আসক্তি



মৌরী তানিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ দুপুরের পর পরই অফিস থেকে ফিরেছে তিন্নি। মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বিকেলবেলা বেডরুমে জানালার পাশে রাখা ইজি চেয়ারটাতে বসল সে। তিন্নি বার বার ঘড়ি দেখছে। যদিও আটটা বাজতে অনেক দেরী আছে তবুও দেখছে। আটটার সময় ইভান ইংল্যান্ড থেকে ফোন করে রোজ। অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই সে ঘড়ি দেখতে শুরু করে। এটা তিন্নির অভ্যাস। হঠাৎ পাশের ছাদে বিষণ্ন একটি শালিকের দিকে চোখ পড়তেই তিন্নির মন খুশিতে নেচে উঠল। তিন্নির মনেহলো শালিকটির সঙ্গীটি হয় মরে গিয়েছে, নয়তো ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে সঙ্গীর কথা ভেবে বিষণ্ন মনে একা একা বসে আছে। এমন বিষণ্ন শালিককে দেখলে যে কারও মন বিষণ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু তিন্নির তা হলো না। কারণ তিন্নি ভাবে, সে মারা গেলে ইভানও ওর কথা মনেকরে এমন বিষণ্নভাবেই একা একা বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। ভাবতেই তিন্নির বুকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা দোলা দিল। তিন্নি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সে মারা গেলে ইভান কোনদিন বিয়ে করবে না। তিন্নিই ইভানের জীবনের প্রথম ও শেষ ভালবাসা।

তিন্নি নিজেকে প্রশ্ন করে, ইভান মারা গেলে সে কি অন্য কাউকে বিয়ে করবে?

না কখনও না। ইভান ছাড়া সে কখনও অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না।

বিষণ্ন শালিকটির দিকে আবার তাকিয়ে তিন্নির বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। এমন বিষণ্ন আর একা! পরক্ষণেই ভাবল, হয়তোবা কাউকে বিয়ে করতেও পারে সে। তবে তার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু ইভানের ক্ষেত্রে এমন ক্ষীণ সম্ভাবনাও তিন্নি দেখতে পায়না। বেঁচে থাকতেও তিন্নি যেমন ইভানের মন দখল করে আছে, মারা গেলেও তিন্নি এমনিভাবেই ইভানের সারা মন জুড়ে থাকবে। ইভানের মনে অন্য কোন নারীর জায়গা নেই। ওর পুরো মন জুড়ে শুধু তিন্নি আর তিন্নি!

ইভান আর তিন্নির প্রেমের শুরুটা হয়েছিল কলেজ জীবনে। কলেজ শেষে দুজন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরিতে ঢোকে। দুজনই খুব তুখোড় স্টুডেন্ট। চাকরি শুরুর পর তারা বিয়ে করে। বিয়ের বছর দেড়েক পর তাদের প্রথম মেয়ে জন্মায়। এর বছর দুয়ের পর দ্বিতীয় মেয়ের জন্ম। দুই সন্তান আর চাকরি নিয়ে তিন্নির গলদঘর্ম অবস্থা। ইভানের এক সিনিয়র বন্ধুর এনজিওতে চাকরি করে তিন্নি। পরিচিত বলেই ছোট বাচ্চা দুটিকে নিয়ে চাকরিটা করতে পারছে সে। কারণ মেয়েরা ছোট হওয়ায় প্রায়ই তিন্নিকে অফিস কামাই করতে হয়। আজ বড় মেয়ের জ¦র তো কাল ছোটটার পেটের সমস্যা। আজ কাজের মেয়ে আছে তো কাল নেই। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতেই তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। হায়ার এডুকেশনের জন্য তিন্নি আর কোন চেষ্টা করেনি। ছোট মেয়ের বয়স যখন তিন বছর তখন ইভান ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যায়। চারবছর হলো ইভান ইংল্যান্ডে। ইভান যাওয়ার দুবছর পর তিন্নি মেয়েদেরকে নিয়ে একবার গিয়েছিল। কমাস পরেই ইভানের পিএইচডি শেষ হবে।

আজ আটটার সময় ফোন করে ইভান তিন্নিকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ভিসার প্রসেস শুরু করতে বলল। অনেকদিন ধরেই ইভান তিন্নিকে বলছে কথাটা কিন্তু অফিসের বিভিন্ন ঝামেলার কারণে তিন্নি শুরু করতে পারছে না। তিন্নি ইভানকে জানাল, আর দেরি করবে না, দ্রুত কাগজপত্র রেডি করে ভিসার জন্য এপ্লাই করবে।

তিন্নি আজ সেই বিকাল থেকে জানালার পাশের ইজি চেয়ারটিতেই বসে আছে। পাশের ছাদে বসে থাকা বিষণ্ন চড়–ই পাখিটা কখন উড়ে গেছে তিন্নি টের পায়নি। মাঝে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। শরীরটা আজ একটু খারাপ লাগছিল বলেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। চেয়ারে বসে বসেই ইভানের সঙ্গে কথা শেষ করল তিন্নি। শরীর খারাপের কথাটা বেমালুম চেপে গেল ইভানের কাছে। বললেই অস্থির হয়ে পড়বে সে। ডাক্তার বন্ধুদেরকে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। আজ মঙ্গলবার হওয়ায় মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারল না ইভান। কারণ বরি,মঙ্গল, বৃহস্পতি সপ্তাহে তিনদিন এই সময় মেয়েরা বাসায় রাখা টিচারের কাছে পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিন্নি দেখল নটা পার হয়েছে। আজ ইভান ফোন ছাড়তেই চাইছিল না। ইশ! এত দেরী হয়েছে! কাজের মেয়েটিকে টেবিলে খাবার দিতে বলে তিন্নি আগামীকালের জন্য মেয়েদের স্কুলের টিফিন, সকালের নাস্তা আর নিজের অফিসের লাঞ্চ রেডি করতে শুরু করল।

পিএইচডিতে খুব ভালো করার কারণে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা শুরু করে ইভান। এরমধ্যে তিন্নিরা যেয়ে মাসখানেক থেকে ফিরে এসেছে। তিন্নি চায় ইভান ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতাটা আরও কয়েক বছর করুক। এত নামকরা ইউনিভার্সিটি! এখানে পিএইচডি করার সুযোগ পাওয়াই কঠিন। সেখানে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছে ইভান! বিশাল ব্যাপার! এতবড় সম্মান! যদিও ইভানকে ছেড়ে থাকতে তিন্নির খুব কষ্ট হয় তবুও ইভানকে এমন উঁচু জায়গায় দেখতে খুব ভাল লাগে তিন্নির। ইভানের জন্য ওর খুব গর্ব হয় । কিন্তু ইভানের দেশ ছেড়ে, তিন্নি আর মেয়েদেরকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। তাই সেখানে বছরখানেক শিক্ষকতা করার পর ফিরে এলো দেশে। ইভান সবমিলিয়ে প্রায় বছর পাঁচেক ছিল ইংল্যান্ডে। ফিরে এসে ইভান প্রথম সারির উন্নয়ন সংস্থায় ভালো বেতনে চাকরি শুরু করেছে।

তিন্নি আর ইভান দুজনই দেখতে খুব সুন্দর। তিন্নির সৌন্দর্যের সঙ্গে যে জিনিসটি সবার নজর কাড়ে তা হলো ওর ভীষন মিষ্টি চেহারা আর হাসি। ওর হাসি দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যায়। আর তাই কিশোরী বয়স থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য ছেলে ওর প্রেমে দেওয়ানা। কিন্তু তিন্নি শুধু ইভানের প্রেমেই দেওয়ানা। ইভান ছাড়া আর অন্য কোন ছেলেকে ভালোবাসতে হয়নি তিন্নির। কারণ ইভানের সঙ্গেই তিন্নির প্রথম প্রেম হয়, যার পরিণতি বিয়ে।

যদি দাঁড়িপাল্লায় মাপা যেত তবে হলফ করে বলা যেত অন্য মেয়েদের তুলনায় স্বামীর প্রতি তিন্নির ভালবাসার ওজনের পরিমান কয়েকগুণ বেশি। যেহেতু তিন্নি ইভানকে খুব বেশি ভালবাসে তাই ইভানের প্রতি তার বিশ্বাসটাও বহুগুণ বেশি। আর বিশ্বাস না হওয়ারও কোন কারণ নেই।  ইভানের প্রতিটি আচরনে তিন্নির প্রতি গভীর ভালবাসাই প্রকাশ পায়। তিন্নির প্রতি ইভান খুব যত্নশীল। তিন্নিকে ছেড়ে ইভান ইংল্যান্ডে পিএইচডি করতে যেতে চায়নি। তিন্নিই জোর করে পাঠিয়েছে তাকে। তিন্নির প্রতি ইভানের ভালবাসা আর যত্নশীলতা দেখে তিন্নির বান্ধবীরা রীতিমতো জেলাস!

নতুন অফিসে জয়েন করার পর ইভানের ফিরতে রাত আটটা-নটা, কোনদিন দশটাও বাজে। তিন্নি অফিস থেকে ফেরে সন্ধ্যার মধ্যেই। বাসায় এসে সে প্রায়দিন ইভান আর মেয়েদের পছন্দের কিছু খাবার-দাবার বানায়। ইভান ফিরলে চারজন একসঙ্গে রাতের খাবার খায়।

ছুটির এক সকাল। ইভান বাজরে গিয়েছে। ল্যাপটপটা ওর টেবিলের উপর খোলা রয়েছে। হঠাৎ তিন্নির বস ফোন করে জানায়, কি একটা জরুরি ফাইল এখনই মেইল করতে হবে তাকে। তিন্নি নিজের ল্যাপটপ খুলে বসল, ধ্যাৎ ল্যাপটপটা অন হচ্ছে না! প্রয়োজনের সময় এমন যন্ত্রণা যে হবে সে আর বলতে! সে ল্যাপটপটা গুতাগুতি করছে খোলার জন্য। খোলা দূরে থাক, বদমায়েসটা অনই হচ্ছে না। মুখটা অমাবশ্যার রাতের মতো ঘুটঘুটে আন্ধকার করে আছে। এরমধ্যে আবার অফিস থেকে বসের ফোন, তিন্নি এখনই ফাইলটা মেইল না করলে, আমরা খুব বিপদে পড়ব। কি আর করা, অগত্যা তিন্নি ইভানের ল্যাপটপে যেয়ে বসল। মেইলটা লিখছে। ইভান ফেসবুক মেসেঞ্জার ওন করে রেখে গিয়েছে। একটু পর পর ইভানকে করা সুস্মির মেসেজের নোটিফিকেশন আসছে। সুস্মিকে তিন্নি চেনে। ইভানের অফিসেই সে চাকরি করে। তবে সুস্মি অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মেয়েটা দেখতে সুন্দর, স্মার্ট। অফিসে সুস্মির সঙ্গে ইভানের তেমন কোন কাজ থাকার কথা না। কিন্তু একই অফিসে চাকরি করলে অনেক সময় কাজ পড়তেও পারে। আর কাজ ছাড়াও কলিগ হিসেবে সুস্মি মেসেজ পাঠাতেই পারে ইভানকে। তিন্নি মেইল লেখায় মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেইলটি পাঠিয়ে দিল। সুস্মি এইটুকু সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার মেসেজ পাঠিয়েছে। বার বার কম্পিউটারে ভেসে উঠছে, সুস্মি মেসেজড ইউ। তিন্নি ভাবল, হয়ত অফিসের খুব জরুরি  কোন বিষয়ে সুস্মি ইভানকে বার বার নক করছে।

একটু আগেই বাজরে গেল ইভান। সারা সপ্তাহের মাছ, মাংস, তরকারি, মুদির দোকানের কেনাকাটা রাজ্যের বাজার! সবকিছু ছুটির দিনেই করে রাখে ইভান। কারণ সারা সপ্তাহে সময় হয় না তার। অফিস আর সংসারের ব্যস্ততার কারণে তিন্নিও বাজারে যেতে পারে না। বাজারের পুরো দায়িত্ব ইভানের উপর। ফিরতে ফিরতে আরও মিনিমাম দু থেকে আড়াই ঘন্টা লাগবে। বাজার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিশ্চয় ইভানকে ফোনে রিচ করতে পারছে না সুস্মি। খুব জরুরি না হলে এতটুকু সময়ের মধ্যে তার এত অসংখ্যবার মেসেজ দেয়ার কথা নয়।

যত ব্যস্তই থাকুক ইভান অন্যকারও ফোন না ধরলেও সাধারণত তিন্নির ফোন ধরে। এমনকি মিটিং-এ থাকলেও ফোনটা ধরে ফিসফিসিয়ে বলে আমি মিটিং এ।  তিন্নি ভাবল, ড্রাইভার তো ইভানের সঙ্গেই আছে, যদি ইভান একান্তই তিন্নির ফোন শুনতে না পায় তাহলে ড্রাইভারকে জানালে ইভান ফোন ব্যাক করবে। আগে সুস্মির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা জেনে নিই। যদি খুব জরুরি হয়, সুস্মি যদি বলে এখনই ইভানের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাহলে তিন্নি ইভানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুস্মিকে কল দিতে বলবে। খুব জরুরি না হলে তিন্নি শুধু শুধু বাজারের হচপচ অবস্থার মধ্যে ফোন করবে না ইভানকে। ও খুব বিরক্ত হবে।

সুস্মির সঙ্গে কথা বলার জন্য তিন্নি ইভানের মেসেঞ্জারটি ওপেন করল, প্রথমে যা দেখল তাতে তিন্নির পায়ের মাটি নড়ে উঠল। একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবল, সে ভুল দেখছে। চোখ রগড়াল, এরপর বেসিনে যেয়ে মুখ- চোখ ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে এসে আবার মেসেঞ্জারের সামনে বসল। না, ভুল সে দেখেনি। এতটুকু সময়ের মধ্যে ইভানকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশবার লাভ ইমোজিসহ ‘আই লাভ ইউ’ ‘আই মিস ইউ’ লিখেছে সুস্মি। তিন্নি ভাবল, সুস্মি ইভানকে ‘আই লাভ ইউ’, ‘আই মিস ইউ’ আরও অনেক কিছু লিখতেই পারে, তাকেও তো মেসেঞ্জারে ছেলেরা কত কিছু লিখে। ইভানের মতো এমন মেধাবী, সুন্দর, স্মার্ট পুরুষকে সুস্মি কেন, সুস্মির মতো হাজারও মেয়ে এসব কথা বলবে এটা খুবই স্বাভাবিক।

তিন্নি নিজেকে ধিক্কার দিল, ছি! সুস্মির পাঠানো মেসেজগুলোর উপর চোখ পড়তেই কেন সে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল! এত নীচ আমি! সে ভাবল, এত বছরের সম্পর্ক আমাদের! একটা মেয়ের লেখা দুটি বাক্যেই তা নড়ে উঠল! আমার আসলে মাথায় সমস্যা আছে!

এবার সে মেসেঞ্জার স্ক্রল করে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করল। প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি লাভ ইমোজিসহ সুস্মির মেসেজগুলো শেষ হওয়ার পর, যা দেখল তাতে তিন্নির বুকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। তার পুরো শরীর দুলতে শুরু করল, যেন ভুমিকম্প সারা পৃথিবীটার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরটাকেও দোলাচ্ছে। চোখ জোড়া ঘোলা হয়ে এলো। 

বাজারে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইভান সুস্মিকে অজ¯্রবার লাভ ইমোজিসহ ‘আই লাভ ইউ’ লিখেছে। আরও লিখেছে, ছুটে যেতে মন চাইছে। একদিন নয়, এ যেন এক যুগ মনেহচ্ছে। ইশ! কেন যে এই শুক্রবারটা আসে! তোমাকে একমুহূর্ত না দেখে থাকতে পারি না! এমন অজশ্র আবেগঘন কথা। ইভানের এমন মেসেজের মাঝে মাঝে সুস্মিরও আবেগঘন অনেক মেসেজ তিন্নি দেখল।

মেসেজগুলো দেখার পর তিন্নি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, মেঝেতে ঢলে পড়ে। ছুটির দিন হওয়ায় মেয়েরা তখনও ঘুমাচ্ছে। কাজের মেয়েটি রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত। ইভান বাজার থেকে ফিরে তিন্নিকে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে কিছুই বুঝতে পারে না। সে তিন্নিকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। মুখ চোখে পানি ছিটালো। একটু পর তিন্নির জ্ঞান ফিরল।  তিন্নি ইভানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! যেন ইভানকে সে চিনে না! যেন ইভানকে সে কোনদিন দেখেনি! ইভান তিন্নির এমন অদ্ভুত আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিন্নিকে ধরে ঝাকুনি দিতে দিতে বলে, এই তিন্নি কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? এই তিন্নি?

ইভানের মনে একবারের জন্যও এই ভাবনা আসেনি, সে সুস্মির সঙ্গে কথা বলতে বলতে মেসেঞ্জার খোলা রেখে চলে গিয়েছে। তিন্নি হয়ত দেখেছে বলে এমন অদ্ভুত আচরন করছে। এমন ভাবনা তার হওয়ার কথা নয় কারণ ইভানের প্রতি তিন্নির বিশ্বাসটা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সেটা ইভান জানে। স্বামীর প্রতি সাধারণ বিশ্বাস সম্পন্ন মেয়েরাই কোন সন্দেহের উদ্রেক না হলে স্বামীর অনুপস্থিতিতে লুকিয়ে তাদের মেসেঞ্জার চেক করে না। এতে তার নীচুতা প্রকাশ পায়। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যায়। আর তিন্নির তো এমন কাজ করার প্রশ্নই আসে না। ওর নিজের আলাদা ল্যাপটপ আছে, যদি ওর আলাদা ল্যাপটপ না থাকত তাহলে ইভান নিজেই সতর্ক হতো। আর ছুটির দিন সে এতটাই ব্যস্ত থাকে সেটা বলে বুঝানো যাবে না। সারা সপ্তাহের কাজ সে গুছিয়ে রাখে এই একদিনে। নিঃশ্বাস নেয়ার সময় হয়না তার। এরমধ্যে কোন কারণ ছাড়া ইভানের মেসেঞ্জার চেক করার প্রশ্নই আসে না।

তিন্নির দু কাঁধ ধরে ইভান আবার ঝঁকুনি দিয়ে বলল, কি হয়েছে বলো প্লিজ!  এবার তিন্নি দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল, ‘ইভান আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইভান! খুব যন্ত্রণা হচ্ছে! আমি এখন কি করব! আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব ইভান!’

ইভান তিন্নির মুখ থেকে হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, পাগলের মতো এসব কি বলছ! কেন বলছ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

‘তুমি সুস্মিকে এসব ---’ তিন্নি শেষ করতে পারল না কথাটা। আবারও সে ঢলে পড়ল বিছানার উপর।

ইভান ল্যাপটপের কাছে যেয়ে সবকিছু বুঝল।

জ্ঞান ফেরার পর ইভান তিন্নির কাছে এসে হাত জোর করে মাফ চাইল। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলল, এবারকার মতো মাফ করে দাও প্লিজ। আসলে সুস্মি সারাক্ষণ আমার পেছনে এমন আঠার মতো লেগে থাকত, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।

ইভান অনেক মাফ চাওয়ার পর, অনেক বুঝানোর পর তিন্নি ভাবে, বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমি নিজে কেন এত কষ্ট পাব! সংসারের সবাইকে কেন এত কষ্ট দিব! আসলে ইভান কখনই এমন করত না। ইভান এমন ছেলেই নয়। ইভানকে আমি সেই কলেজ জীবন থেকে চিনি। ইভান আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসে না। বাসতেই পারে না। আসলে সব দোষ ঐ সুস্মির। সুস্মি সারাক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে ভালবাসার কথা বলেছে, সবসময় পিছে লেগে থেকেছে বলেই ওর প্রতি ইভানের সাময়িক একটা আবেগ তৈরী হয়েছে। আমার প্রতি, নিজের মেয়েদের প্রতি ইভানের ভালবাসা কত গভীর! ইভানের মতো স্নেহশীল বাবা, দায়িত্বশীল স্বামী কখনও এমন হতে পারে না! সুস্মির মতো ছলনাময়ী, চরিত্রহীন মেয়েদের পাল্লায় পড়ে ইভানের মতো সৎ ছেলেরা এমন একটু আধটু ভুল করতেই পারে! 

তিন্নি নিজেকে প্রতিদিন এভাবে বুঝাতে বুঝাতে একসময় স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিষয়টি না ভুললেও সেটা আর তাকে কষ্ট দেয় না। আবার ইভানকে সে আগের মতো বিশ্বাস করে।

ভালই চলছিল সবকিছু। হঠাৎ একদিন সে মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ পায়। রিয়া নামের খুব সুন্দরী অল্প বয়সী এক মেয়ে তাকে মেসেজ দেয়, আপু আপনার স্বামীকে বলেন, আমাকে যেন আর ডিস্টার্ব না করে। আমি আর তার সঙ্গে থাকতে চাই না। সে একটা নোংরা ও অসৎ চরিত্রের মানুষ, আমি প্রথমে বুঝিনি। বুঝতে পেরে সরে এসেছি । আমি এখন তাকে ঘৃনা করি। আমি এখন অন্য একজনকে ভালবাসি। আমি তাকে সব বলেছি। আমরা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করব। আপনার স্বামী সারাক্ষণ আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলছে। ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক করেছি। কিন্তু সে নতুন নতুন আইডি খুলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। মেইল পাঠিয়ে যন্ত্রণা করছে। প্লিজ আপু আপনার স্বামীকে থামান। 

তিন্নি প্রথমে একদম বিশ্বাস করেনি রিয়ার কথা। মেসেঞ্জারে উল্টা রিয়াকেই গালিগালাজ করে সে। তিন্নির ঘরে, তিন্নির বাসরের খাটে ইভানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি তাকে পাঠায় রিয়া। যেগুলো দেখে তিন্নি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়!

রিয়া জানায়, তিন্নি গত রোজার ঈদে যখন ময়মনসিংহে বাবার বাড়ি গিয়েছিল তখন ইভান রিয়াকে রোজ বাসায় আনত। বিয়ের পর ঢাকায় তিন্নির শ্বশুরের কিনে দেয়া এই ফ্ল্যাটেই তিন্নিরা ওঠে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তিন্নি এখানেই আছে। বাসর রাতের সেই খাটটিতেই তিন্নি এখনও ঘুমায়। তিন্নি যখন ঈদ করতে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল তখন ইভান অফিসের কাজের অজুহাতে ঢাকায় ছিল। তিন্নির বাবার বাড়ি আর শ্বশুড় বাড়ি একই শহরে হওয়ায় ঈদে গেলে দুজায়গা মিলিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়।

এবারও ইভান তিন্নির কাছে মাফ চায়, অনেক বুঝায়। তিন্নি এখন বুঝতে পারে, ইভান আগাগোড়ায় একজন অসৎ চরিত্রের ছেলে ছিল। কিন্তু সে প্রথম থেকে তাকে এত বিশ্বাস করত, এত ভালবাসত, কখনই কোন সন্দেহ মাথায় আসেনি। তিন্নির মনেপড়ে, বিয়ের পর পর তার ছোট বোন মিমিকে ইয়ার্কির ছলে ইভান এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল, মিমির বিষয়টি একদম ভাল লাগেনি। তিন্নির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগও করেছিল মিমি। কিন্তু  তিন্নি উল্টো মিমিকে ধমক দিয়ে বলেছিল, দুলাভাই হয় বলে একটু ইয়ার্কি করে, তুই এমন মাইন্ড করিস কেন! এরপর থেকে তিন্নি খেয়াল করেছে ইভান ওদের বাড়িতে গেলে, মিমি তাকে এড়িয়ে চলে সবসময়। তিন্নি মনে মনে ভাবে, মিমিটা একদম কাঠখোট্টা গোছের হয়েছে। দুলাভাইয়ের একটু ইয়ার্কিও সহ্য করতে পারে না। একই অভিযোগ তিন্নির এক বান্ধবীও করেছিল। তাকেও তিন্নি একইভাবে ধমক দিয়েছিল।

রিয়ার ঘটনাটি জানার পর তিন্নি ইভানকে ডিভোর্স দেয়ার কথা ভাবে। কিন্তু সে তার ভালবাসার কাছে পরাজিত হয়। ইভানকে সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না। ইভান তার জীবনে থাকবে না, ইভানকে সে চাইলেই ছুঁতে পারবে না, চাইলেই সে ইভানের গায়ের গন্ধ নিতে পারবে না, এসব ভাবলেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার ইভানের সঙ্গে থাকতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে। দিনে-রাতে যতবার সে খাটে শুতে আসে ততবার সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। এই খাটে ইভান অন্য মেয়েকে নিয়ে কিভাবে শুয়েছিল। ওর কি একবারও মনেহয়নি আমার কথা!

তিন্নি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারারাত সে ঘুমাতে পারে না। খেতে পারে না। প্রায় সারারাত সে কেঁদেই কাটিয়ে দেয়। দিনের বেলা অফিস আর মেয়েদেরকে নিয়ে থাকে বলে কাঁদতে পারে না। তবে বুকের ভেতরে যেন একটা আগুনের কু- জ্বলতে থাকে সবসময়। একসময় সে মানসিক ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়। মা-বাবা, ভাইবোন সবাই ইভানকে ছাড়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ইভানকে ছাড়ার কথা ভাবলেই তিন্নির হাত পা অবশ হয়ে আসে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ইভানকে ছাড়া সে তার জীবন চিন্তা করতে পারে না। ইভানকে সে আগের মতোই ভালবাসে। কিন্তু পার্থক্য হলো  ইভানের প্রতি এখনকার ভালবাসাটা ভয়ংকর যন্ত্রণা আর কষ্ট মিশ্রিত। ইভানের স্পর্শের জন্য সে উন্মুখ হয়ে থাকে। রাতে ইভান যখন তাকে কাছে টানে তখন সে যেন মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ভুলে যায়। দুটি শরীর যতক্ষণ এক হয়ে মিশে থাকে ততক্ষণ তিন্নির মনেহয় ইভান তারই আছে। আগের মতোই সে ইভানকে সন্তুষ্ট করতে পারে। কিন্তু দুটি শরীর আলাদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাসরের খাটে ইভান আর রিয়ার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সেই ছবিগুলো। এতক্ষণ তিন্নি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল! ঘোর কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন্নি ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রায় রাত এভাবেই কাটে তিন্নির। ইভান তাকে যথারীতি বুঝায়, সে ভাল হয়ে গিয়েছে, আর সে এমন করবে না। তিন্নি ইভানের কথাগুলো বিশ্বাস করে না।

তিন্নির বন্ধুরা ওকে অনেক তিরস্কার করে ইভানের মতো এত নীচ আর ভন্ড একজন মানুষের সঙ্গে থাকার জন্য। তিন্নি বলে, আমি নিজের কাছে অসহায়। আমি ওকে ছাড়তে পারছি না। ওর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে থাকতেও পারছি না। তিন্নিকে হাই ডেজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার কিন্তু ওষুধেও ঘুম হয় না ওর।

ইভানকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে ফলো করে তিন্নি বুঝতে পারে সে একসঙ্গে অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। বসুন্ধরার একদম শেষ মাথায় তাদের আর একটি ফ্ল্যাট আছে, ওখানেই সে বিভিন্ন মেয়েদেরকে নিয়ে যেয়ে সময় কাটায়। ফ্ল্যাটটি ফাঁকা রেখেছে সে। ইভান বাবা-মার একমাত্র ছেলে হওয়ায় ওর সিদ্ধান্তই বাবা-মা মেনে নেয়।

ইভান এখন আর কিছু লুকাতে পারে না। লুকাতে না পারার আর একটি কারণ হলো, একসঙ্গে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে ওর সঙ্গে একেক সময় একেক মেয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন তারা তিন্নিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তারা তিন্নিকে ইভানের নামে অভিযোগ করে। গত দশ-পনের বছরে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ,ভাইবারের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে ইভানের আরও বেশি পতন হয়েছে বলে তিন্নি মনেকরে।

এরমধ্যে একটা মেয়ে ওকে জানায়, ইভানের সঙ্গে থাকার কারণে সে দুবার বাচ্চা নষ্ট করেছে। সেই মেয়ে তিন্নিকে আরও বলে, আপনি তাড়াতাড়ি  ইভানকে ডিভোর্স দেন। এভাবে আমি আর থাকতে পারছি না। আমি বিয়ে করে ইভানের সঙ্গে থাকতে চাই। ইভানকে বহুবার বলেছি, আপনাকে ডিভোর্স দিতে কিন্তু তার এক কথা সে আপনাকে ডিভোর্স দিবে না কখনও। তিন্নি অবাক হয়ে ভাবে, যা শুনছে তা কি বাস্তব! নাকি সে স্বপ্ন দেখছে!

ইভান প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিল তিন্নি কখনও ইভানকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, যাবে না কখনও ইভানকে ছেড়ে। রিয়ার সঙ্গে তার বাসরের খাটে অন্তরঙ্গ ছবিগুলো দেখার পরও তিন্নি তাকে ছেড়ে না যাওয়ায় ইভানের এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এ কারণে ইভান যেন আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এখন সে প্রায় দিনই গভীর রাত করে বাসায় ফেরে।

তিন্নি নিয়মিত মানসিক ডাক্তারের কাছে যায়। গাদা গাদা ওষুধ খায়। এরপরও প্রায় দিন তিন্নির প্যানিক অ্যাটাক হয়। তিন্নি সারারাত কাঁদে। নামাজে বসে কাঁদে। তিন্নির মা-বাবাসহ সবাই অনুরোধ করে ইভানকে ডিভোর্স দিতে।  কিন্তু তিন্নি পারে না। তিন্ন অসহায়! নিজের কাছে ভীষণ অসহায় সে!

তিন্নি একদিন ইভানকে বলে, আমি যেহেতু তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারছি না, তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও প্লিজ। তাহলে আমার আর করার কিছু থাকবে না। তোমার কাছ থেকে আমি চলে যেতে বাধ্য হব। কিন্তু ইভান বলে, আমি তোমাকে কখনও ডিভোর্স দিব না।

 কেন?

আমি তোমাকে ভালবাসি।

ইভানের মুখ থেকে ভালবাসা শব্দটি শোনার পর তিন্নির বমি চলে আসে। সে বাথরুমে যেয়ে হল হল করে বেসিন ভরে বমি করে।

এত ঝড়ঝাপটার মধ্যে আগের মতো না হলেও তিন্নি এখনও যথেষ্ট সুন্দরী আছে। ওর মিষ্টি হাসি দেখলে এখনও যেকোন পুরুষের বুক উত্তাল সাগরের মতো উথাল-পাথাল করে। তিন্নির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সিঁথি বলে, তুই অন্য কোন ছেলের প্রেমে পড়লেই ইভানকে ছাড়তে পারবি, তার আগে নয়। আসলেই কি তাই! তিন্নি জানে না। সিঁথির পরামর্শে তিন্নি ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছে। উদ্দেশ্য বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ধীরে ধীরে প্রেমে গড়াবে। ফেসবুকে ও পরিচিতদের মাধ্যমে অনেক ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে তিন্নির। কিন্তু কোন ছেলে এগুতে চাইলে তিন্নি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তিন্নি পারে না, ইভানকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না সে।

এখন প্রায়ই বিভিন্ন মেয়েরা মেসেঞ্জারে তিন্নির কাছে ইভানের নামে অভিযোগ করে। অল্প বয়সী বিভিন্ন মেয়েরা ইভানের টার্গেট। প্রথমে ইভান বিভিন্ন অল্প বয়সী মেয়েদেরকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠায়, ওরা এমন হাই প্রোফাইলের একজনকে তার সঙ্গে অ্যাড করতে পেরে গর্বিত হয়। এরপর ইভান যখন সেসব মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তারা খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলে। কথা চালাতে চালাতে কিছু কিছু মেয়ে তার টোপে পা দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারে সে ভয়ংকর চরিত্রহীন একজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা ইভানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন ইভান তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়। কখনও কখনও ভয়ও দেখায় তাদেরকে। তখন তারা তিন্নির কাছে অভিযোগ করে ইভানের সম্পর্কে। কেউ কেউ তিন্নির কাছে সাহায্যও চায়। এসব শুনে এখন আর তিন্নি অবাক হয় না, বিস্মিত হয় না, ক্ষুব্ধ হয় না! শুনে শুধু হাসি পায় তার, করুন সে হাসি!

ফেসবুকে দীপন নামে একটা  ছেলের সঙ্গে তিন্নির পরিচয় হয়েছে। দীপন তাকে জানায় কলেজ জীবন থেকে তিন্নিকে পছন্দ করে সে। কিন্তু তিন্নি ইভানকে ভালবাসত বলে কথাটা তাকে বলতে পারেনি দীপন। তিন্নির জন্যই সে রুয়েট, কুয়েটে চান্স পাওয়ার পরও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। শুধু তিন্নিকে দেখতে পাবে সে আশায়। দীপন সবসময় আশায় আশায় থেকেছে যদি ইভানের সঙ্গে তিন্নির কখনও ব্রেকআপ হয় তখন সে তিন্নিকে তার ভালবাসার কথা জানাবে। কিন্তু তাদের এত গভীর প্রেম! সেই সুযোগ আর পায়নি দীপন।

সুন্দরী আর মিষ্টি চেহেরার মেয়ে তিন্নির প্রেমে কিশোরী বয়স থেকে অনেক ছেলে হাবুডুবু খেত। তিন্নি সেটা জানত। কিন্তু তিন্নির প্রতি দীপনের এত গভীর প্রেম! ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে শুধু তিন্নির জন্য ঢাকা ভাসির্টিতে ভর্তি হয়েছে সে! কথাটা শুনে তিন্নির কেন জানি খুব ভাল লাগল। অনেকদিন পর তার ভেতরে অন্য কোন ছেলের জন্য অন্যরকম এক ভাল লাগার অনুভুতি জাগল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দীপনকে তিন্নি চিনত। কিন্তু বিষয়টি জানত না। দীপন খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। দীপন আরও জানায়, সে বিয়ে করেছে। প্রায় পনের বছরের সংসার জীবন তাদের। কিন্তু কিছুদিন হলো তাদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। তারা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফেসবুকে তিন্নিকে অনেক খুঁজেছে দীপন। কিন্তু এতদিন পর সে পেল। আসলে তিন্নির প্রোফাইল এতদিন লক করা ছিল। বান্ধবী সিঁথির পরামর্শে কিছুদিন হলো সে প্রোফাইলটা পাবলিক করেছে। এখন তিন্নির মনেহচ্ছে, ইভানের সঙ্গে এভাবে থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু ইভানকে সে এখনও ছাড়তে পারছে না। সে বুঝতে পারছে কারও প্রেমে না পরা পর্যন্ত ইভানকে সে ছাড়তে পারবে না। সিঁথি শুরু থেকেই তাকে এই কথা বলত। কিন্তু এখন তিন্নি নিজেও এটা বিশ্বাস করে। যদিও বলে কয়ে, এভাবে প্রস্তুতি নিয়ে তো আর প্রেম হয় না। কিন্তু প্রেমের বিষয়টা সে এখন সিরিয়াসলি মাথায় নিয়েছে। আর সেকারণে মনের মানুষকে খুঁজে পেতে সে তার প্রোফাইল পাবলিক করেছে।

মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়েছে। বড়টা ভার্সিটির প্রথম বর্ষে, আর ছোট মেয়ে কলেজে পড়ে। বেশিরভাগ সন্তানই চায় না মা-বাবা আলাদা থাকুক। কিন্তু ওর মেয়েরা বাবার এসব কুর্কীতি দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। ওরা এখন মাকে নিয়মিত চাপ দিচ্ছে, আলাদা থাকতে। এখনও তিন্নি পারবে তা ভাবছে না। তবে সে সিরিয়াসলি চেষ্টা করছে।

দীপনের সঙ্গে কথা বলতে তিন্নির খুব ভাল লাগে। দীপনের সঙ্গে পরিচয়ের তিন-চার মাসের মধ্যেই তিন্নি তাকে ইভানের বিষয়টি বলে। দীপন মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। বন্ধুর মতোই চলতে থাকে তাদের সম্পর্ক। একসময় দীপন আর তার বউয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তিন্নি খবরটা শুনে খুশি হয় কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। এখন একদিন দীপনের সঙ্গে কথা না বললে তিন্নির খারাপ লাগে, খুব খারাপ লাগে। দীপনের বউ নেই। ইভানও সারাদিন অফিসে থাকে, অনেক রাত করে ফেরে। তিন্নি অফিসের ফাঁকে ফাঁকে দীপনের সঙ্গে কথা বলে, বাসায় ফিরেও ইভান আসার আগ পর্যন্ত কথা বলে। একসময় তিন্নি খেয়াল করে দীপনকে সে ভালবাসে। ইভানের জন্য তার আর কোন ভালবাসা নেই। ইভানের দেয়া কষ্টগুলো তাকে আর কষ্ট দেয় না। তিন্নির সারা মনপ্রাণ এখন দীপন দখল করে নিয়েছে।  তিন্নি দীপনকে সে কথা জানায়। দীপন বলে, আমি এদিনটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তিন্নি ইভানকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইভানকে সে সিরিয়াসলি ডিভোর্সের বিষয়টি জানায়। ইভান প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে আগের মতোই ইভানকে ভয় দেখানোর জন্য বা রাগ করে বলছে। কারণ ইভান জানে তিন্নি তাকে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সে যখন বুঝতে পারল, তিন্নি সত্যি সত্যি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইভানকে ছাড়ার, তখন অবাক হয়ে সে তিন্নির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপর সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। সে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি সব ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকব।

তিন্নি ইভানের কথা আর বিশ্বাস করল না। কারণ আগে বহুবার একথা শুনেছে তিন্নি। তিন্নি ইভানকে এমন কথাও বলেছে, তুমি সব মেয়েদেরকে ছেড়ে ভাল হয়ে যাও ইভান। আমি তোমার আগের দেয়া সব কষ্ট ভুলে সুখী হতে পারব। আমি যদি শুধু বুঝতে পারি, অন্যকোন মেয়ের সঙে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, তুমি এখন শুধু আমাকেই ভালবাস, তাহলেই আমি পৃথিবীর সেরা সুখী হতে পারব ইভান! প্লিজ ইভান ভাল হয়ে যাও। আমরা আমাদের মেয়েদেরকে নিয়ে বাকি জীবনটা সুখে কাটিয়ে দেই। কিন্তু ইভান শোনেনি। নতুন নতুন মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তিন্নির কাছে ফাঁস হওয়ার পর সে বলেছে, আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি সব ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকব। কিন্তু কিছুদিন পর আবারও সে জড়িয়ে পরে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে।  

ইভানের একথা আর বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। আর বিশ্বাস করেও এখন আর লাভ নেই কারণ তিন্নি এখন দীপনকে ভালবাসে। ইভানের প্রতি ওর আর কোন ভালবাসা নেই।

তিন্নি ডিভোর্সের জন্য উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। এখন ইভান অফিস থেকে রাত আটটা-নটার মধ্যেই বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরতে সে আর গভীর রাত করে না। ফেসবুক চালায় না। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কোন কিছুতেই সে আর এ্যাকটিভ থাকে না। আগে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরোটা সময় সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যমে সে এ্যাকটিভ থাকত। একসঙ্গে সবগুলো মাধ্যম সে অন রাখত। তিন্নি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে ইভান অফিস শেষে বাসায় এসে শুয়ে অথবা বসে থাকে চুপচাপ। খাওয়া-দাওয়াও করে না ঠিকমতো। অফিসে যতক্ষণ থাকে তখনও ফোন ছাড়া তার সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকে। তিন্নি ভাবে এটা তার নতুন চাল।

তবে তিন্নি কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন ইভান এতদিন তিন্নিকে ডিভোর্স দেয়নি! অনেক ভেবেছে সে কিন্তু কোন উত্তর পায়নি। তিন্নির সঙ্গে থাকার কারণে তার লাম্পট্য কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিন্নিকে ডিভোর্স দিলে তার লাম্পট্যের রাস্তা তো ক্লিয়ার হতো। আবার তিন্নি যখন সিরিয়াসলি ডিভোর্স দিতে চাইছে তখন সে কেন বাধা দিচ্ছে! কেন সে ডিভোর্স চায় না! সামাজিক কারণ কি! তিন্নি ভাবে, না, সমাজকে সে বিন্দুমাত্র কেয়ার করে না। সমাজকে যদি সামান্যতম কেয়ার করত তাহলে একজন মানুষ এত নীচু কাজ বছরের পর বছর ধরে চালাতে পারত না! তাহলে কেন! তিন্নি বুঝতে পারে না!

প্রতিদিন রাতে ইভান তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। তিন্নির সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করে, তিন্নি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না!  তিন্নি ভাবে সবই অভিনয়! ইভানের মুখ থেকে ভালবাসা শব্দটি শুনলেই তিন্নির শরীরটা গুলাতে থাকে, বমি পায়! কোন কোনদিন তিন্নি বেসিন ভাসিয়ে বমি করে!

ইভানকে ডিভোর্স দিয়ে দীপনকে বিয়ে করে তিন্নি। মেয়েরা তিন্নির সঙ্গেই থাকে। এর কিছুদিন পর তিন্নি জানতে পারে ইভান আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করার আগে ইভান কুরিয়ারে তিন্নির কাছে একটা চিঠি পাঠায়-

‘তিন্নি আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। বাঁচতে চাইও না। তুমি ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন তিন্নি!

তিন্নি এখন বুঝতে পারে, সত্যিই ইভান তাকে ভালবাসত। এতদিন ধরে ইভান যা করেছে সেটা ছিল ইভানের আসক্তি। বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজা, ভাংয়ের মতো এটাও একটা আসক্তি! যেটা ইভান ছাড়তে পারত না কোনভাবেই! চিঠিটি হাতে নিয়ে তিন্নি হাসে, করুণ সে হাসি!

   

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;