রিপোর্টিংয়ের একদিন



প্রিন্স আশরাফ

  • Font increase
  • Font Decrease

রাত তিনটের কাঁচা ঘুম থেকে মোবাইলের যন্ত্রণায় উঠে পড়ে ভোর সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে পড়তে হলে চাকরির পশ্চাদদেশে লাথি কষাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে দমন করে রিপোর্টার মাহফুজ মিথুন মোবাইলেই এক ঘণ্টা পরে এ্যালার্ম দিয়ে বালিশে মাথা লাগায়। মগজের কোষে কোষে এখনো চিফ রিপোর্টারের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, ‘সুবহে সাদিকের আগে ওদের পাকড়াও করে সচিত্র প্রতিবেদন নেবে। নিয়েই ল্যাপটপের ইন্টারনেট থেকে মেইল করে পাঠিয়ে দেবে। সকালের ফাস্ট নিউজ আওয়ারেই ওটা অনইয়ারে দিতে চাই। ফক্করবাদ গ্রামে আমাদের জেলা করসপন্ডেন্টস থাকবে। সেই নিউজটা...’ লাথিটা এবারে ওই করসপন্ডেন্টস ব্যাটার পশ্চাদদেশে দিতে ইচ্ছে করছে। শালার বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়! সামান্য ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এরা এরকম বানায় যে খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে যায়।

চ্যানেল ফাস্টের স্টিকার লাগানো মাইক্রো মেসের দোরগোড়ায় হাজির। ল্যাপটপ, মডেম, মোবাইল, পেনড্রাইভ নিয়ে পুরোপুরি ডিজিটাল মানুষ হয়ে মিথুন গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার গোমড়ামুখে একমনে সিগারেট টেনে চলেছে। একেবারে পেছনের সিটে ক্যামেরা ক্রু ঝিমাচ্ছে। তার সহকারী রনক বসে আছে।

রনক তার জন্য জায়গা করে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘বস, ঘটনা কী? স্যার এত তাড়াহুড়ো লাগাল কেন? কোনো ব্রেকিং নিউজ নাকি?’
মিথুন দাতে দাত চেপে বলল, ‘শীতের রাতে কাঁচা ঘুম ভেঙে বেরোনোর চেয়ে বড় কোনো ব্রেকিং নিউজ আর আছে নাকি?’
রনক দাত বেরে করে হেসে বলল, ‘বস, শুনলাম কোন যুবতি মাইয়া নাকি পীর হইছে। মাইয়া গায়ে হাত ছোঁয়াইলে অসুখ সেরে যাচ্ছে।’
‘তোর কোন অসুখ আছে নাকি?’ মিথুন সিটে গা এলিয়ে দিয়ে রসিকতা করল। ‘থাকলে কইস, ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
‘মাইয়া হাত বুলাইলে অসুখ আছে। সারা গায়ে অসুখ।’ রনকের দাঁত বেরিয়েই আছে। ছেলেটার হাসি রোগ আছে। ‘কন না, বস, কেস কী?’

মিথুন কোনো উত্তর না দিয়ে বাইরে দেখতে লাগল। খুব ভোরের অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। সব কিছু অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতার দিকে যাচ্ছে। নতুন দিনের শুরুর প্রস্তুতি যেন। তাতে মন ভালো করার উপাদান গুড়ো গুড়ো হয়ে ছড়ানো রয়েছে। মিথুনের মন ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে।

মিথুন পিছনের সিটে আয়েশ করে হেলান দিতে দিতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘মজনু ভাই, জায়গাটা চেনেন? কদ্দুর যেতে হবে জানেন কিছু?’
মজুন ভাই সামনের কুয়াশা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, ‘জায়গা চিনি না। তবে কোন দিকে তা জানি। অনেকটা পথই যেতে হবে। পথে দুই দুইটা ফেরি পড়বে। ফেরিতেই ঘণ্টা কাবার। আপনি আরামে ঘুমান। দুপুরের আগে কোনোমতেই পৌছানো সম্ভব না।’
মিথুন আতকে উঠল, ‘সেকি! বস যে বলল, সকালের মধ্যেই প্রথম নিউজ আওয়ারে অনওয়ার করবে।’
মজুন ভাই ব্যঙ্গের হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বলল, ‘হ, গদি আটা চেয়ারে বসে কইলেই হলো। মাঠে নাইমাই দেখুক না! আমগোর মতন বনবাদাড় তো ঠ্যাঙায়ে বেড়াইতে হয় না।’
মিথুন ড্রাইভারকে আর ঘাটাল না। বকতে থাকলে ঘুম চটে যাবে। রনক ঝিমাচ্ছে। এই ফাঁকে সেও একটু ঝিমুনির মতো দিয়ে নিক।

মজনুর কথাই ঠিক। বেলা বারোটার পরে ফক্করবাদ গ্রামে ঢুকল চ্যানেল ফাস্টের গাড়ি। প্রতিনিধি গাজী শামস আরো কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে পথের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদের নিরাশ করে সে গাড়িতে পথ চেনাতে ড্রাইভারের পাশে বসল।

কুশল বিনিময় শেষে প্রতিনিধিই আগ বাড়িয়ে ব্যাপারটা বলল, ‘এক জ্বিনসাধক ব্যাটা অনেকদিন ধরে করে খাচ্ছিল। ক্যান্সার এইডস থেকে শুরু করে হেন প্রকার অসুখ বিসুখ বা সমস্যা নেই যা জ্বিনসাধক জ্বিনের মাধ্যমে সারায় না। কাজ হোক আর না হোক দশ গ্রামের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমাদের গ্রামের রসুল অনেক দিন ধরে একটু পাগলাটে স্বভাবের। ইচ্ছেমত কাউকে কিছু না বলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়। আবার কিছুদিন পর ফিরে আসে। রসুল এরকম কাজকাম করে যা তার মতো আটবছরের ছেলের করার কথা না। দেড়মণি ধানের বস্তা পযর্ন্ত উঁচু করে তুলতে পারে। সবাই বলে জ্বিনের আছর লাগছে।’
রনক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কি এই রসুলকে নিয়ে?’
‘হ্যাঁ। রসুলের মা রসুলকে নিয়ে জিনসাধকের আস্তানায় যায়। আস্তানার উঠোনের মাটিতে বেশ গভীর গর্ত খোঁড়ে জ্বিনসাধক। তারপর সেই গর্তের মধ্যে রসুলকে দাঁড় করিয়ে দেয়। রসুলের মাথা পর্যন্ত গর্তের মধ্যে পুঁতে ফেলা হয়। চারিদিকে গ্রামের লোক তখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে জ্বিনসাধকের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকে। সাধক ব্যাটা নানান ভং চং করে। কী সব ছকটক বানায়। জাফরানী কালি দিয়ে ছকে কুফরী কালাম লেখে। আরো কী কী যেন করে। তারপরে সেই ভয়ংকর কর্মকাণ্ড শুরু করে।’
‘কী সেটা?’ প্রতিনিধির বাকোয়াজ বাজিতে অধৈর্য মিথুন জিজ্ঞেস করে।
‘মাথা পর্যন্ত পোঁতা রসুলের গর্তের মধ্যে গনগনে আগুন জ্বালিয়ে দেয় জ্বিনসাধক কবিরাজ। আগুন জ্বালিয়ে দেয় গর্তের চারপাশে। দাউ দাউ আগুনে পুড়তে থাকে শিশু রসুল। তার কান্না আর চিৎকারে আকাশবাতাস ভারী হয়ে ওঠে। জিনসাধক উল্লাসে চিৎকার করে, আগুনে জ্বিন পুড়তাছে। ক্যামুন পুড়তাছে। পুইড়া খাক হইয়া যাইতাছে। খবিস জ্বিন পুইড়া মরতাছে। মরণের আগে চিক্কুর দিতাছে। ক্যামুন কানতাছে। সবার চোখের সামনে পুড়ে মরতে থাকে শিশু রসুল। সবাই জ্বিনসাধকের জ্বিন পুড়ানোয় অভিভূত হলেও একজনের মধ্যে বিকার দেখা যায়।’
‘কার?’ ড্রাইভার আর জিজ্ঞেস না করে পারে না।
‘রসুলের মায়ের। মা ছুটে এসে হাউমাউ করে জ্বিনসাধকের পায়ে এসে কেঁদে পড়ে। তাও জ্বিনসাধক নাছোড়। কিন্তু মায়ের কান্না আর আহাজারিতে গ্রামের লোকের টনক নড়ে। কয়েকজন যুবক ছেলে ছুটে এসে গর্ত থেকে পুড়ে প্রায় কয়লা হওয়া রসুলকে টেনে তোলে। তখনও কবিরাজ ব্যাটার হম্বিতম্বি কথার তুবড়ি ছুটছে। কিন্তু গর্ত থেকে তোলা রসুলের মরণাপন্ন অবস্থা দেখে কবিরাজ খুব ভাব ধরে লোকজনের মধ্য থেকে বেরিয়ে যায়।’
‘তার মানে ভণ্ড জ্বিনসাধক পালিয়ে গেছে?’ মিথুন জিজ্ঞেস করে।
‘তাই তো মনে হচ্ছে। তারপর থেকে ব্যাটাকে আর আস্তানার আশেপাশেও দেখা যায়নি।’
‘ব্যাটাকে ধরে রাখতে পারলে সাক্ষাৎকার নিয়ে এক্সক্লুসিভ নিউজ করা যেত। ব্যাটাকে যে করেই হোক ধরার চেষ্টা করতে হবে। আপনি একটু গোপন সংবাদের মাধ্যমে দেখেন তো ব্যাটাকে পাওয়া যায় কিনা। কিছু টাকা পয়সা লাগলে খরচ করা যাবে। ব্যাটাকে পেলে টাকার লোভ দেখিয়ে একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে।’ মিথুন জোর গলায় বলল।
গাজী শামছু হেসে বলল, ‘সে কথা আমাকে বলে দিতে হবে না, মিথুন ভাই। আমি এরই মধ্যে ব্যাটার খোঁজে লোক লাগিয়ে দিয়েছি..’ শামছুর কথার মাঝখানে বাধা পড়ল। পথে অন্য আরেক পত্রিকার প্রতিনিধি সুশীল হালদার হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাল।

পরিচয় পর্ব শেষে গাজি শামছু জিজ্ঞেস করল, ‘কি সুশীলদা, জ্বিনসাধকের কোনো খবর বের করতে পারলা?’
সুশীল হালদার হেসে বলল, ‘জ্বে, শামছু ভাই, কবিরাজের গোপন আস্তানার খবর পেয়েছি। কিন্তু সেখানে কবিরাজের সাগরেদেরা আছে। মারধোর করতে পারে।’
সবাই একটু চুপসে গেল। টাকা দিয়ে কাজ হাসিল করাটা সহজ। মারধোর খাওয়াটা সহজ নয়।
‘চিন্তা কইরেন না। ঢাকার রিপোর্টাররা আসছেন। ব্যবস্থাটা একটা হয়ে যাবে।’ সুশীল আশ্বস্ত করে।
‘ওই ছেলেটার কী অবস্থা?’ রনকের মাথায় রসুলের চিন্তা, ‘এখনো বেঁচে আছে?’
সুশীলই উত্তর দেয়, ‘রসুল বেঁচে আছে। তবে অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। সারা শরীর আগুনে ঝলসে গেছে। বাঁচবে কিনা ভগবানই জানেন।’ সুশীল দু’হাত মাথার উপর তুলে ভগবানকে দেখায়।
‘ছেলেটারে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি?’
‘এরকম অজ পাড়াগাঁয়ে হাসপাতাল কোথায়?’ গাজী শামছু সুর মেলায়, ‘একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো আছে, তাতে না আছে ওষুধপত্তর, না আছে ডাক্তার। বড় ধরনের কিছু হলে যাওয়ার জায়গা নেই।’
মিথুন জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলেও ভিকটিম এখন কোথায়? বাড়িতে?’ তার শুধু রিপোটিংয়ের চিন্তা। পুড়ে ঝলসে যাওয়া রসুলের আপাদমস্তক ভিডিও করুণভাবে করতে হবে। জনগণের সহানুভূতি যোগ হবে। তাতে রিপোটিংটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই রিপোটিংয়ের জন্য পুরস্কারটুরস্কার পেয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
‘না। ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই আছে।’ ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা করছে দেখে গাজী শামছু ক্যামেরা দিকে তাকিয়ে বলে। যাত্রার প্রথম থেকে পুরোটাই ক্যামেরা করা হয়। যাতে এই রিপোটিংয়ের পেছনে কতটা শ্রম ব্যয় করা হয়েছে সেটা দর্শকদের দেখানো যায়। ক্যামেরার কারসাজিতে কষ্টটা একটু বেশিই ধরা পড়ে।

মিথুনের নির্দেশে আগে জ্বিনসাধকের সাধনা আর রোগ সারানোর স্থলে যাওয়া হয়। গ্রামের কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। টিভি ক্যামেরা দেখে তারা বাড়িয়ে চাড়িয়ে ভয়াবহ রূপ দেয়। তাতে রিপোটিং আরো জোরালো হয়। জ্বিনসাধকের গর্তের ক্যামেরা করা হয়। গর্তের ভেতরের নিভন্ত আগুন, চারপাশের পরিবেশ, সেখানে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার সব মিলিয়ে পরিবেশটাকে আরো ভয়াবহ করে তোলা হয়। কৌতূহলী কয়েকজন গর্তের ভেতরে কাঠখড় দিয়ে আবার আগুন জ্বেলে দেয়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখায় ভিডিও ফুটেজ ভরে উঠতে থাকে।

এবার রিপোর্টের গাড়ি ছুটে চলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গাড়ির পেছন পেছন গ্রামের লোক ভেঙে এসেছে। টিভি চ্যানেলের লোক দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে থানা সদরে প্র্যাকটিস করতে থাকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার ইকবাল মোটরসাইকেল চালিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ডাক্তারের সামনেই রসুলের উলঙ্গ শরীরের ক্যামেরা করা হয়। এডিটিংয়ের সময় বাচ্চা ছেলেটার বিশেষ অঙ্গের ওখানটায় ঝাপসা করে দিলেই হবে। বাস্তবে যতটা বীভৎস দেখাচ্ছে ক্যামেরাম্যানের কারসাজিতে তার চেয়ে বীভৎস ফুটেজ ওঠে। ডাক্তারেরও ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। ডাক্তার ইকবাল জানান, সকাল থেকেই তিনি রসুলের তত্ত্বাবধান করছেন। (যদিও টিভি রিপোর্টার পৌঁছানোর মিনিট দশেক আগে এসে পৌঁছেছেন)। রসুলের প্রাইমারি কেয়ার নেওয়া হয়েছে। তবে পোড়াটা অনেক বেশি। ডাক্তারী ভাষায় থার্ড ডিগ্রি বার্ণ। আর এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কেন, জেলা সদরেও পোড়া রোগীর চিকিৎসার উপযুক্ত কোনো চিকিৎসা নেই। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটই সবচেয়ে উপযুক্ত।

মিথুনের রিপোটিংর মূল পর্ব শেষ। এখন একটু থানা পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, চেয়্যারম্যান এদের করণীয় কিছু ইন্টারভিউ নিতে হবে। তবে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ হবে যদি জ্বিনসাধকের ইন্টারভিউটা করা যায়। অনুষ্ঠানের শেষ চমক হিসাবে দেখানো যেতে পারে। এর মধ্যেই মিথুন মোবাইলে ঢাকার সাথে ডিটেলস আলাপ করে ল্যাপটপের ইন্টারনেট থেকে একটা ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা নিউজের সাথে একটা মাত্র দৃশ্য হিসাবে যাবে। আর নিউজে ঘোষণা থাকবে বিস্তারিত আজ রাত দশটায়। তার আগেই আশা করছে সবকিছু কমপ্লিট হয়ে যাবে।

খাওয়াদাওয়া ব্যবস্থা প্রতিনিধি গাজি শামছুর বাড়িতেই ছিল। দুপুরে ভুঁড়িভোজন করে একটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা। গোটা গ্রামের একটা চিত্র তুলে ধরতে হবে।

গ্রামের চিত্র শেষ করতে করতেই বিকাল গড়িয়ে গেল। তখনও জ্বিনসাধকের ব্যাপারে ওরা কোনো রকম অগ্রগতি করতে পারল না। শেষমেষ ফেরার তোড়জোড়ের সময় এক সাগরেদ এসে জানাল, ওস্তাদ টিভির সামনে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র দু’জন আস্তানায় আসতে পারবে। রনকের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ক্যামেরাম্যান আর মিথুন দু’জনে সাগরেদের সাথে একটা বাড়িতে জ্বিনসাধকের গোপন আস্তানায় গেল। জিনসাধনার ধরনধারণসহ কিছু ডামি কর্মযজ্ঞ তাদের অনুরোধে দেখাল। তার জন্য অবশ্য তাদের বেশ কিছু টাকা আর প্রচার প্রসারের আশ্বাস দিতে হলো।

এদিকে মিথুনের কারসাজিতে থানায় খবর চলে গেছে। চলে গেছে জ্বিনসাধকের গোপন আস্তানার খবর। সাথে সাথে থানাওয়ালাদের হানা আস্তানায়। সাগরেদসহ ধৃত জিনসাধক। আবার দৃশ্যপটে টিভি ক্যামেরার আগমন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বাঁশডলার পরে জ্বিনসাধকের সাক্ষাৎকার। এক্সক্লুসিভ।

সব এক্সক্লুসিভ শেষে ঢাকায় ফেরার পালা। ঢাকায় ফ্রি আসার এরকম সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় প্রতিনিধি গাজি শামছু। তার সাথে যোগ দিয়েছে সুবল হালদার। আজ সারাদিনে বেচারা অনেক খাটাখাটনি করেছে। তাকে তো আর ফেলে রেখে যাওয়া যায় না।
গাড়ি ছাড়ার আগে মিথুন কানাঘুষো শুনতে পায়। অগ্নিদগ্ধ রসুলের অবস্থা নাকি খারাপের দিকে। সে কান কথায় কান দেয় না।
ডাক্তার ইকবালের সাথে দেখা হয়। তিনি জানান, রসুলের অবস্থা সংকটাপন্ন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে না নিয়ে গেলে রসুলকে বাঁচানো যাবে না।
মিথুন ইউনিট নিয়ে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড়ে ব্যস্ত। রাত দশটার নিউজের পরে এই রিপোর্ট টেলিকাস্ট হবে। তার অন্তত ঘণ্টাখানিক আগে যে করেই হোক পৌঁছাতে হবে। এডিটিংয়ের ব্যাপারস্যাপার আছে।

এদিকে রসুলের ব্যাপারে স্থানীয় হাসপাতাল জবাব দিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় নিতে পারলে রসুল বাঁচবে। রসুলের হতদরিদ্র বাবামায়ের রসুলকে ঢাকা নেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। ভিটেমাটি বিক্রি করলেও হবে না। আর হলেও এই মুহূর্তে তা কিভাবে সম্ভব। গ্রামের মধ্য থেকে কে যেন রসুলের বাবামাকে বুদ্ধি দেয়, টিভির গাড়ি ঢাকায় যাইতাছে। ওতে করে রসুলরে ঢাকা নিতে পারলে বাঁচত।

নিরুপায় রসুলের মা স্টার্ট নেওয়া গাড়ির কাছে এসে আছড়ে পড়ে। আকুতি জানায়, আমার রসুলরে আপনারা ঢাকা নিয়া যান। রসুলরে বাঁচান।
আকুতি মিথুনের কানে পৌঁছালেও সে গুরুত্ব দেয় না। এই গাড়ি রিপোটিংয়ের, এ্যাম্বুলেন্স নয়।
রসুলের মা কাঁদতে কাঁদতে মাইক্রোর সামনে শুয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে মিথুনকে গাড়ি থেকে নামতে হয়। মিথুন নামতেই রসুলের মা মিথুনের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে পড়ে।
শেষমেশ অসহায় মিথুন মিথ্যের আশ্রয় নেয়। স্থানীয় জনতা আর রসুলের মাকে জানায়, আমরা তো আজকে ঢাকায় ফিরব না। আরেক জায়গায় সাতক্ষীরার দিকে রিপোটিং আছে। সেখানে যেতে হবে। ঢাকায় গেলে ঠিকই রসুলকে নিয়ে যেতাম।
ভুলভাল বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওরা কোনোমতে গ্রাম থেকে বেরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। গ্রামবাসি একবার ক্ষেপলে রক্ষা নেই।

ঢাকায় এসে রিপোর্ট জমা দিয়ে গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছিল রিপোর্টার মাহফুজ মিথুন। তখনই চিফ রিপোর্টারের ঘরে তার ডাক পড়ে। চিফ রিপোর্টার জানান, এইমাত্র খবর এসেছে, ভণ্ড জ্বিনের ওঝার আগুনে পোড়া রসুল স্থানীয় হাসপাতালে মারা গেছে। আমাদের এই রিপোটিংয়ের ফলোআপ হিসাবে মৃত রসুলের একটা ফুটেজ নিতে হবে। এক্সুক্লুসিভ নিউজ করতে হবে।

রিপোটার মাহফুজ মিথুন মৃত রাসেলের এক্সক্লুসিভ নিউজের জন্য আবার বেরিয়ে পড়ে।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;