এদেশের চেরালেজি প্রজাপতিগুলো



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
-শেরপুরের রাঙটিয়া বনে তিতিমৌরাল প্রজাপতি। ছবি- লেখক।

-শেরপুরের রাঙটিয়া বনে তিতিমৌরাল প্রজাপতি। ছবি- লেখক।

  • Font increase
  • Font Decrease

দশ বছর আগের কথা। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সফর করছি। কাজের ফাঁকে এক ছুটির দিনে কুয়ালা লামপুরের আমপাং এলাকার হুলু কেলাং-এ অবস্থিত মালয়েশিয়ার জাতীয় চিড়িয়াখানায় গেলাম। ছয় বছর আগের শেষ সফরের চেয়ে চিড়িয়াখানার বেশ উন্নয়ন ঘটেছে বলে মনে হলো। চিড়িয়াখানার ভিতরে ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটি প্রজাপতি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। প্রজাপতির প্রতি আগ্রহের কারণে অনেকটা সময় নিয়ে পুরোটা পার্ক ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি দেখলাম ও ওদের ছবি তুলতে থাকলাম। ছবি তুলতে তুলতে এক সময় পার্কের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। আর ওখানেই দেখা হয়ে গেল কালো-সবুজের সমন্বয়ে বেশ বড় আকারের এক প্রজাপতির সঙ্গে। এত বড় প্রজাপতি কমই দেখেছি! সত্যিই অপূর্ব! সেটি ছিল একটি পুরুষ প্রজাপতি। খানিক পরে স্ত্রীটিরও দেখা পেলাম। এই প্রজাপতির নাম রাজা ব্রুক-এর বিহন (Raja Brook’s Birdwing।

পৃথিবীতে যত সুন্দর, রঙিন ও বড় আকারের প্রজাপতি দেখা যায় তার বেশিরভাগই লেপিডপ্টেরা বর্গের প্যাপিলিওনিডি (Papilionidae) বা চেরালেজি গোত্রের অর্ন্তভুক্ত। পিছনের ডানায় সোয়ালো পাখির মতো দেখতে চেরা লেজ থাকে বলেই এই নাম। তবে, এই গোত্রের সব প্রজাতিরই কিন্তু এরকম চেরা লেজ নেই, যেমন- অভ্রকুট (Blue Mormon),  কৃষ্ণকটক (Common Mime), নীরদ সিন্ধু (Common Jay) ইত্যাদি। সর্বমোট তিনটি উপগোত্রে বিশ্বব্যাপী এই গোত্রের প্রজাপতির সংখ্যা ৫৫০ থেকে ৭০০টি। এরমধ্যে ভারতীয় উপমাহদেশে দেখা যায় ১০৭টি, যার ৩৬টির দেখা মিলে আমাদের এই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশে। বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাপতি রাণী আলেকান্দ্রার বিহন (Queen Alexandra’s Birdwing), মালয়েশিয়ায় দেখা রাজা ব্রুক-এর বিহন ও বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রজাপতি বেণুবিহন (Common Birdwing) এই গোত্রেরই সদস্য। 

যদিও বেশিরভাগ প্রজাতিই গ্রীষ্মম-লীয়, তথাপি অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশেই এই গোত্রের প্রজাপতি বাস করতে পারে। শিকারী প্রাণী থেকে জীবন বাঁচাতে এই গোত্রের অনেক প্রজাতির প্রজাপতিই অন্যান্য বিস্বাদযুক্ত প্রজাপতির রূপ ধারণ করে থাকে। এই গোত্রের প্রজাপতিদের শণাক্তকারী বৈশিষ্ট্যর মধ্যে সু-বিকশিত সামনের পা, সামনের পায়ের জঙ্ঘাস্থির উপর শক্ত যুদ্ধাস্ত্র, পিছনের ডানায় লেজ (সোয়ালোলেজি/চেরালেজি) অথবা লাল বা কমলা ফুটকি (পার্নাসান) ইত্যাদি প্রধান। ডিম থেকে ফোটার পর শুককীট প্রথমে নিজ ডিমের খোসা ও পরবর্তীতে কাগজি লেবু, লেবু ও কারিপাতা থেকে স্বর্ণ চাপা, আতা, ঈশ্বরমূল, গাজর প্রভৃতি গাছের পাতা খায়। বয়স্কগুলো ফুলের রস পান করে, কিন্তু কাদামাটি ও মলমূত্র থেকেও রস চুষতে দেখা যায়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া স্ত্রী প্রজাপতি পাতার উপর বা নিচের দিকে একটি করে গম্বুজাকৃতির, মসৃণ বা অস্পষ্ট গর্তযুক্ত, চওড়া ও অসচ্ছ ডিম পাড়ে। শুককীট (Caterpillar or lava) শক্তপোক্ত ও মসৃণ বা পিঠে সারি সারি মাংসল কন্দযুক্ত হয়; কখনও কখনও দেহের ৪র্থ খণ্ডে উত্থিত মাংপি- বা ঝুঁটির মতো থাকে। মূককীট (Chrysalis or pupa) আকারে পরিবর্তনশীল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিছনের দিকে বাঁকা হয়, যা সাধারণভাবে লেজের মাধ্যমে উল্লম্ব অবস্থানে যুক্ত থাকে ও মাঝখানে একটি বৃত্তাকার সিল্কের সূতো দিয়ে আরও সুরক্ষিত থাকে। এখানে বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন ১৩টি চেরালেজি প্রজাপতির পরিচয় ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে।

মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় স্ত্রী (বায়ে) ও পুরুষ (ডানে) রাজা ব্রুক-এর বিহন প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০১. বেণুবিহন (Common Birdwing): পশ্চিমবঙ্গে এটি সোনাল নামে পরিচিত। এদেশের বিরল (Rare) ও সংকটাপন্ন (Vulnerable) এই প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Triodes helena (ট্রায়োডেস হেলেনা)। সিলেট (উত্তরপূর্বাঞ্চল), চট্টগ্রাম (দক্ষিণপূর্বাঞ্চ) ও ঢাকা বিভাগ (মধ্যাঞ্চল) জুড়ে এর বিস্তৃতি। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা মিলে। এটি এদেশের বৃহত্তম প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রজাপতির বাম ডানার একপ্রান্ত থেকে ডান ডানার বিপরীত প্রান্ত পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হয় ১৪০ থেকে ১৯০ মিলিমিটার। সামনের ডানার উপর ও নিচের অংশ কালো; ডানার শিরাগুলোতে হালকা ধূসর আভা থাকে। পিছনের ডানা হলুদ ও শিরা কালো, ডানার প্রান্ত কালো ও ঢেউ খেলানো। লেজ নেই। স্ত্রী-পুরুষ আলাদা। প্রজাপতিটি চিরসবুজ ও পত্রঝরা বন ও বনসংলগ্ন খোলা প্রান্তরে বাস করে। সচরাচর উঁচু গাছের উপর দিয়ে উড়ে। পাতার উপর ডানা মেলে রোদ পোহায়। ফুলের রস পান করে। স্যাঁতসেঁতে মাটির রসও চোষে। এদের জীবন চক্র ঈশ্বরী, ঈশ্বরমূল, হংসলতা ইত্যাদি গাছে সম্পন্ন হয়। স্ত্রী একটি করে গোলাকার কমলা রঙের ডিম পাড়ে, যা ৬ দিনে ফুটে শুককীট বের হয়। শুককীট ১৫ দিনে ৫ বার খোলস পাল্টে মূককীটে পরিণত হয়। শক্ত আবরণীর ভিতর ১৯ থেকে ২০ দিন সুপ্ত থাকার পর মুককীটের খোলস কেটে নতুন প্রজাপতি বেরোয়। জীবন চক্র ৪০ থেকে ৪১ দিনে সম্পন্ন হয়। পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতির আয়ুষ্কাল ৬ সপ্তাহ।

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বেনুবিহন প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০২. সপ্ত পদ্মরাগ (Common Rose): পশ্চিমবঙ্গে এটি আলতে নামে পরিচিত। এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান (Common) ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন (Least Concern) প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Pachliopta aristolochiae (পাচলিওপটা অ্যারিস্টোলোচি)। সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা (দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল) ও ঢাকা বিভাগের আবাসিক প্রজাপতিটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও দেখা যায়। এটি একটি লাল দেহের কালো ডানাওয়ালা প্রজাপতি। ডানার বিস্তার ৮০ থেকে ১১০ মিলিমিটার। সামনের ডানা পুরোপুরি কালো। পিছনের ডানার মধ্যাংশে সাদা ছোপ ও প্রান্তে গোলাপি-বাদামি ফুটকি, নিচের অংশে যা আরও বড় ও লাল হয়েছে। পিছনের ডানায় লেজ রয়েছে। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। বাদাবনসহ দেশের বিভিন্ন বন ও বনপ্রান্তে বাস করে। ধীরে ডানা ঝাপটানোর মতো করে উড়ে। গাছের মগডালে রোদ পোহায়। রসের জন্য ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। স্যাঁতসেঁতে মাটির রসও চোষে। স্ত্রী ঈশ্বরী, গন্ধম, চাকরাণী প্রভৃতি পোষক গাছে পাতাপ্রতি একটি করে গোলাকার লালচে ডিম পাড়ে যা ৩ দিনে ফোটে। শুককীট ১৪ থেকে ১৫ দিনে মূককীটে পরিণত হয়। মূককীট থেকে ১১ থেকে ১২ দিন পর নতুন প্রজাপতি বেরোয়।

Caption

 

০৩. কেশবতী (Common Batwing): বিরল ও বিপন্ন (Endangered) এই প্রজাপতিটি নামটি পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। বৈজ্ঞানিক নাম Atrophaneura varuna (অ্যাট্রোফানিউরা ভারুনা)। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের প্রজাপতিটিকে ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারেও দেখা যায়। এটি একটি লেজবিহীন কালো প্রজাপতি। স্ত্রী আকারে বড়সড় হয়। প্রসারিত ডানা ৮৮ থেকে ১৩৬ মিলিমিটার। পুরুষের ডানার উপরটা মখমলে নীলচে-কালো ও দাগহীন। স্ত্রীর ডানার উপরটা বাদামি-কালো, সামনের ডানার ভূমিকোণ বরাবর সাদা দাগ ও শিরার মাঝে গাঢ় ডোরা। এরা আধা-চিরসবুজ বনের প্রজাপতি হলেও জঙ্গলেও দেখা যায়। ধীরে ও মার্জিতভাবে উড়ে। খাদ্যের জন্য ফুলের কাছে ঘুরঘুর করে। যদিও জীবন চক্র সম্পর্কে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে তথাপি বুনো হংসলতা, ঈশ্বরমূল গাছে বংশবৃদ্ধি করে জানা যায়।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বড় ছড়ায় কেশবতী প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০৪. উদয়াবল্লী (Common Mormon): পশ্চিমবঙ্গে কালিম নামে পরিচিত। বহুল দৃশ্যমান (Very Common) ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Papilio polytes (প্যাপিলিও পলিটেস)। পুরো দেশজুড়ে প্রজাপতিটির দেখা মিলে। দেশের বাইরে পাকিস্তান, পশ্চিম চীন, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারে বিস্তৃত। প্রসারিত অবস্থায় ডানার বিস্তার ৮০ থেকে ১১৫ মিলিমিটার। পিছনের ডানার প্রান্ত ঢেউ খেলানো ও মধ্যাংশে এক সারি সাদা ফুটকি বাদে পুরো দেহ কুচকুচে কালো। লেজ আছে। স্ত্রী পুরুষ থেকে বড় ও ভিন্ন রকমের। পুরুষের ডানার দাগগুলো হালকা ও অস্পষ্ট, স্ত্রীরগুলো স্পষ্ট। স্ত্রীতে ৩টি রূপ দেখা যায়। ফুলের বাগান, পার্ক, কৃষি জমি, উন্মুক্ত বন ইত্যাদিতে বসবাসকারী প্রজাপতিটি দ্রুত উড়ুক্কু, কিছুটা এঁকেবেঁকে উড়ে। মাটির কাছে গুল্মে রোদ পোহায়। ফুলের রস পছন্দ করে। পুরুষগুলো ভিজা মাটির রস থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে। স্ত্রী বেল, পাতি বা জামির লেবু, মটকিলা, কারিপাতা প্রভৃতি গাছের পাতার উপর ও নিচে একসঙ্গে ২০ থেকে ২৫টি হালকা হলুদ গোলাকার ডিম পাড়ে। জীবন চক্র সম্পন্ন হতে ২৭ থেকে ৩৫ দিন সময় লাগে। পুরুষ মাত্র ৩ থেকে ৪ দিন ও স্ত্রীর ৬ থেকে ৮ দিন বাঁচে।

মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে উদয়াবল্লী প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০৫. চন্দ্রাবল্লী (Yellow Helen): পশ্চিমবঙ্গে রাজেশ্বরী নামে পরিচিত। দুর্লভ (Uncommon) ও সংকটাপন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Papilio nephelus (প্যাপিলিও নেফেরাস)। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের প্রজাপতিটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই দেখা যায়। বড় ও কালো লেজওয়ালা প্রজাপতিটির ডানা ১১৫ থেকে ১৩০ মিলিমিটার লম্বা। দেখতে অনেকটা লাল চন্দ্রাবল্লীর (Red Helen) মতো হলেও ডানায় ৩টির বদলে ৪টি স্পষ্ট বড় ঘিয়ে-সাদা দাগ থাকে। সামনের ডানার নিচে চেইনের মতো সাদা ফুটকি রয়েছে। পিছনের ডানা ঢেউ খেলানো। চিরসবুজ বনের বাসিন্দাটিকে উন্মুক্ত এলাকায়ও ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। বেশ দ্রুত উড়ে। স্ত্রীগুলো ফুলের নির্যাস পছন্দ করে। পুরুষগুলো ভিজা মাটির রস চোষে। দাহান, আশশ্যাওড়া, গোলাবাজনা প্রভৃতি গাছে জীবন চক্র সম্পন্ন করে। এদের জীবনচক্র অনেকটা লাল চন্দ্রাবল্লীর মতো; তবে স্ত্রী সচরাচর পাতার উপর দিকে ডিম পাড়ে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দুটি চন্দ্রাবল্লী প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০৬. উতলকূট (Great Mormon): বনকালিম (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Papilio memnon (প্যাপিলিও মেমনন)। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের প্রজাপতিটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও জাপানে দেখা যায়। এটি অভ্রকূট প্রজাপতির নিকটাত্বীয়। ডানার বিস্তার ১২০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার। প্রাপ্তবয়স্কগুলো অত্যন্ত অনুকরণকারী ও বহুরূপী; পুরুষের ৪টি ও স্ত্রীর ৯টি রূপ রয়েছে। পুরুষ বড়, লেজহীন, কালো, ডানার উপরের শিরায় নীলচে-ধূসর আঁশ ছড়ানো। স্ত্রী প্রজাপতির বিভিন্ন রূপ দেখতে বিভিন্ন প্রজাতির ক্লাবটেইল ও কেশবতীর মতো। মূলত বন, বনের ধার ও বনের ভিতরের ফাঁকা জায়গায় দেখা যায়। পুরুষ দ্রুত ও স্ত্রী ধীরগতিতে উড়ে। স্ত্রী ফুল ও পোষক গাছের এবং পুরুষ ভিজা মাটির আশেপাশে থাকে। বেল, কাগজী লেবু, সাতকরা, জাম্বুরা প্রভৃতি গাছে ৩৪ থেকে ৩৫ দিনে জীবন চক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী গোলাকার ও ফ্যাকাশে ঘিয়ে-হলুদ রঙের ডিম পাড়ে, যা ৩ দিনে ফোটে।

মৌলভীবাজারের আদমপুর বিটে উতলকুট প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০৭. হলদে খঞ্জর (Five-bar Swordtail): পশ্চিমবঙ্গে লাঠিয়াল নামে পরিচিত। বিরল ও সংকটাপন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Graphium antiphates (গ্রাফিয়াম অ্যান্টিফেইটস)। প্রজাপতিটিকে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে দেখা যায়। দেশের বাইরে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বেশকিছু দেশে বিস্তৃত। প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রজাপতির ডানার বিস্তার ৮০ থেকে ৯৫ মিলিমিটার। সামনের সাদা ডানার উপর ৫টি কালো ডোরা দেখা যায়; নিচটা উপরের মতোই, তবে কালো ডোরার মধ্যবর্তী অংশে সবুজাভ-সাদা আভা থাকে। পিছনের ডানার নিচের পক্ষমূল সবুজ, তাতে কমলা-হলদে ছোঁপ রয়েছে। তলোয়ারের মতো লম্বা কালচে-বাদামি লেজটি সাদায় মোড়ানো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। আর্দ্র চিরসবুজ বনের এই বাসিন্দা দ্রুততার সঙ্গে গাছের উপরের দিকে উড়ে। প্রায়শঃই ভিজা বালিতে নেমে রস চোষে। স্ত্রী বিভিন্ন প্রজাতির অ্যান্ননা, স্বর্ণ চাপা ইত্যাদি গাছের কুঁড়ি বা কচি পাতার নিচদিকে পাতাপ্রতি একটি করে ঘিয়ে সাদা, মসৃণ ও গোলাকার ডিম পাড়ে। জীবন চক্র সম্পন্ন করতে ২৫ থেকে ২৮ দিন সময় লাগে।

 হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে হলদে খঞ্জর প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০৮. শ্বেত ফড়িংলেজী (White Dragontail): এটি একটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাপতি। বৈজ্ঞানিক নাম Lamproptera curius (লেমপ্রোপটেরা কিউরিয়াস)। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের প্রজাপতিটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেরই দেখা যায়। এটি ক্ষুদ্রতম লেজযুক্ত প্রজাপতি। ডানার বিস্তার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ মিলিমিটার। সামনের ডানা সচ্ছ ও কালো ডোরাযুক্ত; পিছনের ডানায় সাদা আগাযুক্ত লম্বা লেজ। ডানার উপরটা কালো, সামনের ডানার বাইরের অর্ধাংশে কালো ডোরায় ঘেরা ত্রিকোণাকার রংবিহীন সচ্ছ অংশ রয়েছে। দু’ডানার কালো গোড়ায় তেরছা সাদা ডোরা থাকে। দু’ডানার নিচটা উপরের মতো। প্রজাপতিটিকে আধা-চিরসবুজ বনের ঝরনা ও প্রবাহমান পাহাড়ি জলধারা এবং নদীর পাশে দেখা যায়। অত্যন্ত দ্রুত উড়তে পারে। ফুল ও ভিজা বালির রস চোষে। স্ত্রী প্রজাপতি ইলিগেরা করডাটা নামক এক ধরনের গাছের কচি পাতায় একক বা গুচ্ছাকারে ডিম পাড়ে, যা ৪ থেকে ৫ দিনে ফোটে। শুককীট কালো ও মসৃণ এবং মূককীট হলদে-সবুজ। জীবন চক্র সম্পন্ন হতে প্রায় ৪২ দিন লাগে।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বড় ছড়ায় শ্বেত ফড়িংলেজি প্রজাপতি। ছবি- লেখক

০৯. মনমেঘা (Tailed Jay): পশ্চিমবঙ্গে এটি চইতক নামে পরিচিত। টেইলড জে ছাড়াও আরও ইংরেজি নাম রয়েছে, যেমন- গ্রিন-স্পটেড ট্রায়েঙ্গেল, টেইলড গ্রিন জে, গ্রিন ট্রায়েঙ্গেল ইত্যাদি। সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম- Graphium agamemnon (গ্রাফিয়াম আগামেমনন)। পুরো দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বিশ্বব্যাপী ভারতীয় উপমহাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে দেখা যায়। ডানার বিস্তার ৮৫ থেকে ১০০ মিলিমিটার। অসংখ্য আপেল-সবুজ ফুটকিসহ সামনের ও পিছনের ডানার উপরটা কালো; আর একই রকমের ফুটকিসহ নিচটা বেগুনি-বাদমি। পিছনের ডানার নিচটায় লাল ফুটকি ও ডানাপ্রতি একটি করে খাটো লেজ থাকে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রীর লেজ লম্বা। বৃষ্টিপ্রবণ বনের কিনারা, গ্রাম, পার্ক, বাগান ইত্যাদিতে বাস করে। বিরামহীনভাবে দ্রুতগতিতে গাছের উপরের দিকে উড়ে। ফুলের রস পান করে। আতা, দেবদারু, স্বর্ণ চাপা ইত্যাদি গাছে ৩২ থেকে ৩৬ দিনে জীবন চক্র সম্পন্ন হয়। ডিম, শুককীট, মুককীট ইত্যাদি নীরদসিন্ধুর মতোই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মনমেঘা প্রজাপতি। ছবি- লেখক

১০. কৃষ্ণকটক (Common Mime): পশ্চিমবঙ্গে খাগড়া নামে পরিচিত। এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Chilasa clytia (চিলাসা ক্লাইটিয়া)। এটি পুরো দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই রয়েছে। ডানার বিস্তার ৯০ থেকে ১০০ মিলিমিটার। লেজবিহীন প্রজাপতিটির দুটি রূপ রয়েছে। ক্লাইটিয়া রূপের স্ত্রী-পুরুষ উষসী বায়স (Common Crow)-এর মতো এবং ডিসসিমিলিস রূপের স্ত্রী-পুরুষ নীলকমলের (Blue Tiger) মতো। ঘিয়ে দাগছোপ ও প্রান্তীয় ফুটকিসহ ক্লাইটিয়ার ডানার উপরটা গাঢ় বাদামি। চওড়া ঘিয়ে সাদা ডোরাসহ ডিসসিমিলিস-এর ডানার উপরটা কালো। গাছপালাপূর্ণ সমতলভূমি ও পাহাড়ি বনাঞ্চলের এই বাসিন্দা অলসভাবে বৃত্তাকারে উড়ে। ফুল ও ভিজা বালির রস চোষে। স্ত্রী প্রজাপতি দারুচিনি, সাদা কুকুরচিতা, লরেল ইত্যাদি গাছের কচি কা-ে এক বা একাধিক হলুদ দানাযুক্ত ঘিয়ে সাদা রঙের গোলাকার ডিম পাড়ে। জীবন চক্র ২৬ থেকে ২৯ দিনে সম্পন্ন হয়।

রাজশাহী শহরের তালাইমারি এলাকায় কৃষ্ণকটক প্রজাপতি। ছবি- লেখক

১১. শীতলপাটি (Great Zebra): প্রজাপতিটির কোনো বাংলাদেশী নাম নেই, শীতলপাটি পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত নাম। বিরল ও বিপন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Graphium xenocles  (গ্রাফিয়াম জেনোক্লেস)। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে বসবাসকারী প্রজাপতিটিকে ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারেও দেখা যায়। লেজবিহীন শীতলপাটির ডানার বিস্তার ৮৫ থেকে ১০০ মিলিমিটার। এটি দেখতে অনেকটা খয়েরি শার্দুল (Chocolate Tiger), ভূঁইচাচার (Glassy Tiger) ও শুভ্রছড়া (Courtesan)-এর মতো। ডানার উপরের ভিত্তি রং কালো। সামনের ডানার কিনারায় সাদা ফুটকির মালা এবং মাঝখান ও সামনের প্রান্তে সাদা ডোরার সারি থাকে। সাদা ফুটকিসহ পিছনের ডানার প্রান্ত ঢেউ খেলানো। ডানার নিচের কারুকাজ উপরের মতোই, কিন্তু ভিত্তি রং বাদামি। আধা-চিরসবুজ পাহাড়ি বনের এই বাসিন্দা কম উঁচুতে উড়ে; পুরুষগুলো দ্রুত ও স্ত্রীগুলো ধীরে উড়ে। স্ত্রী ফুলের রস ও পুরুষ ভিজা বালির রস চোষে। জীবন চক্র ও পোষক গাছ সম্পর্কে জানা যায়নি।

আদমপুর বিটের ছড়ায় শীতলপাটি প্রজাপতি। ছবি- লেখক

১২. সাত ডোরা (Lime Swallowtail): এছাড়াও দোল বাসন্তী বা রুরু (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। লাইম সোয়ালোটেইল ছাড়াও এর বহু ইংরেজি নাম রয়েছে, যেমন- কমন লাইম বাটারফ্লাই, লেমন বাটারফ্লাই, সাইট্রাস বাটারফ্লাই, চেকারড সোয়ালোটেইল, ডিঙ্গি সোয়ালোটেইল, সাইট্রাস সোয়ালোটেইল ইত্যাদি। বহুল দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Papilio demoleus (প্যাপিলিও ডেমোলিয়াস)। এটি দেশের সর্বত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বিশ্বব্যাপী মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, পাপুয়া ননিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া ও হাওয়াই-এ দেখা যায়। লেজবিহীন হলুদ ফুটকিযুক্ত কালো প্রজাপতিটির ডানার বিস্তার ৮০ থেকে ১০০ মিলিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। সামনের ডানার উপর ও নিচের অনিয়মিত হলুদ ডোরা ভেঙ্গে অনিয়মিত বড় ফুটকি ও কারুকাজ তৈরি হয়েছে। পিছনের ডানার ভূমিকোণ প্রান্তে লাল গোলাকার ও শীর্ষপ্রান্তে কালোর উপর নীল ফুটকি দেখা যায়। প্রজাপতিটিকে গ্রাম ও শহরের ফুলের বাগান, পার্ক, কৃষি জমি ও উন্মুক্ত বনে ব্যপকভাবে দেখা যায়। এটি দ্রুত উড়ুক্কু ও চঞ্চল; কদাচ গাছে বসে। ফুলের রস প্রধান খাদ্য। এছাড়াও দলবেঁধে ভিজা মাটির রস চোষে। বেল, পাতি লেবু, মটকিলা, বড়ই ইত্যাদি গাছে ৩০ থেকে ৪৩ দিনে জীবন চক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী হালকা হলুদ রঙের গোলাকার ডিম পাড়ে। প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রজাপতির আয়ুষ্কাল মাত্র ৩ থেকে ৬ দিন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাতডোরা প্রজাপতি। ছবি- লেখক

১৩. তিতিমৌরাল (Paris Peacock): এটিরও কোনো বাংলাদেশী নাম নেই, এই নামটি পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। এদেশের বিরল ও তথ্য অপ্রতুল (Data Deficient) এই প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Papilio paris (প্যাপিলিও প্যারিস)। যদিও নথিপত্রে এটিকে একমাত্র সিলেট বিভাগে দেখার তথ্য রয়েছে কিন্তু সম্প্রতি লেখক শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি থানার রাংটিয়া এলাকার গাড়ো পাহাড় এলাকায় পেয়েছেন। বিশ্বব্যাপী এটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত। প্রসারিত অবস্থায় বয়ষ্ক প্রজাপতির ডানার বিস্তার ৯০ থেকে ১৪০ মিলিমিটার। প্রজাপতিটির কালো ডানার উপর সোনালি-সবুজ আবির মাখানো। পিছনের ডানার উপরটায় উজ্জ্বল নীল দ্যূতি রযেছে যা পাতি পিকক (Common Peacock) থেকে বড়, বাঁকা ও অভ্যন্তরীণ প্রান্তে সুষ্পষ্ট; নীল দ্যূতি থেকে একসারি সবুজ ফুটকি ভুমিকোণের দিকে চলে গেছে। এরকম সারি সামনের ডানাতেও রয়েছে। লেজ লম্বা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। এটি মিশ্র চিরসবুজ ও পত্রঝরা বনের বাসিন্দা। দিবাচর প্রজাপতিটি ভালো উড়ুক্কু; উড়তে উড়তে কখনো কখনো মাটির কাছাকাছি চলে আসে। ফুলের রস পছন্দ হলেও স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই কাদামাটি ও ভিজা বালির রস চোষে। কমলা গুল্ম, সাইট্রাস ইত্যাদি গাছে ৬৯ দিনে জীবন চক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী পাতাপ্রতি একটি করে ঘিয়ে সাদা রঙের গোলাকার ডিম পাড়ে। 

আদমপুর বিটে প্রজাপতির ছবি তোলাশেষে লেখক। ছবি- লেখক (সেলফি) 

 

প্রজাপতি পরিবেশের সুস্থতার নির্নায়ক। প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রজাপতি দেখে আমরা মুগ্ধ হলেও এদের প্রতি মোটেও সচেতন নই। এদেশের শিশু-কিশোর এমনকি বড়রাও সঠিকভাবে প্রজাপতি চিনেন না। তাছাড়া পরিবেশের এদের উপকারিতা সম্পর্কেও অনেকই বিশেষ কিছু জানেন না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদ ও প্রাণী-পাখির মতো প্রজাপতিরও যে ভূমিকা রয়েছে তাও অনেকের কাছেই অজানা। বর্তমানে এদেশে কত প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্তির দোড়গোড়ায় ও কতটি প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার কোন সঠিক হিসেব নেই। তবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি বিভিন্ন প্রজাতির পোষক গাছ বা উদ্ভিদের উপর সরাসরি নির্ভরশীল। কাজেই এসব গাছ সংরক্ষণ করে প্রজাপতি রক্ষা করা সম্ভব। তা না হলে অচিরেই অনেক প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ড. আ ন ম আমিনুর রহমান : বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী, প্রাণীচিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

   

সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী বহুমাত্রিক প্রভাব



অধ্যাপক চয়ন বিকাশ ভদ্র
সাম্প্রতিক ছবি

সাম্প্রতিক ছবি

  • Font increase
  • Font Decrease

উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য নিয়ে আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এই বন আমাদের গর্ব। এটি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। নানা ধরনের গাছপালা, পশুপাখি এবং মৎস্যসম্পদে পরিপূর্ণ বিশ্বখ্যাত সুন্দরবন। আমরা জানি, সুন্দরবনের মোট গাছপালার প্রায় শতকরা ৭৩ ভাগই সুন্দরী গাছ। সুন্দরী গাছ ছাড়াও এখানে রয়েছে পশুর, ধুন্দল, কেওড়া গরান, গর্জন, গোলপাতা ও ফার্নের মতো প্রায় ৩৩০ প্রজাতির গাছপালা ও উদ্ভিদ, সি ঈগাল, বাজ, সাদা বক, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, বনমোরগের মতো ২৭০ প্রজাতির পাখি এবং কোড়াল, ফাইসা, চিংড়ির মতো নানা ধরনের বড় ও ছোট আকারের ৪০০ প্রজাতির মাছ।

বলা প্রয়োজন, সুন্দরবন শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের আধারই নয়, দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা এবং ঝড়, বন্যার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এলাকাকে বাঁচাতে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনাঞ্চলের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। বিগত প্রায় দুইশ’ বছরে কম করে হলেও ৩০ বার বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত হেনেছে সুন্দরবনের ওপর। সবশেষে সিডর, আইলা ও মহাসেনের প্রবল তান্ডবে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবন হারিয়েছে বিপুলসংখ্যক গাছপালা, পশুপাখি ও মৎস্যসম্পদ, এতে হুমকির সম্মুখীন বনের প্রাণিবৈচিত্র। তারপরেও ঝড়ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, সিডর ও আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এলাকাকে বাঁচাতে সুন্দরবন রেখেছে সাহসী যোদ্ধার ভূমিকা। ঢাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থকে সৈনিকের মতো সুন্দরবন রক্ষা করেছে উপকূলীয় লাখো মানুষের জীবন, তাদের বাড়িঘর, পশুপাখি, মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। বাংলাদেশের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন। কিন্তু বার বার আগুন লেগে পুড়ে যাচ্ছে সুন্দরবন। একবার আগুন লাগার ধকল সামলে উঠার আগেই আবার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে একরের পর একর বন। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীব বৈচিত্র্য, এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণী।

গত ৪ মে ২০২৪ শনিবার সকাল ১১টায় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফেরছিলা এলাকায় আগুন লেগে বন বিভাগের হিসেবেই পুড়ে যায় ৭.৯ একর বনভূমি। ৪৭ ঘন্টা পর ৬ মে দুপুর আগুন শতভাগ নিয়ন্ত্রনে আসে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুম মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সুন্দরবনে আগুন লাগা যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্গত সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, এর পছনে স্থানীয় প্রভাবশালী কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের হাত রয়েছে। প্রতিবছরই পুড়ছে বনের নতুন নতুন এলাকা। এবারের আগুন লেগেছে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির এলাকায়। বনে সাধারণত আগুন লেগে থাকে বজ্রপাত অথবা প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে গাছে গাছে সংঘর্ষের কারণে। বন থেকে মধু, গোলপাতা, সুন্দরী গাছ আহরণরতদের ফেলে আসা বিড়ি-সিগারেটের টুকরা থেকেও আগুন লাগা বিচিত্র নয়। তবে তা খুব কমই ঘটে থাকে।

সুন্দরবন একদিকে যেমন বাংলাদেশের গর্ব, অন্যদিকে বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশও বটে। আর তাই বন ও জলদস্যুদের উৎপাত এবং দুর্বৃত্তদের বারবার আগুন লাগানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক। চক্রটি শুকনো মৌসুমে বনে আগুন লাগিয়ে প্রশস্ত করে মাছ চাষের পথ। এর পাশাপাশি বনের জায়গা দখল করাও আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে। বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, সর্বশেষ অগ্নিকা-সহ আগের ২৪টি ঘটনায় সুন্দরবনের প্রায় ৮৫ একর বনভূমির বিভিন্ন ধরনের গাছপালা পুড়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্য। স্থানীয় গ্রামবাসীদের ভাষ্য, প্রধানত মাছ চাষের জন্যই প্রতিবছর দুষ্টচক্র আগুন লাগিয়ে থাকে সুন্দরবনে। সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার পেছনে কিছু মানুষের দুরভিসন্ধি ও হঠকারিতাই প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে ।

আগুনের যে প্রভাব থাকছে অনালোচিত

এবার বারবার আগুন লাগায় এই ম্যানগ্রোভ বনের জীবকুলের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো। ম্যানগ্রোভ বন হল বিশ্বের সবচেয়ে উৎপাদনশীল বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে একটি কারণ প্রচুর পরিমাণে জীববৈচিত্র্য রয়েছে, যার মধ্যে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো-অর্গানিজমের পাশাপাশি অমেরুদন্ডী এবং মেরুদন্ডী প্রাণী রয়েছে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদগুলি উপকূলীয় সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, কার্বন সংরক্ষণ, জল পরিস্রাবণ এবং বিশুদ্ধকরণের মতো অসংখ্য পরিবেশগত ভূমিকা পালন করে। ম্যানগ্রোভের অন্যান্য সহায়ক পরিসেবাগুলি হল পুষ্টিকর সাইকেল চালানো, মাটি তৈরি করা এবং মাছ ও পাখিদের বাসস্থান এবং বাসা বাঁধার জায়গা হিসাবে পরিবেশন করা। ম্যানগ্রোভগুলি প্রায়ই জলাবদ্ধ জলাভূমি পরিবেশে পাওয়া যায় যা ধাতু সমৃদ্ধ। বিভিন্ন ধরণের আগাছা মাটিতে বাস করে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে কাজ করে। ম্যানগ্রোভ বনের চারপাশে আগাছার উপস্থিতি বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে গুল্ম আগুনের জন্য নিজেদের সংবেদনশীল করে তোলে। এছাড়াও, নৃতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ যেমন বন উজাড়, বালি খনন, বাড়ি নির্মাণ, পুনরুদ্ধার এবং তৈলকরণ কার্যক্রম ম্যানগ্রোভ গাছপালাকে ধ্বংস করে এবং ম্যানগ্রোভ বনে পলি জমে যা জলাভূমিকে বালুকাময় মাটিতে রূপান্তরিত করে।

বালুকাময় মাটি আগাছা এবং ম্যাক্রোফাইটের বিস্তারকে সমর্থন করে। বনের ক্ষয়প্রাপ্ত অংশে আগাছার বৃদ্ধি অ-ম্যানগ্রোভ প্রজাতি যেমন আর্থ্রোপড (প্রজাপতি, মৌমাছি, ওয়াপ এবং পিঁপড়া), ইঁদুর (বুশ ইঁদুর), সাপ এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের আকর্ষণ করে। বনের চারপাশের ঝোপগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন দেওয়া হলে তা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে, এটি মাটি এবং গাছপালাগুলির উপর তাপের বিরূপ প্রভাব পড়ে। গাছের পাতা শুকিয়ে গেলে (অক্টোবর-মার্চ) এবং সহজেই দাহ্য হলে শুষ্ক মৌসুমে পোড়ার ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে যাওয়ার ফলে ফলে বনের মাটির উপর পরিবেশগত প্রভাব পড়ে এবং ম্যানগ্রোভ বনের অন্যান্য জীবের উপরও এ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উদ্বায়ী মাটির রাসায়নিকগুলি উচ্চ তাপমাত্রার অধীনে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে এবং অ্যাসিড বৃষ্টি হিসাবে ফিরে আসে, উপরন্তু তরল রাসায়নিকগুলি বৃষ্টিপাতের সময় ভূগর্ভস্থ জলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জলের উৎস এবং প্রতিবেশী জলাশয়কে দূষিত করার জন্য সঞ্চারিত হয় পোড়ানোর সময় জ্বলন্ত আগুন মাটিতে বসবাসকারী ঘাস এবং জীবগুলিকে মেরে ফেলে।

সমস্যা হল গুল্ম পোড়ানো মাটির গঠনকে ধ্বংস করে এবং জলাবদ্ধ ম্যানগ্রোভ মাটি এবং আশেপাশের জলে রাসায়নিক পদার্থের ক্ষয় ঘটায়। মাটির প্রোফাইলে ভারী ধাতুর ছিদ্রের ফলে মাটির পুষ্টির ক্ষতি হয়, যা মাটির পৃষ্ঠের জীবের উপর নতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটির উপরের মাটির পুষ্টি এবং মাটির উন্নতি সাধনকারী জীব যেমন কঁচো এবং কীটপতঙ্গের ক্ষয় হয় যা পচন এবং বায়ুচলাচলের সুবিধার্থে মাটিতে ঢোকে। ঝোপের আগুনের তাপে ধীর গতির প্রাণীর মৃত্যু হয় । পোড়া গাছের ধোঁয়া এবং কালি বায়ুমন্ডলীয় কণা বৃদ্ধি করে। পোড়া গাছের ধোঁয়া এবং কালি বায়ুমন্ডলীয় কণার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি বায়ুমন্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধিতে অবদান রাখে যার ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পায়। পোড়ানোর তাপ ম্যানগ্রোভের পাতাকে সঙ্কুচিত করে এবং তাদের সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। ফলে উদ্ভিদ সঠিক পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন ত্যাগ করতে পারে না।

বন না থাকলে একদিকে যেমন বাঘ, চিতল হরিণসহ অমূল্য বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে অন্যদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হবে জনপদ ও বসতি। বার বার সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে সামগ্রিক ভাবে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে । গত ২২ বছরে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩২ বার আগুন লেগে বড়গাছসহ লতাগুল্ম মারা গেছে। অগ্নিকান্ডের ফলে প্রাণীকূলের আবাস ও প্রজননস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যপ্রাণীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বনের প্রাণ-প্রকৃতির শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রভাব পড়েছে বনের প্রাণীকূলের খাদ্যচক্রে। চরম আঘাত আসে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের উপর।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় লতাগুল্ম বেশি থাকার কারণে আগুনে শুকনো পাতা বেশি পুড়েছে, বড় গাছের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে জানা গেছে, পুড়ে যাওয়া স্থানে লতাপাতা ও গুল্মজাতীয় সিংড়া ও বলা গাছ বেশি ছিল। সিংড়া ও বলা গাছ ম্যানগ্রোভের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। আগুন লাগার এ স্থানটি ছিল পাখিদের আশ্রয়স্থল। নানা ধরণের কীটপতঙ্গ, শামুক, ব্যাঙ ও পাখির বিচরণ এখানে লেগেই থাকত। সুন্দরবন এক জটিল বাস্তুসংস্থান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীব, ছোট-বড় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমন্বয়ে এক বৃহৎ খাদ্যশৃঙ্খল তৈরি হয়েছে এখানে। বনের কোথাও আগুন লাগলে সে স্থানের খাদ্যশৃঙ্খল এলোমেলো হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এই আগুনের কারণে বড় প্রভাব পড়তে পারে অজগরের ওপর। কারণ এই প্রাণীটি ধীরে চলে। এ ছাড়া কীটপতঙ্গ এবং ক্ষুদ্র প্রাণী যারা দ্রুত চলাফেরা করতে পারে না তারা ক্ষতির মুখে পড়বে। বাঘ, শূকর, হরিণ তারা দ্রুত সরে যেতে পারে; তাই তাদের ক্ষতির সম্ভাবনা কম।

বন্যপ্রাণীরা আগুনে ভয় পায়। বনে হঠাৎ আগুন লাগিয়ে দিলে জন্তুরা ভয় পেয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে এ দিক ও দিন ছুটতে থাকে। হারিয়ে যায় ওদের বাসস্থান। আগুন লেগে বনের নীচের দিক পরিষ্কার হয়ে গলে শিকারিদের শিকারেও সুবিধা হয়। বাসস্থান বা লুকনোর জায়গা না মেলায় সহজেই বন্যপ্রাণীরা শিকার হয়। আগুনের ভয়ে ছুটোছুটিতে অনেক পশুর বাচ্চাও পালাতে পারে না। শিকারিরা সহজেই তাদের শিকার করে। এমনকি, বড় প্রাণীরাও অনেক সময়ে আগুনে ঝলসে যায়, না হয় মারা যায়। আগুন নেভার পরে আতঙ্কের রেশে অনেক প্রাণীর বংশবৃদ্ধিও ব্যাহত হয়। আগুনের হাত থেকে রক্ষা পায়না-বাদ যায় না সবুজ লতা-পাতা, উদ্ভিদের কন্দ, বীজ ও মূল, মাটির নানা উপকারী জৈব-অজৈব পদার্থ। সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের এই অংশটি উঁচু হওয়াতে সেখানে অজগরের আবাসস্থল রয়েছে। এ ছাড়া হরিণ, বানর, শূকর, বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ তো রয়েছেই। ফলে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা এবং তাদের আবাসস্থল। তবে আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দ্রুত চলাফেরা করতে না পারা প্রাণী, পতঙ্গ এবং বিশেষ করে অজগর।

বাঘ গবেষকরা বলছেন, বাঘেরা আগুন ও শব্দকে বেশি ভয় পেয়ে থাকে। তাই সুন্দরবনের চাঁদপাই রঞ্জের আমরবুনিয়া ক্যাম্পের বনাঞ্চলের আগুনে বেশি প্রভাব পড়বে বাঘের ওপর। পুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, টেরিটোরিয়াল প্রাণী হওয়াতে বাঘেরা সহসা অন্য এলাকায় গিয়ে অভিযোজিত হতে পারবে না। অন্যদিকে আগুন বেশিদূর না গড়ালেও বাঘের শিকার প্রাণীরা আগুনের কারণে এই এলাকা ছেড়ে চলে গলে খাদ্য সংকটে পড়তে পারে বাঘেরা। বাঘেরা নির্দিষ্ট এলাকায় বিচরণ করে থাকে। এই এলাকায় যে বাঘগুলো ছিল সেগুলো এখন বনের অন্য পাশে চলে যেতে বাধ্য হবে। এতে খাদ্য শিকারে তারা সমস্যায় পড়তে পারে। কারণ বাঘের শিকার প্রাণী হরিণ, শূকর, শজারুসহ বিভিন্ন ছোট-বড় প্রাণী এই এলাকা থেকে সরে যেতে পারে। যেহেতু বনের ওই এলাকায় একটি দুর্যোগ ঘটেছে, তাই সহসা এই এলাকায় ফিরে আসতে চাইবে না বাঘ, হরিণসহ বন্য প্রাণীরা। শিকারি প্রাণী কমে গেলে বাঘের খাদ্যের অভাব হবে। আর বাঘেরা বেশি দিন ক্ষুধার্ত থাকলে লোকালয়েও তাদের শিকার খুঁজতে আসার আশঙ্কা রয়েছে। যতদিন আগুনের ক্ষয়ক্ষতি থাকবে ততদিন আগুন লাগা বনে বন্য প্রাণীর আনাগোনা থাকবে না। যেসব প্রাণী চলাচল করতে পারে তারা দ্রুত সরে গিয়ে রক্ষা পেতে পারে। তবে উদ্ভিদসহ নিম্ন শ্রেণির যে প্রাণীগুলো রয়েছে; যেমন- পোকামাকড়, শামুক, সরীসৃপ ইত্যাদি প্রাণী এ ধরণের আগুনে বেশিই মারা পড়ে। সেকারণেই উদ্বেগ বাড়ছে এই ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনার আধিক্যে।

অতীতের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দেখা যাবে, সুন্দরবনে ঠিক মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের সময়টা এলেই আগুন লাগে। এ জন্যে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে এ আগুন প্রাকৃতিক নয়, মানুষের লাগানো। বনের এই এলাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে এ সময়। এ সময় সুন্দরবনের এই এলাকা কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। কেউ যেন মার্চ -এপ্রিল-মে মাসে ঐ অঞ্চলে বিড়ি, সিগারেট না খায়, মশাল না জ্বালায় সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে। আর যেহেতু প্রতি বছরই এমনটি ঘটছে, তাই শীতকালের এই সময় এ এলাকায় বনজীবীদের পাশ বন্ধ করে টহল জোরদার করা যেতে পারে। ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যেতে পারে এক্ষেত্রে। সেইসঙ্গে বন বিভাগের দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান অপরিহার্য। সর্বোপরি দরকার বনজীবী, ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার আমাদের স্বার্থেই। বুক পেতে সিডর, আইলার তান্ডব মোকাবেলা করার কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্যন্য উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বাস এই সুন্দরবন।

লেখকঃ মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান।

;

পাউলোনিয়া এবং এক রাজকুমারীর গল্প



ড. মইনুল হাসান
ছবি: পাউলোনিয়া, ছবি সৌজন্যে- ড.মইনুল হোসেন

ছবি: পাউলোনিয়া, ছবি সৌজন্যে- ড.মইনুল হোসেন

  • Font increase
  • Font Decrease

ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের প্যারিসের ৬ নম্বর মহল্লায়! গত ৮০ বছর ধরে ডালপালা মেলে ঠাঁয় একইস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁকড়া মাথার বৃক্ষটি নেই। প্রতিবছর বসন্তের শুরুতেই সাদা, নীল ও বেগুনি, তিনটি রং মিলে ঘণ্টির আকারের ফুলে ফুলে ছেয়ে যেতো গাছটির সব ডালপালা।

গাছটি নেই! পৌর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কেটে ফেলা হয়েছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে, ধারালো বৈদ্যুতিক করাতে খণ্ড, খণ্ড করে কেটে ফেলা হয়েছে গাছটিকে।

আট দশকে এ গাছটি অনেক ঘটনার সাক্ষী। অনেক ইতিহাস বুকে নিয়ে সে নিজেই এখন ইতিহাস হয়ে গেল।

খবরটি ছড়িয়ে পড়লো মহল্লায়। একে একে সেখানে জড় হলেন বিষণ্ণ, বিচলিত এলাকাবাসী।

অন্যায়, বড় অবিচার’- ২৫ বছরের তরুণী পলিনের অস্ফুট আর্তি!

ছোটবেলায় এক কবোষ্ণ প্রভাতে বাবার হাত ধরে এ গাছটির নিচে দাঁড়িয়েছিল সে। পরম মমতায় গাছটি ছুঁয়ে তার প্রিয় বাবা বলেছিলেন, ‘পাউলোনিয়া’। রাশিয়ার প্রথম জার, পলের কন্যা রাজকুমারী আন্না পাভলোনার নামে এ গাছটির নামকরণ করা হয়েছে।

পাউলোনিয়া ফুল, ছবি- সংগৃহীত

আজ বাবা বেঁচে নেই! পলিনের মন খারাপ হলেই পাউলোনিয়ার শীতল ছায়াতে এসে দাঁড়াতো। যেন তার বাবার ছায়া! অনেক মায়ার ছায়া! মানুষের নিষ্ঠুরতায় তাও হারিয়ে গেল! সকালের শিশিরের মতো পলিনের চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমে।

বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী উচ্চকিত স্লোগানে উত্তাল হলো। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সংবাদকর্মীরা।

মেয়রের বরাবরে লিখিত কড়া প্রতিবাদ জানালেন তারা। বিব্রত পৌরপ্রধান এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা এড়াতে পারলেন না তিনি।

তিনি জানান যে, গাছটি ভেতরে ফাঁপা হয়ে গিয়েছিল। যেকোনো সময়ে এমনিতেই ভেঙে পড়তে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে গাছটি কেটে ফেলতে হয়েছে।

পাউলোনিয়াসি পরিবারের পাউলোনিয়ার বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। তবে Paulownia tomenteux প্রজাতিটি বেশি দেখা যায়। ৭০ থেকে একশ বছর অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারে।

পাউলোনিয়া, স্থান- তুলুজ, ফ্রান্স, ছবি সৌজন্যে- ড. মইনুল হাসান

১৮৩৪ সালে অপূর্ব সুন্দর ফুলের এই গাছটি প্রথম জাপান থেকে প্যারিসে পৌঁছে। প্রথম পাউলোনিয়া ১৯৫৬ সাল অর্থাৎ ১শ ২২ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল। পৌর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বর্তমানে প্যারিসে এই প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, প্রায় ১ হাজার ৩শটি।

ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে পাউলোনিয়া বিরল নয়। শুধু ফুলের জন্যই নয়, এ উদ্ভিদটি অনেক কারণে সমাদৃত। অতি দ্রুত বর্ধনশীল এ উদ্ভিদটি সাধারণ উদ্ভিদ থেকে চারগুণ বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। তেমনি চারগুণ বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে। বাতাস নির্মল করে।

খুব উন্নতমানের কাঠের জন্য এর কদর কম নয়! তাছাড়া আমিষসমৃদ্ধ গাছের পাতা উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য। অনুর্বর জমিতে জন্মাতে সক্ষম এবং ভূমির ক্ষয় রোধে কার্যকর।

পাউলোনিয়া ফুলের নেকটার মৌমাছিদের খুব পছন্দ। পাতার মতোই, মধুর আছে অনেক ঔষধি গুণ। মিষ্টি ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত সৌগন্ধিকরা এর ফুলের খুব ভক্ত।

এই উদ্ভিদটির আরেকটি নাম ‘রাজকুমারী’। পলিন নিজেও ছিলেন তার বাবার কাছে আদরের এক রাজকুমারী।

ড. মইনুল হাসান: অনুজীব বিজ্ঞানী, প্যারিস, ফ্রান্স

;

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও প্রতিকার জানালেন ড. তপন দে



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনার সাম্প্রতিক ছবি

সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনার সাম্প্রতিক ছবি

  • Font increase
  • Font Decrease

গত শনিবার দুপুর থেকে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় অগ্নি দুঘটনায় তিন দিনব্যাপি আগুনে ৫ একরের বেশি বন পুড়ে গেছে। এনিয়ে ২২ বছরে ২৪ বার অগ্নিকাণ্ডে ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অংশ এই বন। এতবার ধুর্ঘনার পরও কেন রোধ করা যাচ্ছে এই প্রবণতা, জানতে বার্তা২৪.কম কথা বলেছে সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে’র সঙ্গে।

বনবিভাগে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকালে তিনি কর্মরত ছিলেন সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশেও। সুন্দরবনে করমজল ও হারবাড়িয়ায় বনবিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নেও ছিলেন মুখ্য দায়িত্বে। সেইসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জানিয়েছেন সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের কার্যকারণ ও করণীয় সম্পর্কে। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম। 

বার্তা২৪.কম: সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনা আসলে কি কারণে ঘটে? অতীতে দুর্ঘটনাগুলো তদন্তে কি কারণ বেরিয়েছে এসেছে...

ড. তপন কুমার দে: আপনি জানেন যে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে খালগুলি নাব্যতা হারিয়েছে। আগে সুন্দরবনের সঙ্গে মেইনল্যান্ড ডিটাচ ছিল, এখন নাব্যতা হারিয়ে একত্র হয়ে গেছে। অতীতে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করতে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে আমরা চেষ্টা করেছি। যেহেতু নাব্যতা সংকটে এখন জোয়ার-ভাটার পানি ঢুকে না সেকারণে সুন্দরীর মতা গাছগুলো কমে গেছে। তাতে ছন জাতীয় ঘাসের আধিক্য বেড়েছে। স্থানীয়রা নিজেরা ছন সংগ্রহ করে আর এটাকে গোচারণ ভূমি বানিয়ে ফেলেছে। আমার ধারণা, তারাাই আগুনাটা লাগিয়ে থাকতে পারে-যাতে ছনটা পুড়ে নতুন ঘাস হয়, তাতে গরু-ছাগল চরাতে সুবিধা হবে। এটাই মেইন কারণ। ওদের একটা ইলমোটিভ আছে। আগেও অনেকবার হয়েছে। অনেকবার বৈঠক করেছি, যাতে আগুন না দেয় কিন্তু তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। এটা ইন্টেনশনাললি। মৌচাকে মৌমাছি তাড়াতে আগুন দেওয়া থেকে অগ্নিকাণ্ড হলেও হয়ে থাকতে পারে-তবে ওই এলাকায় এর সম্ভাবনা কম।

বার্তা২৪.কম: তাহলে কিভাবে নিরাপদ করা যাবে সুন্দরবনকে?

ড. তপন কুমার দে: সুন্দরবানকে বাঁচাতে হলে খালগুলোর গভীরতা বাড়াতে হবে এবং মেইনল্যান্ডের সঙ্গে বনকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। এতে বাঘের লোকালয়ে আসার প্রবণতা কমবে। কমবে স্থানীয়দের গরু চরাতে সুন্দরবনে ঢোকার অত্যাচারও। চারদিকে খাল ও নালার নাব্যতা থাকলে কোনভাবে আগুন লাগলেও ফায়ারলাইন কাটা যাবে। খালে নাব্যতার কারণে বেশিদূর ছড়াতে পারবে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শরণখোলা রেঞ্জে ঢোকার মুখে বলেশ্বরে আমরা নতুন করে অনেক গাছ লাগিয়ে বনায়ন করেছি। যেখানে সুন্দরী হয় না। লোনা পানি আসে না। অন্যখানে এরকম থাকলে সেখানেও এভাবে বনায়ন করা দরকার। ঘনবন থাকলে অনেক সমস্যাই নিরসন হবে। ইতিমধ্যে সেখানে ভালো বনায়ন হচ্ছে। খাল খনন করে যদি উঁচু জায়গাতে গাছ লাগিয়ে ঘনবন সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক পার্টিশন (খাল প্রবাহমান করে) করা য়ায় তবে লোকজন আর ঢুকবে না। ইলমোটিভগুলো আর চরিতার্থ করতে পারবে না। এটা বনের জন্যও ভালো আর আমাদের সবার জন্যও ভালো।

বার্তা২৪.কম: এ ধরণের অগ্নিদুর্ঘটনা দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের জন্য কি ক্ষতির কারণ হতে পারে?

ড. তপন কুমার দে: যেকোন ফায়ার হ্যাজার্ড হলে তো ছোটবড় বিভিন্ন প্রাণিদের জন্য ক্ষতির কারণ। পুরো ইকোসিস্টেম এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনজ খাদ্যশৃঙ্খলে বড় রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বারবরই এখানে ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিটা প্রটেকশন দিতে হবে। ফায়ার হ্যাজার্ড কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়। এ এলাকায় যেহেতু অনেক আগে থেকে রেকর্ড আছে ..মূলকারণ যেটা বললাম লোকজন সেখানে গরু চরায়। লতাপাতা থাকলে যেখানে যাতায়াতে সমস্যা। বাঘের থেকে মুক্ত থাকার জন্য, গরু চরানোর জন্য স্থানীয় লোকজন এগুলো করে লাকড়ি সংগ্রহ করতে পারে। অনেকটা রামরাজত্ব কায়েমের মত ব্যাপার। আমি যখন ছিলাম তখন অনেক মামলা মোকাদ্দমা হয়েছে।

তবে এই আগুনে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে তা নয়। যদি নতুন ঘাস উঠে আর প্রটেকশন থাকে তাহলে হরিণের জন্য ভালো। যেমন জামতলা, কচিখালী-হরিণ সেখানে ঘাস খেতে পারে, ঘুরতে পারে। এই অগ্নিকাণ্ড হরিণের চারণ ভূমি হবে।

বার্তা২৪.কম: বনের ঘনত্ব বাড়াতে এই মুহূর্তে আর কি করণীয়?

ড. তপন কুমার দে: যেসব গাছে ফায়ার হ্যাজার্ড হয় না, বন্যার পানিতেও ক্ষতি হয় না যেমন রেইনট্রি, জারুল-এগুলো এখানে লাগানো যেতে পারে (আমরা আগেও ট্রাই করেছি)। এতে বনেরও উন্নতি হবে, ফায়ারহ্যাজার্ডও হবে না। এই দুইটা কাজ করতে হবে। আমি থাকলে তাই করতাম। বনের ভেতরে করমজল, হারবাড়িয়া-প্রকল্পগুলো আমার করা। আমরা গবেষণা বেশি করি, কথা বেশি বলি-কিন্তু কাজ করি না। কাজে বেশি মনযোগী হতে হবে।

;

কটিয়াদীতে ২ বছরে ৫০ পুকুর ভরাট, পরিবেশে বিরূপ প্রভাব



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

কয়েক বছর আগেও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার পৌর এলাকায় ছিল ২৫টির বেশি পুকুর। বর্তমানে সেখানে চার থেকে পাঁচটি পুকুর টিকে আছে। এর মধ্যে দুটি অর্ধেক ভরাটের পথে। সবগুলো পুকুরের বয়স শতবর্ষ ছুঁইছুঁই!

এছাড়াও উপজেলা জুড়ে সেই একই অবস্থা। দুই বছরে প্রায় ৫০টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। পুকুর কমতে থাকায় পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। এ কারণে পানি সংকটে পড়েছে প্রাণীকুল।

অপরদিকে, গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল এ বাজার ও আবাসিক এলাকায় আগুন লাগলে পানির সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে, ক্রমশই সমস্যার গভীরতা বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইন অমান্য করে অবাধে একের পর এক পুকুর ভরাট করে সেখনে বাণিজ্যিক প্লট ও বহুতল আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে।
গত দুই বছরে পৌর এলাকায় কম করে হলেও ১০টি পুকুর ভরাট হয়েছে। জমির মালিকেরা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে এসব পুকুর ভরাট করছেন। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও পৌরসভার তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি।

কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালের সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

এলাকাবাসী সূত্রে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, যে পুকুরগুলো ভরাট হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে কটিয়াদীর পৌর এলাকার ভোগপাড়া কুড়িবাড়ি, পশ্চিমপাড়া মেতির বাড়ি, কান্তিবাবুর বাড়ি সংলগ্ন, লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন (ভরাট চলমান), ত্রিরত্ন মন্দির সংলগ্ন, বাসট্যান্ড পুকুর, লালিবাড়ি, রাধানাথ সাহা বাড়ি মোড়, বীরনোয়াকান্দি মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় দুটি পুকুর, পশ্চিম পাড়া দুটি), বীরু সাহার পুকুর (ভরাট চলমান)।

এছাড়াও অর্ধশত ছোট জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরো অনেক পুকুর ভরাট হয়েছে ও হচ্ছে। তাদের কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দফতরেও নেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য।

উপজেলার সবকটি ইউনিয়নগুলোর চিত্র সেই একই রকম। প্রতিনিয়ত অনেক পুরনো পুকুর ভরাট হচ্ছে। জালালপুর কুটির বিল, দুর্গা বিলসহ আরো অনেক বিল প্রতিদিন বেদখল হচ্ছে।

কটিয়াদীর (কিশোরগঞ্জ) পৌর এলাকায় চলছে পুকুর ভরাটের কাজ, ছবি- বার্তা২৪.কম

এমন কী পৌর এলাকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ নদের চড়িয়াকোনা অংশে মাটির বাঁধ দিয়ে ও স্থাপনা করে দখল করে রাখা হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করে এবং সংশ্লিষ্টদের তদারকির গাফিলতি ও অদক্ষতার সুযোগে এভাবেই জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।

পৌরসভার পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা সুজিৎ ঘোষ ও আব্দুর রহিম বলেন, এলাকায় কয়েকটি পুকুর ছিল। কিন্তু রাতারাতি সেগুলো ভরাট করে চড়া দামে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন মালিকেরা। তাদের কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।

কটিয়াদী সরকারি ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক শাহ্ আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'পানি ও প্রকৃতি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। জলাধার না থাকলে প্রাণীকুল ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও আগুন লাগলে পানির অভাবে বড় সমস্যার কারণ হবে। প্রশাসনসহ এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। পুকুর-জলাশয়গুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

কটিয়াদী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসার আতিকুল আলম বলেন, ‘পুকুর ভরাটের খবরটি আসলেই দুঃখজনক! পানির অভাবে আগুন নেভাতে গিয়ে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের যে গাড়ি, তাতে ১৮শ লিটার পানি ধারণ করা সম্ভব। এটা দিয়ে ২০ মিনিট পানি দিতে পারবো। বাকি পানির জন্য পুকুর বা জলাশয়ের প্রয়োজন পড়বে। স্থাপনা করার সময় ফায়ার সেফটি বিষয়ে সবাইকে খেয়াল রাখা জরুরি’।

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মতিন জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পুকুর ভরাটের কথা জানতে পারেন না। জেলা শহরে কয়েকটি পুকুর ভরাট বন্ধ করে দিয়েছেন।

তিনি জানান, কটিয়াদীর বিষয়টি খোঁজ নিয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে এভাবে ভরাট করতে দেওয়া হবে না।

তবে তিনি এটাও জানান যে, লোকবল সংকটের কারণে তাদের রুটিন তদারকি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ঘটনা জানতে পারলে তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন বলে জানান এই পরিচালক।

 

 

;