স্কুল ইন্সপেক্টর



এম আতহার তাহির ।। অনুবাদ : জিয়া হাশান
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

লাঙল নিয়া মিস্ত্রির কাছে যাচ্ছে এমন এক কৃষকের কাছে ইন্সপেক্টর স্কুল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন।
: হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখানে একটা স্কুল আছে। গ্রামের বাইরে মনে হয়।
সে তার ধুলামাখা চামড়া ফাটা খসখসে আঙুল তুলে গ্রামের বাইরে যাবার রাস্তা খায়ে দ্যাখায়ে দেয়। ইন্সপেক্টর তাকায়ে দ্যাখেন—উঁচানিচা এবড়োথেবড়ো রাস্তা। তার এখানে সেখানে পানি জমে কর্দমাক্ত। বাকিটুকু ধুলোময়। তা ক্ষেতের কাছে গিয়া শেষ হয়েছে। তিনি তাই দুই ক্ষেতের মাঝখান দিয়া চলে যাওয়া সে রাস্তা ধরে আগান। দূর থেকে এক সাইকেল আরোহীকে আসতে দ্যাখেন। ইন্সপেক্টরের কাছে এসে সে থামে এবং সাইকেল থেকে নেমে সম্ভ্রমে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। তার কাছে ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করেন—স্কুল কোথায়?
: স্কুল?
: হ্যাঁ
কয়েকটা মাঠের ওপারে একটা বড় গাছের দিকে ইশারা করে সে বলে—ঐ যে শিশাম গাছ দেখছেন তার নিচে।
: আমার সাথে গিয়া একটু দ্যাখিয়ে দিতে পারবে?

শহরের সাহেবকে সহায়তা করতে গ্রামের লোকটা সানন্দে রাজি হয়ে যায়। কেননা স্কুলের ছেলেমেয়েরা এবং মাস্টারসাব কিংবা পথচারীরা যদি তাকে শহরের এই সাহেবের সাথে দেখে তাহলে নিশ্চয়ই গ্রামে তার মান-সম্মান বেড়ে যাবে। এ ভাবনায় তার বুক ফুলে ওঠে। সে পথ দেখায়ে আগায়—সাহেবজি, স্কুল মাস্টার খুব ভালো। দারুণ পরিশ্রম করেন।

কিন্তু স্কুল ইন্সপেক্টর কোনো জবাব দেন না। জেলাজুড়ে এইসব স্কুলের পিছে পিছে ঘোরা অনেকটা নিষ্ফল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা নোংরা শহর, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং তার জিপ যেতে পারে না এমন প্রত্যন্ত গ্রামে স্কুলগুলো ছড়ানো-ছিটানো। আর তাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। খুবই হতাশাজনক। গত তিন বছরে এসব তার গা-সওয়া হয়ে যাবার কথা। কিন্তু না। প্রতিটা স্কুল তাকে এখনো আহত করে। কেননা এগুলোতে সাজ-সরঞ্জামের অভাব, স্থানীয় লোকজনের অনাগ্রহ আর ছাত্রছাত্রীরা যেমন অলস তেমনি শিক্ষকরাও পরজীবী। এসব আজকাল মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে তিনি নিজে কি করতে পারেন? সুপারিশ আর সুপারিশ। আর প্রতিটা সুপারিশই পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ ছেঁটে ফ্যালে। তাদের কাজই যেন স্বল্প পরিকল্পনা আর সামান্য উন্নয়ন।

তারা ফসলের ক্ষেতের মাঝ দিয়া আগান। তার কোনোটা কেবল চাষ দেওয়া আবার কোনোটায় গমের চারা মাথা তোলা। এক জায়গায় দেখা যায় জমি খুব নিচু। ফলে সেখানে পানি জমে ছোটখাট ডোবার মতো হয়ে আছে। তার ওপর পোকামাকড়ের ওড়াউড়ি আর জলে শ্যাওলার ভেসে বেড়ানো চোখে পড়ে। তারা কাছে যেতই একটা গুঞ্জন ওঠে। স্কুল ইন্সপেক্টর হাত নেড়ে মুখের কাছে আসা পোকামাকড় তাড়ায়ে দেন।

গ্রামের লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত হাঁটে। ফলে তার সাইকেলের ঢিলা বেল ঝনঝন করতে থাকে। তবে তার বিবর্ণ জুতার এখানে সেখানে কয়েটা তালি দেওয়া ও সেলাই করা এবং হিল ভাঙা। ফলে তা পায়ে দিয়া হাঁটতে তার কষ্টই হয়।

তারা কান পর্যন্ত উঁচু ভুট্টো গাছের এক ক্ষেত পাড়ি দিতেই দ্যাখেন শিশাম গাছ। চাষ করে বীজ রোপণের উপযোগী করা একটা ক্ষেতের পাশে ছায়াদানকারী গাছটা দাঁড়ানো। কিন্তু সেখানে তো আর কিছু নাই। গ্রামের লোকটা হতাশায় ভেঙে পড়ে—হ্যাঁ, স্কুলটা তো এখানেই ছিল। এই জমি চাষ দেওয়ার আগে এখানেই আমি দ্যাখছি।
: তাহলে?
: মনে হয় অন্য কোথাও চলে গেছে।
: কিন্তু তার ঘর?
: ঘর?
: এখানে কোনো ঘর ছিল না? স্কুল ঘর?
: না, জনাব, কোনো ঘর নাই স্কুলের। মাস্টারসাব তাঁর সাথে সাথে স্কুল নিয়া বেড়ান। তিনি যেখানে যান স্কুল সেখানে যায়।

তাহলে এখন কী করা, ইন্সপেক্টর কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না।

তখন গ্রামের লোকটা কয়েকটা ক্ষেত ওপাড়ের একটায় নিড়ানি দিতে এক লোককে দেখে তার পানে চিৎকার ছুড়ে দেয়—‘হেই মিয়া!’ ডাক শুনে নিড়ানি দেওয়া লোকটা কাজ রেখে তাদের দিকে ফেরে। ফলে তার চোখের ওপর সরাসরি সূর্যের রশ্মি পড়ে। তাই হাত দিয়া ছায়া তৈরি করে সে তাকায়।
: হেই মিয়া! স্কুল কোথায়? এই সাহেব শহর থেকে স্কুল দেখতে এসেছেন।
: স্কুল? ছেলেপেলেগুলা আখক্ষেতের দিকে আছে। সকালে তাদের ওদিকে যেতে দেখেছি।

ঘন ও পরিপুষ্ট আখে ভরা ক্ষেত। ধূসর সবুজ ও গোলাপি তাদের গায়ের রং। মাথায় ঘন সবুজ পাতা। বাতাসে তাদের মৃদু-মন্দ নড়াচড়া। তার পাশে চাষ দিয়া তৈরি করা আরো অনেক ক্ষেত। তারা তাই এদিকওদিক তাকান কিন্তু আর কিছুই চোখে পড়ে না। ফলে গ্রামের লোকটা হতবুদ্ধ হয়ে পড়ে—নিড়ানি দেওয়া লোকটা আখক্ষেতের কথাই তো বলেছিল, তাই না?
: হ্যাঁ, ইন্সপেক্টরের স্বরে বিরক্ত বাসা বাধা।
: তাহলে হয়তো ক্ষেতের ওপাশে হবে।
ভ্রু কুঁচকে ইন্সপেক্টর বলেন—শোনেন, আপনি গিয়া খুঁজে দেখেন। পেলে আমাকে এসে জানান।

গ্রামের লোকটা পাশেই সাইকেল শোয়ায়ে রেখে খুঁজতে চলে যায়। স্কুল ইন্সপেক্টর রাস্তার পাশে বসে সামনের দিগন্তজোড়া পরিষ্কার নীল আকাশ ছোঁয়া ধূসর মাঠ, উঠতি ফসল আর সবুজের নিস্তেজ ছায়ার পানে তাকান। দেখেন দূরের গাছে কয়েকটা কাক আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। আর আকাশের উঁচুতে অলস বিন্দুর মতো কয়েকটা চিল ঘোরাঘুরি করছে। আর কিছু ছোট ছোট পাখি কিচিমিচির জুড়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে চিৎকার কানে আসে। গ্রামের লোকটা ফিরছে। নানা অঙ্গভঙ্গির সাথে সে ছুটে আসছে। তাকে দেখেই ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়ান। তার শরীরের মাংশপেশিগুলা যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। বুঝতে পারেন যে, তিনি নিজেই অচল হয়ে যাচ্ছেন। এখন তার দরকার অফিসে, জিপের সিটে কিংবা যেসব স্কুল পরিদর্শন করেন তার চেয়ারে বসে থাকা।

গ্রামের লোকটার মুখে বিজয়ের হাসি—‘স্কুল খুঁজে পাইছি।’ তারপর ইন্সপেক্টরকে ক্ষেতের ভেতর দিয়া পথ দেখান।

ইন্সপেক্টর দ্বিধা নিয়া আগান। কেননা ঘন আখক্ষেতের ভেতরে ছিনতাই করে সবকিছু নিয়া গেলে কেউ কিছু টের পাবে না। কিন্তু আখের সবুজ পাতা তার মুখে ও হাতে আঁচড় কাটা শুরু করলে তিনি হাত দিয়া তাদের সামলে নিয়া সামনে তাকান। দেখে নেন কোথায় যাচ্ছেন। মাটি উঁচা-নিচা তাই বেশ কয়েকবার তাকে হোঁচট খেতে হয়। তারপর ক্ষেতের মাঝ বরাবর শোরগোল ও গাছের নড়াচড়া লক্ষ করে তারা আগাতে থাকেন। পৌঁছে দেখেন আখগাছ পরিষ্কার করে খোলা মতো একটা জায়গা। সেখানে মাটির ওপর গায়ে গায়ে ঘেঁষে বসা জন চল্লিশেক শিক্ষার্থী। কোনো মাদুর-ম্যাট চোখে পড়ে না। ক্ষেত ভেঙে আসার সময় শোনা শোরগোল এখানে এসে হঠাৎ থেমে যাওয়ায় কানে বাজে। তবে শিক্ষার্থীদের দেখে মনে হয়, তারা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নামতা মুখস্থ করছিল। বাকিরা ঝুঁকে পড়ে স্লেট বা বোর্ডে লিখছিল। কয়েকটা বোর্ড আবার সূর্যের দিকে মুখ করে আখগাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা। তাতে তখনো কালির দাগ তরতাজা।

শিক্ষার্থীদের মাঝখানে একটা নড়বড়ে চেয়ারে বেত হাতে এক বয়স্ক লোক বসা। দেখেই বোঝা যায় চেয়ারটাতে কয়েকবার জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে। তাই জোড়ায় জোড়ায় বাড়তি পেরেক মারা। আর পিছনের মূল ফ্রেমের সাথে আরেকটা তক্তা আঁটা। তাছাড়া বসার ও হেলান দেবার কাঠের যেসব জায়গায় পচন ধরেছে সেখানে বিসদৃশ্যভাবে তক্তা লাগানো। ইন্সপেক্টরকে দেখে মাস্টারসাব উঠে দাঁড়ান। তার খালি পা জুতো খুঁজে নেয়।

মেন্টর ইংরেজিতে কমান্ড করে—‘ক্লাস স্ট্যান্ড।’ সাথে সাথে সব শিক্ষার্থী উঠে দাঁড়ায় এবং তাদের জামার পেছনের ধুলো ঝেড়ে নেয়। স্কুল ইন্সপেক্টর আসায় মাস্টারসাব অস্থির হয়ে পড়েন। থির হতে কিছু সময় নেন। তারপর কাঁধের রুমালে চেয়ারের ধুলোবালি ঝেড়ে নিয়া তাতে বসার জন্য ইন্সপেক্টরকে অনুরোধ জানান। তার সাথে আসা গ্রামের লোকটা স্বস্তি বোধ করে। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইন্সপেক্টর বিদায় জানান। সাথে সাথে সে হাওয়া হয়ে যায়।

: হুজুর! হুজুর!!
ইন্সপেক্টর চারদিকে তাকান—এই তাহলে স্কুল?
মাস্টার সাব ঢোক গেলেন—জি, সাব।
: আপনি এদের কী কী পড়ান? প্রশ্ন করে তিনি আবার মাস্টারসাবের ঢোক গেলার শব্দ শুনতে পান।
: উর্দু, অঙ্ক, ইংরেজি আর হাতের লেখা শিখাই, স্যার।
: সরকার নির্ধারিত বই থেকে?
: জি স্যার, সরকার নির্ধারিত বই থেকে।
তিনি চেয়ারের পায়ার কাছ থেকে পাতা ছেঁড়া কতগুলো আস্তো বই তুলে স্কুল ইন্সপেক্টরের হাতে দেন।

ইন্সপেক্টর উর্দু টেক্সট বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা অধ্যায়ে গিয়া থামেন। একজন ছাত্রকে তা পড়তে বলেন। কিন্তু ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
: স্যারজি, বইটা ক্লাস ফোরের কিন্তু ছেলেটা ক্লাস টুয়ের।
: এখানে তাহলে কয়টা ক্লাস আছে?
: ছয়টা, স্যারজি। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স।

ইন্সপেক্টর যাদের একটা দল বলে ভেবেছিলেন এতক্ষণে তাদের ভাগটা বুঝতে পারেন। মাস্টারসাব তার হাতের বেত দিয়া ইঙ্গিত করে বলেন—স্যারজি, ও ক্লাস ফোরে।
তাকে ইন্সপেক্টর নির্দেশ দেন—তুমি পড়ো।

ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়ে পড়া শুরু করে। স্পষ্ট উচ্চারণে জোরালো কণ্ঠে সে পড়ে যায়। কোনো ভুল নাই, এতটুকু তোতলামি নাই। ফলে মাস্টারসাবের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। তিনি অনুরোধ করেন—স্যারজি, অন্য ক্লাসের একজনরে ধরেন।

স্কুল ইন্সপেক্টর ক্লাস টুয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংক কষতে দেন। তা অধিকাংশেরই সঠিক হয়। ক্লাস ওয়ানের একজোড়া ছাত্র মুখস্থ রাখতে সুবিধা হয় সেরকমভাবে গানের সুরে সুরে ছন্দের তালে তালে আগে-পিছে মাথা দুলিয়ে ইংরেজি অক্ষরগুলো নির্ভুলভাবে আবৃত্তি করে। একই সুরে সুরে বা বা ব্লাক শিপ ছড়াটা পড়ে শোনায় ক্লাস সিক্সের একটা ছেলে। যদি সে অন্তর থেকে তা করে থাকে তাহলে বলতে হবে চমৎকার হয়েছে। আর যদি বই থেকে পড়ে থাকে তাহলে উত্তম হয়েছে বলে ইন্সপেক্টরের মনে হয়। তাই স্বীকার করতেই হয় যে, তার আওতাধীন প্রাথমিক স্কুলগুলোর তুলনায়, যে কোনো বিচারেই হোক, এটার মান অনেক উঁচুতে। সুতরাং এই স্কুল মাস্টারের সুখ্যাতি অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য। শিক্ষার্থীদের পারফমেন্সে সন্তোষ প্রকাশ করে ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়ান। ফলে চেয়ারটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে ওঠে। তবে মাস্টারসাবকে উদ্দীপ্ত দেখায়।

মেন্টর চিৎকার করে ওঠে—‘ক্লাস স্ট্যান্ড।’ আগেরবারের তুলনায় এবারেরটা অনেক জোরালো। ইন্সপেক্টর চলে যাবার পথ ধরেন। বেত হাতে মাস্টারসাব তার পিছু নেন। তাদের গ্রামের হালহাকিকত ও আরো অনেক বিষয় নিয়া কথা বলতে থাকেন। ক্ষেতের বাইরে বের হয়ে তবেই ইন্সপেক্টর স্বস্তি বোধ করেন। তখন জিজ্ঞাস করেন—আপনি স্কুলের স্থান বদল করেন কেন? এখানে ভাড়ায় ঘর পাওয়া যায় না?
: ভাড়ায়, স্যারজি?
: তাহলে তো ভালো হয় ।
: না, না, সাবজি। কেউ-ই আমাদের ঘর দিতে চায় না। তারা চায় না এখানে স্কুল হোক। সে কথা তারা বহুবার বলেছে। তারা মনে করে তাদের সন্তানদের সময় অপচয় হচ্ছে। কোথাও কাজ করা, বাবাকে ক্ষেতখামারে সহায়তা করা কিংবা গরু-বাছুর চড়ানোর বদলে এখানে এসে তারা দুষ্টুমি করছে। গ্রাম-প্রধান চৌধুরী আলী মোহম্মদই একমাত্র আমাদের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন, স্যারজি। তিনি মনে করেন শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনিও আমাদের ঘর দেননি। কিংবা এক খণ্ড জমি। কিন্তু ক্ষেতে চাষবাস শুরু করার আগ পর্যন্ত গত মৌসুমের পুরোটা সময় তিনি আমাদের শিশাম গাছের ছায়াটা দিয়েছিলেন। আর এই মৌসুমে আমরা তার এই আখক্ষেত ব্যবহার করছি।
: আপনাদের জন্য আখক্ষেতের মাঝখানটা খালি করে দিয়া তিনি ভালোই করেছেন।
: হ্যাঁ, সাবজি। মাঝখানটা খালি করে দিয়া তিনি ভালো করেছেন। স্কুলের ছেলেরা ও আমি মিলে তার এ জায়গার আখ কেটে দিয়েছি, স্যারজি। তার জন্য আমার তিন দিন কাজ করেছি। এমনকি ক্লাস ওয়ানের ছেলেরাও। সকাল আটটা থেকে মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত। শেষে ঘন অন্ধকার নেমে এলে আমরা আঁটি বেঁধে বেঁধে চৌধুরীর গরুর গাড়িতে তুলে দিয়েছি। চৌধুরী বলেন, আমাদের অবশ্যই শিক্ষার মূল্য দিতে হবে। তাই এইভাবে আমাদের তা দিতে হয়েছে বলে মাস্টারসাব মাথা থেকে তাঁর সাদা পাগড়ি খুলে দেখান। সেখানে তাঁর মেহেদিরঙা চুলের মাঝখানে এক ফালি টাক। তাঁর চোখে পানি চলে আসে। কিছুক্ষণের জন্য কণ্ঠ ফুঁপিয়ে ওঠে। শেষে পাগড়ি আবার মাথায় দিয়া অন্য দিকে তাকায়ে বলেন—আঁটিগুলো বয়ে নিয়া যেতে গিয়া আমার মাথার চুল পড়ে গেছে।

তারা আরো সামনে হাঁটতে থাকেন। স্কুল ইন্সপেক্টর আলপথে আর ক্ষেতের ওপর দিয়া বিসদৃশ্যভাবে তার পাশে পাশে কিছুটা খাটো দেহের মাস্টারসাব। তিনি নরম কণ্ঠে বলেন—সাবজি, যদি আমাদের একটা ঘর থাকত, কেবল একটা ঘর, যদি ঘর নাও হয় একখণ্ড জমি। তাহলে ছেলেপেলেদের নিয়া আমি নিজেই তা বানিয়ে নিতাম। তাতে হয়তো পুরো একটা মৌসুম লেগে যেত, স্যারজি। তবু আমরা তা করে নিতে পারতাম।

স্কুল ইন্সপেক্টর নীরবে হাঁটতে থাকেন।

: আমি বুঝি, স্যারজি, একখণ্ড জমি অনেক দামি আর লোকজনও এতটুকু চায় না স্কুল। তবে যে কোনো জায়গায় জমি হলে আমার আপত্তি নাই। গ্রামের কামলা-কিষাণরা যে এলাকায় থাকে সেখানে কিছু জমি আছে। তাই সেখানে স্কুল নিয়া যেত হলেও আমরা খুশি হব, স্যারজি। একখণ্ড জমিই ভালো...

স্কুল ইন্সপেক্টর নীরব। তিনি ইতিমধ্যেই তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হিসাবে দেখে ফেলেছেন। কেননা প্রাইমারি স্কুলের জন্য সরকার কোনো জমি বা ঘর দেয় না। স্থানীয় লোকজনকেই তা দিতে হয়। সুতরাং এখন কেন তা বদলানো হবে। আইন আইনই। এমন আইনও আছে যা শত শত বছর ধরে মেনে চলা হচ্ছে। স্বাধীনতার পরও তার কোনো বদল হয়নি। তখন যা ভালো ছিল এখনো তা-ই ভালো হয়ে আছে। সর্বোপরি আছে ব্যয় সংকোচন। সর্বত্র তিনি তা শুনতে পান। তাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ছ্ট্টো একখণ্ড জমি—শুধু এইটুকুমাত্র চাওয়া। কিন্তু তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক কয়জন আছে। কতজনই বা এমন আন্তরিক হয়েও এরকম হতাশার মুখোমুখি। এই তিন বছরের চাকরি জীবনে তিনি আর একটি মুখও মনে করতে পারেন না।

তিনি জিপে ওঠেন। ইঙ্গিতে মাস্টারসাবের বিদায়ী সালামের জবাব দিলে গাড়ি চলতে শুরু করে। তবে মাস্টার সাবের চোখে চোখ রাখা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না।


এম আতহার তাহির
পাকিস্তানের এই গল্পকারের জন্ম ১৯৫১ সালে। লাহোর সরকারি কলেজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় তিনি পড়াশোনা করেছেন। ১৯৮৪ সালে তিনি হুবার্ট এইচ হামফ্রে ফেলোশিপ লাভ করেন। প্রধানত ইংরেজিতেই তাঁর লেখালেখি। দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছে।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;