ভাসা ভাষা



আফরিনা ওয়াশিন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

উপমহাদেশের বিখ্যাত পণ্ডিত কালিদাসের অনিচ্ছা শর্তেও কিছু পণ্ডিত প্রায় জোরপূর্বক আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হল, কালিদাস কখনও কাওকে তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেন না। আদোতে কালিদাস কিপ্টে নন। তিনি তার পরিবারের অজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে চিন্তিত, কিভাবে করবে তারা বিজ্ঞ অতিথিদের আপ্যায়ন? তাই তিনি তার বাবার সামনে পুঁথি ধরিয়ে দিয়ে তা পাঠ করতে বসালেন। যেহেতু বাবা এই বিষয়ে অজ্ঞ, কালিদাস তাঁকে অনুরোধ করলেন ভগবান, কৃষ্ণ এবং রাম নাম জপতে। পুত্রের কথা মতো বাবা এক নাগাড়ে নাম জপতে আরম্ভ করলেন, “ভগবানকৃষ্ণরাম…… ভগবানকৃষ্ণরাম…।“ একপর্যায়ে সব গুলিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো , “ভকর…ভকর…ভকর…ভকর…”। বিজ্ঞ অতিথিগণ জপের আদ্যপান্ত কিছু না বুঝে কালিদাসকে প্রশ্ন করলেন । উত্তরে কালিদাস জানালেন, এটি ভগবান, কৃষ্ণ ও রাম এঁর সংক্ষিপ্ত রূপ। উপস্থিত বিজ্ঞজন স্বভাবতই ধারণা করে নিলেন কালিদাস বংশগতই জ্ঞানী বটে।

গল্পটি কোথায় শুনেছিলাম মনে নেই। রেফারেন্স দেয়ার ভয়েই হয়তো স্বীকার করে নিলাম। তবে গল্পটি একারণেই বললাম, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দৌড়ও ভকর…ভকর… জ্ঞানের মতোই। তা সে পাঠ্য বই হোক কিংবা ধর্মীয় গ্রন্থ। ভাষাই বুঝি না আর বই পড়ে বুঝবো কি? তাই বলে আমি আমাদের সব শিক্ষককে কালিদাসের বাবার ভূমিকায় দাঁড় করাচ্ছি এমনটিও নয়। কিন্তু ইংরেজি ক্লাসে শিক্ষক যখন বলেন, “ইংরেজি বলতে হলে, ইংরেজিতেই চিন্তা করতে হবে”। তখন আমার মতো অনেকেরই হয়তো না ঘারকা, না ঘাটকা অবস্থায় পড়তে হয়।

ভার্সিটিতে কোন এক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় আমি বাংলা বিষয়ে ফেল করেছিলাম। সবাই ভীষণ হেসেছিল। আমি নিজেও যে দাঁতে বাতাস লাগাইনি তা নয়। কারণ ইংরেজিতে যথেষ্ট ভাল নম্বর পেয়ে পাস করেছি। আমার এই লজ্জাহীনতার পেছনেরও একটা ঘটনা আছে। আমার স্বর্গীয় মাতামহ একবার আমেরিকা ঘুরে এসে জানালেন, সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারাও ইংরেজি বলতে পারে। বিষয়টি ছোট বয়সেই আমাকে খুব মর্মাহত করেছিল। এরপর থেকে আদা জল খেয়ে ইংরেজির পেছনে লেগে পড়লাম। ইংরেজির পেছনে লেগে না আমি তার আগে যেতে পেরেছি, না মাঝে। ঠিক পেছনেই আছি। ততদিনে আমার বাংলা ব্যাকরণ বই উইপোকাতে খেয়ে নিয়েছে। বাংলা না বুঝেই ইংরেজি শিখবো কি করে? কবির ভাষায় আমার এই অভাগা দশা ঠিক এমন-

“ওরে বাছা মাতৃ কোষে রতনের রাজি,

এ ভিখারী দশা কেন তোর আজি?”

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল মানুষের পূর্ণ বিকাশ ঘটানো। যা পড়ছি তা যদি আর আচার আচরণ বা অভ্যাসেই না আসে তাহলে সমাজ বিবর্তনের কথা বলেই বা কি লাভ। শিক্ষার ভাষা সহজতর হলে তবেই না তা অভ্যাসে রূপ নিবে। মানুষ তার অভ্যাসের সাথে যতটা নিরাপদ, চাপিয়ে দেয়া বিষয়ে ঠিক ততোটাই আনাড়ি এবং ভীতু।

একথা স্বীকার করতে সংকোচ নেই ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজির হাত ধরেই এসেছিল। কিন্তু ভারতীয় স্থানীয় বিজ্ঞ সমাজ প্রথমেই বুঝেছিলেন ইংরেজি শিক্ষা তৎকালীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে নিজের গতি থেকে আলাদা করতে চাইছে। তাই তারা নিজের ভাষা ও শিল্প সংস্কৃতিকে বাঁচাতেই সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে তাদের হয়ে তাদের ভাষায় বই লেখা শুরু করলেন। অথচ শখানেক বছর পরে এসেও বাংলা ভাষাভাষি লেখক-পাঠক সম্পর্ক ঠিক তেমন সহজ নেই। লেখকের অবস্থাও আমার মতো আনাড়ি ছাত্রের মতো। না সে বাংলা সাহিত্যানুরাগী না অন্যকোন সাহিত্যে যথেষ্ট পারদর্শী। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধর্মশালার নামে মুষ্টি চাল আদায়ের মতো সব সাহিত্য ঘেটে যতটা কঠিন লিখছেন, ততোটাই যেনো পাণ্ডিত্য জাহির হয়। লেখক পাঠকের বিনিসুতার বাঁধনের কষাঘাতে ভাষা হল বলির পাঠা। ভাল বাংলা বই পড়ছি না, ভাল বাংলা জানছি না। তবে খারাপ বাংলা কি তাতেও আমাদের পরিপক্ক দক্ষতা আছে কিনা প্রশ্নের বিষয়। জুবার্টের ভাষায় বলতে হয়, “এককালে পৃথিবী বইয়ের উপর কাজ করতো, এখন বই পৃথিবীর উপর কাজ করে. ‘’ সাথেসাথে পাঠকের কান চিলে নিয়ে যায় ক,দিনের জন্য। এরপর যখন কান ফেরত আসে, তখন তা আর কান থাকে না। রীতিমত ইংরেজি শব্দ “ফান” হয়ে যায়। সুতরাং লেখক যে শুধু পাঠককে বোকা বানাচ্ছেন তা-ই নয়, বোকা বনে যায় সমগ্র বাংলা ভাষাভাষি পাঠক সমাজ।

এতোসব দুর্গতির দায় কেবল লেখক একা নিতে বাধ্য নন। কারণ বুদ্ধিজীবী মহল তার আগেই সুবিধা জনক অবস্থায় শেয়ালের মতো গর্তে লেজ ঢুকিয়ে বসে আছেন। কাঁকড়ার টান লাগলেই গর্ত থেকে লেজ আপনা আপনিই বেরিয়ে আসবে। কাঁকড়াটিকে করমর করে চিবিয়ে খাবেন। কিন্তু পাশে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জানান দেবেন না, “যতোটা টাকা ফেলবেন, ততোটাই বলে দেবো আপনার হয়ে।‘’ হর্তাকর্তাদের টেবিলে নোট পড়লে আপনিই হয়ে উঠতে পারেন লেখক, গায়ক বা শিল্পী হিসেবে লেটেস্ট কিংবা ফিটেস্ট।

ধর্ম গ্রন্থের জন্য তো সমাজ বদল বা শিক্ষার অভ্যাস কোনদিনই বদলায় না । কুরআনে বর্ণিত আছে, “ ধর্ম প্রচারের জন্য প্রেরিত পুরুষ কেবল নিজ গোত্রের মানুষদের ভাষায় কথা বলেন, যাতে করে তিনি সহজ এবং স্পষ্ট ভাবে ধর্মের বাণী প্রচার করতে পারেন।”( ১৪ আব্রাহাম, ৪)। আমাদের কতজন ধর্মীয় প্রতিনিধি এই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে সামনে এনেছেন। কতজন ধর্মবিদ ওয়াজ মাহফিলে বলেছেন মাতৃভাষায় কুরআন পাঠে করলেও পুণ্য আসে। পুণ্যের ঘর শূন্য রেখেই নিজের শেখা আরবিকে আরও কতোটা দূর্বোধ্য ভাবে প্রদর্শন করে মাদ্রাসা বোর্ডকে মহান ঘোষণা করা যায় সেই তালেই থাকেন।

তালে তাল মিলিয়েছেন পন্ডিত মশাইও। বৈদিক ছন্দোমঞ্জরীতে বর্ণিত আছে, "মননাৎ ত্রায়তে যস্মাৎ তস্মাৎ মন্ত্র উদাহৃতঃ।" অর্থাৎ যা মন,চিন্তা ও ধ্যানের দ্বারা সংসারের সকল দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে পরিত্রাণ দেয় তাই মন্ত্র। প্রায় একই কথাকে পরিশ্রমের সাথে যুক্ত করে মধযযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বলছেন- “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন ।” মন্ত্র বিষয়টাই এমন বার বার পাঠ করার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কষ্ট করলে কেষ্ট মিলবে। বুঝলাম, আপনাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা আমাদের বাংলা ভাষারই পূর্ব রূপ। তাই বলে তা সহজ বাংলায় অনুবাদ করলে অন্যরা পড়লে আপনার জাতটা চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে কি? ধর্ম আর রাজনীতির প্রধান অস্ত্র যদি হয়ে থাকে ভাষা তাহলে আর আমরা আলাদা হলাম কি করে। সেই তো ইংরেজদের মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট রেফারির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছের মায়ের পুত্র শোক করছি।

বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাবোর্ডগুলো ভাষার স্বতন্ত্রতাকে কোন পর্যায়েই নিরপেক্ষ থাকতে দিতে চাইছে না। বৈদিক সমাজের শ্রেণিভেদের মতোই ভাষার জাত নির্ধারণ হচ্ছে। যা সাজালে এমন দাঁড়ায়- ইংরেজি মাধ্যম ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণী, বাংলা মাধ্যম ক্ষত্রিয়, মাদ্রাসা বোর্ড বৈশ্য আর বাকী বিভিন্ন আদিবাসীদের শিক্ষা মাধ্যমগুলো শূদ্র। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রটি বাঙালি হয়েও বাংলা জানবে না, এটা ইদানীং গর্বের কারণ । কিন্তু বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা কেনো শুদ্ধ বাংলা জানে না এই কথাটা আলোচনায় কতবার এসেছে? পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষা চর্চা করে বলে তো এই না, তারা নিজের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়েছে বা সিলেবাসে গণ্য হিসেবে স্থান দিয়েছে। গ্রামের একটি ছোট ছেলে হন্তদন্ত হয়ে তার বদরাগী কৃষক চাচার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জানালো তার ফসলের ক্ষেতে কারা যেনো মল ত্যাগ করছে। চাচা লাঠি নিয়ে ছুটলো ক্ষেতের দিকে। পুরুষালী কণ্ঠে চিৎকার করে বললো, “ কে হাগোছে আমার জমিতে?” হঠাৎ করে একজন আর্মি সদস্যকে উঠে দাঁড়াতে দেখে চাচা মেনী বিড়াল সেজে গেলেন। সে আঙুল তুলে তার সব ক্ষেত দেখিয়ে বললো, “ এটা আমার জমি, ওটা আমার জমি। হাগেন, হাগেন। আপনারা হাগবেন না, তো কারা হাগবে।” আমাদের অবস্থাও অনেকটা চাচার মতই। ইংরেজি জানলে জগতের সব সুবিধা আমাদের। তাই ওটাই আগে। তাহলে প্রশ্ন আসে , জাপান, চীন, জার্মানিদের কি চাচার প্রয়োজন হয় না?

এতকিছু বলার পেছনে ইংরেজিকে ভাষা হিসেবে অস্বীকার করা কিংবা ছোট করে দেখানোর কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইচ্ছা নেই আমার। কেবল এটাই বলতে চাইছি, শুধু ইংরেজি বা অন্য ভাষায় দক্ষতা আছে বলে আমি আমার নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করবো এটা ঠিক হবে না। শেষমেষ অস্তিত্বের গোড়া না নড়বরে হয়ে যায়। নিজের ভাষায় সঠিক ভাবে আয়ত্ত থাকলে অন্য যে কোন ভাষা আরও স্বল্প সময়ে আয়ত্তে আনা সম্ভব। কারণ সুন্দর বাক্য তৈরি করাতেই ভাষার আর্ট। ব্যক্তির মুখ যদি হয় তুলি, ভাষা তাতে রঙ। যেভাবে সাজাবেন, সেভাবেই সাজবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে প্রথম বর্ষেই আমি আবিষ্কার করেছিলাম আমার পাঠ্য বইয়ের প্রায় সবই ইংরেজি ভাষায় রচিত। বাংলাদেশ বলতে আমরা যারা এখনও যারা ঢাকা বুঝি তাদের মফস্বল কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই বললেই চলে। সেই জায়গা থেকেই আসা আমার জন্য বাংলা বই খোঁজাটা খুব একটা হাস্যকর চোখে না দেখার অনুরোধ রইলো। কারণটা বলি, অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু ইংরেজি অনুবাদকৃত বাংলা বই পেলেও তা যে ইংরেজির চেয়েও ভয়াবহ রকমের কঠিন এটা কেবল আমরাই জানি। যার ফলে বাংলা বই পড়ার ইচ্ছাটাকে ছেঁড়া ঝুলিতে রেখেই ইংরেজিকে গুরু মেনে এগিয়ে যেতে হয়। এতে করে কি আমাদের অজ্ঞতা ঢাকা সম্ভব হলো? জৈনক অনুবাদক বেচারার যে বাঙলার দাঁতের গোঁড়া এখনও নড়ছে সেটা উনি না স্বীকার করলেও বাঙলার ছেঁড়া ঝুলিটি দামি কাপড়ের নিচে থেকেও উঁকি মেরে জানান দেয়। সুতরাং যে ছেলেটি বা মেয়েটি গণিতে ভাল, বিজ্ঞানে ভাল, কেবলমাত্র ইংরেজি জানে না বলে তাঁর ভেতরের আবিষ্কারককে আমরা ইচ্ছা করেই গলা টিপে হত্যা করি। খুব বেশি হলে তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞ সমাজ দুচারটা হাস্যকর উক্তি লিখতে পারেন। কিন্তু সহজবোধ্য অনুবাদ লিখে দিতে বললে উটের মতো গর্তে মাথা লুকিয়ে রাখবেন। ভুললে চলবে না গীতাঞ্জলী অনুবাদ হয়ে “সং অফারিংস” হয়েছিল বলে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিশ্চয়ই মাতৃভাষার পূর্ণ দক্ষতা ছিল জন্যই অনুবাদ করতে গিয়ে পান্ডিত্য দেখাতে কঠিন কঠিন শব্দ না লিখে অভ্যাস সুলভ সরল শব্দ লিখেই সর্বজনগ্রাহী করেছিলেন। অনুবাদ সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য হল ভাষার কাছে আত্মসমর্পণ করা। মোটেও পাণ্ডিত্য জাহির করা নয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা হয়তো তাঁর নিজের অতীতকে স্মরণ করেই বলেছিলেন, “ যদি তুমি কারো সাথে তোমার ভাষায় কথা বলো, তাঁর কাছে যেতে পারবে; যদি তাঁর ভাষায় কথা বলো, তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে।“ আমাদের ভারতবর্ষে এই উদাহরণ আমরা কমই দেখেছি। মুখের ভাষা আর পরনের কাপড় দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করি। ঠিক যেমন মুখে স্বাদ লাগলেই খাবার অযোগ্য হলেও খাই। যেমন আদিবাসী কোটার ব্যবস্থা করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছি বটে। কিন্তু ক্লাসে এলে তার বুলি নিয়েই বুলিং করছি। আমাদের শিক্ষকরাও যে তাদের হয়ে বা তাদের মতো করে শেখাচ্ছেন তাও নয়। ভারতীয় ইতিহাসে গুরুশিষ্য পরম্পরা যে সুখকর না তার প্রমাণ বারবার সামন আসে। দ্রোণাচার্য যেমন ভাল ছাত্র অর্জুনকে নিয়ে গর্ব করতে করতে একলব্যের মত প্রকৃত বীরকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের শিক্ষকরাও তেমন একচোখা ভাবেই যারা এগিয়ে তাদেরকেই এগিয়ে নিয়ে যান। ওইসকল আদিবাসী ভাষাভাষীর শিক্ষার্থীদের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সময় কই তাদের। এমনই অভাগা জাতি আমরা, বেশির ভাগ মানুষই জানি না আদিবাসী ভাষাগুলোতেও শিক্ষার প্রচলন আছে বা আরও প্রচলিত হতে পারে। আমার কেন কেবল মনে হয় আদিবাসী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে, যেচে গিয়ে ডেকে এনে এইসকল নিরীহ মানুষদের জাতিসত্ত্বাকে আঘাত করছি আমরা।

চীনা কবি লু চি বলেছিলেন, “লেখকের আনন্দই সব জ্ঞানীলোকের আনন্দ। প্রাণ না থাকলে ঘটে প্রাণের জন্ম ,নিরবতার বাইরে কবি দেন গানের জন্ম।” মানুষ ভাষা সৃষ্টি করেছে। সুতরাং বর্ণ, শব্দলিপি, প্রতিলিপিও মানুষেরই তৈরি। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু দুচারটা ভাষা ভুল বললে বা লিখলেই আমাদের অগ্রজরা যেভাবে তেড়ে আসেন এবং সমালোচনা করেন, তাতে করে মনে হয় ভুল করার চেয়ে না বলা, না লেখাই ভাল ছিল।

আমারা বাঙালীরা গোঁড়া থেকেই উদার মনভাবের। কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা ভীষণ গোঁয়ার। যে কোন পরিবর্তনকে আমরা মানতে চাই না সহজে। কখনোবা দেরীতে মানি। যেমন ইওরোপীয় পরাবাস্তববাদ আমরা মহাজ্ঞানীর মতো ধারণ করেছি। কিন্তু নিজের দেশের অল্প বয়সী একজন লেখকের ভাষায় সামান্য মেটাফোর মানতে পারি না। শুধু লেখকের ভাষাই বলছি কেন। শিল্পের ভাষাতেও একই অবস্থা। সিনেমা হলে গেলে শোনা যায়, “ আই সে গেট আউট, আমি বলছি তুমি বেরিয়ে যাও”। যেনো ইংরেজির সাথে এর বাংলা অর্থ না বলে দিলে আমরা কিছু বুঝতাম না। কিন্তু এখনকার একজন তরুণ নির্মাতা যদি দেখান, একজনের চোখে রাগ, হিংস্রতা দেখে অপরজন মাথা নিচু করে প্রস্থান করলো, তাহলেই বিপত্তি শুরু। কেন ডায়লগ দিয়ে দর্শককে গুলিয়ে খাওয়ানো হলো না। চোখের ভাষা আর মুখের ভাষা কোন ভাষা নিয়েই আমরা ভাবছি না এবং দর্শক ও পাঠককুলকেও দায়িত্ব নিয়ে ভাবতে সুযোগ করে দিচ্ছি না। না ভাবলে তো ভাষা গতি থেমে যাবে। সাহিত্য হবে না , গান হবে না। আমাদের অগ্রজরা যদি আমাদের এই ভাবনার জগতকে কিছুটা স্বাধীন করে দেন, তাহলেই ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে।

মাতৃভাষা একটি বড়সড় ঢালের মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে যত রাজা বা শাসক এসেছেন সবারই প্রথম রীতি ছিল নিজের মাতৃভাষাকে রাজ ভাষার মর্যাদা দেয়া। এতে করে তাদের জন্য শাসন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো সহজ হতো। এতোটা দূরে গিয়ে উদাহরণ না টেনে আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী আমাদেরকে শাসন করার জন্যই নিজেদের সুবিধা মতো ঊর্দূকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে চেয়েছিল। আমরা তাদের হা তে হা মেলালেই যে তারা আমাদেরকে শাসন করা বন্ধ করতো তেমনটি নয়। বরং বাংলা জানি বলেই আমরা নিজেদের ভাষাভাষির মানুষদের খুব কম সময়েই একত্র করে জনঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। সুতরাং মাতৃভাষা কেবল একটি ভাষাই নয়, বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচার প্রতীকী কৌশলও বটে।

পাকিস্তানের ঊর্দুকে আমরা মেনে নিইনি তা ঠিক। তবে উপনিবেশিক শাসনের দিন এখনও শেষ হয়নি তা বেশ বোঝা যায় সর্বত্র ইংরেজির রাজত্ব দেখে। এই বিষয়টিকে হয়তো আমরা জেনে কিংবা নিজের অজান্তেই মেনে নিয়েছি। ভাষা হিসেবে ইংরেজি খুব সহজ তাও না। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা প্রবন্ধে লিখেছেন, “একে তো ইংরেজি ভাষা অতিমাত্রায় বিজাতীয় ভাষা। শব্দ বিন্যাস,পদ বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের ভাষার সহিত তাহার কোন প্রকার মিল নাই। তাহার পরে আবার ভাব বিন্যাস এবং বিষয় প্রসঙ্গও বিদেশী। আগাগোঁড়া কিছুই পরিচিত নহে, সুতরাং ধারণা করিবার পূর্বেই মুখস্থ করিতে হয়। তাহাতে না চিবাইয়া গিলিয়া খাইবার ফল হয়।”

বাংলাকে অবজ্ঞা করে ভকর…ভকর… করে ইংরেজি পড়লেও ভাষা না জানার যে আক্ষেপ থাকবে তাতে হয়তোবা জীবনের অনেক কথা, ভাব, অভিব্যক্তি না জানিয়েই পৃথিবী ছাড়তে হবে। আবারও কবির ভাষাতেই ইতি টানছি – ‘এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা — সলিল রয়েছে প’ড়ে, শুধু দেহ নাই।” বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে চাইলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা জানতে হবে। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাক শুধুমাত্র একটি পাঠ্য বিষয় না ভেবে মুখ্য স্থানটি দেয়ার পর ইংরেজি জানা মঙ্গলকর।

মহাভারতে দ্রৌপদীর জন্য নীলপদ্ম তুলতে গিয়ে যুধিষ্ঠিরের ভাইয়েরা একের পর এক যক্ষের হাতে নিহত হয়েছিল। তাদের পুনঃজীবনীর জন্য যুধিষ্ঠিরকে যক্ষের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। একটি প্রশ্ন ছিল, সুখীজন কে? যুধিষ্ঠির উত্তর দেয়- “দিবসাস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ অনুনী চাপ্রবাসে চ স বারিচর মোদতে।” এর অর্থ দাঁড়ায়, সন্ধ্যাবেলা যে লোক শাক রান্না করে, যার কোন ঋণ নেই আর যে বিদেশ থাকে না তাকেই সুখী বলা হয়।“ অথচ নিজের ভাষা থাকতেও আমরা যেনো নিজ দেশেই রিফিউজির মতো আশ্রিত। মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন করা আমাদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু অপসংস্কৃতি আমাদের ঘারে এতটাই জেঁকে বসেছে, মাতৃভাষার পূর্ণ সম্মানটাও আমরা দিচ্ছি না। মাতৃভাষায় শিক্ষার সহজ মাধ্যম গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। একমাত্র বাংলা ভাষাই পারে বাংলাদেশের সকল শিক্ষার মাধ্যমকে এক করতে। পারে সব কাতারের মানুষকে এক কাতারে এনে দাঁড় করাতে। কথার চেয়ে বড় মরণাস্ত্র নেই, মাতৃভাষার চেয়ে বড় কোন ঢাল নেই।

৩১.০১.২০২১

আফরিনা ওশিন,শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;