রবীন্দ্রনাথ, আপনিই পারেন



আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

বাঙালির সামনে আজ সমূহ সংকট উপস্থিত। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি আত্মপরিচয়ের সংকট যেন তার ক্রমশই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। বাঙালির রাজনীতি আজ সন্ত্রাস আর দুর্বৃত্তায়নের অপর নাম। সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি দ্রুত অপস্রিয়মাণ। শিল্প ও সংস্কৃতি আত্মবিস্মরণ আর অনুকরণসর্বস্বতায় আকণ্ঠ আকীর্ণ। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ, সে তার প্রকৃত পরিচয়টুকু পর্যন্ত যেন হারাতে বসেছে আজ। কিংবা হয়তোবা আত্মপরিচয়ের সংকটই তাকে ক্রমে ঠেলে দিচ্ছে অবধারিত পতন ও ধ্বংসের কিনারে।

বাঙালির সবচেয়ে বড় পরিচয় তার ভাষা ও সংস্কৃতি, প্রায় একক প্রচেষ্টায় যার ভিত্তি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আপনি স্বয়ং। শুধু তা-ই নয়, তাকে জগৎসভায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন আপনি স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি দুর্মর দায়বদ্ধতায়। আজ বাঙালির এই সংকটকালে পুনরায় ফিরে যেতে চাই তাই রবীন্দ্রনাথ আপনারই কাছে, কেননা আপনার হাতেই তো আমরা প্রথম বাঙালিত্বের দীক্ষা নিয়েছিলাম। আপনার জীবন ও কর্মের অনিঃশেষ ঐশ্বর্য আর অফুরান শক্তির ভেতর থেকেই আমরা আজ খুঁজে নিতে চাই আমাদের পরিত্রাণের প্রেরণা ও মুক্তির মন্ত্রণা।

প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, আপনিই পারেন আমাদের অন্তর্গত হীনম্মন্যতা দূর করে বিশ্বসভায় পুনরায় বাঙালিত্বের গৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রেরণা যোগাতে। বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে সেই কবে আপনি নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের জন্য; বাঙালির নিজস্ব পোশাক পরিধান করে আপনি আবিশ্ব পরিভ্রমণ করেছেন প্রাচ্যদর্শন আর শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী প্রচারের লক্ষ্যে। নিজের বাঙালি পরিচয়টুকু আপনি যে-রকম গর্বের সঙ্গে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শতবর্ষ আগে, সেই আত্মপরিচয়ের গৌরবটুকু আপনি আমাদের মধ্যে সঞ্চার করে দিন পুনরায়।

আপনিই পারেন রবীন্দ্রনাথ, সাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে। আপনি যে-অপরিসীম সাহস ও শৌর্যের সঙ্গে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ ও সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে এক পর্যায়ে তা বর্জন করেছিলেন; উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের তীব্র নিন্দা করেছিলেন যুগপৎ; জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে পশ্চিমা সভ্যতার নির্মমতা, কপটতা ও অমানবিকতার কড়া সমালোচনা করেছিলেন ‘সভ্যতার সংকট’ ভাষণে; আপনার সেই অতুলনীয় সৎসাহসটুকু আজকের শিরদাঁড়াহীন ভীরু বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত করে দিন কবি।

আপনিই পারেন আমাদের নিজস্ব শেকড়টুকু চিনে নিয়ে তাকে জীবনের সাথে মিলিয়ে নেবার শিক্ষা দিতে। আপনি নিজে অভিজাত পরিবারের সন্তান ও নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন সর্বদা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন ছেলেভোলানো ছড়া, পল্লীকবি জসীম উদদীনকে দিয়ে লিখিয়েছেন গ্রামজীবনের গাথা, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনকে দিয়ে সংগ্রহ করিয়েছেন ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ আর নিজে হাসন রাজা, লালন ফকিরের রচনা ও দর্শনকে শ্লাঘার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি আপনার এই অকৃত্রিম অনুরাগ ও মাটিঘেঁষা কৃষ্টিকে ভালোবাসার এই অপার ক্ষমতাটুকু আপনি ঐতিহ্যবিমুখ, শেকড়বিস্মৃত বাঙালির চেতনায় বিকশিত করুন আরেকবার।

আপনিই পারেন আমাদের যাবতীয় কূপমণ্ডুকতা, অন্ধ সংস্কার, জাতিবিদ্বেষ, পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা বিসর্জন দিয়ে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদিতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, আধুনিকতা ও মানবতান্ত্রিক প্রগতিশীলতার দীক্ষা দিতে। আপনি নিজে কবি হয়েও বিজ্ঞানের অনুরাগী ছিলেন, এতটাই যে, আপনি আইনস্টাইনের সঙ্গে আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন সমানে সমানে; বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন আপনার প্রিয়তম বান্ধব। নিজেও আপনি রচনা করেছেন ‘বিশ্ব পরিচয়’ এর মতো মূল্যবান বিজ্ঞানগ্রন্থ। আপনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ‘বিসর্জন’, ‘অচলায়তন’, ‘রবিবার’ এর মতো সাহসী সব রচনায়। নারীস্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরেছেন ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘যোগাযোগ’ ও আরো অনেক লেখায়। নিজের পুত্রকে বিধবা বিবাহ করায় উৎসাহ দিয়েছেন। জাতপ্রথা ও অস্পৃশ্যতার সরব প্রতিবাদ করেছেন ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে। বিহারের ভূমিকম্পকে ‘ঈশ্বরের অভিশাপ’ আখ্যা দেওয়ায় মহাত্মা গান্ধীর সমালোচনা করতে আপনি পিছপা হননি। হিটলার, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের সমালোচনা করেছেন, আবার সমালোচনা করেও আস্থা রেখেছেন সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যতন্ত্রে। শিলাইদহে মুসলিম প্রজাদের বসতে দিয়েছেন হিন্দু রায়তদের সঙ্গে একাসনে। আপনার এই অগ্রসর চিন্তা, আধুনিক মানসিকতা আর উদার, সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ভাবনার আলোকে অনগ্রসরতার অন্ধকারে ক্রমনিমজ্জমান আমাদেরকে উদ্ভাসিত করুন আরবার।

আপনিই পারেন আমাদের সব আলস্য আর নিষ্ক্রিয়তা দূর করে দিয়ে কর্মের স্পৃহা আর সৃষ্টির উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করতে। আপনি নিজে কবি ও শিল্পী বলে গজদন্তমিনারবাসী হয়ে থাকেননি কখনো। সাগ্রহে হাত লাগিয়েছেন নানান সাংগঠনিক কাজে। পূর্ববাংলার শাহজাদপুর আর পতিসর গ্রামের কৃষকদের সাহায্যার্থে স্থাপন করেছেন এই অঞ্চলের প্রথম কৃষি ব্যাংক, শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বিশ্বভারতী’র মতো অগ্রসর ও ব্যতিক্রমী বিশ্ববিদ্যালয়। তার পাশেই শ্রীনিকেতনে গ্রামোন্নয়নের বিবিধ কর্মযজ্ঞের আয়োজন করেছেন। চাঁদপুরের কালীমোহন ঘোষকে দিয়ে সমবায় প্রথা চালু করেছেন আপনার পৈতৃক জমিদারিতে। আপন পুত্র ও জামাতাকে কৃষি ও উদ্যানবিদ্যা শিখতে পাঠিয়েছেন সুদূর আমেরিকায়। পরিবেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চালু করেছেন বৃক্ষরোপণ আর হলকর্ষণ উৎসব। ইন্দোনেশিয়া থেকে দেখে এসে বাটিকশিল্পের প্রচলন করেছেন শান্তিনিকেতনে, সেখানকার মেয়েদের জুজুৎসু শিখিয়েছেন আত্মরক্ষার উপায়স্বরূপ।

আপনার সেই অদম্য, অনিঃশেষ কর্মস্পৃহা আর প্রাণশক্তির যে-বিচিত্র ও বহুমুখী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জীবনভর, তার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হবে কেবল। তাই সে প্রচেষ্টায় আপাতত ক্ষান্তি দিয়ে শুধু এটুকুই বলি, নিছক দিনযাপনের আর প্রাণধারণের গ্লানিতে প্রায় জীবন্মৃত আমাদেরকে আপনি আপনার সঞ্জীবনী মন্ত্রে জাগিয়ে তুলুন রবীন্দ্রনাথ, আর একটিবার। নইলে যে এই অতলস্পর্শী পতনের পথ থেকে আমাদের ফিরে আসার কোনো পথই খোলা রইবে না আর।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;