ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি : দুই বাঙালি শহীদের গল্প



যাকওয়ান সাঈদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি

ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯০৮ সালে মাত্র আঠার বছর বয়সে যে কিশোর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছিল, তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরাম বসুর সহযোগী ছিল প্রফুল্ল চাকি, ক্ষুদিরামের ফাঁসির মাস তিনেক আগেই যে পুলিশের হাতে ধরা দেবে না—তাই রিভলবারের গুলি নিজের দিকে তাক করে করেছিল আত্মহত্যা। প্রফুল্ল চাকির আত্মহত্যার দিনটি ছিল ২ মে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ, আর ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল একই বছরের ১১ আগস্ট। এ দুই বিপ্লবীরই মৃত্যু হয়ে হয়েছিল একটি বিশেষ ঘটনা বা অপারেশনকে কেন্দ্র করে।

এ লেখাটি ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকি আর তাঁদের সেই অপারেশনটিকে কেন্দ্র করে। কয়েকটি উপ-শিরোনামের মধ্যদিয়ে আমরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেইসব দিনের গৌরবান্বিত ইতিহাসে কিছুক্ষণের জন্য বিচরণ করে আসতে পারি।

ক্ষুদিরামের জন্ম এবং বাল্যকাল

ক্ষুদিরামের জন্ম ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক বিকেলে, মেদেনীপুরের হবিবপুরে। বাবা ত্রৈলক্ষণাথ বসু জমিদারদের কাছারিতে কাজ করত। মায়ের নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।

পরপর দুই পুত্রসন্তানকে অল্প বয়সে হারিয়ে ত্রৈলক্ষণাথ বসু ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর সংসার-জীবনে একটি গভীর কষ্টের জায়গা তৈরি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, ক্ষুদিরামের যখন জন্ম হলো তখন তাকে নিয়ে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। যদি না এই সন্তানটিও আবার মারা যায়! এমন অবস্থায়, তৎকালীন একটি সংস্কার, যা শিশুর প্রাণরক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল, সেটিই প্রয়োগ করতে হলো ক্ষুদিরামের ওপর। উপাচার অনুযায়ী অল্প কিছু খুদ বা কড়ির বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরামকে। অবশ্য কিনে নিয়েছিল তাঁরই সদ্যবিবাহিত বড়বোন। যেহেতু খুদের বিনিময়ে প্রাণরক্ষা হয়েছিল তাই তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসু।

দুঃখজনক বিষয় এই যে, ক্ষুদিরামের আর মা-বাবার কাছে ফেরা হয়নি, বা তাদের সান্নিধ্য পাওয়াও সম্ভব হয়নি। ক্ষুদিরামের সাত বছর বয়সে, ছয় মাসের অল্প ব্যবধানে তাঁর বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন। বড় বোনের সংসারেই বেড়ে উঠেছিলেন ক্ষুদিরাম।

শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল হাটগাছিয়ার গিরিশ মুখার্জী পাঠশালায়। বোনের স্বামী চাকরিসূত্রে হাটগাছিয়ায় থাকতেন। পরবর্তী সময়ে চাকরি বদলি হলে তারা তমলুকে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে ক্ষুদিরাম বসুকে হ্যামিল্টন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তাঁর বয়স যখন বারো, তখন তমলুকে দেখা দিয়েছিল কলেরা। ক্ষুদিরাম সেই কলেরা-রোধে নেমে পড়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। স্বভাবচরিত্রে ছিল ডানপিটে ধরনের, আর এই ডানপিটে স্বভাব বদলাতে না-বদলাতেই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।

ক্ষুদিরামের বিপ্লবীজীবনের সূত্রপাত

১৯০৪ সালে বয়স যখন চৌদ্দ, ক্ষুদিরামের চিন্তা-চেতনায় বিপুল পরিবর্তন আসে। এসময় পুনরায় বোনের স্বামীর বদলির কারণে তাঁদের মেদেনীপুর চলে আসতে হয়। ক্ষুদিরামকে ভর্তি করে দেওয়া হয় মেদেনীপুর কলিজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ঋষি রাজনারায়ণ বসু—তিনিই ক্ষুদিরামসহ আরো অনেক স্কুলছাত্রের মনে স্বাধীনতার চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

একই স্কুলের ইতিহাস শিক্ষক—জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, ক্ষুদিরামকে দেখেই টের পান এই ছেলের মধ্যে স্বদেশচেতনা অত্যন্ত গভীরভাবে প্রোথিত আছে। এবার শুধু ছেলেটিকে জাগিয়ে তোলাই কাজ। কাজটি জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু নিজ দায়িত্বে করলেন। ক্ষুদিরামকে তিনি নিজের একজন কাছের ছাত্র করে তুললেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল মেদেনীপুর। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্যে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম একটি বিপ্লবী দলে যোগদান করে। এরই মধ্যদিয়ে কিছু রণকৌশলও রপ্ত হয়ে যায় তাঁর। এখানেই লাঠি খেলা, তলোয়ার চালানো, বন্দুক অথবা রিভলবারের ব্যবহার শিখে নেয় ক্ষুদিরাম। যুদ্ধাহত ব্যক্তির প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাপারেও এখান থেকেই ধারণা নেওয়া। বন্যাকবলিত মানুষের আশ্রয়স্থল তৈরিতে এসময় দলের সঙ্গে থেকে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে ক্ষুদিরাম।

প্রথম জেলে যাওয়া

মেদেনীপুরের বিপ্লবীদের দলপতি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসুর প্রথম জেলে যাবার ঘটনায় একটি প্রাসঙ্গিকতা আছে। ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, ক্ষুদিরামের বয়স তখন ১৬ বছর।

মেদেনীপুরের পুরনো জেলে একটি কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেমন, এসেছিল অনেক সাধারণ মানুষও। হঠাৎ সেই প্রদর্শনীতে দেখা গেল এক কিশোর লিফলেট বিলি করছে। কর্তাব্যক্তিদের নজরে এলে দেখা গেল লিফলেটটি মূলত ‘সোনার বাংলা’ নামক একটি পুস্তিকা যা ব্রিটিশবিরোধী প্রচারপত্রগুলোরই একটি। তাৎক্ষণিক ক্ষুদিরামকে গ্রেফতার করে তার নামে রাজদ্রোহের মামলা দিয়ে দেওয়া হয়। কাঠগড়ায় উঠিয়ে তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কে তোমাকে এই পুস্তিকা বিলি করবার দায়িত্ব দিয়েছে?’ উত্তরে ক্ষুদিরাম বসু যেন কিছুই জানে না, এরকম ভাব করে। বলে, ‘তার নাম বলতে পারি না।’ তারপর তাকে আদালতের পুরো কক্ষ ইঙ্গিত করে বলা হলো, ‘দেখো তো এই কক্ষে সেই ব্যক্তিটি আছে কিনা?’ সত্যেন্দ্রনাথ বসু কক্ষেই ছিলেন, মানে তিনিই তাকে পুস্তিকা বিলির কাজটা দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম বসু কম বয়সসুলভ অভিব্যক্তি দিয়েই সত্যেন্দ্রনাথকে সারা আদালত ঘরের কোথাও খুঁজে পেল না। বলল, ‘নাহ, এই ঘরে তো সেই লোককে দেখতে পাচ্ছি না।’ আদালত ভাবল, ছেলেটি হয়তো আসলেও এতটা ভুলমনা, বা বিশেষ ‘ঘাওড়া’ প্রকৃতির, সুতরাং তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো।

তবে হ্যাঁ, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে ক্ষুদিরাম কিছুটা হলেও সন্দেহজনক চরিত্র হয়ে উঠল। চিন্তিত হয়ে পড়লেন ক্ষুদিরামের বোনের স্বামী, কেননা পুলিশ যে কোনো সময়ই ঘরে হানা দিতে পারে। যদিও ঘটনার পরপর ক্ষুদিরামকে অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তবুও ক্ষুদিরামকে কেন্দ্র করে নিজের চাকরিটি হঠাৎ হাতছাড়া হবার আশঙ্কা কাটল না। এমন পরিস্থিতিতে যদিও বোনের স্বামী ক্ষুদিরামকে সরাসরি কিছু বললেন না, কিন্তু কিশোর ক্ষুদিরাম নিজেই যা বোঝার বুঝে নিল আর একদিন না বলে-কয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

এরপর ক্ষুদিরাম বসু যার কাছে আশ্রয় পেল ইতিহাসে তার পরিচয় হিসেবে উল্লেখ আছে, তিনি আবদুল ওয়াহেদ সাহেবের স্ত্রী। এ মহিলা ছোটভাইয়ের মতো স্নেহ ভালোবাসায় ক্ষুদিরামকে গ্রহণ করেছিলেন।

যাই হোক, একটি আঠার বছরের জীবনে আর কতই বা ঘটনা থাকবে! তাই ছোট ছোট এসব বাঁকবদল বাদে ফাঁসির ঘটনাই মূলত ক্ষুদিরাম বসুর জীবনকে অধিকার করে রেখেছে। কেন ও কী কারণে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হলো, বরং সেই আলাপেই প্রবেশ করা যাক।

প্রফুল্ল চাকি, ক্ষুদিরামের সহযোদ্ধা

এই পর্বে ক্ষুদিরামের সহযোদ্ধা প্রফুল্ল চাকিকেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমরা আগেও উল্লেখ করেছিলাম প্রফুল্ল চাকির কথা, পুলিশের কাছে ধরা না পড়ে যে আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছিল।

অপারেশনকে কেন্দ্র করেই প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে ক্ষুদিরামের প্রথম সাক্ষাত হয়। মানিকতলা আখড়ার এই সাক্ষাতের দিনই অপারেশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরামকে। আর ক্ষুদিরামের সহযোগী হিসেবে উত্তরবঙ্গ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রফুল্ল চাকিকে। অপারেশনটির স্বার্থে দুজনকেই দেওয়া হয়েছিল ছদ্মনাম—ক্ষুদিরামের নাম হয়েছিল দুর্গাদাস সেন, আর প্রফুল্ল চাকির নাম দীনেশচন্দ্র রায়।

তাহলে কী ছিল সেই অপারেশন?

তাহলে কী ছিল সেই অপারেশন? আঠার বছর বয়সী ক্ষুদিরামকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করেছিল, ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ‘বন্দে মাতরম’ বলা নিষিদ্ধ করে দেয়। আর যখন ‘বন্দে মাতরম’ নিষিদ্ধ হলো, সেসময় কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিল মি. কিংসফোর্ড। এমনকি অন্য অনেক ব্রিটিশদের চেয়েও কিংসফোর্ড ছিল একটু বেশি মাত্রারই বেপরোয়া। ‘বন্দে মাতরম’ আইনকে কেন্দ্র করে তখন তার জেলখানায় তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না।

ইংরেজ-শাসনের নির্যাতন তো ছিলই, সঙ্গে কিংসফোর্ডের বাড়তি নিষ্ঠুরতা যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছিল এক অতিশয় নির্দয় পরিস্থিতির। ফলশ্রুতিতে মেদেনীপুরের বিপ্লবীদের বৈঠকে একদিন সিদ্ধান্ত হলো, মি. কিংসফোর্ডকে শাস্তি দিতে হবে। আর সেই উপযুক্ত শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এই মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নে এমন কাউকেই খুঁজে পেতে হবে যে একই সঙ্গে বুদ্ধিদ্বীপ্ত এবং তেজি। সম্ভবত ১৯০৮ সালের মেদেনীপুরে অবস্থানকারী সব বিপ্লবী নেতাদেরই ক্ষুদিরামকে কাজটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল।

ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীও টের পেয়েছিল, যে কোনো সময় কিংসফোর্ডের ওপর হামলা হতে পারে। তাই এরইমধ্যে কিংসফোর্ডকে বদলি করে মুজফফরপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকি প্রথমে কলকাতা গিয়ে, তারপর সেখান থেকে মুজফফরপুরে রওনা হবে—এমনই প্ল্যান আগে থেকে ঠিক করা ছিল। সে অনুযায়ী তারা দুজন প্রথমে কলকাতায় এসে বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোর বাসায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে গুলিভর্তি রিভলভার আর টিনের বাক্সে একটি বোমা নিয়ে মুজফফরপুরে চলে গেল। পরিকল্পনামতোই তারা প্রথমে একটি ধর্মশালায় আশ্রয় নেয়।

মি. কিংসফোর্ড ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল, যে কোনো সময় তার ওপর হামলা হতে পারে। সবসময় তাই সাথে বন্দুকধারী নিয়ে চলাফেরা করত। কোর্টে কাজের সময় বাদে প্রায় পুরাটা সময় থাকত বাসায়। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার পরে ক্লাবে গিয়ে তাশ খেলে আসা। বলা চলে বন্দুকধারী-বেষ্টিত দিনাতিপাত করছিল কিংসফোর্ড।

দুই কিশোরের জন্য ব্যাপারটা কঠিনই হয়ে পড়ছিল। একটানা ১৯/২০ দিন সুযোগ-সন্ধানের পরও কোনোভাবেই কিছু ঘটাতে না পেরে ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে তারা। এই অস্থিরতা থেকেই ২৯ তারিখ তারা সিদ্ধান্ত নেয়, পরের দিন অপারেশন বাস্তবায়ন করবেই, যা হবার হবে। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাস।

পরদিন, ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকেই কিংসফোর্ডের বাড়ির আশেপাশে গিয়ে তারা দুজন অবস্থান নেয়। প্রথমে একজন প্রহরী ব্যাপারটি লক্ষ করে তাদের চলে যেতে বলে। তারা সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আরেকটু গোপনীয়তা যোগ করে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। কিংসফোর্ড কখন বাসা থেকে বের হয়, সেটাই তাদের দেখার বিষয়। কিংসফোর্ডকে একবার হত্যা করতে পারা গেলে তাদের ভোগ্যে যা হয় হবে।

তবে সবশেষ ক্ষুদিরাম তার হাতের মুঠোয় থাকা বোমাটি ছুড়ে মারলেও সেই বোমায় কিংসফোর্ড নয়, মারা গিয়েছিল দুজন নির্দোষ ব্রিটিশ নাগরিক। এ দুজন ছিল ব্যারিস্টার কেনেডি নামক এক ব্যক্তির স্ত্রী এবং কন্যা।

রাত সাড়ে আটটার দিকে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল কিংসফোর্ডের বাসা থেকে একটি গাড়ি বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। মূলত, এই দেখার বিষয়টিতেই তাদের আরো পরিপক্বতার, মনোনিবেশের ও অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল। তারা গাড়ির মধ্যে কে আছে সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই গাড়ি উদ্দেশ্য করে বোমা ছুড়ে মারে।

যদিও কে মারা গেল, কিংবা কিংসফোর্ড যে মারা যায়নি এসব ব্যাপারে জানবার কোনো সুযোগ তাদের রইল না। তারা বোম্বিং করবার সাথে সাথেই সেখান থেকে প্রস্থান করে।

ঘটনার পরে কেউ কেউ বলল এখানে তারা দুজন কিশোরকে দেখেছে। কে কীরকম দেখতে ছিল, সেসবও বলাবলি হলো। ফলত সব জায়গায় ঘোষণা করে দেওয়া হলো, এরকম কাউকে দেখলেই তাকে যেন পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ঘোষণার ফলস্বরূপ সর্বত্র নিরাপত্তা জোরদার করে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্লকে ধরতে সচেষ্ট হলো পুলিশ এবং পরদিন সকালেই ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে গেল।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/29/1567077539571.jpg
◤ ক্ষুদিরাম, ধরা পড়ার পরে ◢


প্রফুল্ল চাকির আত্মহত্যা

প্রফুল্ল জামাকাপড় পাল্টে সমস্তিপুর এলাকার দিকে যাচ্ছিল। এসময় একজন তাকে ডেকে জানতে চাইল, ‘কোথায় যাও?’ প্রফুল্ল জানালে রেলস্টেশনে যাচ্ছে, লোকটি বলল, এখন তো কোনো ট্রেন নেই। লোকটি প্রফুল্লকে তার বাসায় বিশ্রাম নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায় আর যখন ট্রেন আসবে তখনই স্টেশনের দিকে যেতে বলে। প্রফুল্লও এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি প্রফুল্লকে এ সহযোগিতা করেছিল, তার পরিচয় জানা যায়নি। হয়তো তিনি প্রফুল্লের আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরেই দয়াপরবশ হয়েছিলেন। এমনকি হয়ে থাকবে, তিনি বুঝতেও পেরেছিলেন এই ছেলে সেই দুজনেরই একজন, যারা গতকাল কেনেডির স্ত্রী আর কন্যাকে হত্যা করেছে। যখন এই ব্যক্তির আশ্রয়স্থল রেখে প্রফুল্লকে ট্রেনে উঠে পড়তে হলো, তখন থেকেই ঘটতে শুরু করে বিপত্তি।

প্রফুল্ল চাকি যেই কামরায় ওঠে, একই কামরায় সাদা পোশাকে একজন পুলিশসদস্য উঠেছিল। নাম নন্দলাল ব্যানার্জী। সাদা পোশাকে তাকে দেখেও বোঝার উপায় ছিল না সে একজন পুলিশ। কিন্তু প্রফুল্লকে দেখেই তার সন্দেহ হলে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করার মধ্যদিয়ে তাঁকে নিজের নজরদারিতে আটকে রাখে ওই পুলিশসদস্য।

ট্রেন যখন স্টেশনে পৌঁছায় তখন ভোর। আশেপাশে কোনো কুলি ছিল না। প্রফুল্লই নন্দলালের ব্যাগপত্র মাথায় নিয়ে কুলির কাজটি করছিল। মাথা থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখতেই প্রফুল্ল টের পেল নন্দলাল ব্যানার্জী সেখানে নেই। এদিক ওদিক তাকাতে একটু পরে দেখা গেল, তিনি পাঁচজন পুলিশসদস্যকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আর প্রফুল্ল চাকিকে জানানো হচ্ছে—‘আপনাকে আমরা গ্রেফতার করলাম।’

পকেটে থাকা রিভলভারটি বের করে সঙ্গে সঙ্গেই প্রফুল্ল নন্দলালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। উত্তেজনায় গুলিটি লক্ষভ্রষ্ট হয়। পরক্ষণেই, যখন ধরা পড়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই, রিভলবার গলায় ঠেকিয়ে নিজেকেই গুলি করে দিলেন প্রফুল্ল চাকি।

ক্ষুদিরামকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর ফাঁসির নির্দেশ

ফাঁসির মঞ্চ এবং তার আগে আদালতের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও ক্ষুদিরাম বসু নিতান্ত স্বাভাবিক আচরণ করছিল। এ দেখে তখন কারোরই আশ্চর্যের কোনো সীমা ছিল না। যেহেতু ক্ষুদিরাম জানত না তাঁর সহযোগী প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছে, কাজেই প্রফুল্লকে বাঁচাবার জন্য শেষপর্যন্ত পুরো অপারেশনটির দায়ভারও নিজের কাঁধেই রাখছিল। এর বাইরে কোনো সংগঠন বা ব্যক্তির নাম বলা দূরে থাক।

মামলাটি শুরু হয়েছিল মে মাসের ২১ তারিখ। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল জুন মাসের ১৩ তারিখ। ফাঁসির রায় শুনেও ক্ষুদিরাম যথাস্বাভাবিক আচরণেই বহাল থেকেছিল। আদালত কর্তৃক তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তুমি কি বুঝতে পেরেছো তোমাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে?’ ক্ষুদিরাম বসু বলল ‘হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি, এবং আমি আবার আসব।’

১৯০৮ সালের আগস্ট মাসের ১১ তারিখ ভোর ছয়টায় ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।

   

প্রকৃতিতে শোভা ছড়াচ্ছে ‘সোনালু ফুল’



ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সবুজের ফাঁকে উঁকি দিয়ে হলুদ আভায় মুগ্ধতা ছড়ানো ফুল সোনালু। নজরকাড়া সৌন্দর্যে মুখরিত এই ফুল পথিকের মনে এনে দিচ্ছে প্রশান্তির ছোঁয়া। পরিবেশ ও প্রকৃতির শোভা বর্ধনে সোনালু দারুণ এক নিসর্গ মায়া এনে দিয়েছে। এই ফুলের দেখা মিলছে নওগাঁর বিভিন্ন পথে প্রান্তরে।

মঙ্গলবার (৭ মে) বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, নওগাঁ শহরের বরেন্দ্র অফিসের পাশে থোকায়-থোকায় হলুদ আভায় ঝুলে আছে সোনালু। ফুলের মাথা হতে লম্বা লতার মত বড় হয়েছে।

শীতকালে সব পাতা ঝরার পর বসন্তে একেবারেই মৃতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে গাছটি। গ্রীষ্মের শুরুতে দু’একটি কচিপাতার সাথে ফুল ফুটতে শুরু করে। হলুদ সোনালি রঙের অসংখ্য ফুল সারা গাছজুড়ে ঝাড় লণ্ঠনের মতো ঝুলতে দেখা যায়।


জানা যায়, সোনালু গাছের পাতাঝরা মাঝারি আকৃতির । এটি আট থেকে ৯ মিটার উঁচু হয়। হলুদ বরণ এ ফুল দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি আছে তার বাহারি নামও। পরিচিত নামগুলো হলো সোনালু, সোনাইল, সোঁদাল, বান্দরলাঠিসহ আরো অনেক। ফুল থেকে ধীরে ধীরে লাঠির মত কালো রঙের ফল হয়ে সেটি কয়েক সেন্টিমিটার অব্ধি লম্বা হয়ে থাকে।

পথচারী আলমগীর বলেন, সোনালু দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর শহরের মধ্যে চোখে পড়েনা বললেই চলে। যতবার দেখি খুব সুন্দর লাগে। মনের মধ্যে এনে দেয় এক প্রশান্তি। 

স্থানীয় বাসিন্দা মিঠু বলেন, আমি মোবাইল দিয়ে প্রচুর ছবি তুলেছি এই ফুলের। আমার খুব ভালো লাগে সোনালু ফুল। তবে এই ফুল যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য আমাদের গাছ লাগানো উচিৎ। আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক সোনালু গাছ আছে যা আমাদের মুগ্ধ করে।


নওগাঁ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এনায়েতুস সাকালাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন- এটি মূলত সৌন্দর্য বর্ধনে রোপণ করা হয়। গ্রাম বাংলায় এই ফুলকে বাদর লাঠি গাছ বলেও ডাকা হয়। এটির বৈজ্ঞানিক নাম 'কেসিয়া ফিসটুলা (Cassia Fastula)। এই উদ্ভিদ বাংলাদেশে অনেক জাতের আছে। ফুলটার জন্য বেশি খ্যাতি রয়েছে বলে অনেক জায়গায় লাগানো হয়। গাছের কাঠগুলো জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয়।

;

দৌলতদিয়ায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া



সোহেল মিয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজবাড়ী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রখর তাপপ্রবাহের বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত প্রকৃতি। কোথাও নেই শান্তি। গ্রীষ্মের রুক্ষতা আর সব ক্লান্তি ছাপিয়ে আপন মহিমায় সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া ফুল। জানান দিচ্ছে শিল্পের দ্যোতনা। পাশাপাশি প্রশান্তির বার্তা বয়ে দিচ্ছে জনমনে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় দেখা যায় কৃষ্ণচূড়ার এমন সৌন্দর্য। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া অংশের দুই পাশে শোভাবর্ধন করছে কৃষ্ণচূড়া ফুল। শত কষ্টের মাঝে এই মহাসড়ক পার হওয়ার সময় হাজারো পথচারীদের হৃদয়ে প্রশান্তির হাতছানি দেয় এই কৃষ্ণচূড়া ফুল। দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে।এ সড়কে যাতায়াতকারীদের নজর কাড়ছে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল।


সরেজমিন দেখা যায়, মহাসড়কের দু’পাশের গাছগুলো ছেয়ে গেছে লাল কৃষ্ণচূড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন বৈশাখের প্রখর রোদ্দুরের সবটুকু উত্তাপ গায়ে মেখে নিয়েছে রক্তিম পুষ্পরাজি; সবুজ চিরল পাতার মাঝে যেন আগুন জ্বলছে। এই আগুনেই সেলফি তুলতে ব্যস্ত পথচারীরা। নিজেদেরকে কৃষ্ণচূড়ার সাথে একাকার করে স্মৃতিময় করে রাখতে ব্যস্ত সবাই।

দৌলতদিয়া ৭ নম্বর ফেরিঘাটের বাইপাস সড়ক থেকে শুরু করে ক্যানাল ঘাট এলাকার মহাসড়কের দুইপাশে ছেয়ে গেছে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ আর পশু পাখি যখন বেসামাল,ঠিক তখনই কৃষ্ণচূড়ার ফুলে বিচিত্র রূপ নিয়েছে দৌলতদিয়ার মহাসড়ক। এ যেন কৃষ্ণচূড়ার রঙে মেতেছে সড়কটি। কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরা গাছগুলো নজর কাড়ছে দর্শনার্থীসহ এই মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রী ও পথচারীদের।


স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছরই দৌলতদিয়া ঘাটের এই অংশটুকুতে (ঢাকা-খুলনা মহাসড়ে) সৌন্দর্য বিলায় কৃঞ্চচূড়া। পুরো এলাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল রঙে রঙিন হয়ে যায়। প্রখর রোদে মনে হয় যেন প্রকৃতিতে আগুন লেগেছে। পড়ন্ত বিকেলে পূর্ব আকাশের রক্তিম আভায় কৃঞ্চচূড়া মিশে যেন একাকার হয়ে যায়। প্রতি বছর এই সময়ে ঘাটের বাইপাস সড়ক নতুন রূপে সাজে। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন ছবি তুলতে।

পথচারীরা জানান, ফুলগুলো দেখলে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। গাছের ছায়া ও বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। প্রখর রোদের মধ্যেও যেন এখানে একটু সবুজের শান্তি পাওয়া যায়।

;

নগরে ফুলের জলসা, গ্রীষ্মের উত্তাপে সৌরভ, স্বস্তি 



মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
হাতিরঝিলে নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানায় উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ও সোনাইল/ছবি: নূর এ আলম

হাতিরঝিলে নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানায় উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ও সোনাইল/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

চারিদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। যেন বইছে গনগনে আগুনের ফুলকি। চারপাশের পরিবেশ ফুটন্ত কড়াইয়ে মতো টগবগে। দাবদাহের তেজে ব্রহ্মতালু ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তাপদগ্ধ চরাচর ক্লান্ত, স্তব্ধ, স্থবির। বৈশাখের রুদ্র রূপে বিপর্যস্ত নাগরিক পরিসর আর জনজীবন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উচ্চারিত গ্রীষ্মের প্রতিচ্ছবিই দেখা যাচ্ছে রাজধানীর প্রকৃতিতে: 'প্রখর তপনতাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে,/বায়ু করে হাহাকার।’

পরিস্থিতি যখন এমনই খরতাপে পোড়া ও তামাটে, ঠিক তখন একপশলা বৃষ্টির ছোঁয়া ঢাকা নগরীর পথে পথে জাগিয়েছে খণ্ড খণ্ড ফুলের জলসা। গ্রীষ্মের এই রংবাহারের উজ্জ্বলতা এবং সৌরভ; নাগরিক বিড়ম্বনা মুছে বুলিয়ে দিয়েছে অনিন্দ্য স্বস্তির পরশ।

সাদা গোলাপীর মিশলে সোনাইল—দূর থেকে মনে হয় পুষ্পিত পোস্টকার্ড/ছবি: নূর এ আলম


নগরের ইটপাথর, কংক্রিটের কংকালের মধ্যে তাপ ও দূষণের সাম্রাজ্যে নানা রঙের বর্ণিল ফুলের বৃন্ত ও পত্রালীতে খেলা করছে মুক্তি ও স্বাধীনতার আরাম। কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, টগরের শুভ্রতা এবং সোনালুর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দাবদাহে পীড়িত রাজধানীতে বসিয়েছে ফুলের জলসা। নিয়ে এসেছে রঙের উল্লাস। গন্ধের মাদকতা। ভালোলাগার এক অনির্বচনীয় অনুভূতি।

উচ্ছল জারুল


গ্রীষ্মের তপ্ত রোদের মধ্যেই শুক্রবার ও শনিবার ছুটির জোড়া দিনে হাতিরঝিলের নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানাল উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া ও সাদা গোলাপীর মিশলে সোনাইল। খুব কাছ থেকে দেখলে মনে হাতিরঝিলে ‘সোনাইল ব্লসম উৎসব’ চলছে। আর দূর থেকে মনে হয় পুষ্পিত পোস্টকার্ড।

কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, টগরের শুভ্রতা এবং সোনালুর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দাবদাহে পীড়িত রাজধানীতে বসিয়েছে ফুলের জলসা/ছবি: নূর এ আলম


হালকা বাতাসে সোনাইল দুলুনির সমান্তরালে গুঞ্জরিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়' গানের শিহরণ জাগানিয়া আবেশ। হাতিরঝিলের পথে পথে হেঁটে ক্লান্ত হলে ছায়া দিতেও প্রকৃতি তৈরি হয়ে আছে। ফুলে ভরা মেঘশিরীষ গাছ প্রসারিত শাখা ও পল্লবে কাছে টানছে পথিকের মনোযোগ। এখানে জারুলের এমন অপূর্ব রূপ— চলতি পথে গাড়ি থামিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে থমকে গিয়ে ক্যামেরাবন্দী করছেন নগরীর মানুষ।

নানা রঙের বর্ণিল ফুলের বৃন্ত ও পত্রালীতে খেলা করছে মুক্তি ও স্বাধীনতার আরাম/ছবি: নূর এ আলম


‘কি বলব- এত গরম, সহ্য করার মতো না। আমার বাসা মধুবাগে। প্রায় হাতিরঝিলে বাতাস খেতে আসি। এত ভালো লাগে বোঝাতে পারব না। তার সঙ্গে বাহারি ফুল তো রয়েছেই। অনেক ফুল চিনি না— কিন্তু ব্যাপারটা অসাম’, বলছিলেন হাতিরঝিলের বেঞ্চ বসা ইরাব নামের এক টগবগে যুবক। এখানকার প্রকৃতি যেন অগোচরে ইরাবের মতো অনেক তরুণ-যুবককে প্রকৃতিপ্রেমী ও ভাবুক বানিয়ে দিয়েছে।

নতুন শহর পূর্বাচলের সড়কে করবী/ছবি: নূর এ আলম


গ্রীষ্মের এই রূপ শুধু ঢাকার পর্যটন-হটস্পট হাতিরঝিলে নয়, প্রাচীন ও রমনীয় রমনা পার্ক, কলোনিয়াল আরবান নস্টালজিয়া মিন্টো রোড, আধুনিক এয়ারপোর্ট রোড, কুড়িল, স্থাপত্যকলার নান্দনিক সংসদ ভবন এলাকা ও ক্রিসেন্ট লেকসহ যেদিকে চোখ যায়- শুধু চোখে পড়ে ফুলের হাসি, রঙের খেলা। ইন্দ্রিয় স্পন্দিত হয় উদ্ভিদজাত গন্ধে ও সৌরভে।

কুড়িলে কৃষ্ণচূড়ার উচ্ছ্বাস/ছবি: নূর এ আলম


নগরীর সর্বাধুনিক সংযোজন মেট্রোরেলে বা এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে বিস্তৃত রাজধানীর দিকে তাকালে সুবিশাল দালান-কোঠা আর সবুজের ফাঁকে মাথা চাড়া দিচ্ছে জারুল, কৃষ্ণচূড়া ও গ্রীষ্মকালীন গাছপালার উচ্ছ্বাস। কোথাও কোথাও ছাদবাগানের বিভা। ফুলে ফুলে রঙিন এসব দৃশ্য প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী ঢাকার প্রাচীন স্মৃতি মনে দোলা দেয়। ক্ষণিকের জন্য বর্ণিল ফুলে ছাওয়া এক অন্য ঢাকা হৃদয়ের অলিন্দে জায়গা করে নেয় সুভাষিত আবাহনে।

সবুজ পাতা ছাপিয়ে সোনালি রঙের ফুলে সেজেছে সোনালু গাছ/ছবি: নূর এ আলম


সংসদ ভবন এলাকা ও ক্রিসেন্ট লেকে গেলে তো মনে হবে সুনীল আকাশের পানে চেয়ে কৃষ্ণচূড়া বলছে- ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-/আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’। এখানে চোখে পড়ে লেকের দু’ধারে কৃষ্ণচূড়ার সুদৃশ্য বীথি-  ‘ডাক দিয়ে যায় পথের ধারের কৃষ্ণচূড়ায়।’ বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরে রঙিন হয়ে ওঠা চলার পথ।

চন্দ্রিমা উদ্যান; গাছের পাতার সবুজ রঙ আজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে


এমন মনোরম প্রকৃতিতে ক্রিসেন্ট লেকে গরম নিবারণে নেমে পড়েছে একদল ডানপিটে কিশোর। যারা কৈশারকাল উদযাপনে মেতেছে। 

পাশেই চন্দ্রিমা উদ্যান; গাছের পাতার সবুজ রঙ আজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে। গত রাতে ঝরেছে বহু প্রতীক্ষার বৃষ্টি। দীর্ঘ তাপদাহে পোড়ার পর বৃষ্টির পরশ পেয়ে গাছগুলো যেন- প্রাণ পেয়েছে। চড়া রোদে স্নিগ্ধ হয়ে দেখাচ্ছে সবুজ পাতা। নেতিয়ে পড়া ফুল আড়মোড়া ভেঙে সুভাষ ছড়াচ্ছে। প্রাণবন্ত সবুজ পাতার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে হরেক রঙ ও রূপের ফুল।

কংক্রিটের নগরীতে কৃষ্ণচূড়ার স্পর্শ/ছবি: নূর এ আলম


‘শোনো বন্ধু শোনো,/ প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা/ ইটের পাঁজরে, লোহার কাটায়/দারুণ মর্মব্যথা।/এখানে আকাশ নেই,/এখানে বাতাস নেই,/ এখানে অন্ধ গলির নরকে/মুক্তির আকুলতা।/জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে...।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার গানে নগরীকে তুলনা করেছেন ইটপাথরের প্রাণহীন গলি হিসেবে। যেখানে ব্যস্ততার ফাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা কষ্ট। তবে এমন প্রাণহীন নগরীতে প্রশান্তির গান ধরেছে আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়া, সোনালু আর জারুল। সঙ্গে অফুরান শোভা ছড়িয়েছে ডুলি চাপা, বরুণ, নাগলিঙ্গম, মাধবীলতা ও কাঠগোলাপ। গরমে ওষ্ঠাগত জীবনে ঢাকার প্রকৃতির রূপ-রস মনে শান্তির সু-বাতাস বইয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর ফুলের নৈসর্গিকতা উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো সময় ছুটির দিন।

হাতিরঝিলের পথে দেখা মেলে কাঠগোলাপের


‘উষ্ণ তাপমাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবুজ ও মনোরম পরিবেশ তৈরির দিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন।

তিনি বলেন, ঢাকার প্রকৃতিকে মনোমুগ্ধকর করতে দেশি ফুলের গাছ দিয়ে সাজালে আরো ভালো হত। পরিকল্পিতভাবে ১০টি প্রধান অ্যাভিনিউকে ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো যেতে পারে। তাহলে শোভা বর্ধনের পাশাপাশি মানুষকে প্রশান্তি দিত- এই নগর।

সোনালুর ছায়া মাখানো পথ/ছবি: নূর এ আলম


মাঝে মাঝে এই ঢাকা, একদিন স্বপ্নের দিন হয়ে, ফুলের জলসার মুগ্ধতা দগ্ধ নাগরিক জীবনের সকল গ্লানি মুছে দিয়ে যায়।  

;

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;