কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

অই তো যায়, টু আ পেনি

[পূর্ব প্রকাশের পর] আমাদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, আমরা উদ্বিগ্ন পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে চিঠি পেতে শুরু করি। তার সব ক’টার সুরই এক। “তোমরা নিশ্চয়ই দেশ ছাড়তে পেরে খুব খুশি! তা তোমাদেরকে কবে নাগাদ আমরা আমেরিকায় আশা করতে পারি?”

কিন্তু আমাদের কারুরই আমেরিকার দিকে যাত্রা করার বাসনা ছিল না। আমরা এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে চাইনি, আর আমাদের মধ্যে যাদের পুনঃপ্রবেশের ভিসা ছিল না, তারা আর কোনোদিন ফিরতে না পারার আতঙ্কে ছিল। আমরা জানি প্রভুই আমাদেরকে বাইরে নিয়ে এসেছেন, যদিও আমরা বুঝিনি এর পেছনে তাঁর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমরা শুধু এটুকু জানি, আমরা সবাই ফিরতে চাই, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

যুদ্ধবিদীর্ণ দেশটিতে আমরা আমাদের বাড়িঘর, জিনিসপত্র, বন্ধুবান্ধব এবং আমাদের হৃদয়খানি ফেলে এসেছিলাম।

আমরা মেয়েরা যখন কেনাকাটায় আর বাচ্চাদের ফুর্তিতে রাখার প্রচেষ্টায় আনন্দেই ছিলাম, পুরুষেরা তখন আমাদেরকে ব্যাংককের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত ছিল। পরিস্থিতির জটিলতা ছিল বহুমাত্রিক। তিনটি পরিবারের কিশোরবয়সী বাচ্চারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মারিতে। আমরা ব্যাংককে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই, আমাদের দলের যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তাদের কাছ থেকে এরকম চিঠি পেতে শুরু করি যে, কিছু বাচ্চা খুবই আতঙ্কিত হয়ে আছে এবং তারা তাদের বাবামাকে পাশে চাইছিল। যাদের কোনো বাচ্চা ছিল না সেখানে, তাঁরা একগাদা পয়সা খরচ করে সেখানে গিয়ে বেকার বসে থেকে, পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার অনুমতি পাবার প্রত্যাশায় দিন গোনার সম্ভাবনায় খুব একটা প্রীত ছিলেন না।

যদিও আমাদের পাকিস্তানে ফিরে যাবার একমাত্র সম্ভাবনা, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী দেশত্যাগীদের একসঙ্গে দলবেঁধে থাকার মধ্যেই নিহিত ছিল। আমাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু তারা আমাদের দেশ ছাড়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল, সেহেতু নিশ্চয়ই তারাই আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তবে এটা তত সহজ ছিল না। আমেরিকার সরকার যতটা করার করছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার আমাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। আমরা তাদের সেই মিথ্যে বুদ্বুদখানি ফাটিয়ে দিয়েছিলাম, “পূর্ব পাকিস্তানে সব স্বাভাবিক রয়েছে।”  যদি সব স্বাভাবিকই থাকত, তাহলে মার্কিন সরকার কেন সবাইকে বিশেষভাবে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল?

এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় এই তথ্যটুকুও যে, আমাদের অর্ধেকেরও বেশির ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেও আমাদের ফিরতে অসুবিধা হবার কথা।

শহরে আমাদের ঘোরাঘুরির সময় আমরা প্রায়ই পাকিস্তান দূতাবাসের পাশ দিয়ে যেতাম। প্রতিবারই তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মেল বিল্‌স প্রাণভরে একবার বলে উঠতেন, “জয় বাংলা”। তাঁর স্ত্রী মার্গি, এটা শত্রুর কানে গিয়ে পৌঁছানর ভয়ে এবং তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে ভেবে তার স্বামীকে তা বলা থেকে বিরত রাখতে চাইছিল।

“ঠিক আছে,” তিনি রাজি হন। “আমি চুপ থাকব, ভেতরে কিন্তু ঠিকই এটা উচ্চারণ করব।”

জে ওয়াল্‌শ ও মেল বিল্‌স মার্কিন দূতাবাস আর পাকিস্তান দূতাবাসের মধ্যে ছোটাছুটি করছিলেন কেবল। পরেরটাতে প্রভু আমাদের পক্ষে ছিলেন। যার দায়িত্ব ছিল এই অনুমতিপত্র প্রস্তুতের, তিনি ঢাকার মানুষ ছিলেন বলে। জে একটু হালকা বোধ করায় তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথাবার্তা শুরু করেন। বাঙালি অফিসারের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তিনি গলা নিচু করে গোপনে তাঁর কাছে দেশের অবস্থা জানতে চান। এরপর থেকে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন আমাদের সাহায্য করতে, যদিও তাঁর শ্রেষ্ঠটাও আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। চূড়ান্ত অনুমোদন আসবে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর থেকে।

আমেরিকান পর্যটকেরা থাইল্যান্ডে মাত্র পনেরোদিন থাকতে পারত। তারপর তাদেরকে দেশ ছেড়ে আবার নতুনভাবে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হতো। আমাদের পনেরোদিন অতিবাহিত হবার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা পেনাং দ্বীপে একটা ছোটখাটো ছুটি কাটাব। আমরা যখন বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য বাসে উঠছিলাম তখন সেখানকার এক কর্মচারী জে-কে বার্তা পাঠান। এই বার্তা আমাদের আনন্দময় ভ্রমণের অনুকূল ছিল না। মার্কিন সরকার এইমাত্র তাদের ইসলামাবাদের পাল্টাপক্ষের কাছ থেকে একটা টেলেক্স পেয়েছেন এই নির্দেশসহ যে, আমরা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবেশের চেষ্টাও না করি। সেই অংশ থেকেও মিশনারিদের বার করে দেওয়া হচ্ছিল।

তখন প্রভু ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না আমাদের। আমাদেরকে অ্যাসেম্বলি অভ গড মিশনারিদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হলো, যারা বলতেন, “যখন তোমাদের মনে হয় যে, প্রভু ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই, তার অর্থ হচ্ছে খাবার ছাড়া আর কিছু খাওয়ার নেই তোমাদের।”

আমরা ঈশ্বরের কাছেই গিয়েছিলাম। আমাদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রর্থনাগুলোতে আগের মতো আর বলছিলাম না, “প্রভু আমাদেরকে ফিরিয়ে আনুন,” বরং অনুরোধ করছিলাম, “প্রভু আমাদেরকে বলে দিন আপনি কী চান, আমরা তা-ই করব।”

জে যাদের সঙ্গে ছিলেন তারা আমাদের যাওয়ার কয়েকদিন আগে ব্যাংকক ফিরে গেল। তিনি সবে ফিরেছেন, অমনি পাকিস্তানি দূতাবাস তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বার্তাটা দেখালেন, “এই মানুষগুলোকে পাকিস্তানে ঢোকার ব্যাপারে যা করার করুন।”

জে গোটা ব্যাপারটা দ্রুতই আন্দাজ করে ফেললেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের মনে আসলে একটা সাধারণ ভ্রমণ অনুমতির বিষয়টাই ছিল, যার মাধ্যমে বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদেরকে তুলে নিয়ে আবার বেরিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি কর্মকর্তাকে দিয়ে এর এমন এক ব্যাখ্যা করালেন, যার অর্থ দাঁড়ায়, “এদের সবাইকে চার বছরের জন্য বহুপ্রবেশ ভিসা দেওয়া হোক।”

আবারও ঈশ্বর আমাদের এই বিশ্বাসের প্রতিদান দিলেন তাঁর উপহারের ঝুলি খুলে। আমাদের প্রত্যেককে, যাদের স্রেফ একটি ভিসাই দরকার ছিল, এমনকি যাদের ভিসার মেয়াদ ফুরোয়ওনি, তাদেরকে সুদ্ধ সব ভিসার সেরা ভিসাটি দেওয়া হলো। সেই চার বছরের বহুপ্রবেশ ভিসাটির অর্থ হলো, আমরা ভিসা নবায়ন না করেই আগামী চার বছর যতবার ইচ্ছা আসাযাওয়া করতে পারব। আমাদের কোনো কোনো নবাগত মিশনারি জীবনেও এটা পাননি, কেননা পাকিস্তানে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁরা এটা নিয়ে আসতে পারেননি।

জে আমাদেরকে পেনাংয়ে ফোন করে সুখবরটা দেন এবং আমরা এই পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে ফিরতি বিমান ধরি সঙ্গে সঙ্গেই। মে মাসের ১৭ তারিখ জে আমাকে, লিনকে আর বেকিকে নিয়ে যান আমাদের পাসপোর্টে ভিসার সিল মারাতে। ফেরার পথে আমেরিকান দূতাবাসে দাঁড়ালে তখনকার কর্তব্য কর্মকর্তা জে-র দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই লোক একেবারে চাঁদের দিকে তির ছোড়েন, তাই না?” তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, “আপনার মনে হয় ওপরে কেউ আছেন আপনার হয়ে কাজ করার জন্য।”

আমাদের ভিসা ও টিকিটের জন্য অপেক্ষা করার সপ্তাহগুলোতে আমরা পত্রিকার খবর গিলছিলাম এবং যে-কেউ পাকিস্তানের ওপর কোনো খবর পড়তে থাকলে অভদ্রের মতো তার কাঁধের ওপর হুমড়ি খেযে পড়ছিলাম। নিউজ উইকের ২৬শে এপ্রিল সংখ্যার এই ধরনের খবরের বিশেষ গুরুত্ব ছিল আমাদের কাছে।

… নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত একটি গৃহযুদ্ধে, ঝটিকা আক্রমণগুলো পরিচিত ছিল তাদের বর্বরতার জন্য। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে, পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বন্দিদের জোরপূর্বক ট্রাকে তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে—যেটা ছিল তাদের প্রিয় শ্লোগান। এই শ্লোগান শুনে লুকিয়ে থাকা বাঙালিরা বেরিয়ে এলে, তাদেরকে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি করে মারে। সিলেট ও কুমিল্লা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যেরা শত শত বাঙালি কৃষকদের লাশ ফেলে রাখে যত্রতত্র শকুন ও কুকুরের খাদ্য হবার জন্য।

আমরা খবর পাই প্রতি দিন প্রায় এক লাখের মতো বাঙালি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। সেইসব হাজার হাজার শরণার্থীর বহন করে নিয়ে যাওয়া হাজারো ট্রাজেডির গল্প শুনি আমরা: বাচ্চাদের সামনে বাবা-মাকে হত্যা করা; বাচ্চাদের ওপরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সৈন্যদের বেয়নেটের ডগায় গেঁথে নেওয়া; কমবয়েসি মেয়েদের জোর করে যৌনদাসী করে রাখা; পুরুষদের চোখ উপড়ে ফেলে পিটিয়ে মারা ইত্যাদি।

এইসব নির্মমতার কথা জেনে বরং আমাদের ফেরার ইচ্ছা আরও প্রবল হয়, যাতে করে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি। তবে সেদিনের সেই অসহ্য গরমে ব্যাংককের রাত্রিতে প্রার্থনারত অনেকেই অনুৎসাহিত ছিল এতে। কিন্তু আমাদের তো পর্বত-চূড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন, আমাদের হাতে ভিসা এসে গেছে।

আমাদের দলের অর্ধেক সিদ্ধান্ত নেন মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ছোট্ট বিরতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার। মালুমঘাট ছাড়ার পর চৌত্রিশজনের আমাদের এই দলটি গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে এতটা সময় একসঙ্গে ছিলাম যে, এমনকি ছোট্ট বারো বছর বয়সী ফিলিপ ওয়াল্‌শও, প্রথম দলের সদস্য তার পরিবারের হাত ধরে অনিচ্ছুকভাবে বলে, “আমি সত্যি মনে করি না আমাদের দল ভাঙা উচিত।”

আমরা যারা ব্যাংককে ছিলাম তারা এই সংবাদ শুনে উল্লাস করি যে, ঢাকার যাত্রাবিরতিতে ডাঃ ওল্‌সেন তাঁর নিজের পরিবার, ওয়াল্‌শ ও কেচামের পরিবারকে অভ্যর্থনা জানান এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা কোথায় থাকবেন তার একটা ছকও আঁটেন। তাঁরা সবাই ফিরে গেছেন, আর আমরা এখানে এই গরম, গুমোট ব্যাংককে আটকে আছি।

পাকিস্তানি দূতাবাস প্রতিজ্ঞা করে যে, ঢাকা প্রত্যাবর্তনের অনুমতি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের খবর দেবে। কিন্তু অনেক কটা দিন কেটে যায়, কোনো খবর আসে না। ২৯শে মে শুক্রবার মেল বিল্‌স দূতাবাসে আশ্রয় নেন, কিন্তু দুপুরের পরেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। মুসলিম দেশগুলোতে শুক্রবার দুপুরেই অফিস বন্ধ হয়ে যায়, আর কোনো সরকারই শনিবার ও রবিবার খোলা থাকে না। সেখানে কোনো সম্ভাবনাই ছিল না যে, আমরা রবিবার বিকালের বিমান ধরতে পারব।

আমরা আসলে ৩১শে মে রবিবার রাতে ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ অভ ব্যাংককে শুরু হতে যাওয়া বিলি গ্রাহামের ছবি টু আ পেনি দেখার ওপর একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম, কেননা ততদিনে আমাদের কাছে কেনাকাটা করা, চিড়িয়াখানায় যাওয়া এমনকি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটাও আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল।

প্রার্থনার সময় অনেকেই স্বীকার করেছিলেন যে, আমাদের বিশ্বাস একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। অন্যেরা ইতোমধ্যেই ফিরে গেছেন, তাহলে আমরা নই কেন? ঈশ্বর কি তাহলে চাইছিলেন না যে, আমরা ফিরে যাই? এতগুলো সপ্তাহ এখানে বেকার বসে থাকার পর আমাদেরকে কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেই ফিরে যেতে হবে? আমরা কি তবে মিশনের পরিচালনা পর্ষদের এই পরামর্শকেই মেনে নেব যে, আমাদের মধ্যে যারা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের ফিলিপিন্সে গিয়ে স্বাস্থ্য-কর্মসূচিতে কাজ করা উচিত? লিন সে-রাতে বিশেষ কিছু বলেনি। সে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছিল আগেই: ঈশ্বর আমাদেরকে ফিরিয়ে নেবেন, এই রবিবারেই!

ব্যাংককের ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ প্রথমে তাদের প্রার্থনাসভার আয়োজন করে, তারপর সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে, রবিবারের স্কুলের ক্লাসগুলো চালায়। সকালের অধিবেশনের উপসংহারে পাদ্রি একটা বার্তা পড়ে শোনান, “এখানে যদি ডাঃ কুক বলে কেউ থাকেন, তাহলে তাঁকে ফোনে ডাকা হচ্ছে।” আমাদের ড. ডিকুক ভাবেন নামটা যথেষ্ট কাছাকাছি, তাই তিনি দৌড়ে গিয়ে সবচেয়ে কাছের যে-ফোন সেটা ধরেন। আমরা তখন রবিবারের স্কুলের উদ্বোধনী প্রার্থনাসংগীত গাইতে শুরু করে দিয়েছি, যখন তিনি আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে ফিরে আসেন। বাকি জমায়েতকে একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদান করে আমরা দ্রুত হেঁটে, বলা চলে প্রায় উড়ে, চলে যাই লবিতে।

বেচারা জো ডিকুক গল্পটা একটু রসিয়ে বলারও সময় পেলেন না। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স এতগুলো যাত্রী হারাতে চায় না বলে সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর বিশেষ চাপ প্রয়োগ করে। দেশে প্রবেশের অনুমতি এসে পৌঁছেছে পিআইএ অফিসে। আমরা কি বিকাল ৫টার মধ্যে তৈরী হতে পারব? পারব আমরা? অর্ধেক মহিলা ততক্ষণে লিফটে ঢুকে গেছেন প্রায়, হোটেল ত্যাগ করার জন্য, ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ তাদের সভাটি হোটেলেই করেছিল। আমি আরো এক তলা সিঁড়ি ভেঙে বাচ্চাদেরকে ক্লাস থেকে বার করে আনি এবং জুনিয়র ক্লাসের ছাত্রদেরকে অন্যদের বিরক্ত না করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত করি। তারা আমার সঙ্গে হলঘরে এসে দেখা করে।

“ব্যাপার কী?” দশ বছর বয়সী ড্যানি জিজ্ঞাসা করে।“

আমরা আজ বিকালে বাড়ি যাচ্ছি, ড্যানি।” আমি উত্তর করি।

“বাড়ি? মানে আমরা পাকিস্তান ফিরে যাচ্ছি? কী মজা! আমাকে ক্লাসে ফিরে গিয়ে সবাইকে তা বলতে হবে। তারা সবাই প্রার্থনা করছিল যেন আমরা ফিরে যেতে পারি।”

আমাদের প্রার্থনার এমন ইতিবাচক উত্তরের অভিঘাত আমাদের মধ্যে দৃশ্যমান হয়, আমরা যখন অতগুলি সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নেমে আসি।

“অই যায়, টু আ পেনি!” আমরা ট্যাক্সিতে ওঠার সময় ড্যানি বলে ওঠে। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১২)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১১)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)

 

 

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;