কালের স্বর্ণে লেখা দ্যুতিময় নাম শামসুর রাহমান



ধ্রুব সাদিক
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

কালের ধুলোয় লেখা-র পূর্বলেখে লিখেছেন, কস্মিনকালেও সন্ন্যাসী কিংবা দরবেশ হওয়ার কথা ভাবেন নি তিনি, আমরণ তাঁর বিশ্বাস ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’ পঙক্তিতে। উল্লেখ করেছেন আরো, প্রত্যেক মানুষের জীবনই একটি ওডেসি, কারো ওডেসি ঘটনাবহুল, বৈচিত্র্যময়, বর্ণাঢ্য, কারো সেই পরিমাণ নয়। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় আবার বলেছেন, শুধু দরবেশরাই পারেন পুরোপুরি নির্মোহ হতে, তাই নিজের কবিতা বাছাইয়ের কাজ এত কঠিন।

২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে মহানগরী ঢাকার শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যেদিন শেষ নিঃশ্বাস তিনি ত্যাগ করেন, এক নিরবতা এবং কেমন নিস্তব্ধতা কি নেমে এসেছিল সে-সন্ধ্যায় রাষ্ট্র বাংলাদেশে? যেন একজন শেরপার মহাপ্রয়াণ হয়েছিল সেদিন, যিনি, বাংলা সাহিত্যের কাব্যকাঠামোর নববিন্যাস মানেই যার কবিতা, সেদিন বিদায় জানিয়েছিলেন মাতৃসমা পৃথিবীকে। যিনি জীবদ্দশায়ই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত ছিলেন।

কালের পথ পরিক্রমায় জীবন ঘষে যারা আগুন জ্বেলেছেন সেইসব আলোর পথযাত্রীদের একজন শামসুর রাহমান। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সোনার বাংলা পত্রিকায় ‘ঊনিশশ ঊনপঞ্চাশ’ নামে, ১৯৪৯ সালে। এরপর বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে শামসুর রাহমানের। বিভিন্ন পত্রিকায় এ-সময় তাঁর কবিতা ছাপা হতে থাকে। তবে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় কবি হিসেবে পরিচিত হওয়ার অনেক পরে, ১৯৬০ সালে, ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ শিরোনামে। জীবনানন্দের ঈষৎ ছায়া পরিলক্ষিত হলেও কবিতার বইটিতে তাঁর মৌলিক কবিপ্রতিভার ছাপ স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’ প্রকাশিত হলে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। বরিশালের এবং রূপসী বাংলার কবির প্রতি হয়তো একধরনের গভীর ভালো লাগা ছিলো কবির, যার কারণে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধের বইটির নামই ছিল ‘আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ’।

প্রগতির সূর্যসন্তান শামসুর রাহমান ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে লিখেন ‘হাতির শুঁড়’ কবিতা। কারাগারে অন্তরীণ শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে লিখেন ‘টেলেমেকাস’ কবিতাটি। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ কর্মরত থাকার পরও পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শামসুর রাহমান। ১৯৬৮ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের সকল ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করলে শামসুর রাহমান মাতৃভাষার উপর শোষকের খড়গের বিরুদ্ধে শুধু বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লিখেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’-র মত হৃদয়স্পর্শী কবিতা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ‘আসাদের শার্ট’-এর মতো স্বজাতির করোটিতে গুলিবিদ্ধ চির-অমর কবিতাও লিখেছেন।

সাহিত্যে কবিতার চিরন্তনতার ব্যাপারটি চলে আসে। ফলত অপশাসন, অপশাসকদেরকে সমুচিত জবাব দেওয়ার চিরন্তন একটি অনুষঙ্গ হিসেবে কবিতা চলে আসে। যেসকল কবি শুধু মাটি, মানুষ, সুন্দর ও স্বদেশকে আপন জ্ঞান করে জড়ভরত হয়ে থাকেন, নিজেকে সেরকম জড়ভরত করে রাখেননি শামসুর রাহমান। একজন দায়বদ্ধ কবির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ফলত কবির দায়বদ্ধতা থেকে অপশাসকদের অপশাসনের সমুচিত জবাব দেওয়ার এক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে শামসুর রাহমানের ‘মেষতন্ত্র’ কবিতাটি আমাদের চোখে ধরা দেয়। ‘মেষতন্ত্র’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই: শাসক ও জনতাকে কেন্দ্র করে মেষ ও মালিক বিষয় দুটি এসেছে। জনতা কথা বলতে পারে না; তাদের মুখ বোবা; তারা শুধু শাসকের হুকুম পালন করে, অথচ তারাই কিনা আবার উজ্জ্বল করে রাষ্ট্রের মুখ। কিন্তু কী নির্মম পরিস্থিতি! দিন-রাত-মাস-বছর চলে যায় জনতা টুঁ-শব্দটিও করতে পারে না। শাসকের শোষণে জনতা যেন অতিষ্ট ও নিরুপায় হয়ে দিনাতিপাত করে।

‘দিনদুপুরে ডাকাত পড়ে
পাড়ায় রাহাজানি,
দশের দশায় ধেড়ে কুমির
ফেলছে চোখের পানি।’
[মেষতন্ত্র]

এদিকে যে দেশের আপামর জনগণ যুদ্ধ করেছে নিজস্ব ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা, অথর্নীতি ও অধিকারের আশায়, সে রাষ্ট্রে কিভাবে গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক নীল ব্লেজারে চারিদিক আচ্ছাদিত থাকে নিশিদিন; স্বৈরাচারী আচরণ বহাল রেখে কিভাবে গণতন্ত্রের নামে হরণ করা হয় মানুষের অধিকার; শামসুর রাহমান লিখলেন:

‘ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।’
[উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ]

পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের কবিতা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি-জ্ঞান করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলো, তার বিপরীতে কবিতায় শামসুর রাহমানের মিথের ব্যবহার এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা কবির অদম্য সাহসকে প্রতিনিধিত্ব করে। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতার বইটির পুরাণ ব্যবহারের ধরনে স্পষ্টত দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নসূত্র লুপ্ত করতে পেরেছিল। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’ ‘খাণ্ডবদাহন’ মিথটির ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্গত সৌরভ-সুগন্ধির স্মারক হয়ে উঠেছে। এছাড়া ‘প্রবেশাধিকার নেই’ কবিতায় ‘দুর্বাসা’ মুনি আর ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায় ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’-এর মিথ ব্যবহারের মধ্যেও। যে চেতনা জাতির অধিকাংশ মানুষকে একই আবেগ আর স্বপ্নের ছায়ার নিচে নিয়ে এসেছিলো, ১৯৭১-এ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রায় অস্ত্র ছাড়াই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছিলো, আকুল স্বাধীনতার যে পিপাসা সর্বস্তরের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল, সবাইকে একই স্বপ্নে শামিল করানোর এই কাজটি করেছিল মূলত জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যকার শ্রেণিচেতনা। ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতার বইয়ে কবি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, স্বাধীনতার জন্য কারা কারা অপেক্ষা করছে বা আত্মত্যাগের জন্য ঘর ছেড়েছে। কবি তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেছেন ‘হাড্ডিসার অনাথ কিশোরী’, ‘সগীর আলী, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক’, ‘কেষ্টদাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা’, ‘মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি’, ‘রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা’ আর ‘রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো সেই তেজী তরুণ’। একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তিনি যখন স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত করেন ‘গ্রাম্য মেয়ে’ থেকে শুরু করে ‘মেধাবী শিক্ষার্থী’ হয়ে ‘মজুর যুবা’ পর্যন্ত।

নাগরিক জীবনের পরাঙ্মুখ ছায়া শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় উন্মোচন করেছেন। আধুনিক কবিতার প্রধানসব বৈশিষ্ট্য: নাগরিক জীবনের হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, নৈরাশ্য, সংগ্রাম মনস্কতা, মানসিক ক্লান্তি, শহুরে জল ও গরলের পাশাপাশি সমকালীন রাজনীতিও বহুমাত্রিকতায় তাঁর কবিতার ছত্রেছত্রে ধরা দিয়েছে। এছাড়া, নাগরিকতার অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় শহুরে প্রেম, প্রকৃতি, পরিবেশ-পরিস্থিতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ। এমনকি কবি নিজেও ‘ইকারুশের আকাশ’ কবিতার বইটিতে নিজেকে নাগরিক কবি হিসেবে তুলেও ধরেছেন। ফলতঃ শামসুর রাহমানকে নাগরিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করাটা সমীচীন। কিন্তু শুধুই নাগরিক কবি হিসেবে তাঁকে গণ্ডিবদ্ধ করাটা অসমীচীন শুধু নয় একদম অনুচিত। ‘মাতাল ঋত্বিক’-র সনেটগুচ্ছের ‘আমিও বনের ধারে’, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘আমার তৃষ্ণার জল’ সনেটগুলি ছাড়াও যার স্পষ্টত প্রমাণ পাওয়া যায় ‘রূপালি স্নান’, ‘কবিকে দিও না দুঃখ’, ‘দুঃখ পেতে থাকি’, ‘রেনেসাঁস’, ‘চাঁদ সদাগর’ প্রভৃতি কবিতায়।

‘আমিও বনের ধারে মধ্যে-মধ্যে একা চলে আসি
শহর পেছনে ফেলে। কোলাহলহীন বেলা কাটে
ঘাসে বসে ঝিলের ঝিলিক আর বীতশস্য মাঠে
পাখি দেখে, শিস বাজে ঘন ঘন; ক্লান্ত শীর্ণ চাষী,
সূর্যসেঁকা, বৃক্ষতলে স্বপ্ন শোঁকে, আশ্রয়-প্রত্যাশী
পান্থজল লম্বা পায়ে বসতির দিকে পথ হাঁটে
এবং সূর্যের চোখ বুজে আসে মেঘাচ্ছন্ন খাঁটে।’
[আমিও বনের ধারে]

যেসকল বৈশিষ্ট্য থাকলে একজন কবি তাঁর ভাষার ও জাতির বড় কবি বলে পরিগনিত হয়ে থাকেন, সেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকাংশই শামসুর রাহমানের ছিল। স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত যে বৈশিষ্ট্যটি খালি চোখে ধরা পড়ে সেটা হলো, তাঁর কবিতার একটি বড় অংশের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাস রাষ্ট্র বাংলাদেশের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে।

শামসুর রাহমানকে নিয়ে একটি প্রবন্ধে হুমায়ূন আজাদও উপরের নির্মোহ সত্যটি তুলেও ধরেছেন- “আধুনিক কবি শামসুর রাহমান আত্মপ্রকাশে তিরিশের উত্তরসূরি আধুনিক কবি ও কবিতাকে অক্ষুন্ন রেখেছেন। শামসুর রাহমানতো পঞ্চাশের কাব্যপ্রতিভা তাই তাঁর স্বাতন্ত্র্য অবশ্যম্ভাবী। তিরিশের কবিতার কাব্যপ্রতিভার মধ্যে শামসুর রাহমান তার সঙ্গে গেঁথেছেন বাস্তবতা ও অব্যবহিত প্রতিবেশ ও সময়। শামসুর রাহমান সমকালে বিস্তৃত ও বাস্তবতাকে ধারণ করেছেন। তার কবিতায় উঠে এসেছে জাতীয় চেতনার প্রতিটি দ্রোহ, উন্মাতাল, আবহ, উত্তাপ, গণমুক্তির মূখর শব্দামালা। শামসুর রাহমানের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বাস্তব প্রতিবেশকে ব্যাপক বিস্তৃত বাস্তবতাকে তাঁর কবিতায় ধারণ করেছেন নিজ স্বভাবে। তাইতো তিনি বাংলাদেশের একমাত্র প্রধান কবি রূপে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। পঞ্চাশের দশক থেকে নতুন শতাব্দীর শুন্য দশক পর্যন্ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শামসুর রাহমানের কবিতা যে চেতনা ও আকর্ষণের জোরেও দীপ্যমান তা হলো তার কাব্যশৈলী, উপমা, প্রতীক, শিল্পরূপ ভাষার সারল্য, আধুনিক কবিতার শব্দ ও চিত্রকল্প কাব্য ভাষার গেীরবময় এতিহ্যে ও গভীর ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি তার কবিতাকে যুগে যুগে মানুষের সুখ ও দুঃখের সাথী করেছে।”

শামসুর রাহমানের জন্ম পুরনো ঢাকার মাহুতটুলি এলাকায় নানাবাড়িতে, ২৩ অক্টোবর ১৯২৯ সালে। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। প্রয়াণের ১৪ বছর পরে ফিরে তাকালে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে, যে ৭৭ বছরের এক জীবনে কি লিখেননি শামসুর রাহমান! কবিতা ছাড়াও শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, প্রবন্ধসহ সাংবাদিক ও সাহিত্য-গদ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সবমিলিয়ে শতাধিক গ্রন্থ। জনপ্রিয় কিছু গানের গীতিকারও তিনি। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননাও লাভ করেছেন শামসুর রাহমান। অনেক প্রতিষ্ঠানই তাঁকে সম্মানিত করতে পেরে নিজেরাই এমনকি সম্মানিত বোধ করেছে। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভূষিত করে কবিকে সম্মান সূচক ডি.লিট উপাধিতে।


সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা
১। শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ শেরপা, হুমায়ুন আজাদ, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৩।
২। আধুনিক কবি ও কবিতা, হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলা একাডেমি, ১৯৭৩।
৩। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, রফিকুল ইসলাম, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;