উপজেলা নির্বাচন
পীরগাছায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম
৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রংপুরের পীরগাছায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা) নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ উপজেলায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ার সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে।
বুধবার (৮ মে) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বিগত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন অনেক কর্মকর্তাকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা থেকে বাদ দিয়ে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া একই শিক্ষককে একাধিক কেন্দ্রে দায়িত্ব প্রদান, ১০ গ্রেডের অফিসার প্রিসাইডিং এবং ৬ষ্ঠ ও ৭ম গ্রেডের শিক্ষককে সহকারী প্রিসাইডিং, কর্মরত প্রতিষ্ঠান এবং নিজ ভোটকেন্দ্রে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে প্রার্থীরা একাধিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নির্বাচনে দায়িত্ব প্রদান করার অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কৌশলে একজন শিক্ষককে দুই বা তিনটি করে ভোটকেন্দ্রে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তীতে দালালের মাধ্যমে পাঁচশ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে অন্যদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা নিয়ে নিয়োগ প্রাপ্তদের মাঝে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পীরগাছা উপজেলায় ১১৩টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। ১১৩টি কেন্দ্রের জন্য ১১৩ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ৭৬০ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ১৫২০ জন পোলিং অফিসার, ১০ শতাংশ অতিরিক্ত ২৩৯ জনসহ মোট ২৬৩২ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী শিক্ষকদের বাদ দিয়ে যারা দায়িত্ব পালন করতে চান না তাদেরকে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তীতে নাম কাটা ও সংযোজন করতে দালালের মাধ্যমে পাঁচশ থেকে দুই হাজার টাকার ঘুষ বাণিজ্য করার অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।
পীরগাছায় সরকারী ও এমপিওভূক্ত কলেজ, মাদ্রাসায় প্রায় ১০০ জন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করছেন। সিনিয়র প্রভাষক, প্রভাষক প্রায় ১৫০ জন, বিভিন্ন সরকারি দফতর, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন প্রায় ৫০ জন অথচ ১০ম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তাদেরকে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেশ কিছু নন এমপিওভূক্ত শিক্ষককে ভোট গ্রহণকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের অনেককেই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
ভূক্তভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ পীরগাছায় যোগদানের পর দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তিনি দালাল ছাড়া কোন কাজই করেন না। অফিস সময়ে দরজা আটকিয়ে ভিতরে বসে থাকেন তিনি। জরুরী কাজে কেউ দেখা করতে চাইলেও মেলে না অনুমোদন। এমনকি সেবা প্রার্থীরা দালাল ছাড়া সরাসরি অফিসে গেলে হেনস্থার শিকার হন এই কর্মকর্তার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, তার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেন না বলে অভিযোগ ভূক্তভোগীদের। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদেরও ফোন রিসিভ করেন না তিনি।
ঝিনিয়া ধনীর বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুমন চন্দ্র বলেন, আমাকে ২৫ নম্বর কেন্দ্রে পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং টাকা ছাড়াই ভাতা প্রাপ্তির মাস্টার রোলে আমার প্রাপ্তি স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। পরে টাকার বিনিময়ে আমার পরিবর্তে হাফিজার রহমানকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মোহাম্মদ আলী দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আজাদ হোসেন সরকার বলেন, আমি ঘুষ না দেওয়ার কারণে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমার মাদ্রাসার শিক্ষকদেরকে দায়িত্ব না দেওয়ায় বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়ে ভোটের দায়িত্ব নিয়েছেন। কাশিয়াবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার সুপার আব্বাস আলী বলেন, নির্বাচন অফিসের এক দালালের মাধ্যমে ১৯৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপত্র দিয়েছেন।
তাম্বুলপুর মাদ্রসার সহকারী শিক্ষক আদোল হোসেন বলেন, নির্বাচন অফিসের এক দালাল শিক্ষক প্রতি ৫শ টাকা হারে নিয়ে ভোটের দায়িত্ব পাইয়ে দিয়েছেন।
ডাকুয়ার দিঘী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোৎস্না রাণী মহন্তকে ব্রামণীকুন্ডা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং অফিসার ও সাতদরগা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনন্তরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রহিমা বেগমকে পূর্ব পারুল ও পেটভাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এবং নাছুমামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারগীছ নিগারকে কিশামত পারুল শাহী স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা, পারুল ও ছাওলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ঝিনিয়া ধণীর বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপক চন্দ্র বলেন, আমি দায়িত্বের জন্য কথা বললে নির্বাচন অফিসের লোক আমার নিকট ৫শ টাকার দাবি করলে আমি নগদ ২শ টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণের ভাতা উঠিয়ে বাকী টাকা পরিশোধের শর্তে আমাকে দায়িত্ব দেন।
এক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর স্বামী শফিকুল ইসলাম মাস্টারকে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কৌশলে অসংখ্য শিক্ষককে দুই থেকে তিনটি কেন্দ্রে দায়িত্ব দিয়ে পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে নতুন করে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগেও হয়রানি করার অভিযোগ করেছেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী তানজিনা আফরোজের স্বামী গোফরান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন অফিসার ফারুক আহমেদ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করতে খুব পটু। তিনি যোগদানের পর থেকে অনিয়ম বেড়ে গেছে।
কৈকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোসলেহা খাতুন ও তাজমিনা আক্তার নিজের ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা। নিজের কর্মরত প্রতিষ্ঠানে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন চৌধুরাণী ফাতেহিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল আউয়াল। এমপিওভূক্ত শিক্ষক বাদ দিয়ে ননএমপিও শিক্ষক হাফিজার রহমান, রুমি ও সাইফুল ইসলামসহ অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহ মাহবুবার রহমান ও তছলিম উদ্দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি থাকায় সেই সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার জন্য সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করেছেন অপর চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মিলন। অভিযোগে তিনি জানান, শাহ মাহবুবার রহমান পীরগাছা মহিলা কলেজের সভাপতি। তছলিম উদ্দিন দেউতি স্কুল এন্ড কলেজ, সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও চর তাম্বুলপুর মাদ্রাসার সভাপতি। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার আবেদন করেন।
অপরদিকে চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মিলন নিজেই তাম্বুলপুর, সাতদরগা দাখিল মাদ্রাসা, পবিত্রঝার ফাজিল মাদ্রাসা, অন্নদানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বলে অভিযোগ করেছেন অপর প্রার্থীরা।
অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ বলেন, কিছু ভুল ত্রুটি আছে সেগুলো নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশোধন করা হবে।
রংপুর সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও রিটার্নিং অফিসার আব্দুল্যাহ্ আল মোতাহসিম বলেন, নিজ কর্মস্থল ও নিজের ভোটকেন্দ্রে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়না। তবে খোঁজ নিয়ে দেখছি। সুনির্দিষ্টভাবে বললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।