নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরের মেঝে। পড়ে আছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাণ্ডবে বেঁচে যাওয়া বাঁশ, কাঠ ও গোলপাতার তৈরি ঝুপড়ি ঘরের কিছু অংশ। সহায় সম্বল হারিয়ে অর্থ সংকটে নতুন করে ঘর তৈরি করতে না পারায় সে ঘরেই তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন অসহায় বাবা বাবুল শেখ।
ঝড়ের পাঁচ দিন পর সরকার থেকে পাওয়া ১০ কেজি চাল থেকে কিছু চাল অস্থায়ী ইটের তৈরি চুলায় রান্নার জন্য বসিয়েছেন বাবুলের স্ত্রী। ঝড়ের পর এই প্রথম চুলায় আগুন জ্বললো তাদের। ঝড় শেষে এই পাঁচ দিনে মোট দুই বেলা কে বা কারা এসে একবার খিচুড়ি ও একবার বিরিয়ানি দিয়ে গিয়েছিল। নিজেরা না খেয়ে গত দুই দিন ছেলে মেয়ের মুখে সে খাবার তুলে দিয়েছেন বাবুল ও তার স্ত্রী। আজ অনেক দিন পর হয়তো পেটপুরে ভাত খাবেন তারা।
এমনই চিত্র শেলা নদীর তীরে অবস্থিত জয়মনি'র প্রায় সব জেলে পরিবারের। ঝড়ের তান্ডবে সেখানকার প্রায় সবগুলো ঘরই ভেঙে গেছে, কোমড় সমান পানিতে ঘরের মেঝের সঙ্গে আসবাবপত্রও তলিয়ে গেছে। নদীতে মাছ ধরে, বনে ও মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানোর পাশাপাশি যে অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন তার সবকিছুই ভেসে গেছে নোনা জলে।
সুন্দরবন ঘেষা মোংলার জয়মনি ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বশেষ সহায় সম্বল রক্ষা করতে ঝড়ের সময় বেশিরভাগ লোকজনই নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ঝড়ের সঙ্গে পানি বাড়তে থাকায় চোখের সামনে ঘরের সবকিছু ভেসে যেতে দেখেও জীবন বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নিতে চলে যেতে হয় স্থানীয়দের।
বার্তা২৪.কমের কথা হয় জয়মনি’র শেলা নদী তীরের বাসিন্দা মো. বাবুল শেখের সঙ্গে। ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাণ্ডবের ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'এর আগে বহুত বড় বড় ঝড় গেছে। কিন্তু, রিমালের মতো এমন তাণ্ডব আগে কহনো দেহি নাই। চোখের সামনে দেখলাম নদীর পানি বাড়তে বাড়তে ঘরে কোমর সমান পানি হইয়া গেল। ডরে ঘর থেইকা বাইরাইতেই দেহি ঘুমানোর খাটটা নদীতে ভাইসা যাইতাছে। সাঁতরাইয়া গিয়া খাটটা আনলাম। আর ঘরের বেড়াগুলা সব উইড়া গেল। টিকতে না পাইরা শেষ পর্যন্ত সাইক্লোন সেন্টারে চইলা গেলাম। পোলাপাইনসহ বউরে আগেই পাঠাইয়া দিছিলাম।'
'ঝড় থামনের পরে আইসা দেহি ঘরের চালঠা কোনওরহম আছে আর ঘরের বাহি বেবাক জিনিসপত্র চাইল, ডাইলসহ হাড়ি পাতিল, থালা-বাসন এমনকি গাত দেওনের জামা কাপড় সব নদীতে ভাইসা গেছে। নিজেগো তো কিছু নাই, মাইনষের তে চাইয়া চাইল, ডাইল আইনা যে বাইত্তে রাইন্ধা খামু তারও তো কোন উপায় নাই। সাইক্লোন সেন্টার থেইকা যে চিড়া মুড়ি দিয়েছিল হেডি-ই পোলাপাইনরে খাওয়াইছি। ছোট ছোট পোলাপাইনগুলারে তো আর না খাওয়াইয়া রাখতে পারুম না।'
ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ সহযোগিতা পেয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বাবুল বলেন, 'দুইদিন না খাইয়া ছিলাম। এরপর কেডা জানি একদিন খিচুড়ি আরেকদিন একবেলা বিরিয়ানি দিয়া গেছিলো। হেইগুলা পোলাপাইনে দুই দিন খাইছে। আমি আর পোলাপাইনের মায় কোনরকম খাইয়া না খাইয়া দিন কাটাইছি। আজকে মেম্বারসাব ডাইকা নিয়া ১০ কেজি চাইল দিসে। আজকে ৬ দিন পর চুলায় আগুল জ্বললো আমগো। এইডা খালি আমগো দুঃখের কথা না, এইহানের সবার একই অবস্থা।'
‘খাওন দাউন যেমন কথা, তিন পোলা-মাইয়া লইয়া নদীর উপরে বিছনা পাতি ছাড়া থাহনের এই কষ্ট কোনভাবেই আর সহ্য হইতাছে না। বাচ্চাগুলা রাইতে খুব ডরায়। পোলাপাইনগুলার দিকে চাইলে বুক ফাইটা কান্দন আহে। এই ঘরটা ঠিক করতে কম কইরা হইলেও ২০ হাজারের দরকার। আমার কাছে তো এক টাকাও নাই। এই পোলাপাইন তিনটারে লইয়া আমি কি করমু। আপনারা আমার পোলা মাইয়াগো থাকার একটু ব্যবস্থা কইরা দেন। সব ঠিক হইলে আমি কাম কইরা আপনাগো টাকা ফিরাইয়া দিমু। আল্লাহর দোহায় লাগে ছোট ছোট এই তিনটা বাচ্চারে আপনারা বাঁচান।’ চোখের পানি ঝড়িয়ে এভাবেই বাবুল শেখ তার আকুতির কথা বলছিলেন বার্তা২৪.কমের প্রতিনিধির কাছে।
নদী তীরের এই মানুষগুলো যে শুধু খাবারের কষ্ট করছে তা নয়, এখানকার মানুষ সবচাইতে বেশি কষ্ট করছেন সুপেয় পানির অভাবে। বৃষ্টির পানি এবং পুকুরের মিঠা পানি সংরক্ষণ করেই তাদের সুপেয় পানির অভাব পূরণ হয়। কিন্তু, ঝড়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার পাত্র এবং মিঠা পানির পুকুর নোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। যে কারণে, সুপেয় পানির অভাবে অনেকেই নদী এবং পুকুরের নোনা পানিই পান করছেন। এতে করে বাড়ছে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা।
আব্দুল গফফার শেখ নামের এক বাসিন্দা বলেন, 'ঘরবাড়ি সব নদীতে চইলা গেছে, আর নাই কিচ্ছু। সংসারে মালামাল কিছুই নেই, সব শেষ। আজকে মেম্বারের কাছ থেইকা ১০ কেজি চাইল পাইছি। এর আগে এক সন্ধ্যা খাইছি বা না খাইয়া রইছি। খাওন না খাইয়া থাকন যায়, কিন্তু পানি না খাইয়া আমরা কেমনে থাকি!। আমগো এইহানে পানির খুব অভাব। বৃষ্টির পানি জমাইয়া রাখছিলাম কিন্তু বন্যায় সব জমানো পানি ভাইসা গেছে। এই নোনা পানি খাইয়া-ই জীবন বাঁচাইতাছি। ঘরবাড়ি ঠিক করনের অর্থকরী নাই। ভাঙ্গা ঘরে বউ বাচ্চা লইয়া দিন কাটাইতাছি। এখন মনে হয় মইরা গেলেই বেশি ভালো হইত। এই কষ্ট আর সহ্য হয় না।’
স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে অত্র এলাকার জনপ্রতিনিধ ইউপি সদস্য নাজমুল হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমার ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ১৬৮০ জন। সে অনুযায়ী ত্রান আসে খুব সীমিত। যে কারণে আমি সবাইকে একসঙ্গে ত্রাণ দিতে পারছি না। ইতিমধ্যে সাড়ে সাতশ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও বেসরকারি কোন সংস্থা এখনো পর্যন্ত আমার এই দুর্গম এলাকায় ত্রাণ বা অন্যান্য সহযোগিতা নিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। আর ক্ষতিগ্রস্তদের বাসস্থানের ব্যাপারে ইতিমধ্যে আমার ঊর্ধ্বতন ও কর্তৃপক্ষের কাছে জানিয়েছি। অনেকেই এসে ঘুরে দেখে গেছেন। আশা করি খুব শীঘ্রই তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এদিকে মংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্নার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে জয়মনিসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে একদিনের মধ্যেই ১০ কেজি করে চাল এবং অন্যান্য ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেছি। যা স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যদের দ্বারা বিতরণ করা হচ্ছে। কেউ যদি এখনো পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে থাকে তা আমাদের জানালে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। ক্ষতিগ্রস্তদের বাসস্থানের ব্যাপারে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’