কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৯)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

পুনর্মিলন ও পূর্বাভাস

[পূর্ব প্রকাশের পর] লিন ও আমি, আমাদের বন্ধুদের দেখতে ও তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চেয়েছিলাম। খুব সাবধানে আমরা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাই, তাদের গল্প শুনি, অভিজ্ঞতা বিনিময় করি, প্রার্থনা করি এবং ঈশ্বর তাদের বিপদমুক্ত রেখেছেন বলে উল্লাস করি। প্রথমদিকেই আমরা গিয়েছিলাম আমাদের রবিবারের স্কুলের কিশোরী ছাত্রীদের বাড়িতে। ঈশ্বর আমাদের যাওয়ার এই সময়টাকে একেবারে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথম-বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখি, একটি ছাত্রীর মা গুরুতরভাবে অসুস্থ। তাঁর রক্তচাপ ও শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে আমরা একটা জটিল গর্ভধারণের আলামত হিসাবে সন্দেহ করি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার তক্ষুনি। তাঁর সাত বাচ্চার প্রত্যেকেই বাড়িতে জন্মেছে, তাই পরিবারটি তাঁকে কোনো অবস্থাতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি, আর যদি তারা তা ভাবতোও, সেটা করার সঙ্গতি তাদের ছিল না। আমরা দ্রুত তার ব্যবস্থা করি এবং তাঁকে চন্দ্রঘোনায় ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিই।

হাসপাতালে যাবার পথে, সেই মা আমাদেরকে বলেন, তিনি এই গোলযোগের সময়ে তাঁর বড় মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। আমরা তাঁকে নিশ্চয়তা দিই যে, ঈশ্বর তাঁর মেয়েদের রক্ষা করবেন। তারপর ঈশ্বর আমাদেরকে নির্বাচন করেন এবং মনে করিয়ে দেন যে, তিনি তাঁর ইচ্ছা চরিতার্থ করার নিমিত্তে মানুষকেই বাহন করার কথা ঠিক করেছেন। একটি ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে নিয়ে মা চন্দ্রঘোনা থেকে ফেরার একটু পরেই ষোল বছরের লুসি আমাদের সঙ্গে থাকতে আসে।

আরেক বিকালে আমরা যখন একঘরের একটি বাড়িতে, রাস্তার দিকে মুখ করা বিছানায় বসে ছিলাম তখন উর্দি পরা দুজন লোককে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখি। তাদের একজন খুবই বাচাল প্রকৃতির ছিল এবং আমাদের দিকে অশোভনভাবে তাকাচ্ছিল।

“তোমরা কী?”
“তোমরা বাঙালি?”
“তোমরা সাহেব?”

তার সহযোগীকে মনে হয় সংলাপ দ্রুত শেষ করে সামনে এগুতে ইচ্ছুক, কিন্তু মুখপাত্র বলেই চলে, “তোমরা কী করো?”

আমরা আমাদের ব্যাখ্যায় কোথাও এগুতে না পারায়, একজন বৃদ্ধা তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করেন। “এটা একটা খ্রিস্টান পাড়া। এরা আমাদের সঙ্গে প্রার্থনা করতে এসেছেন।”
“ওহ।” আলো দেখা দিলে, সে উত্তরে জানায়, “তোমরা তাহলে দেবী!”

নৈরাজ্যপূর্ণ চট্টগ্রামে ক্যাথলিক হিসাবে আমরা প্রতিদিনই ঈশ্বরের উপস্থিতি ও তাঁর নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন হতাম, কিন্তু আমরা এও বিশ্বাস করি যে, পিতা আসলে প্রতিটি দেশি বিশ্বাসীর চোখেই একটা শক্তি হিসাবে প্রতিভাত করছিলেন নিজেকে।

এখানে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুরুষ ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের পরিত্রাণের এমন এক ঘটনা বর্ণনা করেন, যাকে কেবল অলৌকিকতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। নিচের লেখাগুলো ছিল মি. জিমি রজার্স ও তাঁর পত্নীর নিজের হাতে লেখা সত্যি ঘটনার বিবরণ।

“জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭১ সালের তেসরা মার্চে ডাকা জাতীয় সংসদ অধিবেশনকে বানচাল না করে দিলে আমার এই গল্পটা বলা হতো না।”

“ছয় বছর বয়সে অনাথ হয়ে, হিমালয়ের পাদদেশে প্রয়াত ডা: জে এ গ্রাহাম কর্তৃক স্থাপিত বিখ্যাত অনাথাশ্রমে ভর্তি হই আমি। আমাদের গোটা জীবনটাই রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিনিয়ত বদলে-যাওয়া মুখাবয়ব দ্বারা আচ্ছন্ন থাকত। অনাথাশ্রমটি ছিল একটি খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমি কেবল খুব ভালো শিক্ষাই কেবল পাই না, স্বয়ং খ্রিস্টকে আমার ত্রাতা হিসাবেও পাই, এবং বাইবেল পাঠ ও প্রার্থনার অভ্যাস গড়ে তুলি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নৌবাহিনীতে ঢুকে আমার প্রথম জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাই। যুদ্ধ একজনকে ঈশ্বর কিংবা শয়তানের নিকটবর্তী করে তুলতে পারে, বিশ্বাসের গভীরতা ও বন্ধুসঙ্গের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিশ্বাস থেকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আমার ক্ষেত্রে একটু ধীর ছিল; প্রথমে মদ্যপান, তারপর জুয়া খেলা, তারও পর যিশু থেকে ক্রমে দূর থেকে দূরে ছিটকে পড়া; খুন ছাড়া, আইনের চোখে এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা আমি করিনি।”

“শেষ পর্যন্ত নিজের ধ্বংসের কাছে এসে এবং নিজেকে একটি ডাকাতির অভিযোগে মিথ্যেভাবে অভিযুক্ত হতে দেখে আমি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই। এক মুহূর্তে আমার জীবন ছিল অন্ধকার ও অবসাদে আচ্ছন্ন, আর পরের মুহূর্তেই আলো, শক্তি ও আশ্বাস। অনেক বছর পেরিয়ে যায়—নিয়মিত চাকরি, পদোন্নতি সবই ঘটে। আমাদের যেহেতু কোনো সন্তান ছিল না, আমার স্ত্রী ও আমি দুটো বাঙালি মেয়েকে দত্তক নিই।”

“আমাদের আরামদায়ক জীবন ছিল এবং মোটামুটি স্বচ্ছলই ছিলাম আমরা। তারপর হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি চাকরি হারাই এবং বিভিন্ন খুচরো কাজ করি তার পরের ছয়মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি ঢাকায় কাজ করছিলাম। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা, তখন বয়স তিন ও চার, ১৭৫ মাইল দক্ষিণে চট্টগ্রাম শহরে থাকত। আমাদের বাসাটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা থেকে মাত্র আধমাইল দূরে একটি মিলিশিয়া ক্যাম্পের পাশেই ছিল। সেটা খুব নির্জন এলাকা, যার কাছাকাছি মাত্র আর একটা বাড়িই ছিল।”

“ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে আমি যখন ক্রিসমাসের জন্য বাড়ি এসেছিলাম, তখন আমার মনে একটা জোর বিশ্বাস জেগেছিল যে, আমি হয়তো আমার বাড়িটা আর দেখব না। এই অনুভূতিটা এমন জোরালোভাবে আমার মনে গেঁথে থাকে যে, আমি আমার এক মিশনারি বন্ধু জিন গুর্‌গানসকে চট্টগ্রামে চিঠি লিখে সেই ভয়ের কথা খুলে বলি এবং আমার পরিবারের দেখভাল করার অনুরোধ করি।”

“মার্চের ১ তারিখ শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানিরা জাতীয় সংসদ অধিবেশন বানচাল করার জন্য যেসব বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করছিল তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাঙালিদের ডাক দেন। গোটা পূর্ব বাংলা তাঁর ডাকে জেগে ওঠে। মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অবস্থা খুব উৎকণ্ঠাময় ছিল এবং নানা দাঙ্গাহাঙ্গামাও হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি মিলিটারি একটা সর্বাত্মক অভিযান শুরু করল বাঙালিদেরকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাতে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল বলা চলে।

ঢাকাকে রাতারাতি দমন করা গেলেও চট্টগ্রামে যুদ্ধ আরো কুড়ি দিনের মতো চলে। ২৫ মার্চ রাত দশটায় ঢাকা শহরে গোলাগুলি ও বোমাবাজি শুরু হয়। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। রাত দুটোর দিকে মিলিটারি সারা শহর ঘুরে লাউডস্পিকারে লোকদের সাবধান করতে থাকে এই বলে যে, আগামীকাল ২৬ মার্চ সারাদিন র্কাফ্যু থাকবে। বাড়ি থেকে কেউ বার হলেই তাকে গুলি করে মারা হবে।”

“বিকালের মধ্যে আমি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই সাহস করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খাদ্যের সন্ধান করতে থাকি। আমি একটা ছোট্ট ঘুপচিঘর দেখি যার একটি ছোট্ট জানালার ভেতর দিয়ে চা বিক্রি করা হচ্ছিল। আমি এক বোতল চা ভর্তি করে নিই, কেননা আমার সেই অভিযানে আমি এই একটি মাত্র খাদ্যের খোঁজ পেয়েছিলাম। পরদিন আমি একই দোকান থেকে একটি বাসি রুটি এবং আরো কিছু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারি। চারটি বাঙালি পরিবার আমার ঘরে আশ্রয় নেয়। আমি একটি ১০ বাই ১০ ফুট ঘরে থাকতাম, ফলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কী অসুবিধাই না হচ্ছিল সবার।”

“মার্চের ২৮ তারিখ আমি চট্টগ্রামে আমার পরিবারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি দুবার ক্যান্টনমেন্টে যাই একটা বিমানের টিকিটের অনুমতির জন্য, কিন্তু তারা আমাকে মুখের ওপর না করে দেয়। এপ্রিলের ৩ তারিখ আমি আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন বন্ধুকে যোগাড় করি, যে কিনা উর্দু বলতে পারে। সে আমাকে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বিশাল বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে। সে তখন আমাকে অনুরোধ করে, তার সঙ্গে সেই মিলিটারি অফিসারের কাছে যেতে, যে-এই অনুমতিটি প্রদান করছিল। আমি আসার পর আমাকে বলা হয়, আমার বন্ধু আমার নাম ব্যবহার করেছে বিমানের টিকিটের জন্য। তাকে গুলি করার সমূহ ইচ্ছা ছিল তাদের, কিন্তু আমি আমার বন্ধুকে কোনোমতে সেই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করে আনতে পারি। সে বলে যে, তাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল গুলি করার জন্য, কিন্তু সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। সে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দু বলতে পারত, সেহেতু তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয় যেন আমি এসে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করি। অবশ্যই আমি সেদিন কোনো বিমানযাত্রার অনুমতি পাইনি। বাকি সারা সপ্তাহ আমি লাইনে দাঁড়িয়ে সেই চেষ্টা করে যাই কিন্তু আমাকে প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করা হয়, কারণ আমি যে পাকিস্তানি তার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছিলাম না। পাঁচটি ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে ৬ই মে-র একটি উড়ানের অনুমতি দেওয়া হয় আমাকে।”

“আমার বিমানযাত্রার আগের রাতে, আমি একটা টেলিগ্রাম পাই যে, আমার স্ত্রী ও কন্যারা নিরাপদে আছে এবং তারা বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে আছে। এটা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে। আমি তখনই বুঝতে পারি, আমার বাড়ির কিছু একটা হয়েছে, তা নাহলে আমার স্ত্রী কিছুতেই বাড়ি ত্যাগ করত না। কিন্তু আমি সেই টেলিগ্রাম আসার সময়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? আমি এর আগে বিমানযাত্রার অনুমতি পেলে, সরাসরি বাড়ি চলে গিয়ে বাড়ির এই হাল দেখে ধরে নিতাম যে, আমার স্ত্রী কন্যাদের হত্যা করা হয়েছে। ওই সময়ে টেলিগ্রামটা পাওয়াতে আমি সেই মুহূর্তের আতঙ্ক ও বুকের যন্ত্রণা, বেদনা থেকে অব্যাহতি পাই। এই খবর পেয়ে আমি সরাসরি বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে যাই এবং আমার পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত হই। দিন গড়িয়ে যায় এবং আমি আমার স্ত্রীর অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারি। আমি তাকেই সেসব বর্ণনা করতে বলব।” [চলবে]

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৯)
পুনর্মিলন ও পূর্বাভাস
জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ

[পূর্ব প্রকাশের পর] লিন ও আমি, আমাদের বন্ধুদের দেখতে ও তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চেয়েছিলাম। খুব সাবধানে আমরা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাই, তাদের গল্প শুনি, অভিজ্ঞতা বিনিময় করি, প্রার্থনা করি এবং ঈশ্বর তাদের বিপদমুক্ত রেখেছেন বলে উল্লাস করি। প্রথমদিকেই আমরা গিয়েছিলাম আমাদের রবিবারের স্কুলের কিশোরী ছাত্রীদের বাড়িতে। ঈশ্বর আমাদের যাওয়ার এই সময়টাকে একেবারে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথম-বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখি, একটি ছাত্রীর মা গুরুতরভাবে অসুস্থ। তাঁর রক্তচাপ ও শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে আমরা একটা জটিল গর্ভধারণের আলামত হিসাবে সন্দেহ করি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার তক্ষুনি। তাঁর সাত বাচ্চার প্রত্যেকেই বাড়িতে জন্মেছে, তাই পরিবারটি তাঁকে কোনো অবস্থাতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি, আর যদি তারা তা ভাবতোও, সেটা করার সঙ্গতি তাদের ছিল না। আমরা দ্রুত তার ব্যবস্থা করি এবং তাঁকে চন্দ্রঘোনায় ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিই।

হাসপাতালে যাবার পথে, সেই মা আমাদেরকে বলেন, তিনি এই গোলযোগের সময়ে তাঁর বড় মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। আমরা তাঁকে নিশ্চয়তা দিই যে, ঈশ্বর তাঁর মেয়েদের রক্ষা করবেন। তারপর ঈশ্বর আমাদেরকে নির্বাচন করেন এবং মনে করিয়ে দেন যে, তিনি তাঁর ইচ্ছা চরিতার্থ করার নিমিত্তে মানুষকেই বাহন করার কথা ঠিক করেছেন। একটি ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে নিয়ে মা চন্দ্রঘোনা থেকে ফেরার একটু পরেই ষোল বছরের লুসি আমাদের সঙ্গে থাকতে আসে।

আরেক বিকালে আমরা যখন একঘরের একটি বাড়িতে, রাস্তার দিকে মুখ করা বিছানায় বসে ছিলাম তখন উর্দি পরা দুজন লোককে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখি। তাদের একজন খুবই বাচাল প্রকৃতির ছিল এবং আমাদের দিকে অশোভনভাবে তাকাচ্ছিল।

“তোমরা কী?”
“তোমরা বাঙালি?”
“তোমরা সাহেব?”

তার সহযোগীকে মনে হয় সংলাপ দ্রুত শেষ করে সামনে এগুতে ইচ্ছুক, কিন্তু মুখপাত্র বলেই চলে, “তোমরা কী করো?”

আমরা আমাদের ব্যাখ্যায় কোথাও এগুতে না পারায়, একজন বৃদ্ধা তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করেন। “এটা একটা খ্রিস্টান পাড়া। এরা আমাদের সঙ্গে প্রার্থনা করতে এসেছেন।”
“ওহ।” আলো দেখা দিলে, সে উত্তরে জানায়, “তোমরা তাহলে দেবী!”

নৈরাজ্যপূর্ণ চট্টগ্রামে ক্যাথলিক হিসাবে আমরা প্রতিদিনই ঈশ্বরের উপস্থিতি ও তাঁর নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন হতাম, কিন্তু আমরা এও বিশ্বাস করি যে, পিতা আসলে প্রতিটি দেশি বিশ্বাসীর চোখেই একটা শক্তি হিসাবে প্রতিভাত করছিলেন নিজেকে।

এখানে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুরুষ ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের পরিত্রাণের এমন এক ঘটনা বর্ণনা করেন, যাকে কেবল অলৌকিকতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। নিচের লেখাগুলো ছিল মি. জিমি রজার্স ও তাঁর পত্নীর নিজের হাতে লেখা সত্যি ঘটনার বিবরণ।

“জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭১ সালের তেসরা মার্চে ডাকা জাতীয় সংসদ অধিবেশনকে বানচাল না করে দিলে আমার এই গল্পটা বলা হতো না।”

“ছয় বছর বয়সে অনাথ হয়ে, হিমালয়ের পাদদেশে প্রয়াত ডা: জে এ গ্রাহাম কর্তৃক স্থাপিত বিখ্যাত অনাথাশ্রমে ভর্তি হই আমি। আমাদের গোটা জীবনটাই রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিনিয়ত বদলে-যাওয়া মুখাবয়ব দ্বারা আচ্ছন্ন থাকত। অনাথাশ্রমটি ছিল একটি খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমি কেবল খুব ভালো শিক্ষাই কেবল পাই না, স্বয়ং খ্রিস্টকে আমার ত্রাতা হিসাবেও পাই, এবং বাইবেল পাঠ ও প্রার্থনার অভ্যাস গড়ে তুলি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নৌবাহিনীতে ঢুকে আমার প্রথম জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাই। যুদ্ধ একজনকে ঈশ্বর কিংবা শয়তানের নিকটবর্তী করে তুলতে পারে, বিশ্বাসের গভীরতা ও বন্ধুসঙ্গের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিশ্বাস থেকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আমার ক্ষেত্রে একটু ধীর ছিল; প্রথমে মদ্যপান, তারপর জুয়া খেলা, তারও পর যিশু থেকে ক্রমে দূর থেকে দূরে ছিটকে পড়া; খুন ছাড়া, আইনের চোখে এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা আমি করিনি।”

“শেষ পর্যন্ত নিজের ধ্বংসের কাছে এসে এবং নিজেকে একটি ডাকাতির অভিযোগে মিথ্যেভাবে অভিযুক্ত হতে দেখে আমি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই। এক মুহূর্তে আমার জীবন ছিল অন্ধকার ও অবসাদে আচ্ছন্ন, আর পরের মুহূর্তেই আলো, শক্তি ও আশ্বাস। অনেক বছর পেরিয়ে যায়—নিয়মিত চাকরি, পদোন্নতি সবই ঘটে। আমাদের যেহেতু কোনো সন্তান ছিল না, আমার স্ত্রী ও আমি দুটো বাঙালি মেয়েকে দত্তক নিই।”

“আমাদের আরামদায়ক জীবন ছিল এবং মোটামুটি স্বচ্ছলই ছিলাম আমরা। তারপর হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি চাকরি হারাই এবং বিভিন্ন খুচরো কাজ করি তার পরের ছয়মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি ঢাকায় কাজ করছিলাম। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা, তখন বয়স তিন ও চার, ১৭৫ মাইল দক্ষিণে চট্টগ্রাম শহরে থাকত। আমাদের বাসাটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা থেকে মাত্র আধমাইল দূরে একটি মিলিশিয়া ক্যাম্পের পাশেই ছিল। সেটা খুব নির্জন এলাকা, যার কাছাকাছি মাত্র আর একটা বাড়িই ছিল।”

“ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে আমি যখন ক্রিসমাসের জন্য বাড়ি এসেছিলাম, তখন আমার মনে একটা জোর বিশ্বাস জেগেছিল যে, আমি হয়তো আমার বাড়িটা আর দেখব না। এই অনুভূতিটা এমন জোরালোভাবে আমার মনে গেঁথে থাকে যে, আমি আমার এক মিশনারি বন্ধু জিন গুর্‌গানসকে চট্টগ্রামে চিঠি লিখে সেই ভয়ের কথা খুলে বলি এবং আমার পরিবারের দেখভাল করার অনুরোধ করি।”

“মার্চের ১ তারিখ শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানিরা জাতীয় সংসদ অধিবেশন বানচাল করার জন্য যেসব বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করছিল তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাঙালিদের ডাক দেন। গোটা পূর্ব বাংলা তাঁর ডাকে জেগে ওঠে। মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অবস্থা খুব উৎকণ্ঠাময় ছিল এবং নানা দাঙ্গাহাঙ্গামাও হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি মিলিটারি একটা সর্বাত্মক অভিযান শুরু করল বাঙালিদেরকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাতে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল বলা চলে।

ঢাকাকে রাতারাতি দমন করা গেলেও চট্টগ্রামে যুদ্ধ আরো কুড়ি দিনের মতো চলে। ২৫ মার্চ রাত দশটায় ঢাকা শহরে গোলাগুলি ও বোমাবাজি শুরু হয়। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। রাত দুটোর দিকে মিলিটারি সারা শহর ঘুরে লাউডস্পিকারে লোকদের সাবধান করতে থাকে এই বলে যে, আগামীকাল ২৬ মার্চ সারাদিন র্কাফ্যু থাকবে। বাড়ি থেকে কেউ বার হলেই তাকে গুলি করে মারা হবে।”

“বিকালের মধ্যে আমি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই সাহস করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খাদ্যের সন্ধান করতে থাকি। আমি একটা ছোট্ট ঘুপচিঘর দেখি যার একটি ছোট্ট জানালার ভেতর দিয়ে চা বিক্রি করা হচ্ছিল। আমি এক বোতল চা ভর্তি করে নিই, কেননা আমার সেই অভিযানে আমি এই একটি মাত্র খাদ্যের খোঁজ পেয়েছিলাম। পরদিন আমি একই দোকান থেকে একটি বাসি রুটি এবং আরো কিছু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারি। চারটি বাঙালি পরিবার আমার ঘরে আশ্রয় নেয়। আমি একটি ১০ বাই ১০ ফুট ঘরে থাকতাম, ফলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কী অসুবিধাই না হচ্ছিল সবার।”

“মার্চের ২৮ তারিখ আমি চট্টগ্রামে আমার পরিবারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি দুবার ক্যান্টনমেন্টে যাই একটা বিমানের টিকিটের অনুমতির জন্য, কিন্তু তারা আমাকে মুখের ওপর না করে দেয়। এপ্রিলের ৩ তারিখ আমি আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন বন্ধুকে যোগাড় করি, যে কিনা উর্দু বলতে পারে। সে আমাকে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বিশাল বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে। সে তখন আমাকে অনুরোধ করে, তার সঙ্গে সেই মিলিটারি অফিসারের কাছে যেতে, যে-এই অনুমতিটি প্রদান করছিল। আমি আসার পর আমাকে বলা হয়, আমার বন্ধু আমার নাম ব্যবহার করেছে বিমানের টিকিটের জন্য। তাকে গুলি করার সমূহ ইচ্ছা ছিল তাদের, কিন্তু আমি আমার বন্ধুকে কোনোমতে সেই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করে আনতে পারি। সে বলে যে, তাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল গুলি করার জন্য, কিন্তু সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। সে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দু বলতে পারত, সেহেতু তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয় যেন আমি এসে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করি। অবশ্যই আমি সেদিন কোনো বিমানযাত্রার অনুমতি পাইনি। বাকি সারা সপ্তাহ আমি লাইনে দাঁড়িয়ে সেই চেষ্টা করে যাই কিন্তু আমাকে প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করা হয়, কারণ আমি যে পাকিস্তানি তার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছিলাম না। পাঁচটি ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে ৬ই মে-র একটি উড়ানের অনুমতি দেওয়া হয় আমাকে।”

“আমার বিমানযাত্রার আগের রাতে, আমি একটা টেলিগ্রাম পাই যে, আমার স্ত্রী ও কন্যারা নিরাপদে আছে এবং তারা বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে আছে। এটা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে। আমি তখনই বুঝতে পারি, আমার বাড়ির কিছু একটা হয়েছে, তা নাহলে আমার স্ত্রী কিছুতেই বাড়ি ত্যাগ করত না। কিন্তু আমি সেই টেলিগ্রাম আসার সময়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? আমি এর আগে বিমানযাত্রার অনুমতি পেলে, সরাসরি বাড়ি চলে গিয়ে বাড়ির এই হাল দেখে ধরে নিতাম যে, আমার স্ত্রী কন্যাদের হত্যা করা হয়েছে। ওই সময়ে টেলিগ্রামটা পাওয়াতে আমি সেই মুহূর্তের আতঙ্ক ও বুকের যন্ত্রণা, বেদনা থেকে অব্যাহতি পাই। এই খবর পেয়ে আমি সরাসরি বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে যাই এবং আমার পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত হই। দিন গড়িয়ে যায় এবং আমি আমার স্ত্রীর অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারি। আমি তাকেই সেসব বর্ণনা করতে বলব।” [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৮)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৭)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;