মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ



ড. কাজল রশীদ শাহীন
মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ

মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্ব প্রকাশের পর) আবুল মনসুর আহমদ ‘মোহাম্মদী’তে ভালই ছিলেন, কর্মঘণ্টা বেশি হলেও বিবিধ রকমের কাজ মনের আনন্দে শিখে নেন। মনে করেছেন সকল সুযোগকে কাজে লাগানো উচিৎ। এমনকি প্রুফ দেখার মধ্যেও তিনি বিশেষ আর্ট খুঁজে পান।

তিনি লিখেছেন ‘প্রুফ দেখা একটা বিশেষ আর্ট। জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতা ও নিপুণতা এ কাজে অধিক আবশ্যক।’ এ ছাড়া তাঁর ‘মতিগতি’ও ছিল অন্যরকম। এই ‘মতিগতি’র সুবাদে এবং ‘কাঁধ পাতিয়া দেয়ার’ অভ্যাস গুণেই তাঁর পক্ষে পরবর্তীতে একজন কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক হয়ে ওঠা সম্ভব হয়।

মোহাম্মদীতে চাকরি করেন প্রায় দেড় বছর। তারপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চাকরি চলে যায়। অপরাধ কি, কিছুই জানানো হয়নি। কারণ খুবই গৌণ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিষেধ না করে, কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর হাতে বরখাস্তের কাগজ ধরিয়ে দেন। আর তক্ষুনি আবিষ্কার করেন, মোহাম্মদীতে কাজ করার পরও ‘সত্যাগ্রহী’ পত্রিকার মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী ও মওলানা আবদুল্লাহিল বাকীকে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান মোহাম্মদী কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক মনে করেননি।

আবুল মনসুর আহমদ পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে ‘আত্মকথা’য় বলেছেন, ‘সত্যাগ্রাহীতে সাহায্য করা অপরাধ জানিলে এ কাজ তিনি করিতেন না। কারণ এই পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরি ছাড়িয়া থাকার মতো উপায় নেই। ...বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছেন এবং বিয়ার দিন তারিখও ঠিক হইয়া গেছে।’

আবুল মনসুর আহমদের তৃতীয় চাকরি ‘দি মুসলমান’ পত্রিকায়। মওলানা আবদুল্লাহিল কাফীর অনুরোধে মৌলবি মুজিবুর রহমান এখানে চাকরি দেন। অগ্রিম বেতন পঁয়ষট্টি টাকা দিয়ে গ্রামে গিয়ে বিয়ে করে আসার নির্দেশ দেন। এখানে চার বছর চাকরি করেন।

অভিজ্ঞতার কথায় লিখেছেন মৌলবি সাহেবের কাছে শেখা শিষ্টাচারের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘কোন সমালোচনা বা নিন্দা করিতে গিয়া শিষ্টাচার ও ভদ্রতার খেলাফ করিও না।’ এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর কর্মদক্ষতার যথাযথ মর্যাদাও পেয়েছিলেন। শুধুমাত্র তাঁর কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ বাংলা সাপ্তাহিক ‘খাদেম’ প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি সম্পাদন-পরিচালনার পুরো দায়িত্ব পান। এবং একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় বিশেষ দূরদর্শিতার পরিচয় দেন।

ঘটনাটা এরকম-এলাহাবাদের স্বামী সত্যদেব ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতায় এলে তাকে অভ্যর্থনা ও টাকার তোড়া দেওয়ার আয়োজন করা হয়। সেই সময়ের সব মুসলমান সংবাদপত্রই এ কাজের সমর্থন করেন। কিন্তু ‘খাদেম’ একা এর প্রতিবাদ জানায়। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি হলো, ‘‘কোনো অমুসলমান ইসলাম কবুল করিলেই তাকে অভ্যর্থনা দেওয়ার যে ঘটা হয়, এটা ইসলাম ও মুসলমান সমাজের জন্য অপমানকর। এতে প্রমাণিত হয় যে ঐ ভদ্রলোক ‘ইসলাম’ ও মুসলমান সমাজের শক্তি ও মর্যাদা বাড়াইয়াছেন।’’

এ কারণে খাদেমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মৌলবি সাহেবের কাছে নালিশ করা হয়। মৌলবি সাহেব তাঁর মত সমর্থন করেও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর উপদেশ দেন। তিনি চুপ থাকেন।

কয়েকদিন পর দেখা গেল, আবুল মনসুর আহমদই ঠিক ছিলেন। স্বামী সত্যদেবরূপী মহীউদ্দীন এই অঞ্চল থেকে পাঁচ লাখ টাকা হস্তগত করে এলাহাবাদে ফিরে আর্য ধর্মে পুনরায় দীক্ষিত হন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘অভ্যর্থনা-ওয়ালাদের মুখে চুনকালি পড়িল। আমার সমর্থকদের দন্ত বিকশিত হইল। কিন্তু বিজয়ানন্দের উল্লাসে নিজের হতভাগ্য নির্বোধ সমাজের জন্য আমার চোখে পানি আসিল।’

তাঁর প্রথম পর্যায়ের সাংবাদিকতার ইতি ঘটে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে। এ পর্বের সাংবাদিকতায় বিশেষভাবে লক্ষণীয় হলো, তাঁর আগামী দিনের সম্পাদক হওয়ার ‘ড্রেস রিহার্সাল’ সম্পন্ন হয়। ‘ছোলতান’, ‘মোহাম্মদী’, ‘দি মুসলমান’, ও ‘খাদেম’ পত্রিকায় নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করেন। বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে, ‘মতিগতি’ ও ‘কাঁধ পাতিয়া দেয়ার অভ্যাস’। যার সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাপক পড়াশোনার অভ্যাস। অনুসন্ধান বলছে এসব গুণাবলীই একজন সহ-সম্পাদককে সাংবাদিকতা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে সফল ও সার্থক সম্পাদক হয়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে। মাঝে নয় বছরের ব্যবধান। কিন্তু এ সময়ে সক্রিয় সাংবাদিকতায় যুক্ত না থাকলেও পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে দীপ্যমান ও গতিশীল রেখেছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদকের প্রবৃত্তিকে। এ পর্বে তিনি আবির্ভূত হন পূর্ণ সম্পাদক রূপে।

নিখিল-বঙ্গ-কৃষক-প্রজা সমিতির উদ্যোগে ‘কৃষক’ প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে প্রকাশনায় আসে ‘দৈনিক কৃষক’। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন হুমায়ুন কবির। পরিচালক সভায় যুক্ত হন মৌ. শামসুদ্দীন আহমদ, মৌ. সৈয়দ নওশের আলী, নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী, খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান ও ডা. আর আহমদ। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু। সম্পাদকের বেতন দুই শ টাকা আর টেবিল অ্যালাওয়েন্স পঞ্চাশ টাকা।

কৃষকের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: ‘‘খাটিলাম খুব। অল্পদিনেই কাগজ সাংবাদিক মহলে সম্মান ও জনসাধারণের মধ্যে পপুলারিটি অর্জন করিল। আদর্শ নিষ্ঠায় স্বাধীন মতবাদে এবং নিরপেক্ষ সমালোচনায় ‘কৃষক’ বেশ নাম করিল।’’ যদিও নাম-যশে কৃষক সকলের কাছে সমাদৃত একটা পত্রিকা হয়ে উঠল, কিন্তু ভাগ্যাকাশে দেখা দিল কালোমেঘ। কৃষক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে হুমায়ুন কবির পদত্যাগ করলেন।

উক্ত ঘটনায় আবুল মনসুর আহমদের উপলব্ধি হলো:

এক. দৈনিক পত্রিকা চালাতে হলে যথেষ্ট মূলধন দরকার, যা বিবেচনায় নেয়নি কৃষক কর্তৃপক্ষ।

দুই. সংবাদপত্র এখন আর মিশনারি ওয়ার্ক নয়, এর চারিত্র্যকাঠামো এখন ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে।

তিন.  দৈনিক পত্রিকা চালাতে এবং লাভজনক করতে মোটা অংকের মূলধন বিনিয়োগ করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা থাকতে হবে।

হুমায়ুন কবিরের পর কৃষকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান। অবাঙালি হওয়ায় চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি এ কাজে আগ্রহ হারান। এরপর দায়িত্ব নেন মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত ওরফে মি. এইচ দত্ত। তিনি কলকাতা কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ায় কৃষকের ভাগ্যে সুদিন ফিরে আসে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘আমি কম্পোজিটারদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করিলাম (পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো)। বড়ো-বড়ো লাভের কাগজ সচরাচর ঐ সময় তা করে নাই। আমার কাজকে তারা বিদ্রূপ করিয়াছে।’

কিছুদিনের মধ্যে কৃষকে নীতিগত বিরোধ দেখা দেয়। ওই সময় হক মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ওই বিল পাস হলে মেট্রিক পরীক্ষার কর্তৃত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে উপরমহলের প্রায় সকলেই এর বিরোধিতায় নামে। বেশির ভাগ সংবাদপত্র ও কংগ্রেস পার্টি আইন সভার ভেতরে-বাইরে এর প্রতিবাদে জনমত গড়ে তোলে। কেবল কৃষক এই বিলের সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখে।

এই নিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে বিরোধে শেষাবধি পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। সে সময় প্রশ্ন ওঠে যে, সংবাদপত্র তা হলে কার কথায় চলবে? মালিক না সম্পাদক। তাঁর যুক্তি ছিল মালিকপক্ষের কথায়। যা সেদিন ওয়ার্কিং জার্নালিস্টরা কেউই পছন্দ করেননি। প্রতিবাদ জানান।

আবুল মনসুর আহমদ এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বলিয়াছিলাম সাংবাদিকতা ওকালতির মতোই একটা প্রফেশন। এটা মিশনারির মতো আদর্শ সেবা নয়। উকিল  যেমন দোষী-নির্দোষ সকলের কেস নেন, সাংবাদিকও তেমনি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, হিন্দুসভা নির্বিশেষে সকলের কেস নিবেন। সাংবাদিক এইভাবে পরের জন্য টাকার বিনিময়ে কলম চালাইতে গিয়া এতটুকুমাত্র দেখিবেন যে ঐ সাংবাদিক কর্তব্যের বাহিরে তাঁর স্বাধীনতা যেন ব্যাহত বা সংকুচিত না হয়। আপনি যদি কংগ্রেসি হন, তবে কংগ্রেস বিরোধী কাগজে আপনি চাকরি নিবেন না। যদি নেন, কংগ্রেস বিরোধী কথাই আপনাকে লিখিতে হইবে।’

১৯৪১ সালের অক্টোবর মাস। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ‘নবযুগ’ পত্রিকায়। এ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে নাম দিতে রাজি হননি, দেনওনি। ছিলেন ‘শ্যাডো এডিটর’। বেতন সাকুল্যে তিনশ’ টাকা। সম্পাদক হিসেবে নাম দেওয়া হয় কাজী নজরুল ইসলামের। নবযুগ ছিল এ. কে. ফজলুল হকের দৈনিক পত্রিকা।

নাম না দেওয়ার পেছনে উনার যুক্তি হলো, নিরপেক্ষভাবে যে কোনো মতের পত্রিকায় কাজ করা যায়। এই উপদেশ তিনি অন্যদেরও দিতেন। কিন্তু নিজে গ্রহণ করেননি। যুক্তি হলো তাঁর একটা ‘রাজনীতিক জীবন আছে’।

অবশ্য নবযুগের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় বেশিদিন তিনি এই মতে অটল থাকতে পারেননি। আবার কৃষক থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় এই বোধোদয়ও হয় যে, পত্রিকা চলবে মালিকের অভিপ্রায় অনুযায়ী। তিনি লিখেছেন, ‘‘হক সাহেবের তখনকার রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যের সাথে ‘নবযুগ’ এর মরা-বাঁচা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল।

‘নবযুগ’-এর বাঁচিয়া থাকা শুধু আমার একার নয়, ‘নবযুগে’র শতাধিক চাকুরিয়ার জীবন নির্ভর করিতেছে। দু’চার জন বাদে এঁরা সবাই মুসলমান। ‘নবযুগ’ না থাকিলে এঁদের বিপদ হইবে। ‘কৃষক’-এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হইতে এটা আমি বুঝিয়াছিলাম। কাজেই অন্তত ‘নবযুগ’-এর জন্যও হক সাহেবের এই নয়া রাজনীতিকে সফল করিতেই হইবে, এই প্রয়োজনের বিচারেই আমি সম্পাদকীয় লিখিয়া চলিলাম।’’

যে হেমেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে আবুল মনসুর আহমদ কৃষক ছেড়েছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি আবার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রূপে নবযুগে আবির্ভূত হন। প্রথম দিনের সৌজন্য পরিচয়েই ঘটে বড় রকমের বিপত্তি। দু-এক কথার আলাপেই তা রূপ নেয় অনভিপ্রেত ঘটনায়। এবং ঘটনা প্রকৃতপক্ষে যা নয়, সেদিকেই মোড় নেয়। দত্তবাবু রেগে বলে উঠলেন, ‘আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন? এ অপমানের আমি বিচার করাইব।’ এ কথা বলে বের হতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত হুমড়ি খেয়ে চৌকাঠের উপর পড়ে মূর্ছা যান।

এই নিয়ে ‘ভোটরঙ্গ’ ও ‘অবতার’ নামের জনপ্রিয় দুই স্যাটায়ার পত্রিকায় লেখা হয় ‘হেমেন্দ্র বধ কাব্য’ ও ‘হেমেন্দ্র-মনসুর-সংবাদ’ নামে অমিত্রাক্ষর ছন্দের কাব্য নাটিকা। এসব ঘটনায় দত্তবাবু আরও রুঢ় হয়ে ওঠেন এবং নবযুগের দুই প্রধান ব্যক্তির মধ্যে কথা ও মুখ দেখাদেখি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

কিছুদিনের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের তরফে পাঠানো টেলিগ্রামে জানানো হয় ‘আপনার সার্ভিসের দরকার নাই।’ উনার সাংবাদিকতা জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের সমাপ্তি হয় এভাবেই। (চলবে…)

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক, [email protected]

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;