পিটার বিকসেলের গল্প

আমেরিকা বলে কোনো স্থান নেই



অনুবাদ : মিলু হাসান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্প বলে এমন একজনের গল্প ছিল আমার কাছে। আমি তাকে বলতে বলতে কান ঝালাফালা করে ফেলছি যে আপনের গল্পে আমার এক ছটাকও ঈমান নাই। আমি বলছি—আপনে মিছা কইতাছেন। আপনের আষাঢ়ের গপ্ আমার লগে কইয়েন না, বানাইয়া বানাইয়া, আমারে বিশ্বাস করানির জন্য। এসব বলার পরেও তার উপরে কোনো প্রভাব পড়ল না। তার কোনো ভাবান্তর হলো না, সে গল্প বলেই যাচ্ছে, তারপর আমি শেষে বললাম—আপনে মিথ্যুক, আপনে আজগুবি গপ্ কওয়া লোক, আপনে মিষ্টি মিষ্টি গপ্ ফাঁদেন একটার পর একটা, আপনে ধাপ্পাবাজ রসিক। সে একরোখা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, মাথা নেড়ে হুঁ হুঁ করল, একটা মনমরা হাসি দিল আর খুব নরম সুরে এমন কথা বলল যে আমি নিজে বেশ শরমিন্দা বোধ করলাম, শরমে পড়ে গেলাম, সে বলল : আমেরিকা বলে কোনো দ্যাশ নাই।

শুধু তারে বুঝ দেবার জন্য আমি তারে কথা দিছিলাম যে আমি তার গল্পটা লিখব। গল্পটা শুরু হয়েছিল পাঁচশো বছর আগে স্পেনের রাজার রাজদরবারে। তার মধ্যে আছে এক রাজপ্রসাদ, রেশম আর মখলম, সোনা, রুপা, দাড়ি, মুকুট, মোমবাতি, দাসদাসী, আছে তারা যারা সকাল হতে না হতে একে অন্যের ভুঁড়িতে ঢুকিয়ে দেয় তলোয়ার, যারা আগের রাতে পরস্পরের পায়ের কাছে দস্তানা ছুড়ে চ্যালেঞ্জ দেয় যুদ্ধের আর মিনারে পাহরাদার বাজায় শিঙা। আর আছে বার্তাবাহক এরা লাফিয়ে নামে ঘোড়া থেকে আর লাফিয়ে ওঠে জিনপড়ানো ঘোড়ায়, আছে রাজার সাচ্চা দোস্তরা আর ভণ্ড দোস্তরাও, আছে চোখ ধাঁধানো রূপবতী আর ছলচাতুরী আয়ত্ত করা বিপদজনক রমণী, আছে অঢেল সুরা আর রাজপ্রসাদের চারদিকে আছে এমন সব লোকজন যারা এইসব কিছুর জন্য দাম চুকানো ছাড়া ভালো কিছু করার কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু এরকম জীবন যাপন করা ছাড়া রাজা অন্য কোনো জীবন যাপনের কথা ভাবতেই পারে না, যেখানেই যে বেঁচে থাকুক থাকুক, খুব আলিশানভাবে আরাম-আয়েশে কিংবা দীনদরিদ্রে, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা অথবা যেখানেই হোক, দিনশেষে সেই একঘেয়ে ডেইলি রুটিন, বিরক্তি চরমে উঠে যায়। যেমন যারা অন্যখানে থাকে তারা ভাবে বার্সেলোনা একটা চমৎকার জায়গা আর যারা বার্সেলোনা থাকে তারা ভাবে অন্য কোনোখানে গেলে বুঝি বাঁচে প্রাণ।

গরিবরা ভাবে রাজার মতো জীবন যাপন করা কতই না মজার আর এ ভেবে দিলে কষ্ট পায় যে রাজা ভাবে গরিবদের গরিব হওয়াই ঠিক আছে।

সকালে রাজা ঘুম থেকে উঠে আর রাত্রে বিছানায় নিদ্রা যায়, আর সারাটা দিন কাটে একঘেয়ে, বিরক্তিকর আর কত যে টেনশন—দাসদাসী নিয়ে টেনশন, সোনা, রুপা, মখমল, রেশম নিয়ে টেনশন আর তার উপরে মোমবাতিগুলোও তার একঘেয়ে লাগে। তার বিছানা পরিপাটি-সাজানো-গোছানো, জমকালো কিন্তু এতে ঘুম দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করবার কিছু নাই।

দাসদাসীরা সকালে তারে মাথা নুয়ে সম্মান করে—ঠিক ততটুক নোয় পরদিন সকালে, এতে রাজা অভ্যস্ত, এগুলা সে খেয়াল করে না। কেউ তাকে দেয় কাঁটা চামিচ, কেউ তাকে দেয় তলোয়ার, কেউ তার বসার জন্য কেদারা পেতে দেয়, আমজনতা তারে জাঁহাপনা বলে ডাকে আর সাথে জুড়ে দেয় কত কত লকব আর ব্যস, এই তো, এইসব। কেউ তাকে কখনোই বলেনি—আপনি ইডিয়েট, আপনি বোকারাম আর আজকে তার সাথে তারা যে বাতচিৎ করেছে, সেসব পুরানো প্যাঁচাল তারা গতকালও তার সাথে করেছে।

এই হলো গিয়ে অবস্থা।

আর এ জন্য রাজা মশাই রাজদরবারে ভাঁড় পালেন। ভাঁড়েরা যা খুশি করার অনুমতি দেওয়া আছে, যা খুশি তাইই বলতে পারে—রাজামশাইয়ের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য, আর যখন তাদের কাণ্ডকীর্তি দেখে রাজা মশাইয়ের হাসি পায় না তখন তিনি তাদের কতল করার হুকুম জারি করেন কিংবা অইরকম কিছুই করার হুকুম দেন।

তো, একবার তার রাজদরবারে এক ভাঁড় ছিল যে কথাবার্তায় প্যাঁচগোছ লাগিয়ে দিত। রাজা মশাই এতে হাসির খোরাক খুঁজে পেতেন। ভাঁড় ‘রাজামশাই’ না বলে বলত ‘পাদমশাই’, ‘প্রসাদ’ না বলে বলত ‘পরসাদ’ আর ‘গুড মর্নিং’ না বলে বলতো ‘মুড গরিং’।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা বোকাসোকা কিন্তু রাজা মশাই ভাবতেন ফানি। বছরের অর্ধেকটা সময়, ৭ জুলাই অব্দি, তিনি ভাবতেন ব্যাপারটা ফানি আর যখন ৮ তারিখ উনার ঘুম ভাঙল আর ভাঁড় বলল—‘মুড গরিং’, ‘পাদমশাই’—তখন রাজা মশাই বললেন—ওর থেকে আমারে রেহাই দাও।

আরেকজন ভাঁড় খাটো, মোটাসোটা যাকে সবাই পেপে বলে ডাকত, সে রাজামশাইকে মাত্র চারদিন খুশি রাখতে পেরেছিল। সে রাজদরবারের নারী, পুরুষ, রাজপুত্র, উজির-নাজির, সেনাপতির চেয়ারে মধু মেখে রাজার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। চতুর্থদিনে সে যখন রাজামশাইয়ের সিংহাসনে মধু মাখল, রাজামশাইয়ের হাসি পেল না আর পেপে ভাঁড় রইল না। তারপর রাজা মশাই দিন-দুনিয়ার সবচে ভয়ংকর ভাঁড়টিকে খরিদ করে আনলো৷ সে দেখতে কুৎসিত, একইসাথে হাড্ডিসার আবার নাদুস-নুদুস, লম্বা-রোগা আবার বেঁটে-মোটা। কেউ জানত না সে কথা বলতে পারে কিনা নাকি ইচ্ছা করেই চুপ করে থাকে কিংবা সে বোবা কিনা। তার চোখের নজরের ভাব ছিল বিদ্বেষপরায়ণ, তার মুখ ছিল দেখতে বদমেজাজি, তার একমাত্র মধুর দিক ছিল তার নাম : তাকে জনি বলে ডাকা হতো।

কিন্তু তার সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার ছিল তার হাসবার ভঙ্গি৷ হাসিটা শুরু হতো ছোট আকারে, তার পেটের মাঝখান থেকে স্বচ্ছন্দে ধীরে ধীরে, ফুলে ফেঁপে উঠে, আস্তে আস্তে তা ঢেঁকুরে পরিণতি লাভ করে জনির দম আটকে চোখ-মুখ লাল হয়ে বিস্ফোরণের মতন ফেটে পড়ত, এক ভয়ংকর গর্জনের মতন চেঁচিয়ে একাকার হয়ে যেত; তারপর সে জোরে জোরে শব্দ করে মাটিতে পা ঠুকত, নাচত আর হাসতেই থাকত হো-হো করে আর এতে রাজা মশাই বেশ মজা পেতেন আর অন্যদের মুখ বেজার হয়ে যেত আর ভয়ে কলিজা চুপসে যেত। আর রাজপ্রাসাদের সব জায়গায় যখন এ হাসির আওয়াজের শব্দ পেত লোকেরা তখন দরজা-জানলা বন্ধ করে দিত, শাটার নামিয়ে নিত, বাচ্চাদের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিত আর কর্ণে গুঁজে দিত তুলা।

জনির হাসবার ভঙ্গি ছিলো দিন-দুনিয়ার সবচে ভয়ংকর ব্যাপার।

আর রাজা মশাই যাই বলতেন জনি হাসতোই। একদিন রাজা মশাই বললেন : জনি আমি তোরে ফাঁসিতে ঝুলাব। আর জনি তা শুনে হাসতেই থাকল হি-হি-হা-হা-হি-হি-হো-হো করে হাসতেই থাকল, এরকম হাসি সে আগে কখনোই হাসেনি।

তারপর রাজা মশাই সিদ্ধান্ত নিল আগামীকাল জনিকে ফাঁসিতে ঝুলাবে। রাজা ফাঁসিকাষ্ঠ বানালেন, তিনি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ছিলেন সিরিয়াস, ফাঁসিকাষ্ঠের সামনে কেমন করে হাসে জনি তা দেখবার খায়েশ জেগেছিল উনার মনে।

তিনি হুকুম জারি করলেন আমজনতাকে এ ন্যক্কারজনক মজমা দেখতে আসার জন্য। কিন্তু লোকেরা সব লুকিয়ে পড়ল, দরজার খিল লাগিয়ে দিল আর সকালে রাজা মশাই দেখলেন তিনি আর জল্লাদ, জল্লাদের হেল্পার আর হাস্যরত জনি।

আর রাজা তার দাসদাসীকে চিল্লাইয়া বললেন—লোকজনরে ধরে আন্। দাসদাসীরা পুরো শহর খুঁজে কাউকে পাইল না, রাজা রাগে কিরমির করতেছিল আর জনি হাসছিল। অবশেষে দাসদাসীরা খুঁজে আনলো একটা বালককে, তারা টেনে হিঁচড়ে তাকে রাজার সামনে আনলো। বালকটি ছিল দেখতে ছোট্ট, গোমড়ামুখ আর লাজুক। রাজা তাকে ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে নির্দেশ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে বললেন। বালকটি ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে তাকাল, হাসল আর হাততালি দিতে থাকল আর বিস্ময় নিয়ে বলল—আপনে নিশ্চয়ই খুব ভালা রাজা, পায়রা বসনের জন্য দাঁড় বানাইছেন, দ্যাখেন, দ্যাখেন, অলরেডি দুইটা আইসা বইছে।
রাজা বলল—তুই একটা ইডিয়েট। তোর নাম কী?
: আমি ইডিয়েট, রাজামশাই, আমার নাম কোলম্বো, আমারে মায় কোলুম্বিনে কইয়া ডাকে।
রাজা বলল—তুই ইডিয়েট। এখানে একজনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।
কোলুম্বিনে জিজ্ঞাসা করল—উনার নাম কী? যখন সে তার নাম শুনল, সে বলল—কী সুন্দর একটা নাম, তাহলে তার নাম জনি। এত সুন্দর একটা নাম যার তারে কেউ ফাঁসিতে ঝুলাইতে পারে?
রাজা বললেন—কারণ ওর হাসি ভয়ংকর, বেজায় বিচ্ছিরি। রাজা জনিকে হাসতে বললেন আর জনি আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভয়ংকর, বেজায় বিচ্ছিরি করে হেসে উঠল। কোলুম্বিনে তাজ্জব হয়ে গেল আর উনাকে জিজ্ঞেস করল—জনাব, রাজা মশাই, আপনার কাছে উনার হাসি হাছা- হাছাই ভয়ংকর লাগতাছে ? রাজা অবাক হলেন, কোনো উত্তর উনার মাথায় এলো না আর কোলুম্বিনে বলতে থাকল—ওর হাসির ভঙ্গিটা আমার পছন্দ লাগতাছে না, কিন্তু দ্যাখেন, দ্যাখেন, পায়রাগুলি এহনো ফাঁসিকাষ্ঠে বইসা আছে। ওর হাসি শুইন্না ডরায় নাই। তাদের কাছে উনার হাসি ভয়ংকর লাগেনি। পায়রাদের কান খুবই স্পর্শকাতর। জনিকে আপনার ছাইড়া দিতে হবে। রাজা ব্যাপারটা ভেবে-চিন্তে বললেন—যা, জনি, তোরে ছেড়ে দিলাম। আর জনি পহেলাবারের মতো একটা কথা উচ্চারণ করল কোলুম্বিনের উদ্দেশ্যে—শুকরিয়া। তারপর ভালো মানুষের মতো একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। রাজার আর কোনো ভাঁড় রইল না।
রাজামশাই কোলুম্বিনেকে বলল—আমার লগে চল্।
রাজ-দাসদাসী, রাজদরবারের সবাই ভাবল যে, কোলুম্বিনে রাজদরবারের নতুন ভাঁড়।

কিন্তু কোলুম্বিনে এতে মোটেও খুশি হলো না। সে দাঁড়িয়ে রইল, তাজ্জব। কালেভাদ্রে একটা কথা বলবে কি বলবে না, হো হো করে হাসেও না, শুধু একটা মুচকি হাসল আর কেউ এতে হাসল না। লোকজন বলল—সে তো ভাঁড় না, সে ইডিয়েট। কোলুম্বিনে বলল—আমি ভাঁড় নই, আমি ইডিয়েটই।

তখন লোকজন তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করল। রাজা যদি জানতেন কোলুম্বিনেকে নিয়ে লোকে হাসি-তামাশা করছে, তাহলে তিনি রাগান্বিত হয়ে পড়তেন, কিন্তু কোলুম্বিনে রাজার কাছে তা বলল না। কারণ তাকে নিয়ে কেউ হাসি-তামাশা করলে সে কিচ্ছুই মনে করে না। রাজদরবারে আছে পালোয়ান, চালাক-চতুর লোক, রাজা তো রাজাই, রুপসী আওরাত, সাহসী পুরুষ, অনুগত ধর্মযাজক আর রান্নাঘরের দাসীরা বেশ পরিশ্রমী—কেবল কোলুম্বিনে, এই কোলুম্বিনে কিচ্ছুই না। যখন কেউ একজন বলে—আয়, কোলুম্বিনে আমার লগে কুস্তি লাগ্, কোলুম্বিনে উত্তর দেয়—আমার শইলে আপনের মতন জোর নাই। যখন কেউ বলে—সাত গুণ দুই কত রে? কোলুম্বিনে উত্তর দিত—আমি আপনের চেয়ে বেশি মুর্খচোদা। যখন কেউ একজন বলে—তোমার কি ঝরনা থেকে লাফ দেওয়ার সাহস আছে ? কোলুম্বিনে জবাব দিত—আমি ভীতুর ডিম। আমার সেরম সাহস নাই।

যখন রাজা তাকে জিজ্ঞেস করল—কোলুম্বিনে তুমি কী হতে চাও? কোলুম্বিনে জবাবে বলল—আমি কিচ্ছুই হইবার চাই না। আমি তো অলরেডি একটা কিচ্ছু হয়েই আছি৷ আমি কোলুম্বিনে। রাজা মশাই বললেন—কিন্তু তোমাকে তো একটা কিছু হতেই হবে। কোলুম্বিনে বলল—একটা মানুষ কী কী হইবার পারে?
তারপর রাজা মশাই বললেন—ওই যে, দাড়িওলা লোকটি দেখতাছো, তামাটে রঙের, শুকনো ও কুঁচকানো মুখশ্রী, সে হলো নাবিক। সে নাবিকই হতে চেয়েছে আর তাই-ই হয়েছে। সে পাল খাটানো জাহাজে করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় আর রাজা মশাইয়ের জন্য নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করে। কোলুম্বিনে বলল—রাজা মশাই যদি চান, তাহলে আমিও নাবিক হব। এ কথা শুনে রাজদরবারে হাসির রোল পড়ে গেল। কোলুম্বিনে রাজদরবার থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল আর উচুস্বরে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে বলল—আমি একটা দ্যাশ আবিষ্কার করমু, আমি একটা দেশ আবিষ্কার করমু। লোকজন পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল আর মাথা ঝাঁকাল আর কোলুম্বিনে রাজপ্রাসাদ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। শহরের ওপর দিয়ে, মাঠের ওপর দিয়ে আর মাঠে যেসব কৃষকেরা ছিল তারা তাকে দ্রুত ছুটতে দেখছিল, সে তাদেরকে ডেকে বলল—আমি একটা দ্যাশ আবিষ্কার করমু, আমি একটা দ্যাশ আবিষ্কার করমু। আর সে দৌড়াতে দৌড়াতে এক অরণ্যে এসে পৌঁছল। আর সপ্তাহে পর সপ্তাহ অরণ্যের ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে রইল এবং ওই সপ্তাহগুলিতে কেউ কোলুম্বিনের কোনো খোঁজ পেল না৷ রাজা মশাই বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, নিজকে নিজে ধিক্কার দিতে থাকলেন আর রাজদরবারের লোকেরা যারা কোলুম্বিনেকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছিল তারা শরমিন্দায় ভুগতে থাকল। আর সেজন্য মিনারের পাহারাদার যখন শিঙায় ফুঁ দিল তখন কোলুম্বিনেকে মাঠ পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে, রাজফটক পার হয়ে রাজা মশাইয়ের কাছে আসতে দেখল সবাই বেশি আনন্দিত হলো আর কোলুম্বিনে রাজা মশাইকে বলল—জাঁহাপনা, কোলুম্বিনে, একটা দ্যাশ আবিষ্কার করছে। রাজদরবারের কেউ কোলুম্বিনেকে নিয়ে যেহেতু হাসি-তামাশা করতে চাচ্ছিল না, তাই তারা গম্ভীর মুখের ভান করে সওয়াল করল—নাম কী দ্যাশের? কোনহানে এইটা? কোলুম্বিনে জবাব দিল—এইটার এহনো নাম হয় নাই, এই তো মাত্র দ্যাশটার সন্ধান পাইলাম, এইটা মেলা দূর, সমুদ্রের ভিত্তে। এরপর দাড়িওলা নাবিক জোশ নিয়ে উঠে দাঁড়াল আর বলল—ঠিক আছে, কোলুম্বিনে। আমি, আমেরিকাগো ভিসপুচ্চি। আমি দ্যাশটা খুঁজতে যামু, তুমি খালি কও কেমনে যাইতে হবে।
কোলুম্বিনে জবাব দিল—পাল খাটানো জাহাজ লইয়া সমুদ্রে বেরিয়ে পড়বেন, তারপরে সোজা সামনে যাইতেই থাকবেন, যাইতেই থাকবেন, যদ্দিন না দ্যাশটার দেখা না পান, হাল ছাইড়া ফিরা আইলে কিন্তু হবে না। কোলুম্বিনে ডর পেয়ে গেল, কারণ সে ছিল মিথ্যুক, সে জানত যে ওরকম কোনো দেশ নাই। সেই টেনশনে কোলুম্বিনের রাতের আরামের ঘুম হারাম হলো। কিন্তু আমেরিকাগো ভেসপুচ্চি দেশটার খোঁজে বেড়িয়ে পড়ল। কেউ জানত না সে পাল খাটানো জাহাজ নিয়ে কোথায় গেছে।

হয়তো সে অরণ্যে লুকিয়ে ছিল। আর যখন শিঙায় ফুঁ দেওয়া হলো আমেরিকাগো ফিরে আসল।

কোলুম্বিনের মুখ লজ্জায় লালে লাল হয়ে গেল আর এত নামজাদা-এত বড় নাবিকের দিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত সে পাচ্ছিল না। ভেসপুচ্চি রাজা মশাইয়ের সামনে দাঁড়াল, কোলুম্বিনের দিকে চেয়ে চোখ টিপ্পি দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিল, কোলুম্বিনের দিকে চেয়ে আবার চোখ টিপল, শোনা যায় এরকম জোরে স্পষ্টভাবে বলল—রাজামশাই, সে বলল—রাজা মশাই, এরকম একটা দ্যাশ আছে। ভেসপুচ্চি আমেরিকাগো গোমর ফাঁস না করার কারণে কোলুম্বিনে এতই খুশি হলো যে দৌড়িয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল আর বলল—আমেরিকাগো, আমার জান আমেরিকাগো। আর লোকে ধরে নিল এটাই বুঝি দেশটার নাম আর তারা যে দেশটা নাই তার নাম দিল—আমেরিকা।

রাজামশাই বলল—এখন তুই বড় মানুষ হইছস্ আর এখন থেকে তোর নাম—কলম্বাস। কলম্বাস নামজাদা হয়ে গেল, সবাই তার দিকে হা করে চেয়ে থাকত আর পরস্পর ফিশফিশ্ করে বলত—বুঝলা, হে-ই আমেরিকা আবিষ্কার করছে। প্রত্যেকে আমেরিকা বলে যে একটা দেশ আছে এটা বিশ্বাস করল, শুধু কলম্বাস এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না, সারাটা জীবন তার সন্দেহে কাটল আর তার সাহসে কুলালো না নাবিককে জিজ্ঞাসা করতে যে সত্যিটা কী তা যেন তাকে বলে।

তারপর অন্যান্য লোকেরা পাল খাটিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্য রওনা করল, ফিরেও আসলো অনেকে আর তারা ফিরে এসে বলল যে—আমেরিকা বইলা একটা দ্যাশ আছে।
যে লোকটা আমাকে গল্পটা বলেছিল সে বলল—আমার কথাই যদি ধরো, এই আমি কখনো আমেরিকা যাইনি।
জানিও না এ আমেরিকা নামে কোনো দেশ আছে কিনা। সম্ভবত লোকজন ভান করে যে এরকম দেশ আছে যাতে করে কলম্বাসের দিলে কষ্ট না লাগে। যখন দুজন লোক আমেরিকার ব্যাপারে কথা বলে তারা খুব কম ‘আমেরিকা’ বলে, সচরাচর তারা ধোঁয়াশা করে বলে—একটা দেশ বা ওই দেশ অথবা ওইরকম একটা কিছু—আকার ইঙ্গিতে কথা বলে।

সম্ভবত যারা আমেরিকা যেতে চায় তাদের প্লেনে অথবা জাহাজে কোলুম্বিনের গল্পটা শোনানো হয়, পরে তারা কোথাও লুকিয়ে থাকে এবং ফিরে এসে বলে—কাউবয়, স্কাইস্ক্র্যাপার, নয়াগ্রা জলপ্রপাত, মিশিসিপি, নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সসিককো সম্পর্কে খোশগল্প ফাঁদে আর বলে।

যাই হোক তারা সকলে একই গল্প বলে, এমন গল্প বলে যা তারা আমেরিকা যাওয়ার আগেই জানত, এটা তুমি মঞ্জুর করে নিবে যে এটা একটা সন্দেহ জাগানো ব্যাপার। কিন্তু লোকজন এখনো তর্কাতর্কি করে এ নিয়ে যে কলম্বাস আসলে কে ছিল।
আমি জানি সে আসলে কে ছিল।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;