সাংবাদিকতায় শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদ: নবযুগ এনেছিলেন যিনি



ড. কাজল রশীদ শাহীন
সাংবাদিকতায় শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদ: নবযুগ এনেছিলেন যিনি

সাংবাদিকতায় শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদ: নবযুগ এনেছিলেন যিনি

  • Font increase
  • Font Decrease

(প্রথম পর্ব)

কিংবদন্তি সাংবাদিক, সম্পাদক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে ২০২৩-এ। ঐতিহাসিক গুরুত্বের সঙ্গে সমকালীন সাংবাদিকতার জন্যও তিনি কম প্রাসঙ্গিক নন।

কর্মগুণে ও সৃজননৈপুণ্যে তৎকালেই তিনি আবুল মনসুর আহমদ হয়ে ওঠেছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। একবিংশ শতাব্দির এই দুই এর দশকে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাঁর পরিধিবহুল জীবন ও কর্ম থেকে আজকের সাংবাদিকদেরও নেওয়ার মতো রয়েছে অনন্য সব নির্দেশনা। একনিষ্ঠতা, কর্মোদ্যোগ, প্রেম ও সাধনায় তিনি যুগপ্রবর্তক সাংবাদিক ও সম্পাদকের আসনে সমাসীন হন।

তিনি সংবাদপত্র শিল্পকে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিকভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন  এক অনন্য উচ্চতায়। যা থেকে একজন সংবাদপত্র মালিকের, একজন সাংবাদিক-সম্পাদকের, একজন অধ্যাপকের, একজন তাত্ত্বিক-গবেষক ‘বই লিখিয়ে’ কিংবা লেখক-দার্শনিক-যুক্তিবাদীর নেওয়ার রয়েছে অমূল্য সব অভিজ্ঞতা ও উপাদান।

সাংবাদিক ও সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের হাত ধরেই শুরু হয় সংবাদপত্রের ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে ওঠার প্রবণতা বা সংস্কৃতি। সংবাদপত্রকে টেকসই প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল রূপ-রূপান্তর ও বাস্তবায়নে যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি ছিলেন সেসকল মেধাবী সাংবাদিক-সম্পাদকদের অন্যতম।

সদর্থক অর্থেই সংবাদপত্রকে বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব ও কর্মপ্রতিভা দিয়ে ‘ইন্ডাস্ট্রি’তে পরিগণিত করেন। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের প্রযত্ন ও নেতৃত্বে তিনি পালন করেছেন একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা। তাঁর নেতৃত্বে বৃহদায়তনে সংবাদপত্র সমৃদ্ধ হয়েছে বহুভাবে। যেমন ইংরেজি পত্রিকা ‘দি মুসলমান’, পাশাপাশি বাংলা সংবাদপত্রের বিকাশে যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা, ‘কৃষক’ ও ‘নবযুগ’। বাঙালি মুসলমানের সংবাদপত্র সৃজন ও সংলগ্নতা পেয়েছে ইতিহাস নির্মাণের সুযোগ, যেমন ‘ইত্তেহাদ’।

তখনকার শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক খবরের কাগজ ‘বঙ্গবাসী’তে একবার এমন খবরও লেখা হয়েছিল, ‘সভায় কতিপয় ভদ্রলোক ও অনেক মুসলমান যোগ দিয়েছিলেন।’ আবুল মনসুর আহমদ এর প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। উনি কখনোই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি বর্গে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায়, মর্যাদা রক্ষায় ও সাম্য অনুশীলনের পদক্ষেপে শিরদাঁড়া সোজা রাখায় ছিলেন বিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন, সকলকে সমঅধিকার দেওয়ার মধ্যে রয়েছে মানবিকবোধের প্রকাশ।

সাংবাদিকতায় তাঁর পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যাশা ছিল হিন্দুরা তো এক্ষেত্রে সামনের সারিতে রয়েছেন, এখন সকলের দায়িত্ব মুসলমানদেরও এগিয়ে নেওয়া। দেশের কোনো একটা ক্ষেত্রে একক কোনো বর্গ, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যদি এগিয়ে যায় তাহলে সেখানে যে ‘সমতা’র চর্চা হয় না, সেকথা বলাবাহুল্য। এ লক্ষ্যেই তিনি চেয়েছেন সাংবাদিকতায় বাঙালি মুসলমানও এগিয়ে আসুক। অন্যদের সমান্তরালে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিক। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু সংবাদপত্রে মুসলিম শিক্ষার্থীদের চান্স ছিল না।’ তার প্রযত্নে অনেক সাংবাদিকই পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক হিসেবে খ্যাত হয়েছেন, সংবাদপত্র শিল্পে গৌরবজনক অবদান রেখেছেন।

এঁদের কয়েকজন হলেন (‘আত্মকথা’য় যেভাবে লিখেছেন) : মি. ওয়ালী উল্লাহ, মি. মোহাম্মদ মোদাব্বের, মি. জনাব আলী, মি. খোন্দকার ইলিয়াস, মি. কে. জি. মোস্তফা, মি. সিরাজুদ্দীন হোসেন, মি. রশীদ করীম, মিস হাযেরা খাতুন, মিস মরিয়ম খানম, কবি আহসান হাবীব, মি. রুকনুযযামান খান, মি. মোহাম্মদ নাসির আলী, মি. কাযী মোহাম্মদ ইদ্রিস, মি. তালেবুর রহমান, মি. খোন্দকার আবদুল হামিদ, মি. জহুরুল হক, কবি গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ। এ তালিকা অনেক দীর্ঘ। নক্ষত্রপ্রতীম এসকল নামের তালিকাসূত্রে আবুল মনসুর আহমদকে বাঙালি মুসলিম সাংবাদিকতার দ্রোণাচার্য বলাই শ্রেয় ও যুক্তিযুক্ত। প্রকৃতার্থেই তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক-সম্পাদক। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শতবর্ষ একারণেই বিশেষ স্মরণের দাবি রাখে।

তিনি ব্রিটিশ শাসনের শেষ কয়েক দশকের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। পেশাগত কারণে সেই সময়ের প্রায় পুরোটা কাটিয়েছেন শহর কলকাতায়। যে শহর তখন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানীর গৌরব হারালেও যুক্ত বঙ্গের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ছিল সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শুরু। সক্রিয় ও পেশাদার সাংবাদিকতার দাঁড়িও পড়ে এখানে। শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন ময়মনসিংহে। শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় আই.এ. এবং বি.এ. পর্বে থেকেছেন ঢাকায়।

আবুল মনসুর আহমদের আট দশকের জীবন-রেখার তারুণ্যদীপ্ত ও সাংবাদিকতার কর্মমুখর অধ্যায়ের সাক্ষী কলকাতা। এই কলকাতাতেই ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রতিষ্ঠা পায় হিন্দু কলেজ। যার মধ্য দিয়ে ইতালীয়-ইউরোপীয় নবজাগরণের মতো অসাধারণ এক নবজাগরণ ঘটে। যা সর্বজনে ‘বাংলার রেনেসাঁ’ হিসেবে পরিচিত। এর ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের অন্যতম হলেন : ডেভিড ড্রামন্ড, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, রামতনু লাহিড়ি, শিবনাথ শাস্ত্রী, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে সংবাদপত্র। ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির নবজাগরণ ইতিহাস মুখ্যত বাংলা সংবাদপত্রেরই ইতিহাস।’

বেদনার বিষয় হল,  বেঙ্গলি রেনেসাঁয় পূর্ববঙ্গকে উপেক্ষা করা হয়েছে নিদারুণভাবে। পূর্ববঙ্গে প্রতিনিধিত্বমূলক কয়েকজন রেনেসাঁ পুরুষের জন্ম হলেও তাঁদের জীবন ও কর্মকে যথোচিত মূল্যায়ন করা হয়নি। কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে নদীয়া, পাবনা, নাটোর, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর অঞ্চলের জমিদার, নীলকর, রায়তপ্রজা, গোরাসৈন্য ও দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোপরি ক্ষমতার বলয়ে থাকা শাসক-প্রশাসক ও তাদের সহযোগী ও অনুচরদের অত্যাচারের নির্মমচিত্র তুলে ধরে প্রজাসাধারণের হিতসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নারী শিক্ষার লক্ষ্যে কুমারখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৮৫৯ সালে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তারপরও তিনি বেঙ্গলি রেনেসাঁর অংশীজন হয়ে ওঠেননি। ঠাঁই হয়নি লালন সাঁইয়েরও। এরকম অনেক বিষয় পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনাবোধ থেকে আবুল মনসুর আহমদ পূর্ববঙ্গ বা ঢাকাকে কলকাতার ‘হিন্টারল্যান্ড’ মনে করতেন।

বেঙ্গলি রেনেসাঁর দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা হলো:

এক. এই রেনেসাঁ ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক।

দুই. একে বেঙ্গলি রেনেসাঁ বলে অভিহিত করা হলেও এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, মূলত কলকাতা ও তার আশেপাশেই সীমাবদ্ধ ছিল-এর ব্যাপ্তি ও বিস্তার।

তিন. অবিভক্ত বঙ্গে প্রধানত দুই ধর্মের মানুষের সহাবস্থান থাকলেও বেঙ্গলি রেনেসাঁয় প্রতিনিধিত্ব করেছে ব্রাহ্ম ও সনাতন ধর্মের অনুসারী এবং কয়েকজন অজ্ঞেয়বাদী, এখানে বাঙালি মুসলমানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বেঙ্গলি রেনেসাঁর সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতার কারণে এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে একটা নবজাগরণ বা রেনেসাঁ সংঘটিত হয়। যার নাম ‘বাংলাদেশের নবজাগরণ’। এই নবজাগরণ ১৯২১ থেকে ১৯৭১ অবধি সময়ে সূচনা, বিকাশ ও নির্মাণ এই তিন পর্বের মধ্যে দিয় তার মহোত্তম অভিপ্রায় সম্পন্ন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের নবজাগরণের সূচনা হয় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের মধ্যে দিয়ে তার পূর্ণতা ঘটে। বাংলাদেশের নবজাগরণের দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন আবুল মনসুর আহমদ সেই সকল মনীষার অন্যতম। সাংবাদিকতা ও বহুমাত্রিক লেখালেখির মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমন্ডলে রেখে গেছেন সক্রিয় ও দিক নির্দেশক ভূমিকা। তাঁর সাংবাদিকতার শতবর্ষে এসেও আলোকবিস্তারী সেসব বিষয়ে যদি আমরা অন্বেষণ ও অবলোকন না করি তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের নির্মাণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। যেকোনো জাতির গৌরবের আধার নিহিত থাকে তার অতীতে। সমৃদ্ধ অতীতই কেবল জাতির আলোকিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। আবুল মনসুর আহমদ এ জাতির বিকাশমান পর্বে সাংবাদিকতা ও অন্যান্য রচনাশৈলির মাধ্যমে রেখে গেছেন এক যুগন্ধর ভূমিকা। যা বাংলা ও বাঙালির জন্য অনুপম এক অতীত।

আজকের বাংলাদেশে যদি উন্নত সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক পরিমণ্ডল নির্মাণে, স্বাধীনতায়, গণতন্ত্র চর্চায়, অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায্যতাভিত্তিক মহোত্তম এক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষায় উপনীত হতে চাই তা হলে আবুল মনসুর আহমদ পাঠ কেবল জরুরি নয়, অত্যাবশ্যকও বটে। তিনি কেবল জাতীয়তাবাদী নন, স্বাতন্ত্র্যবাদীও ছিলেন। যে কোনো পরাধীন জাতির জন্য জাতীয়তাবাদী হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি স্বাধীন জাতির জন্য স্বাতন্ত্র্যবাদী হওয়াও কতটা অপরিহার্য তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন এবং তার যথাযথ দিকনির্দেশনাও রেখে গেছেন। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষে সেসবের দিকে দৃষ্টি ফেরানো জরুরি। তাঁকে পাঠ এবং সাংবাদিকতা-সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালনের বর্ণাঢ্য অধ্যায় সম্পর্কে সবিস্তারে জানা বর্তমান ও উত্তরপ্রজন্মের জন্য কেবল গুরুত্ববহই নয়, অবিকল্পও বটে। তাঁর সাংবাদিকতার শতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণ হতে পারে সেই বোঝাপড়া ও চর্চার বিশেষ লগ্ন।

আবুল মনসুর আহমদ ১৯২৩ সালে শুরু করেন সক্রিয় সাংবাদিকতা। প্রবেশিত হন অনেকটা নিজের চেষ্টায় এবং বন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহযোগিতায়। নিজের চেষ্টাটা কী? দুটো প্রবন্ধ লেখেন: এক. ‘ছহি বড়ো তৈয়বনামা’ ও দুই. ‘সভ্যতার দ্বৈতশাসন’। প্রথমটি ছিল পুঁথির ভাষায় রাজনৈতিক স্যাটায়ার। দ্বিতীয়টি হলো দীর্ঘ দার্শনিক রাজনৈতিক প্রবন্ধ। যা সক্ষম হয় মুসলিম সাংবাদিকদের বিশেষভাবে নজর কাড়তে।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের প্রথম পত্রিকা ‘ছোলতান’। পদ সহ-সম্পাদক। বেতন ত্রিশ টাকা। কর্তৃপক্ষ কাজে সন্তুষ্ট হয়ে কিছুদিনের মধ্যে দশ টাকা বাড়িয়ে করেন চল্লিশ টাকা। ছোলতানে চাকরি করার সময়ই মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তিনি মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর কাছে আবুল মনসুর আহমদকে ‘চাহিয়া নেন’। কারণ তাঁর লেখার বিষয়বস্তু ও ওজস্বিতা তাকে মুগ্ধ করে।

‘ছোলতান’-এ দেড় বছরের চাকরি জীবন শেষ করে যোগ দেন ‘মোহাম্মদী’তে। পদ সহ-সম্পাদক। বেতন পঞ্চাশ টাকা। এখানে সহকর্মী হিসেবে পান ফজলুল হক সেলবর্ষী ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে। সাক্কূল্যে স্টাফ ছিলেন দুই সিনিয়রসহ তিনজন। সিনিয়ররা জুনিয়রদের কাজ চাপিয়ে দেবেন, সুযোগ পেলে সব কাজই করাবেন এটাই সংবাদপত্রের প্রচলিত রীতি; যা শতবর্ষ আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু এটাকেই আশীর্বাদ জ্ঞান করেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর ছিল ‘‘বড়ো বোঝা’ বহিবার জন্য কাঁধ পাতিয়া দেয়ার অভ্যাস।’’ (চলবে…)

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক, [email protected]

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;