল। তাতে বেরিয়ে-আসে সোনার-চাবি।]

দৃশ্য : ০৭
[গাড়ি চলছে, মায়ের সঙ্গে
বালিকা একটা মেয়ে।
পুরাতন গাড়ি—মাটির সরল পথ,
গাড়ি দোলার অভ্যাসে মনে হয়
নিচে যেন জলাভূমি।
পথের দুধার ঘেঁষে ঘন বনভূমি।

মায়ের কোলের মধ্যে মেয়েটির
ঘুম ভেঙে যায়। সে কেবল দেখে
তার মা’র মুখ, নীল ডালিয়ার দেশ যেন
কাছেই কোথাও আছে।

গাড়ি চলছে পুরনো অভ্যাসে
পথের দুধার ঘেঁষে ঘন বনভূমি
আরো ঘন হয়ে আসে]

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;