আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধ



ফরিদ কবির
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

২৫ মার্চ সকাল থেকেই শুনছি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

সকালে আব্বুজি আম্মাকে বললেন, তুমি ফরিদ-শরিফরে লয়া আইনথা চইলা যাও। শুনে আম্মা বললেন, কী কও? নিজের ঘর রাইখা আমি যামু না। এর চাইতে এক কাম করো, তুমি ফরিদ-শরিফরে আইনথায় রাইখা আসো। আইন্তা কেরানিগঞ্জের একটা ছোট্ট গ্রাম। বুড়িগঙ্গার ওপারেই।

আমাদের যাওয়া নিয়া দুজনে কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কে জড়িয়ে গেলে কায়কোবাদ কাকা বললেন, ভাবী, আপনে আর দাদায় বাচ্চাগো লয়া আইনথায় যান গা। আমি বাড়ি পাহারা দিমুনে।

আম্মা কিছুতেই যাবেন না। তিনি বলেন, সংসার রাইখা আমি যামু না।

শেষ পর্যন্ত আম্মা গেলেন না। দুপুরের দিকে আমার নানা এসে হাজির। বললেন, সবতে আমার লগে চল। ঢাকা টাউনে থাকনের কাম নাই।

কিন্তু আম্মা যেতে রাজি হলেন না। তিনি আমাকে আর শরিফকে পাঠিয়ে দিলেন।

আমরা ২৫ মার্চ দুপুরে খেয়ে-দেয়েই নানার সঙ্গে কেরানিগঞ্জে নানাবাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। জিন্দাবাহার থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক বেশ দূরেই। কিন্তু নানা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে হেঁটেই রওনা হলেন। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বাস লোহার পুল হয়ে নারায়ণগঞ্জ যেত। আমরা মার্চের তীব্র গরমের মধ্যেই হেঁটে এসে ভিক্টোরিয়া পার্কের বাসস্টেশনে পৌঁছলাম। বাস স্টেশন ছিল লোকে লোকারণ্য। একটা করে বাস আসে, আর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাতে। নানা আমাদের দু ভাইকে নিয়ে অনেক কষ্টে একটা বাসে উঠলেন। আমরা কোনো সিট পেলাম না। শরিফের তখন মাত্র ৭-৮ বছর বয়স। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ও হাঁসফাঁস করছিল। নানা সিটে বসে থাকা একটা লোককে বললেন, বাবা, আমার নাতিটাকে আপনার কোলে দেই?

লোকটা শরিফের দিকে এক নজর দেখে বললো, আচ্ছা, দেন।

নানা শরিফকে সেই লোকের কোলে বসিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, চল, সামনে কুনু বাসস্টপে সিট খালি হইলে তরে বসায়া দিমুনে।

নানা এক হাতে বাসের হাতল ধরলেন অন্য হাতে আমাকে।

বাস এসে মুন্সিখোলায় নামল। আমরা কোনো বাসস্টপেই লোকজন ঠেলে খালি সিটে বসতে পারলাম না।

মুন্সিখোলা থেকে বুড়িগঙ্গা পার হতে হবে আমাদেরকে। নদীর ওপার থেকে মাইল দেড়েক হাঁটাপথ। গ্রামের নাম আইন্তা। ছোট্ট একটা গ্রাম। এর মধ্যে ভূঁইয়া বাড়িই তুলনায় বড়।

আমার নানার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একদম বড়টাকে আমরা দেখিনি। পরের জন থাকেন পুরোনো ঢাকার কায়েৎটুলিতে। বাকি তিন ভাই তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আইন্তায়ই থাকেন।

আমরা যখন মুন্সিখোলায় নামি তখন বিকেল। কিন্তু মার্চের বিকেল। সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়লেও তার তেজ এতোটুকু কমেনি। তীব্র গরমে আমরা বেশ কাহিল। শরিফকে খুবই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ও এমনিতেই শুকনো, চিকনা-চাকনা। সেই দুপুরে আমরা খেয়ে-দেয়ে জিন্দাবাহার থেকে বেরিয়েছি। পথে আমাদের মুখে আর কিছু পড়েনি। শরিফের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

মুন্সিখোলা ঘাটেও অসম্ভব ভিড়। অনেকবার আমি এ পথে নানাবাড়ি গেছি। এত ভিড় কখনো দেখিনি। আমি শুধু এটুকু শুনেছি, আজ রাতে ভয়ংকর একটা কিছু ঘটতে চলেছে। কী ঘটবে, কেন ঘটবে তার কিছুই জানি না।

কায়কোবাদ কাকা আর আব্বুজির কথা থেকে জেনেছি আর্মিরা হামলা করতে পারে। তখন থেকেই আমার মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, আমরা কী দোষ করেছি? আর্মি আমাদের ওপর কেন হামলা করবে? এর উত্তর জানা নাই। আম্মা আর আব্বুজি ঢাকা টাউনে রয়ে গেছেন। রয়ে গেছেন কায়কোবাদ কাকাও। তাদের কোনো বিপদ হয় কিনা—এ নিয়ে একটা ভয় থেকে থেকেই আমাকে বিষণ্ণ করে ফেলছে।

অনেকক্ষণ হলো আমরা মুন্সিখোলা ঘাটে এসেছি। গিজগিজ করছে লোকে। নানান বয়সী। অনেকের সঙ্গেই বিশাল বিশাল ব্যাগ। দেখে মনে হবে পুরো সংসারটাই সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন। ঈদ-পার্বণের সময় এমনটা দেখা যায়। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সবাই গ্রামের বাড়িতে আসেন। কিন্তু তখন সবার চোখে-মুখে যেমনটা হাসি-খুশি ভাব থাকে, আজ তেমনটা মনে হচ্ছে না। সবার চোখে-মুখেই কেমন আতঙ্কের ছাপ। অবশ্য সেটা বড়দের মধ্যেই। তাদের সঙ্গে থাকা ছোটরা ঠিকই নদীর পাড়ে খোলামেলা জায়গা পেয়ে ছুটোছুটি করছে।

ব্যতিক্রম শুধু শরিফ। ও চুপচাপ আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমরা কখন যামু?

আমি বলেছিলাম, দেখছ না, নাওয়ে অনেক ভিড়।

সূর্য যখন প্রায় ডুবুডুবু তখন আমরা একটা নৌকায় উঠতে পারলাম। নৌকার মাঝি নানারই পরিচিত কেউ। তাকে দেখেই মাঝি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, খসরু বাই, আমার নাওয়ে আহেন।

নানা তার চিৎকার শুনেই আমাকে আর শরিফকে নিয়ে দ্রুত সেই নৌকার দিকে এগোলেন। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি ওঠা যায়! নৌকা পাড়ে ভিড়তেই ভিড় সেদিকে হামলে পড়ল। মাঝি এক হাতে ভিড় ঠেলে আমাদেরকে নৌকায় ওঠার জন্য আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিলেন।

মাঝি যখন নৌকা ছাড়লেন তখন সেটা প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। নানার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি বিড়বিড় করে সুরা পড়ছেন। আমার কেন জানি মনে হলো, আমাদের নৌকাটা ডুবে যাবে। নানার দেখাদেখি আমিও সুরা পড়তে শুরু করলাম। দুটো সুরা তখন আমার মুখস্ত ছিল। সুরা ফাতিহা আর সুরা ইখলাস। আমি সে দুটোই পড়তে শুরু করলাম।

ঠিক সে সময় একটা লঞ্চ আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। সদরঘাটের দিকে যাচ্ছে সেটা। লঞ্চের একটা বিশাল ঢেউ এগিয়ে আসছে আমাদের নৌকার দিকে। সন্ধ্যের আবছা আলো-ছায়াতেও বুড়িগঙ্গার ঢেউকে মনে হলো সমুদ্রের এক বিশাল ঢেউ। সমুদ্র আমি সামনাসামনি কখনো দেখিনি। সমুদ্র সম্পর্কে আমার ধারণা জোছনা খালাম্মার বাড়িতে টেলিভিশন দেখে। আমি চোখ বুঝলাম। মনে হলো, শক্ত একটা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেলো আমাদের নৌাকাটা। তারপর থেমে গেল। সেই ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কেউ একজন আমাকে ধরে ফেলল। চোখ খুলতে দেখি, একটা লোক মিটমিট করে হাসছে।

নৌকা ডোবেনি। সেটা পাড়ে এসে লেগেছে। আমি হাঁফ ছাড়লাম।

আইন্তায় যখন এসে পৌঁছলাম তখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকতেই নানি ঘরের ঠিলা থেকে পিতলের একটা গ্লাসে পানি ঢেলে শরিফের দিকে এগিয়ে দিলেন। তারপর নানার দিকে তাকিয়ে বললেন, আহা রে, আমার নাতিটার মুখ এক্কেরে হুগায়া গেছে গা। অরে আপনে কিছু খিলান নাই?

নানা বিরক্তমুখে বললেন, আরে, রাস্তায় কিছু আছে নিহি। মানু জান লয়া পলাইতাছে।

শরিফ পানি খাওয়া শেষ করলে নানি আমাকেও এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। তারপর নানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনেরও যেমুন কথা। নাতি গো একটা লেবেঞ্চুশও তো মানু কিনা দেয়। কন যে বুইলা গেছিলেন গা।

নানা এসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বললেন, হুমায়ুন ফিরছে?

হুমায়ুন আমাদের একমাত্র মামা। তিনি শ্যামপুরের সাত্তার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।

নানি বললেন, না ফিরে নাই তো। আপনে ইট্টু গিয়া দেখেন না, গোলে আইছে নিহি।

গোলে মিয়া আমাদেরই কী রকম আত্মীয়। আমরা ডাকি গোলে ভাই। গোলে ভাইও সাত্তার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতেই কাজ করেন।

নানা পাঞ্জাবিটা আবার পরে নিলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমিও জামাকাপড় বদলে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নানি জিজ্ঞেস করলেন, কী তর সইতাছে না? আগে খায়া-দায়া ল, তারপর যাইছ।

আমি বললাম, আপনে খাওন বাড়তে থাকেন আমি অহনই আইতাছি। এক লৌড়ে যামু, আরেক লৌড়ে আমু।

নানি বললেন, হ তর লৌড় তো জানা আছে। আক্কু-মুজাহিদ গো পাইলে তর তো আর উঁশ থাকব না। আমি কই, খায়া-দায়া তারপর বাইরে যা। নানি সাহিদা খালাম্মার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, সাহিদা, ফরিদ-শরিফ রে খাওন দে।

আমি নিজের জামা-কাপড় বদলালেও নানি শরিফের শার্ট খুলে ওকে একটা গেঞ্জি পরিয়ে দিলেন।

খেয়ে দেয়েই আমি ছুটলাম মুজাহিদের খোঁজে। মুজাহিদ আমারই সমবয়সী। আক্কু, মানে আকতারও আমার সমবয়সী। আকতার সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। আমার মায়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। মুজাহিদ আর আক্কু দুজনকেই পাওয়া গেল।

আমরা ভূঁইয়া বাড়ির কবরস্থানের এক পাশে বসলাম। আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো আরো কয়েকজন।

রাতে হুমায়ূন মামা ফিরলেন না। নানিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, হুমায়ূন মনে অয়, তগো বাড়িতই গেছে।

আমি হুমায়ূন মামার ঘরেই ঘুমুতে গেলাম।

অনেক রাতে হৈ-চৈ আর গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙল। আমি উঠে বসলাম। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। ঘরের বাইরে অনেক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে। আমি উঠে দরোজা খুললাম। ঘরের বাইরে অসংখ্য মানুষ। আমরা সবাই ‘বন্দে’ চলে গেলাম। সেখানে আশেপাশের বাড়ির মানুষেরাও ভিড় করেছে। দূরে ঢাকা টাউনের যতটুকু দেখা যায়, সেখানে কিছুক্ষণ পরপরই আগুনের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে দ্রিম-দ্রিম-টা-টা-টাস-টাস শব্দে গুলি আর বোমার আওয়াজ। শহরের একটা জায়গায় আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়েছে। দাউ-দাউ করে বাড়িঘর পুড়ছে! কোথায় আগুন লেগেছে, কারা গুলি করছে, কাদের করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে সেন্টুকে দেখলাম। সেন্টু সম্পর্কে আমার মামা। আমার মায়ের চাচাতো ভাই। বয়সে আমার বেশ কিছুটা বড় হলেও আমি ওকে নাম ধরেই ডাকি। ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী অইছে রে? এত্তো গুল্লি কারা মারতাছে?

সেন্টু আমার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল, আর্মি গুল্লি করতাছে। ডাকা টাউনের সবতেরে মাইরা ফালাইতাছে।

মাইরা ফালাইতাছে! ক্যান? আমি অবাক হয়ে গেলাম।

সেন্টু ভয়ার্ত গলায় বললো, শেখ মুজিবরে যারা ভোট দিছে, তাগো সবাইরেই নাকি মাইরা ফালাইতাছে! দ্যাখতাছস না, বাড়ি-গরে আগুন লাগায়া দিছে।

শুনেই আমার বুক ধরাস করে উঠল। আমার আম্মা-আব্বুজি তো ঢাকায়! তাদেরকেও মেরে ফেলবে নাকি আর্মি?

কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব সেন্টু দিতে পারবে না। আমি দৌড়ে ঘরে ফিরলাম। নানা-নানি কেউ ঘরে নেই। শরিফ বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, কী অইছে, ভাইয়া?

আমি বললাম, কিছু অয় নাই। তুই ঘুমা। আর্মিরা গুল্লি করতাছে। ঘর থেইকা বাইর অইছ না কলাম। ঘরে থাকিছ। আমি নানিরে বিছরায়া লয়া আইতাছি।

ঘরের বাইরে বের হতেই পুঁটি খালাম্মাদের আঙিনায় দেখা গেলো একটা ভিড় জমাট বেঁধে আছে। সেখানে গিয়ে নানির দেখা পাওয়া গেল। তবে তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি মাটি থাপড়াতে থাপড়াতে চিৎকার করে কাঁদছিলেন আর কিছুটা সুর করে গাইছিলেন, আমার মিনার কী অইবো রে খোদা। আমার হুমায়ূনের কী অইবো...!

উপস্থিত লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, আরে, মিনার কিছু অইবো না। আপনে আল্লা আল্লা করেন। আয়াতুল কুরসি পড়েন। আরেকজন তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। মুখে বলছিলেন, ও ফুপু, গরে চলেন, মিনা আপার কিছু অইবো না। চলেন, গরে চলেন।

নানি কিছুতে উঠবেন না। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন।

নানির কান্না দেখে আমার কিছুটা ভয় লাগতে শুরু করলো। আম্মা-আব্বুজি ঠিক আছে তো? কায়কোবাদ কাকা? হুমায়ূন মামা?

বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করতে লাগল।

আমি ভয় আর আশঙ্কা নিয়েই এক সময় ঘুমুতে গেলাম। কিন্তু ভূঁইয়া বাড়ির মানুষ সারা রাত ঘুমুল না। সারা রাতই ঘরের চারপাশে তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙল গোলাগুলি আর অসংখ্য মানুষের কথাবার্তা শুনে। বিছানা থেকে উঠে দেখি দরোজা খোলা। বিছানা ছেড়ে দরোজার বাইরে গিয়ে দেখি, বাড়ির সবাই জেগে। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। আমাকে দেখে আক্কু এগিয়ে এসে বলল, তুই গুমাইতাছোস? পাকিস্তান আর্মি তো ঢাকা টাউনে হাজার হাজার মানু মাইরা ফালাইছে। তারপর আস্তে আস্তে এইদিকে আইতাছে। লোকজন ঢাকা ছাইড়া পলাইতাছে।

আমি বললাম, লোকজন পলাইতাছে ক্যামনে বুঝলি?

আক্কু বললো, আমার লগে আয়।

আক্কুর পেছনে পেছনে আমি বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

অসংখ্য মানুষের সারি ভূঁইয়া বাড়ির লাগোয়া সড়কে। নদী পার হয়ে তারা ছুটছে। কারো কারোর শরীরে গুলি লেগেছে। ছেলে-বুড়ো সবার চোখেই আতঙ্ক।

পাকিস্তান আর্মি কেন নির্বিচারে সবাইকে মারছে এটা বুঝতে আমার আরো কয়েকদিন লাগল। এও জানলাম, বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবকে আটক করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে আর্মিরা। তিনি জীবিত আছেন, নাকি তাকে আর্মিরা মেরে ফেলেছে কেউ কলতে পারছে না।

সেদিন দুপুরের মধ্যেই ভূঁইয়া বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল।

শুনলাম ঢাকায় কার্ফিউ চলছে। কার্ফিউ কী জানতাম না। মুজাহিদকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, কার্ফিউ মানে অইলো, কেউ গরের থন বাইর অইতে পারব না। বাইর অইলেই আর্মি তারে গুল্লি কইরা মাইরা ফালাইব।

নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগল! কত কিছুই যে জানি না আমি!

সন্ধ্যার একটু পরেই একটা খ্রিস্টান পরিবার আমাদের ভূঁইয়া বাড়িতে এলো। ভদ্ররোকের নাম অশোক খান। ‘খান’ কিভাবে খ্রিস্টান হয় ভেবে পেলাম না। শুনলাম তিনি সাত্তার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। হুমায়ূন মামার বস। সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী, দুই ছেলে মিখায়েল ও প্রিন্স, আর এক মেয়ে ঝর্না। ঝর্না আর মিখায়েল আমাদেরই বয়সী। প্রিন্স কিছুটা ছোট।

তা হোক, আমাদের বন্ধুদের দল ভারি হয়ে গেল।

দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন মামা ঢাকা থেকে ফিরতে পারলেন না। আমরা ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়লাম। পাকিস্তান আর্মির নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তারা বেঁচে আছেন কিনা আমরা জানতে পারছি না।

যুদ্ধ শুরু হবার ছয় দিনের মাথায় হুমায়ূন মামা আইন্তায় ফিরে এলে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তিনি জানালেন, ঢাকায় আম্মা-আব্বুজিসহ আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা ভালো আছেন। তবে, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। হুমায়ূন মামা আসার সময় কতগুলি লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছেন তার বিবরণ দিলেন। গ্রামের লোকজন ভিড় করে তার গল্প শুনছিল।

ভূঁইয়াবাড়ির লাগোয়া সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে হাজার হাজার মানুষের মিছিল দিন দিন বাড়ছিলোই। নদী পার হয়ে এ পথে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিলেন অসংখ্য মানুষ।

কিন্তু আম্মা আর আব্বুজি গ্রামে এলেন না। তারা থেকে গেলেন ঢাকা শহরেই।
জুন মাসের শেষের দিকে আমরা ঢাকা ফিরলাম।

আমাদের বাসার দরোজায় দেখলাম, লাল কালি দিয়ে উর্দু ভাষায় বিশাল করে লেখা আছে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ তার একটু ওপরে আরবিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’ আব্বুজির হাতের লেখা।

অনেকদিন পর ঢাকায় নিজের বাসায় ফিরে বেশ ভালো লাগছিল।

আমাদের বাসায় কোনো রেডিও ছিল না। বাসায় এসে দেখি আমাদের টেবিলের ওপর রাখা আছে নতুন একটা রেডিও। ফিলিপস ব্রান্ডের।

হঠাৎ রেডিও কেনা হলো কেন তা সন্ধ্যে হতেই বোঝা গেল।

কায়কোবাদ কাকা অনেক কসরৎ করে একটা স্টেশন ধরলেন। শুনলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সেটা।

রাজনীতি বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো জ্ঞান বা উৎসাহ কিছুই সে বয়সে ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আর অত্যাচার-নির্যাতনের নানা বর্ণনা আমার কানে আসছিল। ফলে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি একটা ঘৃণা মনের মধ্যে কিভাবে যেন জায়গা করে নিচ্ছিল।

আইন্তায় থাকতেই কারোর মুখে শুনেছিলাম, আর্মিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে। কোনো কোনো জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে, কত পাকবাহিনী মারা যাচ্ছে তার খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়।

আইন্তায়, মানে নানাবাড়ি থাকতে স্বাধীন বাংলা কেতার কেন্দ্র কখনো শোনা হয়নি। কার ঘরে কখন রেডিও ছেড়ে এই স্টেশনের খবর শোনা হয় তা আমরা কখনো জানতে পারিনি! হয়তো খুব গোপনে এই স্টেশন শোনা হয়। অবশ্য গ্রামে থাকতে আমরা এসব খবর শোনার ব্যাপারে খুব যে আগ্রহী ছিলাম তাও না। সন্ধ্যের পর আমরা সমবয়সীরা নানান খেলায় মেতে উঠতাম। স্কুল নেই, পড়া নেই। আমাদের তখন আনন্দ আর আনন্দ।

জিন্দাবাহারে নিজেদের বাসায় ফিরে আসার পর আমাদের বাইরে যাবার উপায় ছিল না। ঘরেই থাকতে হতো। ফলে, কায়কোবাদ কাকা যখন স্বাধীন বাংলা বা বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকা ধরতেন আমরাও তখন তা শুনতাম। আমাদের ছোট ঘরটিতে রেডিও শোনার জন্য আশেপাশের অনেক মানুষ জড়ো হতেন। পাশের বাসার সাহিদা আপার বাবা মনছুর খলিফা অবধারিতভাবেই উপস্থিত থাকতেন। কায়কোবাদ কাকার সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতেন।

কায়কোবাদ কাকা খুব মনোযোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো শুনতেন। খবর আর গান ছাড়াও শুনতেন চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার।

কায়কোবাদ কাকা আর মনছুর খলিফার আলাপ আমিও কেন জানি না মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তাদের আলাপ থেকেই জেনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনারা ‘গাবুর মাইর’ খাচ্ছে।

আব্বুজি স্বাধীন বাংলার খবর খুব একটা বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলতেন, এইগুলি একদমই ফালতু খবর। পাক আর্মিরা অনেক শক্তিশালী। তাদের কাছে আছে আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র। কোনো ট্রেনিং ছাড়া বাঙালিরা তাদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য না।

কায়কোবাদ কাকা বলতেন, দাদা, গেরিলাযুদ্ধের কাছে কুনু কিছুই টিকব না। আপনের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর মিলিশিয়ারা দেইখেন ক্যামনে জান লয়া পলায়।

কয়েক মাস পার হতেই কায়কোবাদ কাকার কথাই সত্যি প্রমাণ হতে শুরু করল। সারা দেশে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে এবং বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন করার খবর শুনছিলাম।

বিজয়ের দিন

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা আবার আমরা নানাবাড়ি আইন্তাতেই ফিরে গেলাম। মার্চের দিকে যখন এসেছিলাম তখন মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখেছিলাম সেটা আর নেই। মানুষ অপেক্ষা করছে, কখন পাকিস্তানি হানাদাররা সারেন্ডার করে।

ডিসেম্বরের তের-চৌদ্দ তারিখের দিকে পাকসেনাদের ওপর বিমান হামলাও তীব্র হয়ে উঠল। সাঁ-সাঁ করে যখন মিগ টুয়েন্টি ওয়ান উড়ে যেতো মানুষ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠত। কেউ কেউ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠত।

১৫ ডিসেম্বর আইন্তা ভূঁইয়া বাড়িতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আশ্রয় নিলেন। তারা আমাদেরই দূরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন। হুমায়ূন মামাকে দেখলাম, তাদের সঙ্গে গল্প করছেন। এক সময় দেখা গেল তিনি তাদের একজনের কাছ থেকে একটা লাইট মেশিনগান নিয়ে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আমি তার পাশে গিয়ে বললাম, মামা, আমি একটু দেখি?

মামা বললেন, মাম্মা, এইটা তো আপনে তুলতে পারবেন না। অনেক ভারী।

আমি বললাম, পারমু।

মামা আমার দিকে মেশিন গানটা এগিয়ে দিলেন। আমি সেটা নিতে গিয়ে বুঝলাম, বেশ ভারী। হুমায়ূন মামা অস্ত্রটা আমার হাত থেকে নিয়ে যার অস্ত্র তাকে ফিরিয়ে দিলেন।

আগে কখনো মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি। ঢাকায় আমার বন্ধুরাও কখনো মুক্তিযোদ্ধা দেখেনি। এরকম কাছ থেকে কোনো অস্ত্রও তারা দেখেনি। আমিও হাত দিয়ে কখনো কোনো অস্ত্র ধরে দেখিনি। আজ একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজনকে দেখে এবং নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে ভেতরে কেমন একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম।

আমার পাশে আক্কু আর মুজাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের বললাম, চল আমরাও মুক্তিবাহিনীর খাতায় নাম লেখাই।

ওরা আমার কথা শুনে রাজি হয়ে গেল। আক্কু বলল, অরা তো আমগো নিব না। আঠারো বছর অইলে নিত। আমি হুনছি, আঠারো বচ্ছর বয়স অইলে মুক্তিবাহিনিতে যাওন যায়।

ওর কথা শুনে আমাদের মনের কথা মনেই রয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় ভূঁইয়াবাড়ির উঠোনে একটা নাটক মঞ্চস্থ হলো। গত কয়েক মাস ধরেই এর রিহার্সাল চলছিল। নাটকের নাম: নবাব সিরাজুদ্দৌলা। হুমায়ূন মামাও এতে অভিনয় করলেন। তিনি হলেন লর্ড ক্লাইভ।

অনেক রাত পর্যন্ত নাটক চলল।

তখন তেমন কারোর কাছে ঘড়ি ছিল না। কিংবা আমাদের ঘড়ি দেখার কেনো প্রয়োজনও ছিল না। রাত দশটা হোক কিংবা দুটো। দুটোই আমার কাছে সমার্থক। ভূঁইয়া বাড়িতে আমরা সমবয়সীরা সংখ্যায় নেহায়েৎ কম না।

সারাদিন আমাদের তাস খেলে, দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হাডুডু খেলে কাটত। এই তাস অবশ্য বড়দের তাস ছিল না। আমরা খেলতাম সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে। কিংস্টর্ক, সিজর্স, প্যারট, ক্যাপস্টান- এসব সিগারেটের খালি প্যাকেট সংগ্রহ করে আমরা খেলতাম।

নাটক শেষ করে আমরা প্রায় ভোরের দিকে ঘুমুতে গেলাম। পরের দিন একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। নাস্তা করছি এমন সময়ে দেখলাম, বাইরে বেশ হৈ-চৈ হচ্ছে। কে একজন বলল, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে!

আইন্তা গ্রামটা একটা অদ্ভুত গ্রাম। বেশিরভাগ মানুষই এখানে অশিক্ষিত। আমি যখনই গ্রামে এসেছি, কোনো না কোনো গুজব আমি শুনেছি।

মার্চে যখন এখানে এসেছিলাম, তখনও শুনেছিলাম, শেখ মুজিবকে পাকবাহিনী মেরে ফেলেছে। পরে, শুনেছি তাকে বন্দী করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে! অবশ্য কোনটা যে ঠিক আমরা তখনও জানি না।

তবে, চারদিকে বেশ গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে সড়কে একটা ছোটখাটো মিছিলও বের হতে দেখলাম। মিছিল থেকে স্লোগান উঠছে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয় বাংলা।

আমরাও সেই মিছিলে মিশে গেলাম।

মিছিল নিয়ে আমরা দোলেশ্বর চলে গেলাম। দোলেশ্বরে গিয়ে দেখা গেল একটা লঞ্চ বুড়িগঙ্গার তীরে অপেক্ষা করছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মানুষ তাতে গিজগিজ করছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছিলো আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল।

আমরাও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে লঞ্চে উঠে পড়লাম। বুড়িগঙ্গা দিয়ে যেসব নৌকা ও লঞ্চ যাচ্ছিল সেগুলো থেকেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান চারদিক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পর আমাদের লঞ্চও চলতে শুরু করল। লঞ্চে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও ছিল শ খানেক মানুষ। বিভিন্ন বয়সের শিশু-কিশোরও ছিল দশ-বারোজন।

লঞ্চ বিকেলের দিকে সদরঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে নামতে যাচ্ছিলাম, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের নামতে দিল না।

মুক্তিযোদ্ধাদের নেতাগোছের একজন চিৎকার করে সকলের উদ্দেশে বললেন, দয়া কইরা আপনারা কেউ নামবেন না। সবাই লঞ্চে থাকেন।

আমরা ডেকে এসে দাঁড়ালাম। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন লঞ্চঘাটে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একটা লোককে চোখ বেঁধে ঘাটের একপাশে এনে দাঁড় করাচ্ছে। তার দু হাত পিছমোড়া করে বাঁধা।

নিশ্চয়ই রাজাকার কিংবা আল বদর।

আমরা লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছি। কী ঘটতে যাচ্ছে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল আক্কু। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটারে কি অহন মাইরধর করব?

আক্কু বিজ্ঞের মতো ভঙ্গি করে বললো, দেখ না কী অয়! চোদনাটারে মনে অয় ভালোই ঠেঙ্গানি দিব।

আক্কুর কথা শেষ না হতেই গুলির আওয়াজ হলো। প্রথমে পিস্তলের একটা গুলি ছুটল। পর মুহূর্তেই এলএমজি টা-টা-টা করে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দিল। আমাদের চোখের সামনেই চোখ আর হাত-পা বাঁধা লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে লাথি দিয়ে নদীতে ফেলে দিলেন।

এত কাছ থেকে কাউকে মেরে ফেলার দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। আমার বুকটা ঢিবঢিব করতে লাগল।

লঞ্চ যখন সদরঘাটে এসে ভেড়ে তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম, আমি এখানে নেমে যাব। সদরঘাট থেকে জিন্দাবাহার সেকেন্ড লেনে আমাদের বাসা আধাঘণ্টার পথ। আম্মা-আব্বুজি আর কায়কোবাদ কাকাকে দেখতে খুব মন চাইছিলো। তা ছাড়া, ঢাকায় আজ অনেক কিছু ঘটবে। সেসব দেখার ইচ্ছেটাও মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার পা লঞ্চে কেউ যেন পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে। বেশ কিছু লোক লঞ্চ থেকে তখন নেমে গেলেও আমি নামতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ পরই লঞ্চ ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে লঞ্চটা তখন ঘাট ছেড়ে আবার দোলেশ্বরের দিকে যাত্রা করেছে। একটু পরেই সদরঘাট টার্মিনাল আমার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। তখনো লঞ্চের মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আর রাইফেলের ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে বিজয় উদযাপন করছে।

কিন্তু আমার চোখের সামনে অচেনা এক রাজাকারের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য বারবার ভেসে উঠতে লাগল।

দেশ স্বাধীন হবার পরের দিনই আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম।

   

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;