বস্তির বস্ত্রশিল্প ও অলিম্পিক ভিলেজ



মঈনুস সুলতান
অলিম্পিক ভিলেজ

অলিম্পিক ভিলেজ

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রচুর পর্বত ও হালকা বনানীতে পূর্ণ আফ্রিকার ছোট্ট রাজ্য লিসোটোতে কিছুদিন হলো আমি বাস করছি। লিসোটোর রাজধানী হচ্ছে মাসেরু। কিছু দিন আগে আমি মাসেরুতে বেড়াতে আসি। তখন খুঁজে বের করি বছর দুয়েক আগে জিম্বাবুয়ের কবি সন্মেলনে পরিচয় হওয়া এক তরুণী—কবি নাকাতুলে মোপালেসাকে। নাকাতুলের সাথে আমার জানাশোনা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাই এ যাত্রায় তার দরাজ হাতে সঙ্গদানের ওপর ভরসা করেছিলাম। কিন্তু নসিব খারাপ, ইতিমধ্যে লিসোটোতে কর্মরত জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির এক বিপত্নীক কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. সাইমন ইনগ্রাম হিলের সাথে তরুণী কবিটির জোরালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মাসেরুতে এসে আমি নাকাতুলের সঙ্গ পেয়েছি স্বল্প, তবে সে একটি উপকার করেছে, ড. ইনগ্রাম হিলের সাথে আমার যোগসূত্র ঘটিয়ে দিয়ে কনসালটেন্ট হিসাবে ছোটখাট কিছু কাজ পাইয়ে দিয়েছে।

এধরনের একটি কনসালটেন্সি জাতীয় কাজের হিল্লা ধরে আমি এ মুহূর্তে মাসেরু শহরের একটি হোটেলের লবিতে বসে আছি। লবির দেয়াল জুড়ে ঝুলছে চমৎকার সব চিত্রিত বস্ত্র। কোনো কোনো কাপড়ে ছাপ দিয়ে করা নকশা। অন্যগুলোতে আছে সুইসুতা দিয়ে আঁকা ছবি। আমি নোটবুকে এসবের একটি ডিটেল বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছি। ইউএনডিপির কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. ইনগ্রাম-হিল আমাকে এ কাজের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি কয়েকদিনের জন্য জোহানেসবার্গে গিয়েছেন। আগামী বুধবারের ফ্লাইটে তার ফিরে আসার কথা। গেল বছরের প্রচুর সময় তিনি কাটিয়েছেন স্থানীয় একটি বস্তিতে হস্তশিল্পের প্রকল্প বাস্তবায়নে। বস্তির মানুষজনরা সকলে একসময় বাস করতেন মাসেরু শহরের প্রান্তিকে বেশ উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে। তারপর ব্যাপক ভূমিধসে তারা বাস্তুহারা হয়ে শহরের অন্য একটি বস্তিতে আশ্রয় নেন। ড. ইনগ্রাম-হিল এদের মাঝে যে সব নারী খানিকটা হাতের কাজ জানেন, তাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এ প্রকল্প। ইউএনডিপি সচরাচর এধরনের মাইক্রো প্রজেক্টে জড়ায় না। পুরা ব্যাপারটা হচ্ছে তার নিজের উদ্যোগে। তবে তিনি ইউএনডিপির কানেকশন ব্যবহার করে বস্তির হস্তশিল্প প্রকল্পের ফান্ডের সংকুলান করে দিচ্ছেন। উইকএন্ডের ছুটিতে তিনি বস্তিতে নিজে কাজের তত্ত্বাবধান করেন। আজ মাসেরুর একটি হোটেলে বস্তি প্রকল্পের হস্তশিল্পের নমুনার প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে। আরো ঘণ্টা দেড়েক বাদে দাওয়াতি দেখনেওয়ালারা হাতের কাজ দেখতে আসবে। উদ্যোক্তারা দেয়ালে সূচিকর্ম ও চিত্রিত বাটিক ঝুলিয়ে বিরতি নিয়ে বাইরে গেছেন লাঞ্চ সারতে।

আমি এখানে লবির নিরিবিলিতে নোটবুক নিয়ে একটি টেবিলে বসেছি। লিসোটো খুবই ছোট্ট দেশ। পথঘাট দুর্গম, মাসেরু শহরে পর্যটক আসে অল্প। তাই বস্তির হস্তশিল্প চড়া দামে বিক্রি হাওয়ার সম্ভাবনা কম। ড. ইনগ্রাম-হিল চাচ্ছেন এসব পণ্য সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ বা কেপ টাউনের মতো বড় শহরে বাজারজাত করতে। ওখানে আছে হস্তশিল্পের ওপর বেশ কয়েকটি পর্যটকভোগ্য ম্যাগাজিন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন ‘ভূমিধসে বাস্তুহারা মানুষের হাতের কাজ’ শিরোনামে বর্ণনাত্মক স্টোরি তৈরি করে দিতে; যা তিনি একটি ম্যাগাজিনে ছাপাবেন। আমাকে অনুরোধ করার পেছনে কারণ হচ্ছে কয়েক দিন আগে তার সক্রিয় সাপোর্টে আমি মাসেরুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘অলটারনেটিভ টু ভায়োলেন্স’-এর ওপর একটি প্রশিক্ষণ করেছি। ওই সময় কিছু কয়েদিদের সাথে কথাবার্তা বলে কারাগারে কিভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে সে বিষয়ে বর্ণনাত্মক রিপোর্ট তৈরি করে দিয়েছি। বর্ণনা তার পছন্দ হয়েছে, তাই তিনি আমাকে বস্তির বস্ত্রশিল্পের ওপর স্টোরি তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি অপেক্ষা করছি লাঞ্চের পর প্রদর্শনীর উদ্যোক্তারা সাথে করে নিয়ে আসবেন বস্তির কয়েকজন নারীকে যারা মূলত নিজ হাতে এ কাজগুলো করেছেন; আমি তাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলব।

লবিতে বস্ত্রশিল্পের নমুনা

হাতে সময় আছে দেখে আমি নোটবুকে অন্য একটি বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করি। এ ঘটনায় জড়িয়ে ছিলাম গতকাল ও তার আগের দিন। যার সাথে মাসেরু শহরের বাইরে গিয়েছিলাম তার সঙ্গ কোর্তায় লেগে থাকা বাসি আতরের মতো এখনো মনে ছড়াচ্ছে মৃদু মৃদু সৌরভ। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কবি নাকাতুলে মোপালেসার অপেক্ষায় সকালবেলা দাঁড়িয়ে ছিলাম গুড টাইম ক্যাফের সামনে। ঝকঝকে একখানা সাদাটে ক্রিমকালারের ভেসপা চালিয়ে সে আসে। অফ হোয়াইট জিন্সের সাথে একই কালারের জ্যাকেট ও হেলমেট পরাতে মেয়েটিকে খানিকটা নভশ্চরের মতো দেখাচ্ছিল। সে ড. ইনগ্রাম-হিলের ভেসপা চালিয়ে এসেছে। তিনি তো এখন জোহানেসবার্গে। নাকাতুলে ভেসপাখানা ক্যাফের মালিকের গ্যারাজে নিরাপদে পার্ক করে আমাকে বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ি এলাকায় আউটিংয়ে যাওয়ার তথ্য দেয়। যেতে আমার আপত্তি আছে, তা নয়। তবে আমি তো বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ওভার-নাইট ব্যাগ ইত্যাদিসহ আসিনি। সে তার ব্যাকপ্যাক দেখিয়ে বলে, এতে সব ব্যবস্থা আছে। একটু খটকার মাঝে পড়ি। পার্কিংলটে হর্ন বাজিয়ে এসে দাঁড়ায় বেজায় বড় লাল রঙের একটি গাড়ি।

ভ্যান গাড়িটি যিনি ড্রাইভ করছেন তিনি গায়ে গতরে বিশাল এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। ভদ্রসন্তান কম্বল কেটে তৈরি একটি হুডওয়ালা কানমাথা ঢাকা কালচে লোমশ জ্যাকেট পরে আছেন, তাই তাকে কেমন যেন আধবুড়ো গরিলার মতো দেখায়। তার পাশের সিটে লাল টিশার্ট পরে বসে আছেন আরেক ব্যক্তি। তার গলা থেকে ঝুলছে সাদা পুতির সাতনরী হার, তাতে গাঁথা জানোয়ারের দুটি শিং। তিনি নেমে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেকে মাকগথলা মাবই নামে পরিচয় দেন। পেশায় তিনি জংগল গাইড। ছোটখাট কথায়বার্তায় বুঝতে পারি, আমার আন্দাজ বেঠিক নয়, ভ্যানখানা একসময় ফায়ার ব্রিগেডের অগ্নি নির্বাপক গ্যাস বহন করার গাড়ি ছিল। ইঞ্জিন বিকল হলে তা নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এখন যিনি ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন তিনি ছিলেন মাসেরু ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। মাইনা যথেষ্ট নয় বলে তিনি সার্ভিসে ইস্তেফা দিয়ে জংগল ট্যুরের কোম্পানি খুলেছেন। নিজের শরীর-গতর বেমক্কা কিসিমের ওজনদার, তাই সচরাচর পর্যটক নিয়ে তিনি বনজংগলের আশেপাশে গাড়ি পার্ক করে তাতে বসে বসে ঝিমান। মাকগথলা মাবই দেখনেওয়ালাদের পায়ে হাঁটিয়ে পাহাড়-পর্বত, হ্রদ-গণ্ডার, হাতি ও জিরাপ দেখান। গাড়িতে চড়ার সময় দেখি, তার দরোজায় লালের ওপর কালো আলকাতরা দিয়ে সৃজনশীল বানানে লেখা ‘জ্যংগোল ট্যুর লিমিলেড’, পাশে মাথা হেট করা দুটি জেব্রার ছবি।

নাকাতুলের সাথে আমি পেছনের দিকে বসি। ভ্যান গাড়িটির এদিকে খোলা জায়গা প্রচুর। তাতে রাখা খনিতে পাথর ভাঙার হাতিয়ার, তীরধনুক, বল্লম, দোনলা বন্দুক, ও বোধ করি পর্যটকদের ভয় দেখানোর জন্য কোনো জানোয়ারের দাঁতমুখ খিঁচানো খটখটে করোটি। আমি হাতিয়ারগুলোর দিকে কৌতূহলী নজরে তাকাই। অতীতে আমি আফ্রিকার ট্যুর কোম্পানির গাড়িতে বনেলা জানোয়ার দেখার সুবিধার জন্য বাইনোকুলার রাখা দেখেছি, তীরধনুক ও বল্লমের অভিজ্ঞতা এই প্রথম হতে যাচ্ছে। তবে কি আজকের কর্মসূচীতে বন্যপশুর সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহের আশঙ্কা আছে?

যাই হোক, প্যাত প্যাত করে হর্ন বাজিয়ে ভ্যান স্টার্ট দিতেই আমি জাঁকিয়ে নাকাতুলের পাশে বসি। পেছনে সিট বলতে যে সুপরিসর কাঠামোটিতে আমরা বসেছি, তা বোধ করি কাঠমিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করা। তাতে জাজিমের মতো পুরু গদি পাতা। বালিশ, কুশন ও কম্বলের ঢালাও বন্দোবস্ত আছে। চাইলে পা ছড়িয়ে শোওয়া যায়। সিটটি এমনই আরামদায়ক যে মওকা পেলে এখানে সঙ্গম সেরে নেওয়া যায়।

নাকাতুলের সাথে আউটিংয়ে আমি আগেও গিয়েছি। তখন অবশ্য ট্যুর কোম্পানি বা ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দামদর, কোথায় যাব, কী করতে বাসনা হচ্ছে—এসব আমিই ঠিক করেছি। এবারের আয়োজনে সে উদ্যোগ নিয়েছে। তা নিক, পুরুষ হিসাবে বিল তো আমাকে পে করতে হবে। লিসোটোতে ক্রেডিট কার্ডের চল কম। তাই মাসেরু শহর থেকে তোড়ে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বলি, “তুলিকা সুইট লিটিল গার্ল, ড্রাইভারকে বলো গাড়ি ঘোরাতে। শহরের মধ্যিখানের স্কোয়ারে আছে সাউথ আফ্রিকান নেড ব্যাংক, ওখানকার এটিএম মেশিন থেকে একটু টাকাপয়সা তুলতে হচ্ছে যে।” সে গোলাপি রঙ মাখানো পূর্ণ ঠোঁট খানিক বাঁকা করে বলে, “হোয়াই? এ ট্যুরের জন্য তোমাকে কিছু পে করতে হচ্ছে না, অল আর এডভান্স পেইড ফর।” আমি না বলে পারি না, “তুমি হঠাৎ করে এত টাকাপয়সা পেলে কোথায়?” সে মাথা ঝাঁকায়, তাতে তার কিন্তিলি চুলের মৌচাকাকৃতিতে যেন মধুভুক পতঙ্গের ভেতর মৃদু আলোড়ন শুরু হয়। সে দুহাতে চুলের শেইপকে অগোছালো হতে না দিয়ে বলে, “ড. ইনগ্রাম-হিল পেইড ফর এভরিথিং, আমার বার্থ-ডে গিফ্ট হিসাবে তিনি এ ট্যুরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।” কোথায় দূরের কোন তেপান্তরের মাঠে আমার ওড়ানো ঘুড়িটিকে অদৃশ্য কেউ যেন কাচ-গুড়োর মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় কেটে নেয়। আমি কান্নি খেয়ে পড়ে যেতে থাকা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে ফাস্টট্রেটেড হয়ে বলি, “তুলিকা, আমাকে জিঞ্জেস করবে তো, আমি ড. ইনগ্রাম-হিলের তোমাকে দেওয়া ট্যুরে যেতে চাচ্ছি কিনা?” সে চোখমুখে কপট কঠিন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলে, “তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছো আমি জন্মদিনে মার্বেল পাথরের টেবিল চাই কি না? গতকাল ফার্নিচারের একটি কোম্পানি থেকে পিকাপ ট্রাকে করে টেবিলটি আমার দিদিমার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে, লুক হোয়াট হেপেনড? ভারি টেবিলটি টানাটানি করতে গিয়ে..।”

নাকাতুলে ডিজাইনার স্নিকার খুলে মোজা গুটিয়ে তার পা-টি বাড়িয়ে তুলে দেয় আমার ঊরুর ওপর। চামড়া খানিক ছড়ে গিয়ে পায়ের গুছিতে বেগুনি হয়ে আছে। আমি ওখানে মৃদু আঙুল বুলিয়ে বলি, “এ ট্যুর ছাড়া ড. ইনগ্রাম-হিল তোমাকে জন্মদিনে আর কিছু দেয়নি?” সে কুশনে আধশোয়া হয়ে ঝুঁকে ব্যাকপ্যাকের জিপার খুলতে খুলতে ফিচেল হেসে বলে, “আর ইউ শিওর ইউ ওয়ান্ট টু সি দিস?” আমি “লেট মি সি” বলে হাত বাড়াই। খুব বড় না, এ-ফোর সাইজের সেলোফোনে মোড়া সাদা কাডবোর্ডে পেন্সিল দিয়ে আঁকা...প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় পালকে ঠোঁট-মাথা গুঁজে বসা দুটি কপোতের ছবি। তার নিচে সিসোটো ভাষায় লেখা ‘লেবা লা-কা’, বা ‘মাই পিজিওন’। আমি কার্ডবোর্ডটি ঘুরিয়ে অন্য পারসপেক্টিভ থেকে তাকাই। তখনই বিষয়টা পরিষ্কার হয়, যা দেখছি তা কিন্তু আদপে জোড়া কবুতরের চিত্র নয়, আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ওঠে পরস্পরের সাথে সন্নিবেশিত হয়ে থাকা যুগল স্তনের দৃশ্য। আমি তার দিকে তাকাই। সে আধশোয়া হয়ে কিন্তিলি চুলে দুহাতে বিলি কাটলে তার ভরাট বুক তীব্রভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে শরীরের ভঙ্গি বদলিয়ে তা আড়াল করার চেষ্টা না করে বোধ করি নীরবে আমার রিএকশন শোনার জন্য অপেক্ষা করে। তো আমি বলি, “সো, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ড. ইনগ্রাম-হিল লাভস্ ইউ।” সে ফিনকি দিয়ে হেসে বলে, “হি ইজ মাই সুগার ড্যাডি। সে আমাকে নিয়ে কী ভাবে.. আই সিম্পলি ডোন্ট কেয়ার। তাকে যে পছন্দ করি না, তাও না। হি ইজ মাই টুথসিওটসি বাটার কাপ। এক্সপেনসিভ গিফ্ট দেওয়াই তো তার কাজ।” বলে সে আমার সিনিওর সার্ভিসের প্যাকেট থেকে একটি সিগ্রেট বের করে তাতে লাইটারে আগুন দেয়।

আমি ‘সুগার ড্যাডি’ টার্মটি নিয়ে মনে মনে তর্পণ করি। সুগার ড্যাডি হচ্ছে মূলত মাঝবয়সী বা বয়োবৃদ্ধ বিত্তবান পুরুষ, যিনি অল্পবয়সী কোনো মেয়েকে সঙ্গদান ও দৈহিক ভালোবাসার বিনিময়ে প্রদান করেন দরাজ হাতে গিফ্ট ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকাপয়সা। ধোঁয়ার রিং ছুড়তে ছুড়তে নাকাতুলে যেন স্বগতোক্তি করে, “হি ইজ ভেরি গুড, বাট আ বিট অব আ সেক্স ডেভিল।” আমি সাবধানে সেলোফোনের র‌্যাপার মুড়িয়ে পেন্সিল স্কেচটি তার ব্যাকপ্যাকে রাখি। তারপর কল্পনায় জুতা দিয়ে আধপোড়া সিগ্রেটকে পিষে নেভানোর মতো প্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করি।

কিছুক্ষণ আমরা কোনো কথাবার্তা বলি না। ফায়ার ব্রিগেডের ভ্যানটি অনেকক্ষণ হয় পাড়ি দিয়েছে উপত্যকার দিগন্তে ছাড়ানো প্রান্তর। এখন আঁকাবাকাঁ সড়ক বেয়ে ভ্যানটি ছুটে যাচ্ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। পর্বতগুলোতে গাছপালা বৃক্ষলতা তেমন কিছু নেই। কী রকম যেন খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে শিলা পাথরের মন্সস্টারগুলো। দেখতে দেখতে পাথরের কালচে খয়েরি শরীর ধূসর হতে হতে ভরে ওঠে শুভ্রতায়। মাসেরু শহর থেকে যখন এ ভ্যানে চাপি, তখন নগরীর জনপদে ছলকে যাচ্ছিল ঝকঝকে রোদ। এখন ঘুম ভাঙতে দুস্বপ্নের মতো তা উবে গিয়ে আকাশ হয়ে এসেছে ভারী মেঘলা। আর গুঁড়িগুঁড়ি তুষারের শুভ্র হালকা পালকে ভরে যাচ্ছে গিরিকন্দর। নাকাতুলে গাড়ি স্লো করতে বলে। আমরা মালিবামাটসো নদীর সাদা ফেনায় জলচর পাখিদের সাঁতার কাটতে দেখি। সামনের সিট থেকে জংগল গাইড মাকগথলা মাবই ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চান, আমি ‘পিডিপিডি’ বা বেলেহাঁসের ছবি তুলতে চাই কি না? আমার ভেতরে কেন জানি উৎসাহ মরে আসছে, তাই কোনো জবাব দিই না।

ভ্যান স্পিড পিক করে আবার ছুটে চলে। পহাড়ের ঠিক কার্নিশে ঝুলে আছে টেনিস কোর্টের সমান একটি শিলাপাথরের সমতল চাকলা। ওখানে ভ্যান পার্ক করলে আমরা নেমে আসি। জায়গাটি অনেকটা লুক আউটের মতো। দূরে পরিষ্কার দেখা যায় কাটসে ড্যাম। টারবাইনে চূর্ণিত হয়ে জলবিদ্যুতের এ প্রকল্প থেকে পানি নেমে আসছে প্রপাতের ধারা প্রবাহে। তুষার ঝরা তীব্র শীতে কাবু হয়ে আমরা ফিরে আসি গাড়িতে। ড্রাইভার তীব্র দক্ষতায় মিনিট পনেরোর ভেতর আরেকটি বাঁক ঘুরে আমাদের নিয়ে আসেন কাটসে ড্যামের বেশ কাছাকাছি। বাঁকানো ব্রিজের মতো করে তৈরি একটি সিমেন্টের সড়ক লিসোটো হাইল্যান্ড ওয়াটার প্রজেক্টের বিখ্যাত বাঁধটিকে ঘিরে আছে। তার ওপর দিয়ে একজন মানুষকে অলস পায়ে হেঁটে যেতে দেখি। এদিকে কোনো তুষারপাত কিছু হচ্ছে না, ঘাসপাতা সমস্ত কিছু খটখটে শুকনা দেখে বড় অবাক লাগে।

বাঁধ ঘিরে সিমেন্টের সড়ক

ভ্যান গাড়িটি আবার চড়াই উৎরাই ভাঙে। আরো মিনিট তিরিশেক আমরা পথ চলি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি হ্রদের জল, তার অতলে প্রতিফলিত হচ্ছে বিশাল মেঘভাসা আকাশ। আমি গাড়ি থেকে নেমে হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার ভেতরবাগে জেগে ওঠা ছোট্ট দ্বীপাণুর দিকে তাকাই। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে গাড়িতে পোশাক চেঞ্জ করে নীলাভ ট্র্যাকস্যুট পরে বেরিয়ে আসে নাকাতুলে। তার পকেটে বাজছে সিডি ওয়াকম্যান। মৃদু মৃদু সুরধ্বনি শুনে আমি লিরিকটি চিনতে পারি—‘নো মোর ওয়াক ইন দ্য উড/ দ্য ট্রিজ হ্যাভ অল বিন কাট ডাউন।’ ১৯৭১ সালে লস এ্যঞ্জেলসে ‘দ্যা ঈগলস্’ নামে একটি আমেরিকান রক ব্যান্ডের গাওয়া গান। বছর তিন বা চারেক আগে জিম্বাবুয়েতে যখন নাকাতুলের সাথে প্রথম দেখা হয়, তখন আমি তাকে এ সিডিটি গিফ্ট হিসাবে দিই। সে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বলে, “এ জায়গাটি তুমি দেখতে চেয়েছিলে। ডু ইউ রিমেমবার?” বিষয়টি এবার আমার মনে পড়ে।

কয়েক বছর আগে আমি ইউরোপীয় এক রাজকুমারের লেখা লিসোটো নিয়ে একটি ট্র্যাবেল একাউন্ট পড়ি। লিসোটোর রাজা গ্রিফিথ লিরোথলির মেহমান হয়ে রাজকুমার এখানে তিনদিন তাঁবু খাটিয়ে বাস করেন। তার বর্ণনাতে হ্রদের কোনো উল্লেখ নেই। তবে তিনি এখানে প্রচুর কনিফার বৃক্ষের চিরহরিৎ একটি উপবনের দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। লিসোটোর এ অঞ্চলের পাহাড়ে গাছপালা তেমন কিছু জন্মায় না। তবে এখানে হঠাৎ করে সবুজের বিপুল সমারোহ দেখে রাজকুমার অবাক হয়েছিলেন তীব্রভাবে। তার তাঁবুর চারদিকে ছিল ‘ইরিকাস’ নামে এক ধরনের ঝোপ। তাতে ওড়াউড়ি করছিল অজস্র পাখি। তিনি ‘টুসোক’ বলে এক ধরনের দীর্ঘ ঘাসের উল্লেখ করেছেন যেখানে লুকোচুরি করছিল খরগোস। জলবিদ্যুত প্রকল্পের কারণে এখানে ওয়াটার রিজারভার হিসাবে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সরোবর। উপবনটি বরফে ডুবে গেছে তার তলায়। আমি নিসর্গপটের এ পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভ্যান গাড়িতে ফিরে যাই। নাকাতুলে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলে, “লিসেন, উপবনের জলে নিমজ্জন নিয়ে আমি বাঁধতে চাচ্ছি একটি পালা গান। ঈগল নামে রক ব্যান্ডের করা গানটির স্ট্রাকচার থেকে সুরের অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কিন্তু লিরিকের কথাগুলো ঠিক মতো সাজিয়ে উঠতে পারছি না। উইল ইউ হেল্প মি আ বিট?” আমি নোটবুক খুলে তাতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলি, “জাস্ট ট্রাই টু ডেসক্রাইব ইন প্লেইন এন্ড সিম্পল সিসোটো লেংগুয়েজ...ইউরোপের রাজকুমার আবার যদি ফিরে আসেন, হোয়াট হি উইল সি..।” তখনই জংগল গাইড মাকগথলা মাবই ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, “পিডিপিডি.. পিডিপিডি...” আমরা জানালা দিয়ে তাকাই, দেখি সরোবরের জলে ঝাপিয়ে পড়ছে এক ঝাঁক বেলেহাঁস। আমি নাকাতুলের হাতে নোটবুক দিয়ে বলি, “ট্রাই টু ইউজ দিস ইমেজ এ্যজ ইয়োর হুক। সরোবরের জলে বেলেহাঁসের জল ঝাপটানো নিয়ে শুরু করো। তারপর ফিরে যাও আরেকটু পেছনে, বর্ণনা করো উপবনে তাঁবু খাটিয়ে রাজকুমারের বসবাস, আর টুসোক গ্রাসে খরগোসের ছোটাছুটি। চাইলে এ গাঁথাতে তুমি মেশাতে পারো খানিক কল্পনা, রাজকুমারের এনগেজমেন্ট রিংটি যে ঘাসের গুচ্ছে হারিয়ে গিয়েছিল সে কাহিনী।” সে চোখ বড় বড় করে জানতে চায়, “ওয়াজ দ্য প্রিন্স রিয়েলি লস্ট হিজ এনগেজমেন্ট রিং হিয়ার?” আমি বলি, “তুলিকা, নট রিয়েলি, ইন ফ্যাক্ট হি লস্ট হিজ রোলেক্স ওয়াচ। ঘাসের আড়ালে বসে থাকা খরগোসের ছবি তুলতে গিয়ে তার কব্জি থেকে চেন লুজ হয়ে খসে পড়ে ঘড়িটি। নাও ডিসাইড, গানের পালায় তুমি রোলেক্স ঘড়ির ডিটেল ব্যবহার করবে, নাকি জুড়ে দেবে এনগেজমেন্ট রিং হারিয়ে যাওয়ার কাল্পনিক গল্প? অল ইজ নাউ আপ টু ইউ।”

ভ্যান গাড়িটি আবার ছুটে চলছে বাঁকা হয়ে তিমি মাছের পেটের মতো ছোট ছোট উপত্যকা মাড়িয়ে ভিন্ন এক পাহাড়ের দিকে। নাকাতুলে উডপেন্সিলে পালাগানের লিরিকের বাক্য সাজাচ্ছে। আর থেকে থেকে পেন্সিলের গোড়ার রাবার দিয়ে কণ্ঠার কাছে চুলকাচ্ছে। তাতে লালচে বেগুনি হয়ে উঠছে তার ত্বক। এদিককার একটি পাহাড়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক কেতার অনেকগুলো কটেজ। আমরা গাড়ি থেকে নামি। ড্রাইভারও তার বেমক্কা কিসিমের ভারী শরীর নিয়ে নেমে পড়েছেন। তিনি শরীর বাঁকিয়ে হাতপা ছুড়ে বাতাসে ঘুষাঘুষির ভঙ্গি করে হাতপায়ের খিল ছোটাচ্ছেন। চোখ মুদে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ ব্যাদান করে হাঁপানি ও শ্লেষা জড়ানো কণ্ঠে তিনি গ-র-র-র আওয়াজ করছেন। ভদ্রলোকের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হয়, তিনি গণ্ডার ফন্ডারের সাথে মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

জংগল গাইড মাকগথলা মাবই

নাকাতুলে ও আমি কটেজগুলোর মাঝ বরাবর তৈরি পিচঢালা পথে একটু হাঁটি। সাউথ আফ্রিকার এক তেজারতি কোম্পানি এ গ্রামটি তৈরি করেছে অনেকটা অলিম্পিক ভিলেজের কায়দায়। আমাদের পাশ দিয়ে জগিং করে ছুটে চলে শ্বেতাঙ্গ স্পোর্টসম্যানদের তিন চার জনের ট্রুপস্। কোনো কোনো কটেজের সামনের লনে শর্টস্ পরে স্বর্ণকেশী যুবতীরা খেলছে স্কিপরোপ। বারান্দায় বুকডন দিচ্ছেন মাথা কামানো তিনজন নওজওয়ান কিসিমের সাহেব। তাদের একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লে তার মুখমণ্ডলকে দেখায়, প্রচুর মাখন আর গুঁড়ামরিচ দিয়ে ভাজা কাঁকড়ার মতো লালচে। নাকাতুলে বলে, জলবিদ্যুত প্রকল্প গড়ে ওঠার আগে এখানে ছিল দরিদ্র বাসোটো সম্প্রদায়ের মানুষদের টমালেতালি নামে একটি গ্রাম। এরা সকলে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে বাস করছে মাসেরু শহরের বস্তিতে। তাদের সনাতনী কেতার কুটিরগুলো ভেঙেচুরে সাফসুতরা করে গড়ে তোলা হয়েছে অলিম্পিক ভিলেজের রেপ্লিকা। ইউরোপের স্পোর্টস করনেওয়ালা সাহেব মেমদের সন্তানাদি এখানে আসছে সস্তায় উইন্টার অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিতে। আমি এবার নির্দ্দিষ্টভাবে জানতে চাই, “হোয়াট এলজ্ ডু ইউ নো তুলিকা আবাউট দিজ ভিলেজ? এ গ্রাম সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবে কি?” সে জবাব দেয়, “ড. ইনগ্রাম-হিল একটি স্থানীয় এনজিওকে নিযুক্ত করেছেন টমালেতালি গ্রামের বাস্তুহারাদের মাঝে ত্রাণ প্রকল্প করার জন্য। তারা ছোট্ট একটা সার্ভে করে রিপোর্ট তৈরি করেছে। তাতে কিছু দুঃখজনক তথ্য আছে—এ গ্রামের কেউ কোম্পানির কাছ থেকে এখনো খেসারত হিসাবে কোনো টাকাপয়সা পায়নি। আর তরুণী মেয়েরা প্রায় সকলে শরীর বিক্রি করছে পর্যটকদের কাছে।”

ভ্যান গাড়ির দিকে হেঁটে ফিরতে ফিরতে আমরা আবার ঘাড় ঘুরিয়ে অলিম্পিক ভিলেজের পিকচারাস দৃশ্যপটের দিকে তাকাই। নাকাতুলে মন্তব্য করে, “ড. ইনগ্রাম-হিল ইজ রিয়েলি কাইন্ড টু দি পুওর হোমলেস পিপুল্ অব টমালেতালি ভিলেজ।” আমি বিরক্ত হয়ে বলি, “উনার প্রসঙ্গ পরে আলাপ করলে হয় না।” সে প্রথমে অবাক হয়, তারপর মুখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে তুলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাকে মোকাবেলা করে, “আই থিংক আই নিড টু ক্লারিফাই মাই রিলেশনশিপ টু ড. ইনগ্রাম-হিল।” আমি জবাব দিই, “নো, ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু। তুমি তো বলেছো হি ইজ ইয়োর সুগার ড্যাডি। আর সুগার ড্যাডি হলে কী ধরনের সম্পর্ক হতে পারে এটা আমি বুঝতে পারি।” এবার সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে সে বলে, “আই লাইক ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ইজ আফ্রিকা। লিসোটোতে মেয়েদের মনোগমাস হওয়ার কোনো রীতি নেই, শুনেছি ভারতবর্ষে এখনো অনেক মেয়ের এমন কি বিবাহবহির্ভূত একজন প্রেমিক থাকলেও তা নেগেটিভভাবে দেখা হয়।” আমি এবার অসহিষ্ণু হয়ে বলি, “তুলিকা, হোয়াই আর উই টকিং আবাউট দিস?” সে জবাব দেয়, “বিকজ, আই লাইক ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি, আই অ্যাম আ বাসোটো গার্ল ইউথ নো মানি। ড. ইনগ্রাম-হিল হচ্ছেন মাকগোওয়া বা বিত্তবান শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। বিয়ের আগে একটি বাসোটো মেয়ের নিইয়াটসি বা মিসট্রেস হতে সামাজিক আপত্তি কিছু নেই। ১৯০১ সালে আমাদের রাজা মহান লিটসে লিরোথলি এধরনের সম্পর্ক অনুমোদন করে ফরমান জারি করে গেছেন।” আমি এবার আলোচনার কনক্লুসনে আসতে চেয়ে পকেট ডিকশনারি বের করে সরাসরি সিসোটো ভাষায় জানতে চাই, “ও থাবিলে” বা “আর ইউ হেপি তুলিকা?” সে ঠোঁট কামড়ে জবাব দেয়, “আই অ্যাম নট গোয়িং টু আনসার দিস টু ইউ, আন্ডারস্ট্যান্ড?” আমি মাথা হেলিয়ে বলি, “ইয়েস, আই ডু।”

আমরা চলে আসি ভ্যানের পাশে। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের তীব্রটানে দারুণভাবে হাঁপাচ্ছেন। মাকগথলা মাবই দেখি উবু হয়ে বসেছেন পাহাড়ের কার্নিশে। ভাবি এ ভদ্রসন্তানের প্রক্ষালনের প্রয়োজন হয়েছে। একটু পর তিনি হাঁটু ভাঁজ করা দু পায়ের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে কানের লতি ছুঁয়ে কোলাব্যাঙের মতো লাফিয়ে ওঠেন। আর থেকে থেকে তার কন্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসে, “কা-ট-ছো পো-লা না-লা” ধ্বনি। ব্যাপার কী জানতে চাইলে নাকাতুলে বলে, “মাবই প্রার্থনা করছেন যেন ঝরে বৃষ্টি অজোর ধারায়, জংগল ভরে ওঠে পত্রপল্লব ও ঘাসপাতায়, আর প্রাণীদের যেন অনটন হয়না খাবারের।” এ ব্যাখ্যার পরও আমি তার আচরণ ভালো করে না বুঝলে সে আবার বলে, “একটু পর মাবই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন জংগলে রাজার খাস মহালে। বাসোটো সম্প্রদায়ের মাঝে শিকারে যাওয়ার আগে বনানীর মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করার রেওয়াজ আছে। এতে করে বন্যপ্রাণীর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।” মাকগথলা মাবই এবার তার গলায় ঝোলানো শিঙ্গা বাজিয়ে আমাদের ভ্যানে উঠে পড়ার ইশারা দেন। আমি বিরস বদনে নাকাতুলের পাশে বসতেই সে চোখের পাঁপড়ি কাঁপিয়ে বলে, “তোমার মতো যারা ঘুরে বেড়ায়, ট্র্যাবেল করতে ভালোবাসে, সিসোটো ভাষায় তাদের বলা হয় মোয়েতি। ইউ আর আ ফাইন মোয়েতি, এন্ড আই লাভ টু ট্রাবেল উইথ ইউ”—বলে হাত বাড়ালে আমি তার করতল স্পর্শ করি।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;