লালন সাঁইয়ের ১২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী

মানবতার প্রাণপুরুষ ফকির লালন সাঁই, শানিত মারণাস্ত্র গান ও আত্মোপলব্ধি



সিরাজ প্রামাণিক
ফকির লালন সাঁই

ফকির লালন সাঁই

  • Font increase
  • Font Decrease

বিদগ্ধ ও পণ্ডিতজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই আগেই। তাঁদের মতো লালন বিষয়ে পড়াশোনা, তত্ত্বতালাশ এবং সাঁইজীর জন্ম-মৃত্যু, জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে গবেষণা আমার নেই। সাঁইজীর গান আগেও শুনেছি, এখনো শুনি একান্ত মনোযোগী শ্রোতা হয়ে। সাঁইজির গানের মুদ্রিত পাঠ হাতের কাছে যতটুকু পেয়েছি সংগ্রহ করেছি, করে যাচ্ছি ক্রমান্বয়ে। নানা রকম পাঠভেদ মেনে নিয়ে পড়েছি, এখনো পড়ে যাচ্ছি। সাঁইজীর পড়শি হিসেবে তাঁর ধামে আসা-যাওয়াও কম নয়। পড়তে পড়তে ও সাঁইজির ধামে আসা যাওয়ায় আমি যা অনুভব করি, তা শোনার চেয়ে অনেক গভীর, বলা যায় অতলান্ত। বিশিষ্ট গবেষকদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, মানবতার প্রাণপুরুষ ফকির লালন সাঁইজীকে নিয়ে আমি আমার অনুভবের কথা লিখছি।

লালনের গানে তাঁর অনুসারীরা খুঁজে পান অমৃতের সন্ধান। মানবজীবনের মোহমায়া, ভোগলিপ্সা থেকে মুক্ত হয়ে পরমার্থের জন্য মহাজনেরা যুগে যুগে, দেশে দেশে কঠিন সাধনায় আত্মনিবেদন করেছেন। বহুজনের বহুমত, বহুপথ। লালন বলেছেন মানবধর্মের কথা। অমৃতের সন্ধান করেছেন আত্মজ্ঞানের মধ্য দিয়ে। সেই অমৃতের সন্ধানেই সাঁইজির ধামে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী, অনুসারীরা ছুটে আসেন।

সত্যিই লালনকে সন্ধান করতে গেলে ফাঁপরে পড়তে হয়। কে এই লালন, কী তাঁর জাত পরিচয় অথবা কেমন তাঁর ধর্ম-জীবনপ্রণালি, প্রশ্ন জাগে। মানুষের মতামতের যেমন শেষ নেই, তেমনি গবেষকরাও তাঁর সব বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। অথচ ১২৯ বছর আগে দেহত্যাগী লালনের একজোড়া গুরু-শিষ্যকে ধরে নেমে এলেই জীবিত বাউলের দেখা মেলে। যেহেতু বাউলবাদ গুরুবাদী, সেহেতু গুরু-শিষ্যের সরেজমিন কথোপকথন, জীবন, যৌনাচার সবকিছুর বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যাবে সম্যক লালন ও তাঁর দর্শনকে। বাউলরা দেশময় ছড়িয়ে থাকলেও তাঁদের মন পড়ে থাকে লালনের বারামখানায়। নানা ছুঁতোয় তাঁরা চলে আসেন মনতীর্থে। দোল কিংবা কার্তিক হলে তো কথাই নেই। ফকির লালন সমকালে যেমন শিষ্যদের নিয়ে ফাগুনের পূর্ণিমায় মচ্ছব করতেন, তেমন করে প্রতি বছর মচ্ছব বসে আখড়াবাড়িতে। ১৮৯০ সালের পয়লা কার্তিকে লালন গত হওয়ার পর থেকে দোলের সঙ্গে স্মরণোৎসবও যোগ হয় মচ্ছবানন্দে। পরম্পরায় বয়ে চলেছে এ ধারা। কার্তিক এলেই আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদনৃত্যে ভারি হয়ে ওঠে সাধুবাজার। গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের চোখে চোখ রেখে শুরু হয় ভাবের খেলা। ভাবজগতের মধ্যে বেজে ওঠে তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে। একতারা, দোতরা, ঢোলখোল, হারমোনি, বাঁশি, জোয়ারি, চাকতি, খমক হাতে একযোগে বাউলরা উড়াল তোলে। শোক বিয়োগের দিন হলেও ভক্তভারে ক্রমেই দৃশ্যগুলো তখন পাল্টে যেতে শুরু করে। খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে তালের উন্মাদনায় দমকে দমকে ভাসতে থাকে ভাববাদী ঢেউ। স্মরণোৎসব শোকাচ্ছন্ন থাকে না, উল্টো আনন্দময় মচ্ছবে পরিণত হয়। দুটো বড় আয়োজন বাদেও প্রায় প্রতিদিনই সাধু-গুরুদের বাজার বসে আখড়াবাড়িতে। সাধুবাজারেই পাওয়া যায় বাউলিয়ানার সরেজমিন আচারনিষ্ঠা এবং সাধন ভজনের স্বরূপ বৃত্তান্ত। পরিবেশনার আঙ্গিক যেমনই হোক না কেন, গানগুলো সব একজনেরই। ভক্তের কাছে তিনি দীক্ষাগুরু। সাধারণ শ্রোতার কাছে বাউলসম্রাট, বিদগ্ধজনের কাছে বাংলার লোকসংগীত ও মরমি দর্শনের অন্যতম দিকপাল লালন সাঁই। সাধুদের আধ্যাত্মিক চর্চার অনুসঙ্গ হিসেবে শুরু হওয়া এই আয়োজন এখন নানা দেশ, নানা শ্রেণী-পেশার, নানা বয়সী নর-নারীর বিপুল সমারোহে এক বিশাল বিচিত্র কর্মযজ্ঞ।

সাঁইজিরও আশা ছিল এমন এক সমাজের, যেখানে কোনো জাতিভেদ থাকবে না। মানুষ তার মনুষ্যত্বের মূল্যেই পরিচিত হবে। তিনি গেয়েছিলেন, ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মোছলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে...।’ কে জানে কবে আসবে সেই দিন, তবে সেই দিনের বাণী নিয়েই এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন সাধুসন্তরা, লালনের গানের ভক্ত সাধারণ মানুষ।

◤ কুষ্টিয়ায় ফকির লালন সাঁইয়ের মাজার ◢


লালনকে বিশ্লেষণ করতে হলে অবশ্যই তার সমকালীন সমাজকে জানতে হবে। সমাজে যখন জাতিভেদ প্রথার ছোঁয়াছুঁয়ির কবলে পড়ে নীচুতলার মানুষ ঊণমানবে পরিণত হয়ে মুক্তির আকুতি নিয়ে আকুলি বিকুলি করছিল কিন্তু প্রতিবাদের অস্ফুট স্বর কণ্ঠ পেরিয়ে মুখে আসছিল না লালন তখন এই জাতপাতের ওপর খড়গ ধরলেন এবং তাদের মুখে ভাষা দিলেন। তিনি বলিষ্ঠভাবে সমাজ আরোপিত জাতপাতকে অস্বীকার করে ঘোষণা করলেন, ‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা/সত্য পথে কেউ নয় রাজি সব দেখি তা না না।।/যখন তুমি ভবে এলে /তখন তুমি কী জাত ছিলে/কী জাত হবা যাবার কালে/সেই কথা ভেবে বলো না।।/ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি/এক জলেই সব হয় গো সুচি/দেখে শুনে হয় না রুচি /যমে তো কাউকেই থুবে না।।/গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় /তাতে কি ধর্মের ক্ষতি হয়/লালন বলে জাত কারে কয় এ ভ্রম তো গেল না।।

সমকালীন সমাজে জাতিভেদপ্রথা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজকে বিষিয়ে তুলছিল। কী হিন্দু কী মুসলিম উভয় সমাজেই এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। জাতিভেদ প্রথা এতটাই প্রকট ছিল এবং সমাজে বিভেদের প্রকার তুলেছিল যে নীচজাতের লোকেদের সঙ্গে উঁচু জাতের লোকেরা খাওয়া দাওয়া ওঠাবসা করত না। একের ছোঁয়ায় অন্যে অপবিত্র হয়ে যেত। ছোঁয়াছোঁয়ির এই ভেদবিভেদের মধ্যে পড়ে একই সমাজের মধ্যে নানা উপসমাজের তৈরি হয়েছিল এবং সমাজের নীচু তলার মানুষ প্রকারন্তরে সমাজের মূলস্রোত থেকে ছিল অনেকটা নির্বাসিত। বর্ণাশ্রায়ী গ্রাম যেমন ব্রাক্ষ্মণ গ্রাম, শূদ্র গ্রাম এভাবেই একই সমাজের ভেতর অনেক উপ-সমাজ তৈরি করে উচ্চবর্ণের লোকেরা সমাজের নিম্নবর্ণের লোকেদের সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিছন্ন করে রেখেছিল এবং নীচুবর্ণের লোকেরা তা বিধির বিধান বলে মেনে নিয়ে সমাজের অন্যায়ের কাছে, সমাজের শোষণের কাছে নতজানু হয়ে সমাজ আরোপিত শোষণকে মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে লালন এসে ঘোষণা করলেন সমাজ কর্তৃক মানুষে মানুষে বিভাজন ঠিক নয়। কারণ সমাজের বর্ণভেদ প্রথার মারপ্যাঁচে পড়ে বিভক্ত শ্রেণী ব্রাক্ষ্মণ, চণ্ডাল, চামার মুচি—এর মধ্যে প্রভেদ নেই। কারণ বিধাতার রাজ্যে সবাই সমান। সবার জন্য বিধাতার একই বিধান। সুতরাং সমাজের সুবিধাবাদী গ্রুপের সৃষ্টি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, ভেঙে ফেলতে হবে সমাজের এই কুসংস্কার সত্য প্রতিষ্ঠায়। আর সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের আন্দোলন করতে গিয়ে লালন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ ধর্মের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে চিহ্নসর্বস্ব ধর্মের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং সমাজ বদলের সংগ্রামে লালন চিহ্নসর্বস্ব ধর্মকে অস্বীকার করেছেন দৃঢ় কণ্ঠে, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কিরূপ দেখলাম না এই নজরে।।/কেউ মালা কেউ তজবি গলায়/তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়/যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।/যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/তবে নারী লোকের কি হয় বিধান/বাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ/বাহ্মণী চিনি কিসে রে।।/জগৎজুড়ে জাতের কথা/লোকে গর্ব করে যথাতথা/লালন কয় জাতের ফ্যাতা/ডুবাইছি সাত বাজারে।।

লালনের এই উচ্চারণকে যদি আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখি তবে লালনের সাহসের সত্যিই তারিফ করতে হয়। লালন ধর্মীয় কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সমাজ কাঠামোতে আঘাত করতে গিয়ে সমাজের সবচেয়ে সেনসেটিভ ইস্যু ‘ধর্ম’ এবং ‘নারী’ এই দুটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা আজকের এই অধিকতর সেক্যুলার সময়ে এসেও আমাদের বোধের অতীত। কিন্তু সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সময়ে বসে লালনের এই স্পর্ধা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে। লালন শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজের কাঠামো পরিবর্তন না করলে সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। তাই তিনি ভারতীয় সমাজের মৌল কাঠামোর ওপর নির্মম আঘাত হেনেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে যা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা সাহস করিনে। তিনি মুসলমান ধর্মের চৈহ্নিক অসাড়তার কথা বলতে গিয়ে খতনার কথা বলেছেন এবং সেই বলাটাকে তীক্ষ্ণতা দিতে গিয়ে তিনি মুসলমান নারী সমাজের অবতারণা করেছেন। আর সমভাবে হিন্দু সমাজের নারীদের কথাও পেরেছেন তীক্ষ্ণ প্রশ্নের বাণে। লালনের সময়ে গ্রামীণ সমাজ ছিল অত্যন্ত কুসংস্কারযুক্ত এবং রক্ষণশীল। সেই রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস তার সময়ে কেউ দেখাননি। কিন্তু লালন সেই কাজটিই করেছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। কারণ তিনি জানতেন সমাজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে হলে, সমাজের কাঠামো বদল করতে হলে সেই কাঠামোর ওপরই আগে আঘাত করতে হবে। লালন সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নিজের সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছেন। তিনি নিজের সামাজিক পরিচিতি তথা সাম্প্রদায়িক পরিচিতির ব্যাপারে অবলীলায় বলেছেন, ‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু না যবন/লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।।’

◤ আখড়ায় গানোন্মত্ত এক বাউল ◢


একবার যদি আমরা গভীরভাবে ভাবি লালনের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা তাহলে আমাদের মনের অজান্তেই শিউরে উঠতে হয়। কারণ এই একবিংশ শতাব্দীর অধিকতর সেক্যুলার সময়ে এসেও ধর্মের উদারনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে কেউ স্থির থাকতে পারছেন না। আর সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বসে লালন তার সাম্প্রদায়িক পরিচিতি অবলীলায় অস্বীকার করে হিন্দু-মসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মর্মমূলে কুঠারাঘাত করেছেন—এটা কত বড় স্পর্ধার কাজ! এবং সেই আন্দোলনে গতি দেওয়ার জন্য তিনি একের পর এক রচনা করেছেন গণজাগরণী গান সমাজের সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। লালনের এই যে আন্দোলন তার পথ যে খুব মসৃণ ছিল তা কিন্তু নয়। লালনকে তার সমকালে এবং উত্তরকালে তার উত্তরসূরিদের সমাজের চরম প্রতিরোধ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাইতো তিনি খেদের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন, ‘শোনায়ে লোভের বুলি/নেবে না কাঁধের ঝুলি/ইতর আশরাফ বলি/দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।/আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই/সবার পাওনা পাবে সবাই/আশরাফ বলিয়া রেহাই/ভবে কেহ নাহি পাবে।।/ধর্ম-কুল-গোত্র জাতির/তুলবে না গো কেহ জিগির/কেঁদে বলে লালন ফকির কে মোরে দেখায়ে দেবে।।

লালনের গানে মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে তার দর্শনের যে প্রতিফলন দেখা যায় তা দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমানবিক মূল্যবোধের পরিচয় তুলে ধরে। লালন তাই কেবল বাঙালি মরমি কবি বা গীতিকবিদের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন, বিশ্ব লোকসংস্কৃতির অঙ্গনেও তার অবস্থান অনেক উঁচুতে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে জাত-ধর্মের বাহ্যিক আচরণ ও ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে লালন ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার গান জাত-পাতের বিরুদ্ধে মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়। গানে তিনি বলছেন, ‘একই ঘাটে আসা যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া/কেউ খায় না কারো ছোঁয়া বিভিন্ন জল কে কোথায় পান।’

বাংলার বাউল ধর্মমতের শুরু মধ্যযুগে। গবেষকদের মতভেদ রয়েছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, বাউলধর্মের সূত্রপাত আনুমানিক ১৬২৫ সালের দিকে। আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন, ‘ঊনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ।’

লালন সাঁইয়ের বাউলতত্ত্ব পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবধর্ম-নির্ভর। যদিও সব বাউলদেরই একই পথ তবুও বাংলার ঐতিহ্য, চিন্তাধারা, সমাজ ব্যবস্থার সুর পুরোপুরিই পাওয়া যায় লালনের গানে। আধ্যাত্ম চেতনা আর ঐশ্বর্যের মাধুর্যে লালন সাঁই যে মরমি জগত সৃষ্টি করেছিলেন আজ তার মানবলীলা সম্বরণের ১২৬ বছর পরও তার গানের চেতনায় ভাটা পড়েনি বরং চর্যাপদের মতো তার গানের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি দিনের পর দিন মানুষের বোধকে ত্বরান্বিত করেছে চিরভাস্কর সাম্যবাদিতা আর অসাম্প্রদায়িকতার দিকে। জাতভেদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লালন সাঁইর গান এক নীরব মূলমন্ত্র, চেতনার শানিত মারণাস্ত্র।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;