দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন



রামকৃষ্ণ জানা
দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

  • Font increase
  • Font Decrease

রামকৃষ্ণ জানা

[বিশ্ব নদী দিবস প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার। বিশ্ব নদী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘রাইটস অব রিভার'। বিশ্বেরা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড.  রূপকুমার বর্মণ নদী ও ইতিহাসের চর্চায় উন্মোচন করেছেন মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাহুমাত্রিক বিন্যাস।]

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নদী-অববাহিকাগুলোতে ঘটে চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে নদীকে বহুমুখী ব্যবহারের মাত্রাবৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত নদীজনিত সমস্যার কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের াা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জোরপূর্বক অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটকে ড. রূপকুমার বর্মণ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন।   

মোট তিনটি অধ্যায় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সারণীসহ এই বইটিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলার জেলেসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে নদীর অপরিসীম প্রভাব। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যগুলি যে তৎকালীন সমাজের দর্পণ-লেখক তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সাহিত্যের নিরিখে  বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসকে লেখক উক্ত অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু নদীর সম্পর্কের আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে কেন্দ্র করে নদী-উপকূলবর্তী মানুষের জীবনসংকট ও তারই প্রভাবে যে তাদের অভিবাসন ঘটেছিল সেই প্রেক্ষিতকে নদীর ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তিতাস-অববাহিকায় মালোসম্প্রদায়-অধ্যুষিত চরটি একে একে জনশূন্য হয়ে উঠেছিল-তাও এতে পরিস্ফুটিত। বর্তমানে পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে বর্ণিত এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন সংকটের কথাকে স্মরণ করিয়ে ডঃ বর্মণ এই সাহিত্যকে ইতিহাসের এক অন্যতম আধারে পরিণত করেছেন। 

ই. এইচ. কার(E. H. Carr)-এর ইতিহাসচর্চার মূল নির্যাস-‘ইতিহাসকে জানার আগে ঐতিহাসিক কে. জানো’-এ সম্পর্কে গ্রন্থকার পূর্ণমাত্রায় সচেতন। তিনি মালোজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুকানন হ্যামিল্টন(Francis Buchanan-Hamilton), নৃতত্ত্ববিদ জেমস(Dr.James Wise) ও রিসলে(H.H. Risley) প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জেলেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক সরকারের হীনবিভাজন নীতি থেকে মুক্তি পেতে তারা যে ১৯১৩ সালে ‘ঝালো-মালো ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতায়ন ঘটিয়েছিল লেখক তা বর্ণনা করেছেন।   

অধ্যাপক বর্মণ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসাম ও বাংলার নদী-উপত্যকাগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের সার্বিক জীবনের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে ঐ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলোকে তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন। দেবেশ রায় রচিত ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-কে লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন যে একটি নদী  কীভাবে আঞ্চলিক স্তরের সংগ্রাম থেকে মানুষকে আন্তর্জাতিক স্তরের সংগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। তিস্তা নদী রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল এক দেবীস্বরূপা আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রভূত মানুষের কাছে এই নদী-উপকূল হয়ে উঠেছিল আশ্রয়দাত্রী জননীস্বরূপা। এই প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায় ও আগন্তুক উদ্বাস্তু বাঙ্গালীর দ্বন্দ্বকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে  ধরেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত বিভিন্ন ভূমিসংস্কারমূলক পদক্ষেপ (যেমন-‘অপারেশন বর্গা’) এই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় এবং ইউ. কে. ডি. (UKD) ও ইউ. টি. জে. এ. এস. (UTJAS)-নামক আঞ্চলিক দলগুলি অচিরেই তাদের পূর্বতন দাবী তথা কামতাপুর রাজ্যগঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ জলবণ্টনচুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দ্বারা সরকার মানুষের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হলেও সেই উন্নয়নযজ্ঞই কীভাবে নদী-উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করেছিল। অবশেষে ডঃ বর্মণ প্রশ্ন তুলেছেন-বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ কি তবে তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে নাকি এখনও  মানুষ তিস্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?  

এরই সঙ্গে গ্রন্থকার সাহিত্যিক জিতেন্দ্র দাস লিখিত ‘কলহি নদীর একুল হিকুল’-গ্রন্থের ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন আসামের বিশেষত দিপার বিলসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। কালক্রমে এই নদীর চরে অশান্তির বার্তা বহন করে আনে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন এবং এরই  ফলশ্রুতিতে এখানে শুরু হয় বহিরাগত ও স্থানীয় মানুষদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপনের এক তীব্র অসম লড়াই। অসমের একটি নদীচরের মানুষের আভ্যন্তরীণ সংকট কীভাবে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল তা লেখক বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ড.  রূপ কুমার বর্মণ তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ভুটানের ওয়াং-চু (পশ্চিমবঙ্গে রায়ডাক ও বাংলাদেশে দুধকুমার নামে পরিচিত) নদী কীভাবে ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ সমগ্র ভুটানবাসীর জীবনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভুটানের বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে কীভাবে এই নদী ভুটানবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল তার ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন।  লেখকের বর্ণনায় প্রাধান্য পেয়েছে রায়ডাক-১ ও রায়ডাক-২ নদীর গতিপথে অসম ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ভূত ঝাউকুঠি, বলাভুত ও রামরাই কুঠির মত অসংখ্য চরে বসবাসকারী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে কোচ, মেচ, রাভা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এখানকার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে রাজবংশী মানুষের বসতি। ঔপনিবেশিক আমলে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডাদের শ্রমিক হিসেবে আগমনের ফলে এই নদী-অববাহিকার বসতিগুলি এক মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকেও অনেক মানুষকে এই অঞ্চল সাদরে গ্রহণ  করে নিয়েছিল। ডঃ বর্মণের নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এইভাবেই এই নদী-অববাহিকা হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারতবর্ষ।  

লেখক এই অধ্যায়ে আরও দেখিয়েছেন যে একই নদীর জল বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। কোচবিহারের রাজাদের অনুগ্রহে কামাক্ষ্যা মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনের ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে আবার এই রাজারা এই অঞ্চলেই একাধিক শিবমন্দির স্থাপন করে কোচবিহারের প্রধান দেবতা হিসেবে শিবকে স্থান দেন। অন্যদিকে এখানেই শঙ্করদেবের হাত ধরে একসময় যে বৈষ্ণবধর্মের উত্থান ঘটেছিল তা পরবর্তীতে কোচসাম্রাজ্যের রাজধর্মে পরিণত হয়। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বৈষ্ণবসত্রগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। একদা কোচপ্রশাসনের ওপর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁরা নিজেদের নামের সাথে ‘নারায়ণ’ উপাধি সংযোগ করেছিলেন ও কোচমুদ্রার নাম ‘নারায়ণী মুদ্রা’ রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীরও পূজা-পাঠ প্রচলিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ঔপনিবেশিককালে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘ইভানজেলিকালিজম্’ ধারণার বশবর্তী হয়ে রাভা ও মেচ উপজাতিদের কীভাবে খ্রিষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এইসকল প্রান্তিক মানুষদের জীবনে পাশ্চাত্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রবেশের সাথে সাথে তাদের নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতির যে পরিবর্তনগুলি ঘটেছিল সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।

তবে আলোচ্য গ্রন্থে এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক নদীর কথা লেখকের আলোচনায় স্থান পায় নি। তিনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে তুলে ধরলেও তাঁর লেখায় একটি বিশেষ জনজাতির কথা প্রাধান্য পেয়েছে। নদীর অভিশাপ তাহলে কি শুধুমাত্র জেলেসম্প্রদায়ের ওপর পড়েছিল কিংবা ঝালো-মালো সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কেমন-এসকল প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে লেখক নীরব থেকেছেন। তিনি অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট এই অঞ্চলের আদি-অধিবাসীদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলেও বাঙ্গালী উদবাস্তুর যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখায় উহ্য থেকেছে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নযজ্ঞ এই অঞ্চলের জনজাতিবিন্যাসকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হলে তা পাঠকের মনে অধিক আগ্রহের সঞ্চার করত। কামতাপুর রাজ্যের দাবী উত্থানের পশ্চাতে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের অভিবাসনের ঘটনা লেখক ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ডঃ বর্মণ তাঁর লেখা এই বইটিতে দেখিয়েছেন যে কোন অঞ্চলের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলকেন্দ্রিক রচিত সাহিত্যগুলি কীভাবে ইতিহাস রচনার প্রামান্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে প্রতিভাত দলিত মানুষের জীবনসংগ্রামকে নদীকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান দিয়ে লেখক তাঁর অনন্য রচনাশৈলীর পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। নদী কীভাবে জনমানসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সেইসঙ্গে মানুষের জীবনধারণের অর্থনৈতিক কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে তা লেখক তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তাঁর লেখায় নদী হয়ে উঠেছে নদী-অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতীক। আবহমানকাল ধরে নদী মানুষের অভিবাসনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এবং দ্বন্দ্বপ্রসূত অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আদি-অধিবাসী ও আগন্তুক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দলিল এই উপন্যাসকেন্দ্রিক ইতিহাস-বিশ্লেষণ। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন(১৯৬৯) এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন(১৯৭৯-১৯৮৫) উদ্ভবের ক্ষেত্রে নদী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠে তা লেখকের ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেইসঙ্গে নদী কীভাবে ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে তার এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-বিশ্লেষণ লেখকের লেখনীতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও অসমের পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় এই বই যে কতখানি মূল্যবান তা পাঠক  বইখানি পাঠের পর সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।     

......

গ্রন্থ সমালোচনা

Rup Kumar Barman, River, Society and Culture: Environmental Perspectives on The Rivers of Assam and Bengal. Delhi: Primus Books, 2023, xix+95pp, ISBN: 978-93-5687-835-8(Paperback)

.........

রামকৃষ্ণ জানা ,গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;