অপাঠ্য ভ্রমণ

পিটার শ্লেমিল : এক ছায়াহীন মানুষের কাহিনী



এনামুল রেজা
আডেলবার্ট ফন শামিসো ও তাঁর বই

আডেলবার্ট ফন শামিসো ও তাঁর বই

  • Font increase
  • Font Decrease

বইয়ের দোকানে লক্ষ্য ঠিক করে খুব কমই গিয়েছি আমি। সুযোগ পেলেই বাংলামোটোর হয়ে শাহবাগ বা নিউমার্কেট এরিয়ার গ্রন্থবিতানগুলোতে এত ঢুঁ মারা হয়, প্রত্যেকবার লক্ষ্য ঠিক করে রাখা সম্ভব না আসলে। এই ব্যাপারটার মধ্যে চাপা উত্তেজনা আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কিছু বই একেকবার হাতে চলে এসেছে, সেসব পাঠান্তে আমি আমার নিরুদ্দেশ ওইসব ভ্রমণকে গোপনে ধন্যবাদ জানিয়েছি।

এভাবেই কোনো এক গ্রীষ্মের দুপুরে ছোট্ট বইটার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। শেলফে ঘুমিয়ে ছিল। হাতে তুলে নিতেই যেন সে জেগে উঠল করতলে, আঙুলের ফাঁকে। বিড়বিড় করলাম, ‘অদ্ভুত তো, ছায়া হারিয়ে ফেলা এক লোকের গল্প। নাম ‘ছায়াবিহীন’। ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়া এক জার্মান নভেলা পিটার শ্লেমিল (Peter Schlemihl)। লেখক আডেলবার্ট ফন শামিসো। ইংরেজি অনুবাদ থেকে সেটি বাংলায় নামিয়েছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।

আকারে ছোট হলেও উপন্যাসিকাটির বিষয়বস্তুকে কেন জানি না, খুবই ভারী বলে মনে হলো আমার। কিন্তু ফাউস্তিয়ান কিংবদন্তির নেশাধরানো আমন্ত্রণ খুব বেশিদিন এড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। এক উইকেন্ডের রাতে বইটা নিয়ে বসে গেলাম।

আমাদের নায়ক পিটার শ্লেমিল জাহাজে চেপে নতুন এক শহরে হাজির হয়েছে যেখানে সে তার ভাগ্যকে বাজিয়ে দেখতে চায়। সম্বল সামান্য একটা ব্যাগ, অল্প কিছু অর্থ। ভাঙাচোরা সস্তার একটা সরাইখানায় সে আশ্রয় নিল।

খুঁজে পেতে যার সন্ধান সে বের করতে চাইল, তিনি শহরটির অন্যতম ধনী ব্যক্তি মিঃ জন। শহর থেকে একটু দূরে এক জমকালো বাড়ি আর পাহাড়ী গোলাপবাগানে লোকটিকে খুঁজে পেল পিটার। মান্যগণ্য পুরুষেরা মিঃ জনকে ধন্য ধন্য করছে। সুন্দরীরা তার সঙ্গ পাবার জন্য আকুল। এসবের মাঝখানে নিজেকে খুবই বেচারা, অসহায় আর অনাহুত মনে হলো তার। কিন্তু মিঃ জন হতাশ করলেন না, যেহেতু তার সম্পদের কোনো কমতি নেই, আশ্বাস দিলেন যে পিটারের ব্যাপারটা দেখবেন তিনি।

আরো পড়ুন ➥ প্রেম ও পুরুষের পৃথিবীতে

এই ধনী লোকদের আসরের মাঝখানেই ধূসর কোট পরা লম্বা এক লোককে ঘুরে বেড়াতে দেখল পিটার শ্লেমিল। ব্যাখ্যার অযোগ্য তার ক্ষমতা, সন্দেহজনক তার আনুগত্য ও বিনয়। যে যা চাইছে, নিজের কোটের পকেট থেকে সে জিনিসটাই নিমেষে তাকে বের করে দিচ্ছে লোকটা। সামান্য একটা কোটের পকেট থেকে এত কিছু কিভাবে বের হচ্ছে, পিটার ভেবে বের করতে পারল না। এক সময় ব্যাপারটা তার সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে ওখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানে কাজ মনে হলো। আর তখনই সেই রহস্যময় লোক আচমকা পথ আঁটকে দাঁড়াল, ব্যাপারটা যেন এরকম, ‘আরে যাচ্ছেন কোথায়? আপনার সঙ্গেই তো আমার আসল কারবার।’

কী এই আসল কারবার?

লোকটি পিটারকে বলল যে তার ছায়াটি বড় চমৎকার, অমূল্য। এমন নিখুঁত ছায়া পৃথিবীতে খুব অল্প মানুষেরই হয়। পিটার যদি ছায়াটি বিক্রি করতে রাজি থাকে, খুব যোগ্য বিনিময় দিতে রাজি আছে সে। এই কথা বলে কোটের পকেট থেকে সে বের করল এমন এক থলি, যা থেকে অনিঃশেষ স্বর্ণমুদ্রা বের হয়।

দরিদ্র্য পিটার শ্লেমিল হতভম্ব হয়ে গেল এই কাণ্ড দেখে। একটা সামান্য বিনিময়ে ওই অসম্ভব ঐশ্বর্যের খনি? কিছুক্ষণ দোটানায় ভুগলেও লোকটির প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। বিক্রি করে দিল নিজের ছায়া।

এই ঘটনার পর থেকেই আসলে শুরু হলো তার জীবনের এক ভয়ঙ্কর দুর্দশাগ্রস্ত আর অস্তিত্ব সংকটে ধুকে ধুকে কাটাবার পর্ব। শ্লেমিল শব্দটা হিব্রু, এর অর্থ হলো হতভাগ্য। যে লোকের ছায়াই নেই, সে কিভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে?

শুরুতেই বলেছি, এই গল্পের উৎসবিন্দু হচ্ছে ফাউস্তিয়ান কিংবদন্তি। ফাউস্ত ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু জ্ঞানের অসীম তৃষ্ণা মিটছিল না তার। সুতরাং, শয়তান এসে তাকে দেখা দিল আর দিল বিচিত্র এক প্রস্তাব। ফাউস্ত শয়তানকে নিজের আত্মা বিক্রি করলেন, বিনিময়ে পেলেন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান আর অফুরান ধনসম্পত্তি।

এই এক জার্মান উপকথা গোটা ইউরোপে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে আছে চিরকাল। ক্রিস্টোফার মারলো থেকে গ্যেটে থেকে টোমাস মান, ফাউস্তের ট্র্যাজেডি নানাভাবেই রিক্রিয়েট হয়েছে সাহিত্যে। আরো হয়তো হবে এবং হচ্ছেও।

আরো পড়ুন ➥ সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি

কিন্তু পিটার শ্লেমিল পড়তে গিয়ে মনে হলো, নিজের আত্মজৈবনিক হতাশাকে ধরে রাখতে শামিসো কি ফাউস্তের চেয়ে জবর কোনো টুলস আর খুঁজে পেতেন? সেই অমোঘ নিয়তির মতো বই পড়তে পড়তে লেখকের ব্যক্তিজীবনে ডুব মারার বিরক্তিকর স্বভাবটা মুহূর্তেই আমাকে আচ্ছন্ন করল। সব লেখকের ক্ষেত্রে এমনটা না হলেও রচনায় লেখকের নিজস্ব যাপনের কিছু কিছু ছায়া তো থেকেই যায়, এমনকি অন্যদের জীবনকে নিজের জীবনের মতো করে গল্প তৈরির ক্ষমতাও থাকে একজন শক্তিমান রচয়িতার।

পিটার শ্লেমিল পড়তে গিয়ে এই দুটি ব্যাপারই আবিষ্কার করলাম। পিটার একজন বাস্তব মানুষ, আর আডেলবার্ট ফন শামিসোকে মূলত নিজের দুর্ভাগ্যের কাহিনী সে শোনাচ্ছে, এমন কয়েকটা দৃশ্য আছে গল্পটিতে। এমনকি পিটারের স্বপ্নে ফন শামিসোকেও আমি দেখতে পাই, কাচের জানালার ওপাশে শামিসোর টেবিলে একটা বই এবং নিশ্চিতভাবেই বইটা গ্যেটের লেখা ফাউস্ট।

আডেলবার্ট ফন শামিসো এক এরিস্টোক্র্যাট ফরাসি পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব চলছে যখন, ১৭৯০ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে বালক শামিসোকে পাড়ি জমাতে হইয়েছিল জার্মানিতে। ফরাসি হয়েও জার্মানিতে বসবাস আর জার্মানিতে থেকেও তারা যে ফরাসি, এই ব্যাপারটা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারতেন না।

এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৭৯৮ সালে নিজের জন্মভূমি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আশ্রয়দাতা জার্মানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল তাকে। যদিও জার্মানির লোকজন তাকে নিজেদের মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছিল, শামিসো ভাবতেন যার দেশ নেই, তার কি কোনো অস্তিত্ব আছে? জাতীয়তাবাদের এক গর্বোদ্ধত যুগে তার সাবকনশাসে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাকে ভয়ানক এক ক্ষত হিসেবেই অনুমান করা যায়। পৃথিবীর সকল মানুষই কোনো না কোনো দেশের নাগরিক, আর এই দেশ ধারণাটি তাকে পৃথিবী থেকে বড় দূরে সরিয়ে দেয়। তার মনে সংকট তৈরি করে। এমনকি দেশের মাঝে যে ছোট ছোট দেশ, সেসব স্থানে বেঁচে-বর্তে থাকা লোকজনও এ সংকট থেকে মুক্তি পায় না।

পিটার শ্লেমিলের ছায়াহীনতাকে মূলত লেখকের বিপন্ন অস্তিত্বের রূপকই মনে হয় আমার। আমি পড়িও সেটা ধরে নিয়েই। অর্থবিত্তের অভাব না থাকলেও সমাজ যখন দেখে শ্লেমিলের ছায়া নেই, তখনই তাকে আর মেনে নিতে পারে না। তার জীবন হয়ে ওঠে একজন পলাতকের জীবন। দিনের আলো যে ভয় পায়, রাতের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে চায় না। প্রতি মুহূর্তে আত্মপীড়ায় নিজেকে সে রক্তাক্ত করে।

এই দুর্দশার মধ্যেও শ্লেমিল কিন্তু খুঁজতে থাকে সেই ধূসর কোট পরা লোকটিকে। সে এই করুণ জীবন থেকে পরিত্রাণ চায়, অনিঃশেষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে লাভ কি যদি তার ছায়াই না থাকে? বহুদিন পার হলে অবশেষে লোকটি আসেও। তবে নতুন এক প্রস্তাব নিয়ে। নিজের বহু মূল্যবান ছায়াটি পিটার ফেরত পেতে পারে, কিন্তু এবার বিনিময় হিসেবে লোকটি চায় তার আত্মা।

এবার সে কী করবে? ফাউস্টের মতো সেও কি তার আত্মা বিক্রি করে দেবে? যেন চাইলেই ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন লেখক শামিসো, কিন্তু এতদিন যে দেশ তাকে আশ্রয় দিল, তার সঙ্গে করতে হবে বেঈমানী!

বইটির ন্যারেটিভ খুবই সমান্তরাল। একটা মোক্ষম শুরু এবং অভাবনীয় সমাপ্তি আছে। সেই সমাপ্তি উন্মুক্ত। যেন আরো বিচিত্র সব অভিযানে অংশ নেবার জন্য পাঠককে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। লেখক ও বৃক্ষবিদ ফন শামিসো তার কাহিনীতে যে কল্পনা ও উপকথার মিশেল ঘটিয়েছেন, তাকে জাদুবাস্তবতার আদিকাণ্ড হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়।

নিজে সমাজের যেই অংশের প্রতিনিধি ছিলেন, তাদের সম্পর্কে শামিসোর মনোভাব স্বস্তিকর কিছু ছিল না, তিনি ভাবতেন এরা সবাই মূলত শয়তানের কারবারি, আর সাধারণ মানুষেরাও যে ধনীদের স্তুতি করত তা কেবলমাত্র সম্পদের লোভেই। শহুরে মানুষের এই দুই শ্রেণী কেউ কাউকে বিলং করে না কিন্তু একে অন্যকে ছাড়া টিকতেও পারে না, এ ব্যাপারটিকেও বিদ্রুপের কাঁটায় তিনি হয়তো বিদ্ধ করতে চেয়েছেন।

তবে এভাবে না দেখে, এমনকি যে পাঠক শামিসোকে চেনেন না একদম, কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই পিটার শ্লেমিলকে পড়ে নিতে পারেন।

অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসতে চাওয়া জীবনের এক অপূর্ব গল্প এটি। যেখানে আছে শয়তানের ধোঁকা, ফরচুনেটাসের থলি যার ভিতরে হাত গলিয়ে দিলেই মেলে মুঠো মুঠো সোনার মোহর, আজব পাখির বাসা যা মাথায় দিলে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়, সপ্তসিন্ধু জুতো যা পায়ে দিলে অনবরত ঘুরে বেড়ানো যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চোখের পলকেই। আর চূড়ান্তভাবে আছে অশুভের বিরুদ্ধে মানবাত্মার সেই চিরায়ত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে জিতে গেলেই মুক্তি মিলতে পারে, হেরে যায় শয়তান, আত্মার যেই মুক্তির কাছে পৃথিবীর সমস্ত ধন-সম্পদ তুচ্ছ। কিন্তু এই জিতে যাওয়াটা কি সম্ভব?

কতভাবেই না একটা বই লেখা যেতে পারে, আর বিচিত্র পাঠক কতভাবেই না সে বইটি পড়তে পারেন।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;