লকডাউন



আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

হাজার পঞ্চাশ স্কোয়ার ফিট মেঝের ওপর যদি তিন রুমের অ্যাপার্টমেন্ট হয়, তাতে যদি দুটো বাথরুম কিচেন ডাইনিং-ড্রইং স্পেসও থাকে তাহলে অনুমান করা যায় এককটা রুমে ডাবল খাট ফেলার পর ওয়ার্ডরোব ঢোকালে পা চালানোই মুশকিল। মাস্টার বেডে আবার বইয়ের আরমারি ঢুকানো হয়েছে। চুমকি বই পড়ে। ইংরেজি-বাংলা দুই ভাষার বই-ই।

কম কথা বলে, রাগ হলে মাথা ঝিমঝিম করে, পিরিয়ডের প্রথম দুটো দিন মেজাজ খারাপ থাকে, সবুজ রঙের কোনো কাপড় দুচক্ষে দেখতে পারে না, যেখানে ছোট বোন রুমকির সাথেই এক বিছানায় থাকতে ইচ্ছে করত না সেখানে একজন ব্যাটাছেলের সাথে ঘুমোতে হবে এটা ভাবতেই গাটা কেমন যেন করে ওঠে—এসব কথা আমাকে বিয়ের আগেই শুনিয়েছে। আমাদের বিয়ের আগে ঠিক প্রেম নয়—কথাটা বলার এই পর্বটি মাত্র চুয়াল্লিশ দিনের। তখনও সম্পর্কের ধরনটা আপনি সম্বোধন নির্ভর ছিল। বিয়ের ঠিক আগের দিন আমরা একই সঙ্গে তুমিতে নেমে আসি টেলিফোন আলাপের মাধ্যমে। ঢাকা শহরে আমার তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকায় কেবল ছবি তোলার জন্য তাদেরই বিল্ডিংয়ের ছাদে চুমকির একটা নামমাত্র গায়ে হলুদ হয়েছে।

বিয়ের পর তিনটা বছর আমাদের ভালো যায়নি। প্রথম বছরই আমরা দুজনই বুঝি ভুল হয়ে গেছে। চুমকি রাখঢাক না করে বলেছে যার ইন্টেলেকচুয়াল কোনো ডেপথ নেই তাকে বিয়ে করা আর মিরপুর চিড়িয়াখানার একটা শিং ভাঙা মহিষকে বিয়ে করা একই কথা।

মিরপুর চিড়িয়াখানায় শিং ভাঙা কোনো মহিষ আছে কিনা তাও আমি জানি না। তিন বছর কোনোভাবে কাটলেও পরের দুটা মাস আমাদের দুজনের জন্যই ছিল ভয়ঙ্কর। চুমকি বলল, তোমার লজ্জা করে না শ্বশুর বাড়িতে থাকো?

অবশ্যই করার কথা। সে জন্যই তো আমি আমার দেড় রুমের ভাড়া বাসা ছেড়ে আসতে চাইনি। বলেছি চালো আপাতত, এখানেই উঠি তারপর দেখেশুনে দু রুমের একটা বাসা নেব। ঘরজামাই থেকে আমার বাবাকেও যথেষ্ট লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। আমি এর মধ্যে নেই। কেউ কিছু না বললেও আমার মনে হতো নিশ্চয়ই আমাকে কিছু একটা বলছে। মনে করে দেখো তুমি কী বলেছিলে।
কী বলেছিলাম?

বলেছিলে অ্যাপর্টমেন্টটা তো তোমার শ্বশুরের নয় যে তোমার ঘরজামাই ঘরজামাই লাগবে। বাবা দিলেও এটা আমার নামেই পাকাপাকি রেজিস্ট্রি করা। স্ত্রীর সম্পত্তি থাকলে ঘরজামাই বলার কোনো সুযোগই নেই।

তুমিই একটা পিকআপ ভ্যান নিয়ে আমার যা যা ছিল সব এনে তুললে তোমাদের অ্যাপার্টমেন্টে। জায়গা ছিল না বলে আমার প্রায় সব জিনিসপত্র রাখলে তোমাদের নামে বরাদ্দ গ্যারেজের জায়গাটিতে। তোমাদের গাড়ি ছিল না গ্যারেজ ছিল। কেবল আমার একটি ছোট্ট টেবিল আর রিভলভিং চেয়ারটা সিমকি তার রুমে ঢুকিয়েছে। তোমার ভাবি তোমার মাকে পছন্দ করতেন না বলে তিনি রয়ে গেলেন তোমার সাথে—মানে আমাদের সাথে। রুমকির অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়েছে। তোমার মা আর সিমকির যৌথভাবে একটি অ্যাপার্টমেন্ট সেখানে থেকেও ভাড়া আসে। ব্যবস্থা এমনভাবেই করা হয়েছে যেন তোমার মায়ের মৃত্যুর পর কেউ মায়ের সম্পত্তির ভাগ না চায়—এটা পেয়ে যাবে সিমকি।

এতসব কথা আমি বলিনি; এমনিই বিড়বিড় করেছি।
যা আমি স্পষ্ট করে বলেছি তা হচ্ছে বেশ আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।

আরো আগে বেরোনো উচিত ছিল। ডিভোর্স আমিই দিচ্ছি, কাগজটা নিয়ে তবে যেয়ো। তুমি আমাকে ডিভোর্স করেছো এই অহঙ্কার করার সুযোগ চুমকি তোমাকে দেবে না।

তোমার সাথে থাকার প্রশ্নই আসে না।

সিমকি আটকাল, বলল, ফর গডস সেইক দুলাভাই যাবেন না। আমি মার রুমে চলে যাচ্ছি, তুমি এ রুমে থাকবে, তাহলে চুমকির সাথে থাকা হবে না। আমি তোমাকে মিস করতে চাই না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চুমকির অফিসের গাড়ি এসে পড়ে কাঁধে চামড়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে এক হাতে খাবারের হটপট অন্যহাতে শাওমি স্মার্ট ফোন নিয়ে বেরিয়ে যায়। সিমকি বলল, চুমকির রুমের চাবি দাও তোমার জিনিসপত্রগুলো এখানে শিফট করি।

কিচেন একটা বাথরুম আর চুমকির মায়ের রুমটা ছাড়া সবগুলো লক করা থাকে। মাস্টারবেড, একটা চাবি আমার কাছেই থাকে। আমি রুম খুলে দিয়ে বেরিয়ে যাই। সিমকির দক্ষতা সম্পর্কে আমার সামান্য সন্দেহও নেই, অফিস থেকে ফিরে যখন এ রুমটাতে ঢুকব, এমনভাবে রুমটা গোছানো থাকবে যে এটাকে আমার রুমই মনে হবে। আমার অফিস দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বের মধ্যে। চুমকির গাড়িতে চল্লিশ মিনিট ফেরার সময় জ্যামে আটকা পড়লে আড়াই ঘণ্টাও লেগে যায়। আমি খাবার নিই না, অফিসের ক্যাফেটেরিয়াতে ভর্তুকি দামে পঁচিশ টাকায় ভরপেট খাওয়া যায়।

আমি স্থানান্তরিত হই ১৯ মার্চ রাতে। সিমকি সবই এনেছে পেস্ট-টুথব্রাশ, জিলেট শেভিং ফোম ও রেজর, ওল্ড স্পাইস আফটারশেভ লোশন, স্যান্ডেল, প্যান্টের বেল্ট প্যারাসিটামল ট্যাবলেট—যাতে আমাকে চুমকির ঘরের দরজায় ঢুকতে টোকা দিতে না হয়। তবুও বলল, অ্যাটাচডকাম নেই, তোমার কষ্ট হবে।

পরদিন শুক্রবার চুমকির সারাদিন বাসায় থাকার কথা, তার সাথে দেখা হয়ে যাওয়া এড়াতে নাস্তার আগেই বেরিয়ে যাই। বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাস সদরঘাট যাচ্ছে, আমি উঠে পড়ি। লঞ্চঘাটের কাছাকাছি একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে তন্দুর রুটি এবং খাসির পায়ার নেহারিতে একটি জবরদস্ত নাস্তা করি। টার্মিনালের ভেতর ঢুকে দূরগামী লঞ্চ দেখি, একবার ভাবি উঠে পড়ি কিন্তু শনিবার আমাকে অফিস করতে হয়।

মহসিন হলের আমার রুমমেট আবদুল হান্নানকে প্রায় চার মাস পর ফোন দিই, বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরায় তার বাড়ি ও কসমেটিক্সের কারখানা। কারখানাটা বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ডের প্রসাধনদ্রব্য এখানে তৈরি হয়। শুধু বিদেশি খালি কৌটা পেলেই চলে। ফোন ধরতেই বললাম, সদরঘাটে আছি নদী পেরিয়ে তোর বাড়িতে আসছি।

হান্নান বলল, ফিরে আয়, স্কোয়ার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার সামনে হাঁটাহাটি করছি, নার্গিসের জোড়া বাচ্চা হবে, বুঝলি দোস্ত দেলাইয়া দিলাম দুইটাই মই। তোর মতো আঙ্গুল চুষলে আঙ্গুল ক্ষয় হবে, বাচ্চা বের হবে না।

সুতরাং জিঞ্জিরা যাওয়া হলো না। এখানে আধঘণ্টা ওখানে পৌনে এক এমন করতে করতে ‘সাবলেট চাই’-র অন্তত দশটি বিজ্ঞাপন দেখে—ছয়টি সরেজমিনে দেখে রাত সাড়ে দশটায় বাড়ি ফিরি। সিমকি বলল, চুমকি ফোনে কোনো এক উকিলের সাথে কথা বলেছে। তাতে তার ডিভোর্স কেইসটা শক্ত করার জন্য তোমার বিরুদ্ধে কয়েকটা পয়েন্ট দাঁড় করাচ্ছে।

১. শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছো।
২. যৌতুকের জন্য মারধোর করেছো।
৩. স্ত্রীর ভরণপোষণ দিচ্ছো না।
৪. স্ত্রীর শারীরিক চাহিদা মেটানোর যে হক তা আদায় করছো না।
৫. সন্তানের আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও তাকে গর্ভবর্তী বানাতে পারোনি।

আমি বললাম, আসল পয়েন্ট তো বাদ পড়ে গেছে তার স্বামীর চরিত্র খারাপ অন্য নারীতে আসক্ত। উদাহরণ হিসেবে সিমকির নাম উল্লেখ করতে পারত।

সিমকি বলল, তাহলে তার মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই। কোনো কারণে কথাটা রাশেদের কানে গেলে ২৭ এপ্রিলের অনুষ্ঠানটা ভেস্তে যাবে।

সিমকির বিয়ে ২৭ এপ্রিল রাশেদের সাথে। ২৩ এপ্রিল কানাডার কুইবেক থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছাবে ২৫ তারিখ ঈদ করবে ২৭ তারিখ বিয়ে করবে, ৩০ তারিখে আবার চলে যাবে। রাশেদ কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছে মাত্র ছ’ মাস আগে। আমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে, নিজে থেকেই বলেছে, দিনের বেলা কিছু পড়াশোনা করি, ফ্রেঞ্চ ভাষাটা ভালো করে শিখেছি বলে ওখানকার স্যোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট ইন্টারসেক্টর হিসেবে ডাকে, সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত বারটা পর্যন্ত ক্যাব চালাই। সিমকিকে নিয়ে আসার পর টাইমটা আবার অ্যাডজাস্ট করে নেব। ফ্রেঞ্চটা সিমকিও কমবেশি শিখে নেবে। টরন্টো, আটায়া ও দিকটাতে ইংলিশ চলে, কিন্তু বাঙালি বেশি আমি বাঙালিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই।

রুমকির শাশুড়ির মৃত্যুশয্যায় শেষ দেখার জন্য রুমকি তার স্বামী রইস আহমেদ, তিন বছর বয়সী ছেলে ভিঞ্চি সাত দিনের জন্য ফ্রোরেন্স থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে সোজা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ নামের গ্রামে। তৃতয়ি দিনেই তার মৃত্যু হয়, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের রাতে আবার তারা ফিরে যাবে ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় চুমকি কিংবা সিমকিদের বাড়িতেই এসে হাজির, এখানে দু রাত পরের রাত তো উড়োজাহাজেই। যে রুমে আমার আশ্রয় হয়েছিল সেই রুমটিই ছেড়ে দিতে হলো।

তাহলে আমার রাতের আশ্রয় হবে কোথায়? একটাতে চুমকি, একটাতে রুমকি ও রইস আহমেদ এবং তাদের ভিঞ্চি। একটাতে আমার শাশুড়ি যার একটি বড় সময় শুয়েই কাটে, সাথে সিমকি। আমি কোথায়?

আমি ফিসফিস করে সিমকিকে বলি, আমি কোনো এক বন্ধুর বাসায় চলে যাচ্ছি, চিন্তা করো না যোগাযোগ রাখব।

ভয়ঙ্কর দুঃসাহসী একটি কথা বলে বসল সিমকি। বলল, বেশ তুমি চুমকির সাথে ঘুমাবে না, এই তো। আমি মাকে চুমকির রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমার সাথে ঘুমাবে। আমি হেসে উঠি এবং বলি, পাগলামির একটা সীমা থাকা চাই, কি রকম লঙ্কাকাণ্ড ঘটবে ভেবে দেখ।

সিমকি তখনই ঢুকল চুমকির রুমে, কী বলল আমি শুনিনি। কিন্তু দুতিন মিনিটের মধ্যেই চুমকি বেরিয়ে এসে আমার হাত ধরে প্রায় হেঁচকা টানে তার ঘরে নিয়ে বলল, কী নাটক শুরু করলে? রুমকির বরের সামনে এই বাহাদুরিটা না দেখালে হয় না?

পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যে টুথপেস্ট ব্রাশ রেজার শেভিং ফোম, স্যান্ডেল সব এনে চুমকির রুমে আগে যেখানে যেটা যেভাবে ছিল রেখে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে গুড নাইট বলে সিমকি বেরিয়ে গেল।

চুমকি বলল, অসুবিধে নেই, আমি আগেই সুইচ অফ করে দেব।

আমি বললাম, আলো থাকলে আমার সমস্যা হবে না যখন তোমার কাজ শেষ হবে তখনই অফ করো।

কাজ মানে উপন্যাস পড়া। ইংরেজি বাংলা দুই-ই। এক নজরে দেখলাম তার বইটার নাম লাভ স্টোরি। ওই এমনই হয়, নিজের জীবনে প্রেম না থাকলে লাভ স্টোরিই পড়তে হয়। এক সময় দেয়ালমুখো হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে নাস্তার সময় রইস আহমেদ বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমার তো চাকরি নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে। টার্কিশ এয়ারওয়েজ—আসা বা ঢাকা থেকে যাওয়া সব ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে।

রুমকি বলল, মানে? আমাদের টিকেট তো টার্কিশ এয়ারের।

তিনি বললেন ম্যাসেজ তো আগেই দিয়েছে, কিন্তু ওয়াইফাই জোনে না থাকায় দেখিনি, একটু আগে সিমকির কাছ থেকে তোমাদের বাড়ির পাসওয়ার্ড নিয়ে লগ-ইন করতেই একডজন ম্যাসেজ এলো। করোনা ভাইরাসকে প্যানডেমিক ডিক্লেয়ার করেছে। সার্সও তো প্যানডেমিক তখন তো এত ফ্লাইট ক্যানসেল হয়নি। এয়ারপোর্টে এটা-ওটা পরীক্ষা হয়েছে। রুমকি বলল, তোমার সিস্টেম ছাড়, অন্য যে এয়ারলাইনের টিকেট পাও সেটাই কেনো।

নাস্তার টেবিলে বসেই ফোন করলেন, কাকে করলেন তিনিই জানেন। কিন্তু এটা শুনলাম বার বার বলছেন, সর্বনাশ সর্বনাশ তাহলে কেমন করে যাব।

রুমকি বলল, মানে?

কোনো এয়ারলাইন্সই অপারেশনে নেই। ২৬ তারিখ থেকে টোটাল লকডাউন শুরু হয়ে যাচ্ছে। এয়ারপোর্টও বন্ধ।

এ বাড়িতে টেলিভিশন আছে। কিন্তু কেউ এমনকি হিন্দি সিরিয়ালও দেখে না। চুমকি একটু অবসর পেলে বই নিয়ে বসে, সিমকির হাতের মোবাইল ফেইসবুক হোয়াটসঅ্যাপ ভাইবার চলছেই, আমার শাশুড়ি বসে থাকলে ভার্টিগোতে পড়েন, এখন টিভির সামনেই আসেন না। পৃথিবী দেশ এসব নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি ভাবছি সাবলেটই ভালো, কিছু বাড়তি টাকা দিলে দুবেলা অফিসের খাবার ছ’ দিন তো আছেই, শুক্রবার দুপুরে বাইরে কোথাও মেরে দেবে। না খেলেও সমস্যা নেই। রাতে ভাত একটু বেশি টানবে।

রুমকি রিমোট কন্ট্রোল খুঁজে বের করে টিভি সার্ফ করতে শুরু করল। করোনা নিইে সবার কথা সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরা, বাংলাদেশ চ্যানেল বলছে ছাব্বিশ তারিখের পর থেকে সব অফিস আদালত বন্ধ। দেশে কমপ্লিট লক ডাউন। বাসা থেকেও কেউ বেরোতে পারবে না। বাসা থেকে বেরোনো ঠেকাতে পুলিশ র‌্যাব সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

রুমকি বলে, পৃথিবীটা কোন দিকে যাচ্ছে? আমি তো কখনো উহানের নাম শুনিনি। কেয়ামত এসে গেছে নাকি?

রাতের বেলা রুমকি বলল, ঐ দেখো টিভিতে চীনের বাংলাদেশিরা ফেরার জন্য কান্নাকাটি করছে, সরকার ব্যবস্থা করতে দেরি করছে বলে অভিশাপ দিচ্ছে। আরো দুটো খবর দিল রুমকি ইতালি আর আমেরিকার অবস্থা খারাপ। ও বাবা, এটা কি প্লেগ নাকি? ব্ল্যাক ডেথ?

সিমকি একটু পড়াশোনা করে বলল, শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে। সিমটম হচ্ছে জ্বর গলাব্যথা কাশি।

রুমকি বলল, ওহ মাই গড, আমার তো গলা ব্যথা, গত রাতে একটু জ্বরও ছিল। প্যারাসিটামল খেয়ে সামলেছি। করোনার নাকি কোনো ঔষধ নেই? আমি মরে গেলে ভিঞ্চির কী হবে?

রইস আহমেদ বললেন, চিন্তা করো না, তুমি মরে গেলে ভিঞ্চির কিন্ডারগার্টেনের অ্যাটেন্ডেন্ট ফ্রান্সেসকাকে বিয়ে করব, মেয়েটা ভিঞ্চির খুব টেইক কেয়ার করে।

হঠাৎ রুমকি খেপে গেল, গ্লাস ভর্তি পানি ছুঁড়ে মারল ভিঞ্চির বাবার ওপর। বলল, তোমার চোখের তারা কাকে দেখলে নেচে উঠে আমি কি সেটা জানি না? তুমি বিয়ে করবে ঐ প্রস্টিটিউটটাকে। ভিঞ্চির সেকেন্ড শিফটের বুয়া। অ্যাটেন্ডেন্ট আবার কী? বুয়া বলতে পারো না। তোমার রুচি কখনো বুয়ার উপর উঠেছে? পরিবারিক প্রস্তাবে রাশেদের সাথে সিমকির বিয়ে যোগাযোগটা রাখছেন সিমকিদের ছোটমামি হাফসা। রাশেদ হাফসার ক্লাসমেট, নিষেধাজ্ঞা হাফসারই। সিমকি রাশেদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল। হাফসা বলেছে, প্রশ্নই আসে না। তাহলে সিমকির দাম কমে যাবে। বিয়ের পর কথা বলবে, তার আগে দু পক্ষের যত কথা সব হাফসাই বলবে। সিমকি রুমকিকে বলল, ভালোই হয়েছে আমি নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ নই যে প্লেনভাড়া দিয়ে আমার বিয়েতে আসবে। আটকা যখন পড়েছোই বিয়েটা অ্যাটেন্ড করে যাও। আজ তো এপ্রিলের ছয়, আর একুশ দিন।

রইস আহমেদ বলল, বিয়ে কি কাজী সাহেবকে করবে না পাত্রকে? কেন? কাজীকে কেন বিয়ে করব? পাত্র কি ঘাস কাটবে?

এছাড়া কোনো উপায় নেই। ওসব দেশে ঘাস অনেক বড় হয়। দুনিয়ার কোনো খোঁজখবর না রাখলে হবে কেমন করে? দেখো ফেডারেল এভিয়েশন অথোরিটি কী বলছে—জুনের আগে উত্তর আমেরিকার কোনো এয়ারপোর্ট থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা নেই। একজন এভিয়েশন জার্নালিস্টের ভিডিও করা খবরটি দেখায়। হঠাৎ সিমকি মলিন হয়ে যায়।

রুমকি বলে, মন খারাপ করিস না। হেঁটে কিংবা রিকশায় কিংবা টেম্পোতে তো আর কুইবেক থেকে আসতে পারবে না। প্লেনে চড়তে হবে। রইস আহমেদ একটা বিকল্প পথ দেখায়। বিয়ের দিনই ভিডিও কনফারেন্স করে কাজীকে নিয়ে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে পার। তারপর যখন আকাশে প্লেন উড়বে জামাই চলে আসবে।

সিমকি বলল, তাই হবে, আমি ছোটমামিকে বলছি।

এপ্রিলের ২১ তারিখ সিমকিদের ছোট মামা কান-হাতে গ্লাভস, মুখে ক্লিনিক্যাল মুখোশ পরে এলো। বলল, ফোনে বললে পারতাম, কিন্তু বিশ্বাস করাটা কষ্টকর হতো।

রুমকি জিজ্ঞেস করল, ছোট মামা কোনটা বিশ্বাস করতে বলছো? কানাডার লোকটার সাথে সিমকির বিয়ে হবে না। হতে পারে না। সে হচ্ছে হাফসার বয়ফ্রেন্ড। সিমকির বিয়ের নাম করে প্রত্যেকদিন তার সাথে দেড় দু ঘণ্টা কথা বলে, এদ্দিন পাত্তা দিইনি, কাল কিছুক্ষণ কান পেতে যা শুনলাম! আফসা তার সাথে থ্রি এক্স স্টাইলে কথা বলেছে পুরো পথ।

সিমকি বলল, তুমি এসব কী বলছো ছোট মামা? হাফসা যা বলছে তার একশ ভাগের একভাগও বলিনি। বলেছে সিমকিকে টাচ করার আগে হাফসার সাথে তার ঘুমোতে হবে, সব সুযোগ যেন তৈরি করে দেয়।

এই বিষয়ে প্রথম মুখ খুলল চুমকি। বলল, তুমি যে এসব জেনেছো ছোটমামি কি তা জানে?

জানবে তিন চারদিন পর। আমি এখন মুখে যা বলব সব অস্বীকার করবে, এমনকি আমাকে বলতে পারে মানসিক ডাক্তার দেখাও। এটা তোমার অবসেশন। আমি আজই সিক্রেট ভয়েস রেকর্ডার আমার এন্ড্রয়েড ফোনে ডাউনলোড করছি। ফোনটা সাইলেন্ট মোডে দিয়ে বেডরুমে কোথাও লুকিয়ে রাখব। আমি টিভি দেখার নাম করে চলে আসব। এভাবে তিনদিনের কথা রেকর্ড করে নিজে শুনে সিমকিকে এবং তোমাদের শুনিয়ে তারপর হাফসাফে বলব। যদি শুভ্র আর রুদ্র না থাকত আজই হতো হাফসার সাথে আমার শেষ দিন।

চুমকি বলল, ছোটমামা তুমি আসলেই মেন্টাল কেইস নয় তো?

চারদিন পর ডকুমেন্টসহ আসছি।

ছোটমামা সিমকিকে জিজ্ঞেস করল হেয়াট ইজ ইয়োর ডিসিশন?

সিমকি বলল, বিয়ে যেহেতু আমি ঠিক করিনি, তোমরা ঠিক করেছো, বিয়ের তারিখও তোমাদের ঠিক করা। আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?

ছোট মামা বেরোবার আধঘণ্টার মধ্যে র‌্যাব চুমিকদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। মাইকে জোর গলায় বলল, এই ভবনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। এই বাড়ি সম্পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছে। কেউ বেরোতে চেষ্টা করলে গ্রেফতার করা হবে। হ্যান্ডমাইকে আরো ঘোষণা করা হলো, এটি একটি প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে রোগ। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর নাম মোদাব্বের হোসেন বয়স সত্তরের উপরে, তিনি এই বিল্ডিংয়ের চারতলার ডানপাশের ফ্লাটে থাকতেন। এই ফ্লাটের বাসিন্দা ছাড়া অন্য কেউ যদি তার সংস্পর্শে এসে থাকেন তিনিও বিপদজনক ভাইরাস বহন করে থাকতে পারেন। অবিলম্বে তাকে সনাক্ত করুন এবং আমাদের কাছে হস্তান্তর করুন।

মোদাব্বের হোসেন দূরের কেউ নন, সিমকিদের একমাত্র ভাই রাতুলের শ্বশুর, ডায়নার বাবা। নভোচারীর মতো পোশাক পরা লোকজন মোদাব্বের হোসেনকে চারতলা থেকে নামিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে তুলতে তিনি চিৎকার করছিলেন, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে আল্লাহ আমাকে বাঁচাও।

ডায়না ভাবির সাথে তার শ্বাশুড়ির খারাপ সম্পর্ক থাকলেও ডায়নার বাবা আসার পর তিনি তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। আবার মায়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে সিমকি। চুমকি এবার চড়াও হলো মা ও বোনের ওপর, তোমরা কোয়ারেন্টাইনে চলে যাও। চৌদ্দ দিনের আইসোলেশনের পর যদি সুস্থ থাকো তবেই কথাবার্তা হবে নতুবা এই-ই শেষ। আল বিদা।

তারপর রুমকির সামনে করোনাভাইরাস কত ভয়ঙ্কর রোগ, শ্বাসকষ্টে কেমন দুঃষহ মৃত্যু ঘটে তার একটি বর্ণনা দিল। ভয়ঙ্কর এক ধমক দিল আমাকে সাবধান রুম থেকে বেরোবে না, তুমি অনেক অশান্তি আমাকে দিয়েছো, দয়া করে এইবার মা আর সিমকির কাছ থেকে করোনাভাইরাস এনে আমাকে দিয়ো না।

রুমকি তার স্বামীকে বলল, যেভাবেই হোক ভিঞ্চিকে বাঁচাতে হবে, একটা ট্যাক্সিক্যাব ডাকো, আমরা আবার চুয়াডাঙ্গা চলে যাব। সমস্ত নষ্টের মূল হচ্ছে আমার মা। কী দরকার ছিল ঐ ঘাটের মরাটাকে দেখতে যাবার?

রইস আহমেদ বলল, লকডাউন মানে বোঝো? প্লেন যেমন বন্ধ ট্যাক্সিক্যাবও। তাছাড়া কাল দেখোনি টিভিতে রাস্তায় বেরোলে পুলিশ কান ধরে উঠবস করাচ্ছে।

হঠাৎ আমাদেরটা ফ্ল্যাটটা ভুতুরে ফ্লাট হয়ে উঠল।

টোকা দিলে শুধুমাত্র রুমকি আর ভিঞ্চির জন্য আমাদরে রুমের দরজা খোলা হয়, দুজন আমাদের বাথরুম শেয়ার করে।

রুমকি যখনই ঢোকে তখনই একটা না একটা মৃত্যুসংবাদ দেয়। ইতালির মিশানে মারা গেছে রইসের বড়মামা কামাল আহমেদ, নিউ ইয়র্কে রুমকির বন্ধবীর বড়বোন ও তার খালা শাশুড়ি।

সিমকির বিয়ে নিয় আলোচনা হঠাৎ থেমে গেছে। আমাকে ডিভোর্স করার নোটিশের ড্রাফট চূড়ান্ত হয়ে আছে। অনেকদিন ধরেই, করোনাভাইরাসের প্রকোপ হবার আগে থেকেই আমি ও চুমকি বিছানাতেও স্যোশাল ডিসট্যান্স রক্ষা করে চলেছি। এখন তো আরো স্ট্রিক্ট হতে হচ্ছে। আমি দেয়ালের দিকে মুখ করেই ঘুমোই সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি চোখের সামনে দেয়াল। চুমকি দেখে চোখের সামনে জানালা।

জ্বরটা হঠাৎ করেই এলো, বাড়লও খুব দ্রুত। মাঝরাত কি তার পরে আমি কাঁপতে শুরু করলাম। আমার লেপ দরকার কিন্তু এত রাতে কাকে বলি—চুমকির সাথে এক বিছানায় থাকলেও আমাদের টকিং টার্ম নেই। আমি দেয়ালের দিক থেকে চাদরসহ তোশকটা টেনে নিজেকে এর ভেতর সেঁটিয়ে দিই। কিন্তু তাতে আমাকে বিছানার প্রায় মাঝামাঝি চলে আসতে হয় তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে আমার হাত চুমকির ওপর পড়েছে না চুমকির হাত আমার ওপর বলতে পারব না, কিন্তু ঘুমটা, যখন ভাঙে বুঝতে পারি আমরা দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে আছি। তারপর বহু যুগের অভুক্ত নরনারীর বেলায় যেমন হয়, পরস্পরের শরীরে এখানে ওখানে ধরতে ধরতে আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল।

তারপর চুমকি বলল শরীর এত গরম কেনো? করোনাভাইরাস ঢোকেনি তো? আমাকে আবার ইনফেকটেড করছো না তো?

আমাদের পুরো ব্যাপারটাই অন্ধকারে ঘটে। নীলাভ ডিমলাইটের সুইচ অন করে চুমকি দুটো প্যারাসিটামল বের করে আনে। পানিসহ ট্যাবলেট এগিয়ে দেয়। বলে, আগে টেম্পারেচার কন্ট্রোলে আসুক।

সকালে যখন ঘুম ভাঙে, অনেক অনেকদিন পর আবিস্কার করি আমরা মুখোমুখি শুয়ে আছি।

দুই.
চৌদ্দ দিন পর সিমকি এবং তার মা আইসোলেশন থেকে মুক্ত হয়। ডায়ানার বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারেননি। সরকারের পিপিই পরা লোকজন তাকে খিলগাওয়ে কোনো একটি কবরস্থানে সমাহিত করেছে। সিমকি মুক্ত হবার তিন কি চারদিন পর ছোটমামি হাফসা মাস্ক গ্লাভস এসব পরে বাসায় এসে সবাইকে শুনেয়েই বলে, আল্লাহর রহমতের শেষ নেই। যদি এই ভাইরাসটার কারণে লকডাউন না থাকত সিমকি তোর অনেক ভোগান্তি হতো। ভাগ্যিস এয়ারপোর্ট বন্ধ। বুঝলি রাশেদের কথায় আমার খুব সন্দেহ হচ্ছিল এজন্য কদিন ধরে পটিয়ে পটিয়ে বের করলাম তার একটা বউ আছে, বউয়ের নাম পেনিলোপ ক্রুজ। আমি মুখের উপর বলে দিয়েছি, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, নো ফারদার টক। সিমকিকে তোমার মতো বদমাশের কাছে বিয়ে দেব না।

সে রাতেই ছোটমামা ফোন করে বললেন, একচুয়ালি হাফসা নিজেই প্রতারিত বোধ করে আনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছে।

২৫ মে ঈদ উল ফিতরের সকালে চুমকি বলল, দিলে তো আমাকে ফাঁসিয়ে। পিরিয়ড মিস হলো। ভাবলাম যে কোনো সময় শুরু হবে। এখন ইউরিনে স্ট্রিপ চুবিয়ে দেখি পজিটিভ—এই দেখো, টেস্ট লাইনের রঙটা দেখো। আমি এখন কোনটা সামলাব—প্রেগন্যান্সি না ডিভোর্স?

টুয়েন্টি টুয়েন্টির করোনাভাইরাস সংক্রমণকালের লকডাউনে শেষ পর্যন্ত আমি ও চুমকি সোশাল ডিস্ট্যান্স বজায় রাখতে পারিনি। চুমকির পিরিয়ড মিসের সূত্র ধরে আমরা একটি বাবুর জন্মের অপেক্ষায় আছি।

আমাদের অনিবার্য তালাক অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়ে গেছে।

   

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;